#এলোমেলো_হাওয়া
#পর্ব_৮
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
আজ শুক্রবার, তীহাদের বাড়ি থেকে চলে যাওয়ার দিন আজ। দুপুরের নামাযের পর সবাই মিলে ছাদে বসে ভোজন করল। সে সময়ে সবাই হাসিতে মাতোয়ারা। বিকেল হতেই ধীরে ধীরে সবার মুখের হাসি মিলিয়ে যেতে লাগলো। তীহার বাবার মুখ অন্ধকার, মায়ের চোখ কাঁদোকাঁদো। বোন মুখ ঘুরিয়ে নেয় শুধু,নিজের মন খারাপ বুঝতে দিতে চায় না বোনকে। তবুও তীহা সব বুঝে গাঁট হয়ে বসে রইলো।
আদ্র ঘরে ঢুকে তীহার অবস্থা দেখে বলল,
“আজ থাক তাইলে। আগামীকাল যাবোনে বাসায়।”
তীহা গুমোট মুখে প্রশ্ন করল,
“কেন?”
“এই যে,তুমি যেভাবে মুখ আঁধার করে রেখেছো,তাই। তোমার মন খারাপ দেখতে ইচ্ছে করবে না বাসায় গিয়ে।”
“কাল গেলেও তো মন খারাপ হবে। তখন কী পরশু যাবেন?”
আদ্র হেসে ফেলল।
“তাহলে মুখ থেকে অন্ধকার সরাও। যাও, বাবা-মায়ের সাথে গিয়ে কথা বলে আসো। দেখবা, মনটা হালকা লাগবে। আর যদি তুমি চাও,প্রতিমাসে একবার করে এসে বাবার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেও। আমি কখনোই মানা করব না।”
তীহা মুখ আরও ভার করে বলল,
“এত কথা বলতে হবে না আর আসতেও হবে না। চলুন, সব গোছান।”
তীহা উঠে যেতে নিলে আদ্র তার হাত টেনে ধরল। তীহার চোখের দিকে তাকাতেই টলমলে একজোড়া নেত্র দেখতে পেল। তীহা চোখ সরিয়ে নিলো। আদ্র বলল,
“যার বাবা-মা আছে পৃথিবীতে, সে অনেক সুখী হয় তীহা। এই বাবা-মা যেদিন থাকবে না সেদিন এইসব দিন গুলোর কথা ভেবে ভীষণ আফসোস হবে বিশ্বাস করো। আজ উনারা আছে দেখেই অভিমান করতে পারছ। না থাকলে কার সাথে অভিমান করতে?”
তীহার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা উত্তপ্ত জল গড়িয়ে পড়ল। আদ্র যত্ন সহকারে সেই জল ফোঁটা গুলি মুছে নিয়ে বলল,
“যাও তীহা,কথা বলে এসো। ভালো লাগবে। অভিমান ছাড়ো। অভিমান থেকে যাবে কিন্তু মানুষ চিরকাল থাকবে না।”
____
বিয়ের দিন যে বিদায়পর্ব হয়নি,সেই বিদায়পর্ব যেন আজ হলো। তীহা কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে ফেলল যেন এটাই তার প্রথম শ্বশুর বাড়ি যাওয়া। তার কান্না দেখে আদ্র’র ভয় হতে লাগল। যদি তীহার বাবা-মা বেঁকে বসে!যদি বলে আর কটাদিন থেকে যাক তাদের মেয়ে। আদ্র’র সমস্যা নেই কিন্তু নিরুপমা বেগম আবার গাল ফুলাবেন। এমনিতেই দুদিনের জায়গায় তিনদিন হয়েছে বলে গতকাল রাতে আদ্রকে ভীষণ ঝাড়াঝাড়ি করেছেন নিরুপমা বেগম ফোন দিয়ে। আদ্র সেসব কথা তীহাকে জানায়নি। নিজের ভেতর চেপে রেখেছে। আজকে যদি না যায় তবে আগামীকাল সে-ই না বউ নিতে চলে আসে একদম। কিন্তু আদ্র’র ভয়কে গায়েব করে দিয়ে তীহার বাবা-মা আর থাকার জন্য বললেন না। বরং আদ্রকে বললেন, তারা যেন আবার দ্রুতই চলে আসে বেড়াতে। আদ্রও তাদের আশ্বস্ত করে এলো।
গাড়িতে বসার পর তীহা চোখের জল,নাকের জল টিস্যু দিয়ে মুছছিল, আদ্র বলল,
“জমানো মেঘে টোকা মারলাম নাকী?”
তীহা নাক টেনে বলল,
“আপনি কীসব বলে বলে আমাকে শুধু কাঁদান।”
“তার মানে কী,আমি পঁচা?”
“আমি কী বলেছি আপনি পঁচা?”
“ওহ, এর মানে ভালো।”
“আমি তাও বলিনি।”
“তাহলে কী?”
“আপনি নিরামিষ।”
“অ্যাহ!”
“হ্যাঁ।”
তীহার কান্না থেমেছে,ঠোঁটের কোণে মিষ্টি হাসি। আদ্র অপলক তাকিয়ে রইলো সেকেন্ড কয়েক। তারপর চোখ সরিয়ে নিলো। বউটা তার-ই,ধীরেসুস্থে দেখা যাবে। দেখাদেখির এত তাড়া তো নেই!
____
আহসান খান অদূরে বসে থাকা মেয়েটিকে একবার আগাগোড়া কঠোর চোখে পরখ করে নিলেন। মালোতি মাথানিচু করে বসে রয়েছে। আজ দু’দিন যাবত অনিন্য কোনোকিছুই মুখে তুলছে না। তাকে পাওয়া গেছে একটা সমিলের পাশের আবর্জনার স্তুপে। সেখান থেকে তুলে আনার পর থেকে এই অবস্থা। মাথা ফাটিয়ে এমনিতেই অনেক রক্ত খুঁইয়েছে। এখন যদি এভাবেই না খেয়ে থাকে তাহলে বেঁচে থাকার আশংকা নেই,ডক্টররা সাফ জানিয়ে দিয়েছে তা। খবর পেয়ে আহসান খান দ্বিতীয় বারের মতো ছেলেকে দেখতে ছুটে এসেছেন। প্রথমবার এসেছিলেন,ওকে উদ্ধার করতে ওই ড্রেন থেকে। আহসান খানকে দেখে অনিন্য চোখমুখ শক্ত করে ফেলল। কোনো কথা না বলে মুখ একদিকে ঘুরিয়ে রাখল। তা দেখে আহসান খানের জেদ আরও বাড়ল। তিনি উঁচু গলায় বললেন,
“আমার দিকে তাকাও অনিন্য। তুমি এসব কী শুরু করেছো? তোমার মা আমাকে জ্বালিয়েছে,এখন কী তুমিও আমাকে জ্বালিয়ে মারবে? মৃত্যুতেও বুঝি আমার শান্তি হবে না!”
অনিন্য দ্রুত মুখ ফিরিয়ে তাকাল। শরীরে শক্তি নেই, গলায় দম নেই। তবুও যতটুকু জোরে সম্ভব ততটুকু জোর দিয়েই চেঁচিয়ে বলল,
“আমার মা’কে নিয়ে একটাও বাজে কথা বলবেন না।”
“বলব না যদি লক্ষী বাচ্চার ন্যায় খাওয়াদাওয়া শুরু করো তো..”
“আমি খাব না। আমি মরে গেলে কার কী?”
“সত্যি বলব? কারো কিছুই না। আমারও ঘাড় থেকে আপদ বিদেয় হতো। কিন্তু শত হোক,তুমি আমার রক্ত! এখানেই আঁটকে যাই। এখন শোনো,তোমার জন্য একটা গুড নিউজ আছে,আর একটা ব্যাড নিউজ। কোনটা আগে শুনবে?”
অনিন্য সেকথার জবাব দিলো না। আহসান খান মুচকি হেসে বললেন,
“ব্যাড নিউজটাই আগে শোনো। ওই যে মেয়েটা,কী যেন নাম তার, উম! তীহা,আগামীকাল সে হানিমুনের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবে তার আদরের স্বামীর সঙ্গে। এখন তুমি যদি এরকমই থাকো,তবে আমাকে বাধ্য হয়েই সে যাত্রা ভন্ডুল করতে হবে। বলতে পারো, আমার খারাপ রূপের শেষ টুকু আমি তাকে দেখাবো। আর যদি খাওয়াদাওয়া করে আমার চিন্তা কমাও,তবে সে চুলোয় যাক,সে খবর আমার নিয়ে লাভ হবে না।”
অনিন্যর শক্ত মুখে আরো খানিক কাঠিন্য যোগ হলো। আহসান খান চুপচাপ বসে রইলেন। তিনি জানেন,এবার তার ছেলে ঠিকই খাবে। জায়গা মতো টোটকাটাই সে দিয়েছে!
অনিন্য’র বুক চেঁড়া দীর্ঘশ্বাস সে কাউকে বুঝতে দিলো না। ভার মুখে বলল,
“পরের মেয়ের অভিশাপ কুড়িয়ো না।”
“তার মানে তুমি খাবে?”
“খাবো।”
আহসান খানের মুখের হাসি চওড়া হলো। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে মালোতির দিকে ইশারা করে বললেন,
“এই মেয়ে,অনি’র খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব তোমার উপর দিলাম। এর জন্য মাস শেষে মোটা মাইনে পাবে।”
মালোতির চোখমুখ লজ্জায় লাল হয়। অপমানে থমথম করছে সে। অনিন্য হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল,
“আর গুড নিউজটা?”
আহসান খান উৎসুক গলায় বললেন,
“আমার ব্যাপারে তোমার আগ্রহও আছে দেখছি! যাইহোক..”
হঠাৎ তিনি লজ্জা মিশ্রিত গলায় বলেন,
“তোমার আবার ভাই-বোন আসছে।”
অনিন্য অন্যপাশ ফিরে চোখের জল আঁটকালো। তার বাবা এরকমটা ছিল না। দ্বিতীয় বিয়ের পর তিনি কেমন যেন পাল্টে গেছেন। ছেলের দুঃখে তিনি সুখ খুঁজে পান!
(চলবে)
বিঃদ্রঃ দীর্ঘদিন গল্প দেওয়া থেকে বিরতি নিয়েছিলাম। কারণ আমি গ্রামে এসেছি এবং এখানে নেটও নেই। তাছাড়াও এখানে লিখার সুযোগ টা নেই। একটা ছোট পর্ব আজ দিলাম। নেক্সট পর্ব ইনশাআল্লাহ পরশুদিন দেব।