#ইস্ক
#সাদিয়া


এতদিন কিছু একা থেকে শুধু খেলেছি একাই,
পরাজিত প্রেম তনুর তিমিরে হেনেছে আঘাত
পারিজাতহীন কঠিন পাথরে।

প্রাপ্য পাইনি করাল দুপুরে,
নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যো ও প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।

আরো কিছুদিন, আরো কিছুদিন- আর কতোদিন?
ভাষাহীন তরু বিশ্বাসী ছায়া কতটা বিলাবে?
কতো আর এই রক্ত তিলকে তপ্ত প্রণাম!
জীবনের কাছে জন্ম কি তবে প্রতারণাময়?

এতো ক্ষয়, এতো ভুল জমে ওঠে বুকের বুননে,
এই আঁখি জানে, পাখিরাও জানে কতোটা ক্ষরণ
কতোটা দ্বিধায় সন্ত্রাসে ফুল ফোটে না শাখায়।
তুমি জানো নাই- আমি তো জানি,
কতটা গ্লানিতে এতো কথা নিয়ে, এতো গান,
এতো হাসি নিয়ে বুকে নিশ্চুপ হয়ে থাকি।

বেদনার পায়ে চুমু খেয়ে বলি এইতো জীবন,
এইতো মাধুরী, এইতো অধর ছুঁয়েছে সুখের সুতনু সুনীল রাত।

তুমি জানো নাই- আমি তো জানি।
মাটি খুঁড়ে কারা শস্য তুলেছে,
মাংসের ঘরে আগুন পুষেছে,
যারা কোনোদিন আকাশ চায়নি নীলিমা চেয়েছে শুধু,
করতলে তারা ধ’রে আছে আজ বিশ্বাসী হাতিয়ার।

পরাজয় এসে কন্ঠ ছুঁয়েছে লেলিহান শিখা,
চিতার চাবুক মর্মে হেনেছো মোহন ঘাতক।
তবুতো পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে মুখর হৃদয়,
পুষ্পের প্রতি প্রসারিত এই তীব্র শোভন বাহু।

বৈশাখী মেঘ ঢেকেছে আকাশ,
পালকের পাখি নীড়ে ফিরে যায়-
ভাষাহীন এই নির্বাক চোখ আর কতোদিন?
নীল অভিমানে পুড়ে একা আর কতটা জীবন?
কতোটা জীবন!!

তিতিল ঘর গুছিয়ে সবেমাত্র জানলার ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। বিশাল বাগান টা স্পষ্ট এখান থেকে দেখা যায়। গাঢ় নীল আকাশ ছেয়ে গেছে স্বচ্ছ সাদা মেঘে। খুব লোভনীয় দেখাচ্ছে ওই আকাশটা। তিতিল আপন মনে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অভিমানের খেয়া কবিতা টা বিড়বিড় করে বলল ওই লোভনীয় নীল সাদাব আকাশের পানে চেয়ে। কবিতা যেন জীবন। জীবন যেন কবিতার প্রতিটা লাইন প্রতিটা শব্দ আর প্রতিটা অক্ষর। তিতিল একটা নতুন রুমে দাঁড়িয়ে আছে। আজই পরিষ্কার করেছে এটা। রুমটায় আগে কখনো আসেনি সে। কিন্তু মন্দ লাগছে না দেখতে। তিতিল আবার দেখল সবটা রুম। সবেমাত্রই নিজের টুকটাক জিনিস গুছিয়ে রেখেছে সে। বিশাল মাপের নয় বলেই হয়তো ঘরটা এত ভালো লাগছে। তাছাড়া ব্যালকুনি দিয়ে সাঁইসাঁই করে আসা বাতাস তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তিতিল খানিক হেসে হেটে হেটে ব্যালকুনিতে গেল। এই রুমে আসতে রেহেলা না করলেও সে শুনেনি। যার সাথে জীবন কাটা হবে না তার সাথে এক ঘরে থাকার কি মানে? আরো মায়ায় মুখ থুবড়ে পড়া। তিতিল অনেক কষ্টে এই রুমে পাড় হয়েছে। হয়তো একটু বাদেই ইয়াদ বাড়িতে ঢুকবে। তিতিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে দেয়। মুহূর্ত যেতে না যেতেই গেইট দিয়ে গাড়ি ঢুকল। মেয়েটা জানে এখানেই তার স্বামী তার কাঙ্ক্ষিত মানুষটা আছে। সাথে সাথে তিতিল উল্টে পিঠে ঘুরে যায়। বুকের মাঝের মাংসপিণ্ড টা আওয়াজ করে উঠানামা করছে। সেই ধ্বনি যেন তাকে আরো বিব্রত করে তুলছে। তিতিল দৌড়ে রুমের ভেতর চলে গেল। কান্না আটকাতে জোরে জোরে নিশ্বাস ফালতে লাগল। ভেতরে চাঁপা কষ্টের ওজন ক্রমশ অতিশয় হয়ে উঠছে।

ইয়াদ তার মাকে সালাম করে সটান হয়ে দাঁড়ালে তিনি মুগ্ধ নয়নে তাকালেন ছেলের দিকে। বিশাল দেহের চওড়া গ্রীবা। আগের চেয়ে আরেকটু ফর্সা হয়েছে ছেলে। রেহেলা বেগম হাসলেন।

“মা কিছু বলবে না?”

“….

“রেগে আছো?”

“ছেলের উপর রাগ করব কেন?”

উত্তরে ইয়াদ কিছু বলল না। রেহেলা বললেন,
“ফ্রেশ হয়ে নিচে আয় খেতে।”

“মা তাকাও আমার দিকে।”

রেহেলা না তাকানোতে ইয়াদ উনাকে জড়িয়ে ধরল। মায়ের মন গলে পানি। ছেলে কে চুমু দিয়ে মুখে হাত বুলালেন।

—-
চিংড়ি দিয়ে লাউ, পুইশাক, গরুর কালো ভোনা, দেশি মুরগীর ঝোল, ডিমওয়ালা সর্ষে ইলিশ আর রুই মাছের ঝোল সব একা রান্না করেছে তিতিল। যদিও প্রতিদিন সে নিজেই রান্না করে কিন্তু আজ অনেক আগ্রহ আর মনোযোগ দিয়ে রান্না করেছে। ইয়াদ সর্ষে ইলিশ টা পাতে চেটেপুটে খেয়ে লাউ চিংড়ি নিয়েছে। চোখ বন্ধ করে মুখের ভাবই বদলে নিয়েছে সে। মুখে স্বাদের শব্দ তুলে বলল,
“মা লাউ চিংড়ি টা যে বানিয়েছো না। ইশশ অনেক সুস্বাদু হয়েছে।”

কেউ কিছু বলল না। রেহেলা হিমা ইনা একবার ইয়াদের দিকে তাকিয়ে নিজেদের দিকে চোখ বুলাল। ইয়াদ আবার বলল,
“মা তোমার রান্না এখন যে আরো মজা হয়েছে তা জানতামই না। আগে জানলে তো কবেই চলে আসতাম দেশে।”
ইয়াদ আর কথা না বলে নিজের মতো করে খাচ্ছে। আজ অনেক বেশি খাচ্ছে সে।

ইনা মুখের ভাব শক্ত করল আর বলল,
“ভাই এই গুলি মা রান্না করে নি।”
ইয়াদ তাকাল ইনার দিকে। তারপর মায়ের দিকে। তিনি নিজের মতো খাবার গিলছেন।

ইয়াদ ভ্রুকুটি করে আবার ইনার দিকে তাকাল।
“আমাদের বাড়িতে এখন মা রান্না করে না ভাই।”

খানিকটা অবাক হলো ইয়াদ। ফরিদা আন্টির করা রান্না এ বাড়িতে খাওয়া হয় না। আর উনার রান্না এতো টা ভালো তো কখনোই না। ইয়াদ জিজ্ঞাস করল,
“তবে রান্না করল কে?”

“….

“কি হলো আপু? মা রান্না না করলে কে করল? তুমি নিশ্চয় না।”

“তিতিল।”
স্তব্ধ হলো ইয়াদ। খানিক নড়েচড়ে বসল সে। নিজের অবস্থা এক রেখে আশপাশে চোখ দিল। কোথাও কেউ নেই তারা ছাড়া। টেবিলের কোণায় তো শুধু ফরিদা আন্টি খাবার এগিয়ে দিচ্ছেন।

ইনা বলল,
“খাবার তিতিল রান্না করেছে।”

“….

“তিতিল এত ভালো রান্না করে জানলে কি তুই আরো আগে চলে আসতি ভাই?”

“….

কথার সাথে খাবারও আটকে এলো ইয়াদের। এই উত্তর কি হবে সে তো জানে না। কোনো রকম পাতের ভাত গুলি নিশ্চুপে খেয়ে উঠে গেল সে। সোজা নিজের রুমে গেছে। ইনা মা আর বোনের দিকে তাকিয়ে খাবার ছেড়ে উঠে গেল।

—-
জানলার এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে তিতিল। বৃষ্টির কণা এসে তাকে ডাকছে। বিন্দু বিন্দু পানি গুলি তিতিল অন্য হাতে স্পর্শ করল। মন টা আজ ভীষণ খারাপ। কারণ জানে না খুঁজতেও চায় না। তার ঘর থেকে ছাদ খুব একটা দূরে নয়। তিতিলের ঠোঁটের কোণায় হাসি দেখা যায়।

ইয়াদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ব্যালকুনিতে। দমকা হাওয়ার সাথে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি তার শরীর কে অর্ধেক ভিজিয়ে দিয়েছে। সেদিকে কোনো হুশ নেই তার। সে চিন্তা করছে তিতিল নামের মেয়েটি কে নিয়ে। যাকে কিনা সে বিয়ে করেছিল। স্বেচ্ছায় নয় মায়ের কথায়। গ্রামের মেয়ে আর কেমনই বা হবে? গ্রামের ওমন সেকালের এক মেয়েকে নিয়ে কি করে সে জীবন কাটাবে? মুখও দেখেনি সে। বিয়ের আগে গ্রামে গিয়ে কবুল বলেই গাড়ি নিয়ে চলে এসেছিল একা। তার পর দিন সেই যে বাসা ছেড়েছিল আর মেয়েটার কথা তার মনে হয়নি। কিন্তু এখনো যে মেয়েটা তার বাড়ি থাকবে বা থাকতে পারে সেটা ভাবতেই পারেনি। এদিকে তার বোন তো বলল তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবে। তখন হয়তো নতুন করে শুরুর কথা চিন্তা করবে সে।

ইয়াদ যখন নিজের দিকে খেয়াল দিল তখন প্রায় ভিজেই গিয়েছে সে। মাথার হাল্কা ভিজে চুল গুলি ঝাঁকিয়ে ছাদে ছুটল বৃষ্টির পানি শরীরে মাখবে বলে।

ইয়াদ ছাদের শেষ সিঁড়িতে পা দিতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল। চোখ গুলি তার যেন ঠিক ওখানেই আটকে আছে। চোখের সামনে এক তরুণী উল্টো পিঠে হাত প্রসারিত করে উর্ধমুখে দাঁড়িয়ে আছে। শূন্য আকাশে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকা সেই তরুণীর আকর্ষণীয় দেহে ভিজে কাপড় একদম লেপ্টে আছে। তরণীর লম্বা কালো কেশ গুলি যেন ভিজে অঙ্গ ঢাকতেই পাহারাদার হয়েছে। তার ওমন দৃষ্টি থেকে রক্ষা করতেই যেন চুল গুলি এক সাথে লেগে ওই দেহ আড়াল করছে। ইয়াদ স্তম্ভিত। চোখের পাতা স্তব্ধ। হৃদয় নামক যে মাংস স্তূপ টা আছে সেটার স্পষ্ট কম্পন তাকে মুখরিত করে তুলছিল।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here