#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_১৫
লেখনীতে- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি

“কী ভাবছো?” আদ্র’র আচানক উপস্থিতিতে তীহা চমকে উঠল। ঘুরে তাকাতেই আদ্র দুই কদম পিছিয়ে দাঁত কেলিয়ে বলল, “তোমার বিশ্বাস নাই। আবার মেরে বসবা হুটহাট। বলবা,আত্মরক্ষার্থে মারছো।”
তীহা লজ্জা পেয়ে দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। উঠোনের সামনে বিস্তৃত ক্ষেতের সমাহার। দূরে দূরে মানুষের উপস্তিতি। সবাই কাজে ব্যস্ত। সেদিকে তাকিয়ে থেকে তীহা নিচু কণ্ঠে বলল, “আপনি তখন নতুন ছিলেন..”
“আর এখন কী পুরোনো হয়ে গেছি?” আদ্র গলা বাড়িয়ে উৎসুক কণ্ঠে জানতে চাইলো। তীহা মাথা নাড়িয়ে বলল, “উঁহু, তবে পরিচিত হয়ে গেছেন।”
“যাক, বউয়ের কাছে অবশেষে পরিচিত তো হতে পারলাম!” একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল আদ্র। তীহাকে শুনিয়ে শুনিয়ে.. তীহা প্রত্যুত্তর করল না। কিছু বিষয় এখনো খুব অস্পষ্ট। ওদের দাম্পত্য জীবন আর দশটা স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনের ন্যায় নয়। আদ্র জানেও না,আদৌও তীহা স্বাভাবিক হবে কীনা। তার সঙ্গে স্বাভাবিক দাম্পত্য জীবনে যাবে কীনা। তবুও কেন সে এত নিস্পৃহ!
তীহা বলল, “একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
আদ্র বলল, “তার জন্য অনুমতি চাওয়ার কী আছে?”
“না মানে.. যাইহোক, প্রশ্নটার ঠিক ঠিক উত্তর দিবেন কিন্তু। ফাপর মারলে আমি ঠিক বুঝে যাব।”
আদ্র জবাবে বলল, “আমি তোমাকে মিথ্যা বলেছি এই পর্যন্ত?”
“কী জানি!” বলে একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলল তীহা।
আদ্র আশ্বস্ত করল, “তোমার যা ইচ্ছা তাই জিজ্ঞেস করো। যেটা সত্যি, আমি সেটাই বলব। ভরসা রাখতে পারো আমার উপর।”
আদ্র এমন ভাবে তার উপর ভরসা রাখতে বলল যে তীহার অনেককিছুই মনে পড়ে গেল। সময়টা যেন থমকে দাঁড়াল। সে চলে গেছে বর্তমান ছাড়িয়ে অনেকটা পেছনে,অতীতের কোনো এক সময়ে…

শুক্রবার, সকাল থেকেই দিনটা অনেক সুন্দর। তীহার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে আছে। দীর্ঘ আটদিন পর আজ অনিন্যর সাথে দেখা হওয়ার সৌভাগ্য হবে তার। অনিন্য ব্যবসায়িক কাজে এতই ব্যস্ত থাকে যে,তাদের দেখা সাক্ষাৎ অনেক কম হয়। তীহা সবসময় দেখা করার জন্য মুখিয়ে থাকে,ওদিকে অনিন্য সবসময় নির্লিপ্ত, নির্বিকার। যেন দেখা হওয়া না হওয়া নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই৷ এই নিয়ে তীহা সম্পর্কের শুরুতে অভিযোগ করলেও এখন আর করে না। কেননা একবার অনিন্য জবাব দিয়েছিল, “এত পরিশ্রম কেন করি,বোঝো না? তোমার আমার ভবিষ্যতের জন্যেই তো। মানলাম ব্যবসাটা বাবার। বাবার ব্যবসাতেই আমি নিজের জন্য স্থান তৈরি করে নিচ্ছি। একটু তো ধৈর্য্য ধরতেই হবে তীহা!”
তীহা এরপর আর কিছুই বলেনি। সবসময় ধৈর্য্য ধরে গেছে। যদি জানত ধৈর্য্যর ফল শেষে এই, তবে সে অনেক আগেই সরে যেত। একটা ভাঙা মন কারো কাছে আকাঙ্ক্ষিত বস্তু নয়। কেউ চায় না, নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে শেষে দুঃখের পাহাড় বুকে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে।

বেলা এগারোটা থেকে একটা বাজে। তীহা রেস্টুরেন্টে দুই ঘন্টা যাবত অপেক্ষা করে। অথচ অনিন্য’র দেখা নেই। সে ঠিকই ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করে গেছে। ফোনের উপর ফোন দিয়েও অনিন্যকে পাওয়া যায় না। আড়াই ঘন্টার মাথায় অনিন্য’র নাম্বার থেকে ফোন আসে। তীহা ফোন ধরার সাথে সাথে শুনতে পেয়েছিল, “সরি তীহা, আজ হচ্ছে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা মিটিংয়ে ফেসে গেছি। এতক্ষণ ক্লায়েন্টদের সাথে ছিলাম।”
তীহার চোখ উপচে পড়ে নোনা জলের বারিধারা। তবুও নিজেকে অপ্রকাশিত রেখে সে প্রশ্ন করেছিল, “সকাল বেলাতেই একটা ম্যাসেজ দিয়ে দিতে। আমি কষ্ট করে এখানে এসে লজ্জিত হতাম না।”
জবাবে অনিন্য তেজ নিয়ে বলেছিল, “বিশ্বাস রাখলে রাখো না রাখলে নাই। আমি আছি মহা ঝামেলায় আর তুমি বাঁচো না তোমার রঙে..”
টুট টুট জাতীয় আওয়াজ কানে ভেসে এলে তীহা বুঝতে পেরেছিল অনিন্য ফোন কেটে দিয়েছে। না,রাগ না,ভীষণ অভিমান জন্মেছিল তীহার। সেই অভিমান জমতে জমতে একসময় ফুরিয়েও গেছিল। অথচ অনিন্য’র অভিমান ভাঙানো তো দূর, একবারও সেই বিষয়ে দ্বিতীয় কথা বলেনি। এমনকী নিজের ভুলটাও স্বীকার করেনি!

পুরোনো কথা ভাবতে গিয়ে তীহার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে ভারী দীর্ঘশ্বাস। খেয়াল হয়, আদ্র পাশে দাঁড়িয়ে। তীহা ধাতস্থ হয়। আদ্র’র দিকে তাকাতেই আদ্র বলে উঠল, “স্মৃতিচারণ করা শেষ?”
তীহা লজ্জা পেল। কিছু বলল না।
আদ্র বলল, “তুমি কিছু একটা ভাবছিলে, তাই আর ডিস্টার্ব দেয়নি। এবার বলো,কী যেন জিজ্ঞেস করবে।”
তীহা অন্যমনস্ক হয়ে বলল, “উঁহু,কিছু না।”
“আমি জানি তুমি কী প্রশ্ন করতে চাও।”
“আপনি জানেন?” তীহাকে অবাক লাগলো।
আদ্র মাথা দুলিয়ে বলল, “হুম। সবই জানি। আমি কেন তোমার সাথে তবুও কন্টিনিউ করছি,সেটাই তো জানতে চাও তাই না? আর এখন নিশ্চয়ই ওই হারামজাদার কথা ভাবছিলে?”
“ক..কোন হারামজাদা?” তীহার বিব্রত কণ্ঠস্বর।
আদ্র তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, “বোঝো না? না বুঝলে বুঝতে হবে না। একটা ছোট্ট ভুল করেছি তীহা..”
“কী?”
“তোমার ডায়েরিটা.. পড়ে ফেলেছি।”
তীহা বিস্ময়ের চূড়ান্তে, একটা ডায়েরি সে বানিয়েছিল। অনিন্য’র দেওয়া কষ্টগুলো আর তার জমানো অভিমান গুলো লিপিবদ্ধ করত সেইখানে। ভেবেছিল অনিন্য’র সাথে বিয়ে হওয়ার পর প্রথম রাতেই ডায়েরিটা তার হাতে তুলে দিয়ে বলবে, “এত এত কষ্ট দিয়েছো আমাকে। এত এত অভিমান আমার। আজ রাতে সেই সব অভিমান তোমার ভাঙাতে হবে৷ এটাই তোমার শাস্তি।”
অনিন্য’র সাথে বিয়েও হলো না, আর সেই ডায়েরিটাও দেওয়া হলো না!
কিন্তু কোন ফাঁকে সেসব পড়েছে আদ্র!

আদ্র বলল, “তুমি নিজে থেকে আমাকে কিছুই খোলাসা করবে না,তাই আমি সব পড়েছি,জেনেছি। আর এটাও জেনেছি ওই হারামজাদা তোমাকে কতটা কষ্ট দিয়েছে! আর যেই প্রশ্নটা তোমার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে,সেটার উত্তর হলো, আমি চাই না পরবর্তীতে কোনো আফসোস করতে। এই যে, এখন যেমন তুমি আফসোস করে করে মরছো,কেন আগে বুঝলে না। ঠিক সেভাবে আমি আফসোস করতে চাই না। আমি চাই না কখনো ভাবতে যে একটু আগালে হয়তো মেয়েটার জীবন সুন্দর করা যেতো! তাই নিজের সবটুকু দিয়ে তোমাকে আবারও একটা সুন্দর, স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে চাই। ব্যস,এইটুকুই..”

“আর ভালোবাসা? ভালোবাসার কথাটা কেন স্বীকার করছেন না?” নিচু কণ্ঠে তীহা প্রশ্নটি করে বসল। আদ্র স্মিতহাস্যে বলল, “ওই কথাটা স্বীকার করলেই তুমি আমাকে দুর্বল ভেবে নিবে তীহা। আর.. ওই কথাটা বললেই কী তুমি আমার হবে? তোমাকে পাওয়া যাবে? যদি যায়, তাহলে শোনো, আমি তোমাকে পছন্দ করি, তোমার উপস্তিতি সবসময় কামনা করি। তুমি আশেপাশে থাকলে আমার ভালো লাগে। তুমি দুঃখ পেলে আমার খারাপ লাগে। তোমার মনটা ভালো করাই যেন আমার একমাত্র কর্তব্য- এমন মনে হয়। এর কারণ যদি ভালোবাসা হয়ে থাকে তাহলে ইয়েস, আই ডু। আই লাভ ইউ!”

আদ্র’র অকপট স্বীকারোক্তি তীহাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে তুললো। আদ্র ফের বলল, “একটা কথা শোনো,তোমার থেকেও খারাপ অবস্থায় যারা আছে তাদের কথা সবসময় মনে রাখবে। তাহলে দেখবে কষ্ট কম লাগছে। আর হ্যাঁ,জীবন কিন্তু একটাই। এই জীবন টা শেষ হয়ে গেলে আর পাবে না ফিরে। তাই সময় থাকতেই জীবনের কদর করতে শেখো তীহা। হায়াত থেকে থাকলে এখনো অনেক লম্বা সফর বাকী!”

আদ্র চলে গেছে। তীহার মনটা হুট করেই ভীষণ ভালো হয়ে গেল। মনে মনে একটা দারুণ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে, ওই হারামজাদার কথা আর ভাববে না। যা হারিয়েছে,হারিয়েছে। এখন পাওয়ার অনেক কিছুই বাকী! তীহা খেয়াল করল, সেও অনিন্যকে হারামজাদা বলে সম্বোধন করেছে। সে হেসে ফেলল! গুনগুন করে গান ধরতে ধরতে রান্নাঘরের দিকে এগোলো। আজকের রান্নাটা তীহা করবে..

(চলবে)
[কেমন আছেন সবাই? আমি ভীষণ অসুস্থ!!]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here