#মন_নিয়ে_খেলা(৩)
*********************

লাইব্রেরিতে ঢুকে সাদমান দেখল, লম্বা টেবিলের শেষ মাথায় অরণী বসে আছে। অরণীর সামনে কয়েকটা বই খোলা রয়েছে। সাদমান সামনে এসে সামনে দাঁড়ালে, অরণী মুখ তুলে তাকাল। সাদমানকে দেখে স্মিত হাসি দিয়ে আবারও লেখায় মনোযোগ দিল সে। সাদমান, অরণীর পাশের চেয়ারটায় বসে বলল, খুব ব্যস্ত?

না। কিছু বলবে?

বিরক্ত করলাম?

বিরক্ত করবে কেন?

যেভাবে ‘কিছু বলবে’ জিজ্ঞেস করলে, তাতে মনে হল, বিরক্ত হয়ে আছ।

আমি বিরক্ত হয়ে নেই।

তাহলে কয়দিন ধরে আমাকে এড়িয়ে চলছ কেন?

অরণী লেখা থামিয়ে বলল, কোথায় এড়িয়ে চললাম!

এড়িয়ে চলছ না? সোমবারে আমরা সবাই মুভি দেখতে গেলাম। শুধু তুমি গেলে না। আমার মনে হয়েছে, আমি যাচ্ছি দেখেই তুমি যাওনি। গতকাল ছুটির পরে দাঁড়াতে বলেছিলাম। শেষ ক্লাসটা না করেই তুমি চলে গেলে!

আমার কাজ ছিল। তাই চলে গিয়েছি।

আমি যখন ছুটির পরে থাকতে বললাম, তখন তো বলোনি, তোমার কাজ আছে।

তখন মনে ছিল না।

তুমি আমার সঙ্গে এমন করছ কেন, অরণী?

অরণী কলমটা নোটবুকের ওপর রেখে বলল, তুমি আমার কাছে কী চাও, সাদমান?

কী চাই, তুমি জানো না?

অরণী কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে সাদমানের দিকে তাকিয়ে রইল। সাদমানও পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তার ঠোঁটের কোনে এক টুকরো হাসির রেখা ঝিলিক দিচ্ছে। অরণীর বড্ড অস্থির লাগছে। তার পক্ষে চোখে চোখ রাখা সম্ভব হল না আর। সে চোখ নামিয়ে নিল। অরণী মোবাইলটা হাতে নিচ্ছে, আবার টেবিলে রেখে দিচ্ছে। বারকয়েক এমন করার পর, সে আবারও একই প্রশ্ন করল, তুমি কী চাও, সাদমান?

বহুবার বলেছি, অরণী। আরও বহুবার বলতে রাজি আছি। তোমাকে চাই।

আমিও তোমাকে বহুবার বলেছি, এসব আমার পছন্দ না।

কোন সব?

তুমি আমাকে কেন এভাবে বিরক্ত করে যাচ্ছ?

ঠিক যে কারণে আজ তিন বছর ধরে তুমি আমাকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছ।

আমি তোমাকে কখনও কষ্ট দিইনি। তুমি নিজের মনের ভেতর কষ্টের সাগর বানিয়ে, সেখানে ডুবে আছ।

তুমি আমাকে কষ্ট দিচ্ছ না?

না, দিচ্ছি না। যদি কষ্ট পেয়েই থাকো, সেটা তোমার নিজের কারণেই পাচ্ছ।

আর কত অরণী, আর কত? আর কতদিন তুমি আমাকে অপেক্ষা করাবে?

আমি তোমাকে অপেক্ষা করতে বলিনি।

অরণী, তুমি আমাকে ভালোবাসো না?

না।

আমার দিকে তাকিয়ে বলো কথাটা। ভালোবাসো না তুমি?

কক্ষণো না।

সাদমান, ওর কপালের ওপর পড়ে থাকা চুলগুলো পেছন দিকে সরিয়ে বলল, বারবার একই মিথ্যা বলতে ভালো লাগে তোমার?

আমি মিথ্যা বলি না।

আমি জানি তুমি মিথ্যা বলো না। শুধু এই একটা জায়গায় এসে তুমি বিরামহীনভাবে মিথ্যা বলেই যাচ্ছ। ক্লান্তি লাগে না তোমার? আমি যে কাঙালের মতো বারবার তোমার মনের দরজায় কড়া নাড়ি, তোমার একটু দয়াও হয় না আমার ওপর?

তুমি কী আমার মুখ দিয়ে জোর করে আদায় করতে চাও ভালোবাসার কথা?

না। জোর করব কেন? জোর করার তো কিছু নেই। আমি জানি তো, তুমি আমাকে ভালোবাসো।

তুমি ভুল জানো। আজ স্পষ্ট করে বলে দিচ্ছি, আমি তোমাকে ভালোবাসি না।

কথাটা বলার সময় তোমার গলার স্বর কাঁপল কেন, অরণী?

অরণী অসহায়ভাবে বলল, আমি সত্যি বলছি।

তোমার মুখ এটা বলছে; কিন্তু তোমার চোখ বলছে অন্য কথা। এত বছর ধরে তোমার চোখমুখের ভাষা পড়তে, পড়তে, তোমার প্রতিটা ভাবভঙ্গি আমার মুখস্থ হয়ে গেছে। আমি নির্ভুলভাবে বলে দিতে পারি, কোনটা তোমার কষ্টের চাহুনি আর কোনটা ভালোবাসার। এখন তোমার চোখেমুখে কী দেখতে পাচ্ছি, বলব?

আমি শুনতে চাই না।

তবুও আমি বলব। তোমার মুখে এখন যে কষ্টের ছাপ ফুটে আছে, এটা হচ্ছে, মনের কথাটা বলতে না পারার কষ্ট। ভালোবাসো, এটা বলতে পারছ না, এটা স্বীকার করতে চাইছ না। সেই কষ্টটাই তোমার মুখের ওপর বিষাদের ছায়া ফেলেছে। একবার বলেই দেখো না অরণী। ভালোবাসাকে এভাবে বন্দী করে রেখে, আমাকে আর কত বঞ্চিত করবে? তুমি নিজেও কী ভালো আছ?

অরণী অবাক হয় সাদমানের কথা শুনে। সাদমান কী করে সবসময় তার মনের ভেতরের অবস্থাটা পড়ে ফেলতে পারে! সে সত্যি সাদমানকে ভালোবাসে; কিন্তু এটা স্বীকার করে নেওয়ার মতো সাহস তার নেই। তাদের দুই বোনের জীবন সম্পূর্ণভাবে তাদের মা দ্বারা নিয়ন্ত্রণ। তাদের জীবনের ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর জিনিসটাও পূনমের পারমিশন ছাড়া সম্পন্ন হওয়ার কোনও উপায় থাকে না। নীলোর্মি যা-ও একটু-আধটু ছাড় পায়; কিন্তু অরণীর বেলায় পূনম একচুল ছাড় দেননি কখনও। তাই কারও সঙ্গে জীবন জড়ানোর, কাউকে ভালোবাসার মতো এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা সে কল্পনাতেও ভাবতে পারে না।

সাদমানকে ওর ভালো লেগেছিল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার শুরুতেই। ওদের ক্লাস শুরুর কিছুদিন পরই সাংস্কৃতিক সপ্তাহ শুরু হল। সাদমান, প্রোগ্রামে রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিল। সাদমানের কন্ঠে রবীন্দ্র সংগীত শুনে, অরণী অবাক হয়েছিল। এত চমৎকার গায় ছেলেটা! পরে অবশ্য জেনেছিল, সাদমান জাতীয় পর্যায়ে রবীন্দ্র সংগীতে পুরস্কার পেয়েছে।

যখন বিতর্ক প্রতিযোগিতা শুরু হল, তখন সে আর সাদমান একই দলের প্রতিযোগী হল। সেই সময়ই ওদের বন্ধুত্বের শুরু হয়েছিল। এরপর একটা সময় এল, যখন অরণীর দিক থেকেই প্রথমে বন্ধুত্বটা ভালোলাগায় রূপ নিয়েছিল। সেটা একদম প্রথম বছরেই। তার কিছুদিন পরই অরণী বুঝতে পেরেছিল, সাদমানও ওকে পছন্দ করে। কারণ সবার মধ্যে থেকেও সাদমান, অরণীর সঙ্গে কথা বলার জন্য একটু আড়াল খুঁজত। ওর ভালোলাগা, খারাপ লাগার কথাগুলো সে শুধু অরণীর সঙ্গেই শেয়ার করত। সময়ের সাথে সাথে, ভালোলাগার বিষয়টা যখন ভালোবাসার দিকে মোড় নিচ্ছিল, অরণী তখনই খুব সাবধান হয়ে গেল। বিষয়টা তার আম্মু জানতে পারলে কী হবে, সেটা অরণী কল্পনাও করতে চায় না। মনের ভেতর ভালোবাসার প্রজাপতিগুলো যখনই ডানা মেলার চেষ্টা করত, তখনই পূনমের সুন্দর মুখশ্রীর পেছনের, ভয়ানক রাগী আর জেদি চেহারাটা, অরণীকে চোখ রাঙানি দিয়ে উঠত। তবে শেষ পর্যন্ত অদৃশ্য সেই চোখ রাঙানি, ভালোবাসার মাঝে দেওয়াল হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। অরণী বুঝতেই পারেনি, কোন এক অসতর্ক মুহূর্তে, সে সাদমানকে ভালোবেসে ফেলেছে। তবে এই ভালোবাসার কথা, সে তার মনের ভেতরের গোপন কুঠুরিতে সযত্নে লুকিয়ে রেখেছে। এমনকি নীলোর্মিও জানে না এই ভালোবাসার কথা; কিন্তু ইদানিং তার মনে হয়, যার বোঝার, সে ঠিকই বুঝে গেছে। তাই তো সাদমান দিনকে দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে, তার মুখ থেকে ‘ভালোবাসি’ কথাটা আদায় করার জন্য।

অরণীকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে সাদমান বলল, তুমি কী এভাবেই আমাকে বারবার ফিরিয়ে দেবে?

অরণী নিজের অসহায়ত্ব ঢাকতে, ফেসবুক ঘাটাঘাটি করতে লাগল। যেন সাদমানের কোনও কথা সে শুনতেই পায়নি। সাদমান উঠে দাঁড়িয়ে বলল, আমি যাচ্ছি। ভালো থেকো।

অরণী মোবাইলের দিকেই দৃষ্টি অবনত রেখেছে। সাদমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আজকের পর আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। কথাটা বলে সাদমান আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে গেল।

সাদমানকে চলে যেতে দেখে অরণীর খুব ইচ্ছা হল সাদমানকে ডাকতে; কিন্তু ডাকতে পারল না। সাদমান তাকে এই কথা বলল কেন? ‘আজকের পর আর কখনও দেখা হবে না’ কথাটার অর্থ কী? ক্লাসে এলে, দেখা তো তাদের হবেই। সাদমান কী অন্য কিছু বোঝানোর চেষ্টা করল? ধ্যাত, অরণী কলমটা বইয়ের ওপর রেখে, হাতের ওপর হাত রেখে বসে রইল। তার এখন অসম্ভব কান্না পাচ্ছে। প্রচন্ড কষ্টে, তার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। অরণী তার মনকে জিজ্ঞেস করল, অকারণ এই কষ্টের শেষ কোথায়?

ওদের দুইজনের বন্ধু নিয়ন, লাইব্রেরিতে বসে দূর থেকে ওদেরকে দেখছিল। সাদমানকে চলে যেতে দেখে, নিয়নও লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে এল। ছুটে এসে সাদমানের হাত ধরে বলল, এমন তাড়াহুড়া করে কোথায় যাচ্ছিস?

কোথাও না। তুই কোথায় ছিলি? খুঁজে পেলাম না।

তুই আমাকে খুঁজেছিলি! খুঁজলে অবশ্যই পেয়ে যেতিস। আমি তো তাদের সঙ্গে লাইব্রেরিতেই ছিলাম।

তুই সত্যি লাইব্রেরিতে ছিলি?

অরণীর দিক থেকে চোখ সরলেই না বাকি দুনিয়া দেখতে পাবি। কী রে, কী হয়েছে? অরণীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে নাকি?

অরণীর কথা বাদ দে। তোর আইফোন কেনার কথা ছিল। কিনেছিস?

নাহ। কিনব না।

কেন? নতুন মডেল আসার আগে এত লাফালাফি করলি আর এখন বলছিস কিনবি না?

কিনতে তো ইচ্ছা করেই; কিন্তু টাকার কথা মনে হলে ইচ্ছাটা নষ্ট হয়ে যায়। আপাতত নতুন আইফোন কেনার প্ল্যান বাতিল। পুরোনোটা আরও কিছুদিন চলুক। সাদমান একটা কথা বল তো, অরণীর পিছে পিছে তুই আর কয় বছর ঘুরবি? ভাই রে ভাই, মানুষের এত ধৈর্য কী করে হয়! আমি তো কারও জন্য এক সপ্তাহ অপেক্ষা করলেও, হাঁপিয়ে উঠি।

সাদমানের এখন কথা বলতে একদম ইচ্ছা হচ্ছে না। অরণীর বিষয়ে তো আরও না। সে নিয়নকে বলল, শরীরটা ভালো লাগছে না, দোস্ত। বাসায় চলে যাই।

কালকে আসবি?

জানি না।

সাদমান আর দাঁড়াল না। নিয়ন, সাদমানের চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগল, প্রেমে পড়লে কী মানুষের ধৈর্য এতটা বেড়ে যায়?…………………………..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here