#উজানে_ফেরে_নদী
১.
বাইরে এমন ভয়াবহ দূর্যোগ লাইব্রেরীর ভেতরে বসে নদী তার বিন্দুবিসর্গও বুঝতে পারেনি। এখন সময়মত হলে ফিরতে পারলেই হয়। গেট বন্ধ হলে তো আবার ফুপুর বাড়ি যেতে হবে। সেটাও তো বেশ দূর। আর এই বৃষ্টিতে যাবেই বা কি করে? রিক্সা পাওয়া তো বিশাল ঝক্কি।
-কি রে এখানে দাঁড়িয়ে কি করিস?
চিন্তায় এতটা অস্থির ছিল বলেই হঠাৎ কথা শুনে সে চমকে উঠলো। পেছনে ফিরে দেখলে উজান দাঁড়িয়ে। উজান তাদের ডিপারটমেন্টেই পড়ে। তাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। সিনিয়রগিরি ফলাতেই হয়তো তাকে তুই তুই করে বলে আর কারণে অকারণে তার পিছনে লেগে থাকে। যার জন্য নদীর এই লোকটাকে অসহ্য লাগে।
-দেখছেনই তো বৃষ্টি হচ্ছে।
-তা যাবি কিভাবে? তোর তথাকথিত বয়ফ্রেন্ডটা কোথায়?
-সেটা দিয়ে আপনি কি করবেন?
-কি আর করব? বৃষ্টির দিনে প্রিয় মানুষকে এমনি এমনি কেউ ছেড়ে দেয়?
-কেন আমি কি চলতে ফিরতে পারি না নাকি?
-পারবি না কেন? বাদ দে। চল তোকে পৌছে দিয়ে আসি।
-আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমি যেতে পারবো।
-মুখের জোরেই আজকাল সব কাজ হয়ে যায় নাকি। চল রিক্সা ঠিক করে দেই।
ছাতাটা মেলে উজান দাড়িয়ে থাকলো। বাধ্য হয়ে নদীকে ছাতার নিচে আসতে হল। ভাষা ইনস্টিটিউটের গেটের কাছে এসে রিক্সা পেতেও বেশ খানিকটা সময় লেগে গেল। বৃষ্টির কারনে রিক্সাও কম আর যে কয়টা আছে তারাও যেতে চাইলো না। শেষ পর্যন্ত বয়স্ক এক মামাকে পাওয়া গেল। নদী উঠে বসলো তাড়াতাড়ি। একেবারেই সময় নেই।
– আমি আসি সাথে?
-অনেক কষ্ট করে ফেলেছেন আজকের মত। তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। মামা তাড়াতাড়ি চলেন।
এই মেয়েটা এমন অদ্ভুত কেন? ও কি সত্যি তার মনের কথা বুঝতে পারে না? নাকি বুঝেও না বোঝার ভান করে? মনের মধ্যে অসংখ্য প্রশ্নের আনাগোনা নিয়ে উজান নিজের হলে ফেরে।
হলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিজের ফোনটা হাতে নিল নদী। আসলেই আজ সারাদিন রাফাতের কোন খোঁজ খবর ছিল না। রাজনিতী নিয়ে এতটাই ব্যস্ত যে অন্য কোন কিছুতে তার তেমন আগ্রহ নেই।
সে কি আসলেই রাফাতের প্রেমিকা। তবে রাফাত কেন নিজে থেকে কখনও খোঁজ নেয় না। আবার যখন সে অন্য কোনো ছেলের সাথে কথা বলে তখন এমন ক্ষেপে ওঠে। হাতের মাঝেই ফোনটা ভাইব্রেট করতে থাকে। অপরিচিত নাম্বার। কে ফোন করলো?
-হ্যালো..
-কিরে ঠিক মত পৌঁছেছিস?
-আপনি? আপনার নাম্বার তো এটা না?
-হমম.. আমার নাম্বার এটা না তা আমি জানি। আর আমার নাম্বার যে ব্লক করা তাও জানি। ফোন যখন ধরেছিস তখন ধরেই নিলাম সব ঠিক আছে। থাক তাহলে।
পুরা আজব একটা লোক। নিজে নিজে কথা বলেই রেখে দিল। এটা ঠিক উজানের নাম্বারটা ব্লক করা তবে সেটা সে করনি, রাফাতের কাজ। কেন জানি ওনাকে রাফাত সহ্যই করতে পারে না। রাফাতের ফোনে কয়েকবার চেষ্টা করল। ফোনটা বন্ধ। কোথায় আছে কে জানে?
বৃষ্টি দেখে তার রুমমেট মিতা আপু খিচুড়ি রান্না করেছে। তার জন্য আলাদা করে রেখে দিয়েছিল। সে অন্যমনস্ক ভাবেই খাওয়া শেষ করল। তারপর বই নিয়ে বসলো কিন্তু অনেক্ষন বসে থাকার পরে বুঝলো পড়া কিছুই মাথায় ঢুকছে না। ফোনটা নিয়ে আবার রাফাতকে ফোন দিল। নাহ সেই বন্ধ। টেবিল ল্যাম্প বন্ধ করে শুয়ে পড়লো। কাল আবার সকালে ক্লাস।
ক্লাস শেষ হতেই রাফাত তাকে টেনে বাইরে নিয়ে এল। হাতটা এমন শক্ত করে ধরেছে যে ব্যাথায় নদী হাতটা এক ঝটকা দিয়ে ছাড়িয়ে নিল। রাফাত আগুন দৃষ্টিতে একবার তাকিয়ে হাটতে শুরু করলো। নদীকেও তাই পেছেন পেছন হাটতে হলো।
-কোথায় যাচ্ছি আমরা?
-কথা না বলে চুপচাপ আয়।
হেটে হেটে তারা দুজন লাইব্রেরীর সামনে এসে দাঁড়ালো।
-এখানে কেন?
-কেন মানে? খুব তো কাল বৃষ্টির মধ্যে এক ছাতার নিচে নায়ক নায়িকার মত হেটে গেলি।
-মানে?
-এখন কি মানেও বোঝাতে হবে? কেন গেলি ওই পোলার সাথে?
-তুমি কোথায় ছিলে?
-সেটা কি কোন বিষয়? তুই কেন গেলি সেটা বল। এক জন দিয়ে হয় না। দশ জন লাগে।
-এত জঘন্য কথা বলতে মুখে বাঁধছে না? আশেপাশেই যখন ছিলে তখন ছাতা নিয়ে আসলেই তো পারতে। তাহলে তো আর উজান ভাইয়ার সাথে যেতাম না।
-আবার নকশা করে ভাইয়া ডাকা হচ্ছে। আর একদিন যদি ওই পোলার সাথে দেখছি তাহলে তোর অবস্থা কি হবে তা তুই চিন্তাও করতে পারবি না। এখন যা সামনে থেকে।
মেজাজটা এমন খারাপ হল। হনহন করে হেটে এসে সে রিক্সা নিল। আজ আর কোন ক্লাস নেই। রুমে এসে শুয়ে পড়ল। কাল সারা রাত ভাল ঘুম হয়নি। মাথা ব্যথায় দপদপ করছে। মাঝে মাঝে মনে হয় এমন বিষাক্ত সম্পর্ক থাকার চেয়ে না থাকা ভাল। ফোনটা হাতে নিল। গতকালকের নাম্বারটা থেকে ম্যাসেজ এসেছে।
-“তোর না আজ ক্লাস ছিল? আসিস নাই? শরীর ঠিক আছে তো?”
নাম্বারটা কি সেভ করবে? থাক দরকার নেই। অযথা ঝামেলা বাড়বে।
-“ক্লাস করে চলে এসেছি।”
-“আমার আবার ঘুম থেকে উঠতে আজ দেরি হয়ে গেছে। তোর সাথে দেখা হল না আজ।”
-“আমার সাথে দেখা হওয়াটা কি খুব জরুরী?”
-“জরুরী তো বটেই। দিনটাই যে মাটি হয়ে যায় দেখতে না পেলে।”
-“এইসব কথা না বললেই খুশি হব। দয়া করে আর মেসেজ করবেন না।”
-“তোর কথা শিরধার্য।”
মেসেজগুলো ডিলিট করে ফোনটা রেখে সে উঠলো। ঔষধ না খেলে মাথা ব্যথা কমবে না।
২.
মফস্বল শহরের ছোট রেলস্টেশনটায় ট্রেন যখন থামলো তখন রাত প্রায় এগারোটা। এইখানে ট্রেন এক মিনিটের জন্য দাঁড়ায়। উজান আর রনি তাই তাদের ব্যকপ্যাক আর ট্রলি ব্যাগ নিয়ে আগে থেকেই দরজার কাছে দাড়িয়ে ছিল। ট্রেন থামতেই তারা চট করে নেমে পড়ল। আকাশের অবস্হা বেশি ভাল না। সেই কারনেই হয়তো তেমন লোকজন নেই। তাদের নিতে লোক আসবার কথা। স্টেশনের সামনের চায়ের দোকানটায় আলো জ্বলছে। তার দুজনে দোকানের সামনে দাঁড়াতেই ছেলেটা এগিয়ে এল।
-আপনারা কি আরিফ ভাইয়ের কলিগ?
দুজনেই একসাথে মাথা নাড়লো।
-এইখানে তো গাড়ি রাখার জায়গা নাই তাই ওই সামনে মাঠের পাশে রাখছি। একটু হাঁটা লাগবে। ব্যাগগুলা আমারে দেন।
-সমস্যা নেই ব্যাগ আমরা নিতে পারবো। তুমি রাস্তা দেখাও। তোমার নাম কি?
-আমার নাম নয়ন।
-এখান থেকে কতক্ষন লাগবে যেত বলতো?
-বেশিক্ষণ না ভাইজান। একঘন্টার মত।
রনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল।
-এখনও এক ঘন্টা। ট্রেনে বসে থেকে থেকে তো কোমর বাঁকা হয়ে গেছে। আগে জানলে আসতামই না।
উজান কনুই দিয়ে একটা গুতা দিল। গাড়িতে উঠে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। শহর এলাকাটা পাঁচ মিনিটেই শেষ হয়ে গেল। ছোট্ট্ নদীটা! ব্রিজটা পেরোতেই রাস্তার পাশের বাড়িঘর আর আলোগুলো কমতে শুরু করলো। আরিফের বিয়ে উপলক্ষে তাদের দুজনের এইখানে আসা। আরিফের বাবা চাচাদের বিশাল ফার্ম এই গ্রামে। আর যেহেতু চাচাতো বোনের সাথেই বিয়ে তাই বিয়ের সব অনুষ্ঠান এখানেই করা হবে। তাই গ্রামে হোক বা শহরে বন্ধুর মত কলিগের বিয়ে তো মিস করা যায় না।
-ভাইজান। চলে আসছি।
বিশাল প্রাচীরটা দুজনেরই চোখে পড়লো। মেনই গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই আলোকসজ্জা চোখে পড়ে। নীল নিয়ন আলোয় চারিদিক ঝলমল করছে। মেইন গেট থেকেও বাড়িটা
বেশ ভেতরে। গাড়ি আস্তে ধীরেই বাড়ির সামনে এসে থামলো। তারা নামতেই আরিফ হাসি মুখে এগিয়ে এসে তাদের জড়িয়ে ধরলো।
-তোদের জন্য সারাদিন ধরে অপেক্ষা করতেছি। আয় আগে ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে নে। তারপর সারা রাত আড্ডা দেব।
-তোর সখ হইলে আড্ডা দে বাপ। আমি খাইয়া দাইয়া লম্বা হইয়া শুইয়া পড়বো।
রনির কথায় বাকি দুজন হা হা করে হেসে ওঠে।
গ্রামের বিয়ে বলেই ভোর বেলা থেকেই লোকের আনাগোনা শুরু হল। এল প্যাটার্নের দুইতলা বাড়ি। বিশাল টানা বারান্দা। তাদের ঘরটা ঠিক শেষ মাথায়। রনি এখনও গভীর ঘুমে। উজান বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। বারান্দার গায়ে গায়ে বেড়ে ওঠা বকুল গাছ। গাছের গোঁড়াটা বাঁধানো। কেউ একজন বসে আছে গাছের তলায়। পাশে ঝুড়ি ভরা ফুল। সে সেখান থেকে সরে এল। হাতমুখ ধুয়ে এসে রনিকে ডেকে তুলল। এত সুন্দর চারিদিক। আশেপাশে একটু ঘুরে দেখতে হবে। এসেছে তো মাত্র দুদিনের জন্য। আজ বিকেলে হলুদ কাল দুপুরে বিয়ে। রাতের ট্রেনে তারা ঢাকা ব্যাক করবে। আরিফ নিচেই দাড়িয়ে আছে। ওদের নামতে দেখে আরিফ রান্না ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
-মা।
-কি হল?
-আমরা পুকুর পাড়ে বসছি। চা পাঠিয়ে দিও।
-আগে নাস্তা তো কর। বাড়ির সবার সাথে চা দিব।
-ওই গণচা খাব না মা। তুমি নদীকে বল চা করবে। ওর মত চা কেউ বানাতে পারে না এ বাড়িতে।
-নদীকে কই পাবো এখন?
-হৃদির সাথেই আছে দেখ।
-আচ্ছা তুই যা। আমি দেখছি।
নদী নামটা শুনেই উজানের বুক ধ্বক করে উঠলো। এ কি সেই নদী যাকে সে এতদিন ধরে খুঁজছে? নদী তো অন্য কারো নামও হতে পারে। জিজ্ঞেস করবে কি আরিফ কে? আচ্ছা এখন থাক। চা দিতে নিশ্চই আসবে আর তা না হলে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানে নিশ্চই দেখতে পাবে। তার নদী হলে সে কি চিনবে না?
চলবে…..
এমি
*কপি করা নিষেধ