#মন_নিয়ে_খেলা(৪)
*********************

সাদমান যে সত্যি, সত্যি কথাটা বলেছিল, এটা অরণী তখন বুঝতে পারেনি। সাদমান এর আগেও অভিমান করে দু-একবার এমন ধরণের কথা বলেছে। একবার তো পুরো এক সপ্তাহ সে অরণীর সঙ্গে কথা বলেনি। অনেকবার ‘কী হয়েছে’ জানতে চাওয়ার পরও সাদমান, অরণীর প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। পরে যখন অরণী অভিমান করে কথা বলা বন্ধ করে দিল, তখন নিজেই এসে সরি বলেছিল।

এরমধ্যে সাতদিন পেরিয়ে গেছে, সাদমানের কোনও খোঁজ নেই। অরণী যদিও ভেতরে, ভেতরে ভীষণ কষ্ট পাচ্ছিল; কিন্তু প্রথমদিকে সে বিষয়টাকে তেমন পাত্তা দেয়নি। গতকাল তাদের দুইটা পরীক্ষা ছিল। অরণী ভেবেছিল, ক্লাস মিস দিলেও, সাদমান পরীক্ষা দিতে আসবে; কিন্তু সাদমান ভার্সিটিতে আসেনি। আজকে অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার শেষ দিন ছিল। আজকেও সাদমান এল না। গতকাল থেকে এই পর্যন্ত যতবার সে সাদমানের নাম্বারে ফোন করেছে, ততবারই ফোন বিজি পেয়েছে। অরণী প্রথমে বুঝতে পারেনি। অনেকবার ফোন করে লাইন না পাওয়ার পর তার মনে হল, সাদমান বোধহয় তাকে ব্লক করেছে। অরণী ক্লাস শেষ করে নিয়নকে বলল, নিয়ন, সাদমান আসছে না কেন? ও কী অসুস্থ?

আমি তো জানি না। সেদিন সাদমান লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে বলল, ওর শরীর খারাপ লাগছে। বাসায় চলে যাবে বলে তখনই তো চলে গেল। ঐ যে তোমরা লাইব্রেরিতে বসে যেদিন কথা বলছিলে, সেদিনের কথা বলছি।

এরমধ্যে ওর সঙ্গে তোমার কথা হয়নি?

পরশুদিন রাতে ফোন করেছিলাম। ওর সাথে কথা বলে মনে হল, কোনও কারণে সাদমানের মন খারাপ।

কী কারণ, জানতে পারোনি?

আমি আসলে জানতে চাইনি। আমি অনুমান করেছি, কারণটা কী হতে পারে।

কী কারণ?

তুমি বুঝতে পারছ না অরণী? নাকি বুঝতে চাচ্ছ না?

অরণী ঠোঁট কামড়ে, নিয়নের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিল।

অরণী, একটা কথা বলব?

বলো।

সাদমান তোমাকে সত্যিই অনেক ভালোবাসে। আমি হলে বছরের পর বছর এভাবে অপেক্ষা…… অসম্ভব, চিন্তাই করা যায় না।

আমি ওকে ফোনে পাচ্ছি না। ও মনে হয় আমাকে ব্লক করেছে।

অরণী, তুমি কী আমাকে একটু ক্লিয়ার করে বলবে, তোমার সমস্যাটা ঠিক কোন জায়গায়?

আমার সাদমানের সঙ্গে কথা বলা দরকার। ও পরীক্ষাটা কী জন্য মিস করল? অ্যাসাইনমেন্টও জমা দিল না।

আমি কী বলি আর তুমি কী বলো! অরণী, তুমি ঠিক আছ তো?

অরণী মোটেও ঠিক নেই। মানসিক অস্থিরতা তাকে বেসামাল করে দিচ্ছে। সাদমানের এবারকার অবহেলা, না এটা তো ঠিক অবহেলা না। ওর নিজ থেকে গুটিয়ে যাওয়াটা, অরণীকে ভালো থাকতে দিচ্ছে না। এসব কথা নিয়নের সঙ্গে শেয়ার করতে মন চাইছে না। অরণী ওর মোবাইল থেকে আবারও সাদমানকে ফোন করল এবং যথারীতি লাইন পেল না। সে নিয়নকে বলল, সাদমানকে একবার ফোন করবে?

তুমি কথা বলবে?

হুম। আমার ফোন থেকে কল যাচ্ছে না।

নিয়ন, সাদমানকে ফোন করল। সাথে, সাথেই সাদমান ফোন রিসিভ করল। নিয়ন বলল, কী রে, তুই ঠিক আছিস তো?

আছি।

আছি কী রে ব্যাটা? ভালো থাকলে, ক্লাসে আসছিস না কেন? নে অরণীর সঙ্গে কথা বল।

নিয়ন মোবাইল এগিয়ে দিলে, অরণী ফোনটা কানের কাছে নিয়ে শুনতে পেল, ‘প্লিজ নিয়ন, ওকে ফোন দিস না। আমি এখন কথা বলব না।’ অরণীর ভীষণ কান্না পেল কথাটা শুনে। সে নিয়নের কাছ থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে দাঁড়াল। কান্নাটাকে গিলে ফেলে বলল, কেমন আছ, সাদমান?

কিছুক্ষণ ওপাশ থেকে কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। অরণী বলল, হ্যালো সাদমান, শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো, আমার সাথে কথা বলবে না?

সাদমান এবারও কোনও কথা বলল না।

সরি, নিয়নের মোবাইল থেকে কথা বলার জন্য। আমাকে তো ফোন, ম্যাসেঞ্জার, সব জায়গাতেই ব্লক করে দিয়েছ। কথা বলবে না আমার সঙ্গে? ফোন রেখে দেবো?

দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সাদমান বলল, কেমন আছ অরণী?

আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই। কখন দেখা হবে?

দেখাদেখির আর কী দরকার? দেখা হওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। আমি তোমাকে সারাক্ষণ বিরক্ত করতে থাকি। আর কখনও বিরক্ত করব না।

আমার ওপর রাগ করে নিজের ক্ষতি করছ কেন? ক্লাসে আসছ না কেন?

তোমার ওপর রাগ করব কেন? কারও ওপর রাগ করতে হলে, অধিকার লাগে। অধিকার ছাড়া রাগ দেখানো বোকামি। আমি নিজের সঙ্গে রাগ করেছি।

ক্লাসে আসো, প্লিজ।

অরণী, আমি তোমার সঙ্গে পরে কথা বলি। আমার এখন একটু কাজ আছে।

অরণী ভীষণ কষ্ট পেল সাদমানের কথা শুনে। সাদমান আগে কখনও এমন করে তাকে অবহেলা করেনি। অরণী, নিয়নকে মোবাইলটা ফেরত দেওয়ার আগে বলল, নিজের ওপর রাগ করে থেকো না। ক্লাস করো প্লিজ।

অরণী চলে গেলে, নিয়ন ফোন নিয়ে জিজ্ঞেস করল, সাদমান তুই অরণীকে কী বললি?

আমি কিছু বলিনি।

কিছু না বললে, ওর এমন কান্না, কান্না চেহারা হল কেন? ভাই, তোরা দুইজন এমন বাচ্চাদের মতো শুরু করে দিলি কেন, বল তো? আর অরণীকে ব্লক করেছিস কেন? আনব্লক কর এখনই।

আমি এখন রাখি নিয়ন।

কালকে ক্লাসে আসিস।

নিয়নের কথার উত্তর না দিয়ে, সাদমান ফোনের লাইনটা কেটে দিল।

**************

নীলোর্মি তার অখিল কাকুর সঙ্গে বুয়েটে এসেছে। আধঘন্টা লাইনে দাঁড়ানোর পর, ভর্তি কার্যক্রম শেষ হল। আরও আধঘন্টা সে তার বোনের জন্য অপেক্ষা করল। ক্লাস শেষ করে, অরণী এসে গাড়িতে উঠে বলল, স্বাগতম তোমাকে এই সুন্দর ক্যাম্পাসে।

থ্যাংকস, আপু।

নীলোর্মির বলার ধরণেই অরণী বুঝল, বেচারি এখনও মন খারাপ করে আছে। বোনের হাত ধরে অরণী বলল, মন খারাপ করো না, প্লিজ। যা হয়, আমাদের ভালোর জন্যই হয়ত হয়।

অরণীর বলার ভঙ্গিতে নীলোর্মি না হেসে পারল না। আপু, তুমি তো একদম দাদির মতো কথা বললে।

আম্মু আসতে চাননি তোমার সাথে?

না। আম্মুর মিটিং ছিল দশটায়।

প্রশ্নটা করে অরণী নিজের মনেই হাসল। তারা, তাদের বাবা আর আম্মুকে সারাজীবন ব্যস্ত দেখে এসেছে। তাদের স্কুল, কলেজের ভর্তি, বেতন দেওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজকর্ম, সবসময় অখিলই করে এসেছেন। অখিল না এসে, পূনম এলেই বরং অরণী অবাক হত।

পূনম আর ফাহাদের পরিবারের সঙ্গে অখিল নামের মানুষটার প্রায় বিশ বছরের সম্পর্ক। পূনম আর ফাহাদ দুইজনই যাঁর, যাঁর ব্যবসা আর সামাজিক জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকায়, তাঁদের সংসারের একটা দিকের দায়িত্ব অখিলকেই সামলাতে হয়। এই বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তিনজন ড্রাইভার, বাড়ির ভেতর তিনজন কাজের সহকারী, দুইজন দারোয়ান, মালি, তাঁদের সবার কাজের দায়িত্ব তদারকি করা, বেতন-বোনাস এবং এঁদের সুবিধা, অসুবিধা সবকিছুই অখিল দেখভাল করেন। ছোটোবেলা থেকে এমন ব্যবস্থা দেখতে, দেখতে ওরা দুই বোন এতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিদিন সকাল সাতটায় কাজে এসে, রাত আটটা পর্যন্ত ডিউটি করে যাওয়া অখিল নামের মানুষটাও তাঁর কাজে আন্তরিকতা আর বিশ্বস্ততা দেখিয়ে, এই বাড়ির সবার কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন। অখিলকে ছাড়া এঁরা নিজেদের একটা দিনও কল্পনা করতে পারেন না।

************

বিকেলে বাড়ি ফিরে পূনম, অখিলের কাছ থেকে সারাদিনের কাজের আপডেট নিলেন। নীলোর্মির ভর্তি ঠিকঠাক মতো সম্পন্ন হয়েছে শুনে পূনম বললেন, নীলোর্মি মন খারাপ করে ছিল?

না তো। সেরকম তো কিছু দেখিনি। দুই বোন সারা রাস্তায় গল্প করতে, করতে আসলো।

আমি তেইশ তারিখে বাইরে যাচ্ছি। ফিরে আসতে দশ-বারো দিন সময় লাগবে।

আপা, পরশু তেইশ তারিখ?

হুম। ছাব্বিশ তারিখে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার কথা আছে; কিন্তু আমি তো যেতে পারব না। শান্তিনিকেতন কোনটা, চিনেছ তো? মার্চ মাসে বিরুলিয়া গ্রামে যে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়েছিলাম। তোমার মনে আছে তো?

জি, আপা।

জনি আমাদেরকে নিয়ে গিয়েছিল। ওকে নিয়ে যেয়ো। তাহলে আর চিনতে অসুবিধা হবে না। তুমি ফারহানা আপার কাছে এই দেড় লাখ টাকার চেকটা পৌঁছে দিয়ে, আমার হয়ে সরি বলে আসবে।

জি, আপা।

তোমার স্যারের গাড়িটা বিআরটিএতে নিতে হবে। মনে আছে?

জি, আপা। ডায়েরিতে সব লিখে রাখা আছে। আমাদের যেতে হবে আটাশ তারিখে।

ঠিক আছে। আমি যতদিন না ফিরছি, ফুলবানু, কুলসুম আর পুতুল যেন বাড়ির বাইরে না যায়। এমনিতে ফুলবানু গতমাসে পাঁচদিনে ছুটি নিয়ে, পনেরো দিন কাটিয়ে এসেছে। এবার যেন কেউ এমন না করে৷

আপা, ফুলবানু বুবু মন খারাপ করছিল।

কিসের জন্যর মন খারাপ?

আপনি ওর দশদিনের বেতন কাটতে বলেছিলেন। আমি ওকে বিশ দিনের বেতন দিয়েছি। বুবু বলল, পনেরো বছর ধরে এই বাড়িতে থাকছেন। ঐ কয়টা বাড়তি দিনের ছুটির জন্য বেতন কেটে নেওয়াটা…..

বেতন কেটে ঠিক করেছ। এটার দরকার আছে দেখেই বলেছি। একে তো দেরি করে এসেছে, সেটা না হয় মানলাম; কিন্তু তার স্বামীর অসুখের কথা বলে ছুটি নিয়ে, ভাইয়ের ছেলের বিয়ে খেতে যাবে কেন? সত্যি কথাটা বললে কী ছুটি দিতাম না।

ওনার বোনের মেয়ের বিয়ের সময় ছুটি পায়নি, তাই মিথ্যা বলেছে।

এদের এত বিয়ে লেগে থাকে কেন সারাবছর? যাগ গে, এইসব মিথ্যা এখানে চলবে না। তুমি তার দশদিনের বেতন কেটে রেখেছ, এতে যদি তার শিক্ষা হয়, তাহলে এমন মিথ্যা আর বলবে না। যেই টাকাটা কেটে রেখেছ, এটা ঈদের সময় ওর বোনাসের টাকার সাথে দিয়ে দিয়ো।

জি আচ্ছা। আপা, একটা কথা বলব।

বলো।

আমার মেয়ের বিয়ে পঁচিশ তারিখে। আপনাকে বলেছিলাম….

ওহ হো, আমার তো একদম মাথায় ছিল না তারিখটা। কী করি, বলো তো? আমরা তো থাকতে পারছি না। পঁচিশ তারিখে তোমার স্যারও দেশে থাকবেন না। আমি তো কথা দিয়ে দিয়েছি। তেইশ তারিখের প্রোগ্রাম পেছানোর কোনও উপায় নেই। তুমি একটা মিনিট দাঁড়াও।

অখিলকে দাঁড় করিয়ে রেখে, পূনম ওপর তলায় উঠে এলেন। দুই লাখ টাকার চেক কেটে নীচে এসে, অখিলের হাতে চেকটা দিয়ে বললেন, এটা রাখো। তনুশ্রীকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ো।

চেকটা হাতে নিয়ে অখিল বললেন, আপা আপনি বলেছিলেন, তনুশ্রীকে আশীর্বাদ করতে আসবেন।

সরি অখিল। আমি ফিরে এসে তোমার মেয়ে-জামাই এর সঙ্গে দেখা করব।

ঠিক আছে, আপা।

আচ্ছা তুমি এখন যাও।

অখিল চলে গেলে, পূনম ওপরে উঠে এলেন। নীলোর্মির রুমের দরজা খোলাই ছিল। পূনম রুমে ঢুকে দেখলেন, নীলোর্মী বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে আছে। পূনম সামনে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, কী করো?

নীলোর্মি উঠে বসে বলল, মুভি দেখি।

ক্লাস কবে থেকে শুরু হবে?

আগামী মাসে।

আমার সঙ্গে যাবে?

নীলোর্মি পূনমের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, কোথায় যাব?

মালদ্বীপ যাচ্ছি। তারপর শ্রীলংকা আর ভুটান….

আমি যাব না।

চলো। তুমি তো বেড়াতে পছন্দ করো। তোমার ভালো লাগবে।

আমাদের ভালোলাগা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না, আম্মু। তুমি আমাদের ভালোলাগার কতটা মুল্য দাও, সেটা আমরা জানি।

পূনম বড়ো একটা ধাক্কা খেলেন। তাঁর মেয়েরা আজ পর্যন্ত এভাবে কখনও তাঁর সঙ্গে কথা বলেনি। তিনি এতটাই অবাক হয়েছেন যে মেয়েকে বলার মতো কোনও কথা খুঁজে পাচ্ছেন না। ওদিকে নীলোর্মি একমনে ল্যাপটপের স্ক্রীণের দিকে তাকিয়ে আছে। তার বুকের ভেতর হাঁপড়ের মতো ধড়াস, ধড়াস করছে। ভয়ে সে পূনমের দিকে তাকানোর সাহস পাচ্ছে না; কিন্তু মা’র মুখের ওপর কথাটা বলতে পারায়, তার অসম্ভব আনন্দ হচ্ছে।………………………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here