#ছত্রিশ_ঝামেলা
#পর্ব_১১

শাকিব ঠান্ডা মাথায় পুরো ব্যাপারটা সামালানোর চেষ্টা করছে। সামলানোর বদলে বেসামাল হয়ে যাচ্ছে। লায়লা ভাবী পাশে থাকলেও এতটা খারাপ হতো না।একটু আগেই এই বাড়িতে একটা ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাটা হলো, দুপুরে শাকিবের মা মিসেস সুলতানা লাঞ্চ করতে বাসায় এসে দেখেন, দেশের বাড়ি থেকে শাকিবের রুহুল চাচা এসেছেন। তাঁর হার্টের বাইপাস করা হবে, টাকার জন্য এসেছেন। সুলতানা তখন টাকা বের করতে লকার খুলেন। লকার খুলে তিনি আৎকে উঠেছেন। লকারে দশটা বান্ডেলে পাঁচ লক্ষ টাকা ছিল। টাকাটা নেই। এই টাকাটা তিনি সবসময় ঘরেই রাখেন। কখন হঠাৎ কিসের দরকার হয়? ইমার্জেন্সি ফান্ড! সুলতানা লকারের চারটে তাকেই ভালো করে খুঁজলেন। খুঁজতে গিয়ে আরো দুটো ব্যাপার ধরা পরলো। সুলতানার বড় গয়নার বাক্সটাও ফাঁকা।এই বাক্সে তাঁর বিয়ের সমস্ত গয়না রাখা ছিল। এক পিস গয়নাও নেই। সুলতানা তখন বুকে প্রচন্ড চাপ অনুভব করেন। এক পর্যায়ে তাঁর শরীর ঘামতে থাকে। প্রচন্ড তেষ্টা পায়। তিনি তেষ্টা মিটাতে পানি খেতে যান। পানি বুকে বেঁধে যায়। তিনি সেন্সলেস হয়ে মেঝেতে গড়িয়ে পড়েন। আওয়াজ পেয়ে নতুন কাজের মেয়ে কলি ছুটে আসে। এসে দেখে সুলতানা মেঝেতে চিৎ হয়ে পরে আছেন। সেই শাকিবকে ফোন করে ঘটনাটা জানায়।
শাকিব ডাক্তার নিয়ে এসে দেখে মায়ের জ্ঞান ফিরেছে। তবে বুকের চাপ কমেনি। ডাক্তার চেক-আপ করে বলেছেন। তেমন কিছুই হয়নি। কোনো ঘটনায় হঠাৎ করেই নার্ভে প্রচুর চাপ পড়েছে। নার্ভ চাপ সহ্য করতে পারেনি বলেই এই অবস্থা। চিন্তার কিছু নেই। কিছুক্ষণ রিলাক্স করলেই স্বাভাবিকতা ফিরে আসবে। সেই কিছুক্ষণ এখন প্রায় দু’ঘন্টা হয়ে গেছে। শাকিব চুপ করে মায়ের মাথার পাশে টুল পেতে বসে আছে। সুলতানা চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছেন। তিনি ঘুমে না সজাগ বুঝা যাচ্ছে না বলে শাকিব মাকে ডাকছে না। পাশেই কাজের বুয়া কলি ভোঁতা মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাতে তজবি। সে বিড়বিড় করো দোয়ায়ে ইউনূস পড়ছে। প্রতিবার পড়ার শেষে সে তজবির গুটাগুলো মুঠো পাকিয়ে বেশ শব্দ করে চুমু খাচ্ছে। এইবারও আরেকবার সে চুমু খেলো। একবার তজবি পড়ার সমাপ্তি। কলি মেয়েটির বয়স চব্বিশ-পঁচিশ। ভাবভঙ্গি এবং আচরণ চল্লিশোর্ধ মানুষের মতো।
কলি বুয়া তজবি রেখে এগিয়ে এলো। চিন্তিত গলায় বললো,
-“এখন একবার ডাক দেন। দেখি নানীজান চোখ মেলে কিনা! অবস্থা কেমন গুরুতর বুঝতে পারতেছি না।”
-“আরেকটু অপেক্ষা করে দেখি।”

কলি নিরাশ হয়ে তজবি জপতে শুরু করলো। শাকিব ঘড়ি দেখলো। সময় কি কোনোভাবে থেমে গেছে? এত বড় শক সে নিজেও নিতে পারছে না। রাবু খালা কেন এমনটা করবেন? এত বিশ্বস্ত মানুষ!
-“ও মামাজান, মামাজান, আপনের কী মনে হয়? নানীজান বাঁচবে? বাঁচলেও বড় দুঃখ নিয়া বাঁচবে। টেকা পয়সার দুঃখ, বড় দুঃখ। দুনিয়ায় দুই দুঃখ মানুষ ভুলে না। স্বামী মৃত্যু আর টেকার মৃত্যু। আহারে নানীজানরে আল্লাহ পাক দুই মৃত্যুই দিলো।”
-“কলি তুমি এখন যাও।”
-“আমি তো এখন যাবো না মামাজান। আমি নানীজানের জবান না শুইন্না কোথাও যাবো না। এই দেখেন হাতে বোরকা নিয়া বসা। নানীজান কথা বলবে, কথা শুনবো, নানীজানের পায়ে হাত দিয়া দোয়া নিবো।তারপর বোরকা পিন্দা এক দৌড়ে বাইর হইয়া যাবো।”
-“বোরকা পরে কোথায় যাবে?”
-“থানায় যাবো। এতগুলা জিনিস চুরি হইছে মামলা করতে হইবো না? মামলা করার ব্যাপারে এই কলির পায়ের নাগালেও এই বাংলাদেশে কেউ নাই। নিজের দেওর, ভাসুর, স্বামী, ননদ সবাইরে জেল খাটাইছি।
দেন নানীজানরে ডাক দেন। আমার একহাজার পূর্ণ হইছে। বিসমিল্লাহ!”
শাকিব মায়ের মাথায় হাত রাখলো। মৃদুস্বরে ডাকলো।
-“মা…মা….মা..”
সুলতানা একটু নড়েচড়ে চোখ মেলে তাকালেন।
তাঁর দৃষ্টি হতাশ ও বিষন্ন! মুখবয়বে অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট!
শাকিব দরদভরা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো।
-“মা এখন তোমার কেমন লাগছে? একটু ভালো লাগছে?”
সুলতানা উঠে বসবার জন্য শাকিবের দিকে হাত বাড়ালেন। শাকিব পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে মাকে ধরে বসালো। কলি সাথে সাথেই বোরকা গায়ে দিয়ে ফেললো। মাথা নিচু করে এসে সুলতানাকে কদমবুসি করলো।
-“সালাম করছো কেন?”
-“দোয়া রাখবেন নানীজান। থানায় যাইতেছি। মামলা মোকদ্দমা আপনারা পারবেন না। আপনেরা দিল গলা মানুষ। মামলা করতে শক্ত দিল হওয়া লাগে। তাই মামলার দায়িত্ব আমার। চোররে জেলের ভাত খাওয়ানের দায়িত্ব আমার।”
সুলতানা গলা ঝারলেন।
-“এই দায়িত্ব তোমায় কে দিলো?”
-“দায়িত্ব তো দিতে হয় না নানীজান। আক্কেলবুদ্ধি ওয়ালা মানষের দায়িত্ব আপনা-আপনি ঘাড়ে ঝুইল্লা যায়। আমার ঘাড়ে এখন থানায় যাওয়ার দায়িত্ব।”
-“কলি, ঘাড়ের দায়িত্ব এখন সরিয়ে রাখো৷ তোমাকে থানায় যেতে হবে না। তুমি এখন গিয়ে আমার জন্য একগ্লাস লেবুর শরবত বানিয়ে নিয়ে এসো। সাথে দুই টুকরো লেবু কুচি করে কেটে কাঁচামরিচ ধনেপাতা দিয়ে মাখিয়ে নিয়ে আসবে। ফ্রিজে দই থাকলে একটা পিরিচে করে অল্প একটু দইও নিয়ে আসবে।”
কলি আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো। সুলতানা চোখ রাঙালেন। কলি বোরকা খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেললো।
-“কামের সময় কাম দিলে আমার মাথায় রক্ত উইঠ্যা যায়। থানায় যাবো… কিন্তু না এখন শরবত বানাও।দাসী বান্দী হওয়ার বড় জ্বালা। কাজ কাম করতে হয় অন্যের ইচ্ছায়। চাচাজান, আপনার কিছু লাগলে বলেন একেবারে নিয়া আসি।”
-“আমার কিছু লাগবে না কলি। রফিককে একটু বলে দিও মা এখন ভালো আছেন।”
কলি বেরিয়ে গেল। সুলতানা আবার ডাকলেন,
-“কলি বোরকা নিয়ে যাও।”
কলি বোরকা নিয়ে গেল ঠিকই কিন্তু রান্নাঘরে গিয়ে সেটা জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। তার মেজাজ ভীষণ চটে আছে এখন।
রফিক হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে প্রবেশ করলো।
-“কলি! বড় ম্যাডামের অবস্থা কী?”
-“অবস্থা বেগতিক। এখনো চোখ মেলে নাই। মুখ দিয়া সমানে লোল পড়তাছে। মনে হয় টিকবে না। আমার হাত ধইরা কইলো, বিদায় দেও কলি। বিদায় দেও।তোমার কাছ থাইকা বিদায় না নিয়া তো যাইতে পারি না। রাইতের ভাত কমাইয়া বসাও। রাতে মনে হয় আর আমি ভাত খাইতে পারবো না।”
-“বলো কী?”
-“যা দেখছি তাই বলি। মামাজান বলতে মানা করছে তাও বলি। আপনেরে না বইল্লা তো থাকতে পারবো না।আপনে আপন মানুষ।”
-“ছোডো স্যার ম্যাডামরে হাসপাতালে নিতেছে না কেন?”
-“মামাজান বলতেছে, যা হবার বাড়িতেই হোক। যেই বিছানায় আমার বাপে মরছে, মা মরলেও সেই বিছানায় মরবে। এই দেখেন লেবুর শরবত বানাইতেছি। মৃত্যুর আগে নানীজানের মুখে শেষ পানি দেওয়ার জন্য!”
রফিক যেমন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছিল তেমনি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। এক্ষুনি তাকে আল্লাহপাকের কাছে সিজদাহে পড়তে হবে। অতিরিক্ত চিন্তায় বায়ু নির্গত হয়ে ওযু ভেঙে গেছে। আগে ওযু করতে হবে। রফিক ছুটতে গিয়ে পা ফসকে দেয়াল ক্যাবিনেটের কাচে পড়ে গেল।
কাচ ভেঙে একাকার। দু-টুকরো কাচ তার থুতনিতে ঢুকে গেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে।
রফিক কঁকিয়ে উঠে ডাকলো,
-“কলি… কলি, একটু আসো বইন! ইন্তিকালের দশায় পড়ছি।”
কলি শরবত বানানো রেখে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। বিরক্ত স্বরে বললো,
-“নানীজান মরার আগে আপনি মরার জন্য পাগল হইছেন কেন? আপনার এত তাড়াহুড়া কিসের? এই মাসের বেতনও তো এখনো পান নাই। চলেন, হাসপাতালে চলেন। থুতা তো মনে হয় শেষ।”
রফিক বিড়বিড় করে বললো,
-“ইনশাআল্লাহ দেখবা, বড় ম্যাডামের কিছু হবে না। তাঁর বিপদ কেটে যাবে। আল্লাহপাক তাঁর বিপদ আমার উপরে নিয়া আসছেন। আল্লাহপাকের অশেষ দয়া।”
-“আল্লাহপাক নানীজানের বিপদ আপনারে দেবে কেন? আপনি নানীজানের কে? কামলা! কামলা মানুষের আবার হিসাব কী?”
-“হিসাব আছে। ভালো হিসাব আছে। কারণ আমি পাক কালাম পইড়া আল্লাহপাকেরে বলছি, আল্লাহ গো বড় ম্যাডামের বিপদ আপনে আমারে দেন। আল্লাহপাক দোয়া কবুল করেছেন।”
-“নিজের উপরে এইভাবে কেউ ডাইক্কা বিপদ আনে?”
-“আমি আনি, আমার যারে আপন মনে হয় তাঁর জীবনের সব বিপদ আমার উপরে ডাইক্কা আনি।”
-“বিপদ ডাকাডাকি এখন আপাতত বন্ধ করেন। নেন, আমার ওড়না নেন। থুতায় চাপ দিয়া ধইরা রাখেন। আল্লাহ রক্ত তো সাগর হইয়া গেছে। এক সাগর রক্তের বিপদ। দাঁড়ান, আমি বোরকা নিয়া আসতেছি।”

কলি রফিককে নিয়ে হাসপাতালে রওনা হলো। রফিক কলির কাঁধে মাথা এলিয়ে রিক্সায় বসে আছে। ব্যথায় তার মুখ দিয়ে গোঁ গোঁ শব্দ বেরোচ্ছে। কলি মনে মনে বললো, আল্লাহ গো এখন থাইকা এই মানুষের সমস্ত বিপদ তুমি আমারে দিবা। আমি তাঁর জীবনের বিপদ ভাগিনী হইতে চাই। তাঁর জীবনের বিপদের ভাগ আমার। আর সুখের ভাগ তাঁর।
কলি রফিকের মাথায় হাত রাখলো। ইশ মানুষটার সব চুল পাইক্কা একাকার। হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে একটা সেলুনে ঢুইকা চুল কলপ করাইতে হবে। সামনে বিয়াশাদী। এত সাদা চুল নিয়ে তো আর বিয়ের আসরে বসা যাবে না।
কলি ধমকে উঠলো,
-“মাথা তুলেন। মাথা তুলেন। মাথার ওজন এক মুন। মাথার ভারে তো আমি রিক্সা থাইকা পইড়া যাবো।”

রফিক অনেক চেষ্টা করেও মাথা তুলতে পারলো না। তার থুতনিতে প্রচন্ড যন্ত্রণা হচ্ছে।

~চলবে~

#তৃধাআনিকা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here