আসলে আন্টি ওর শারীরিক কিছু প্রবলেম আছে!যার কারণে আমাদের বেবি হচ্ছে না।এই বলে তাকিয়া দুঃখজনক ফেইস করে। আড়ালে কোন রকম হাসি চেপে রেখেছে।
বাড়িওয়ালার বউ আলিয়া খুব দুঃখ নিয়ে বললেন,
-“আমি দুঃখিত না জেনে তোকে অনেক বড় কষ্ট দিয়ে ফেললাম, আমাকে মাফ করে দিস।
-“ছি ছি আন্টি কি সব বলছো?আমি একদম কষ্ট পাইনাই। তুমি প্লিজ এমনে কইয়ো(বলো) না।
তাকিয়া আর আলিয়ার কথার মাঝে,এ বাসার হেল্পিং হেন্ড রিনু ঘর মুছতে মুছতে কথায় ফূরন কেটে বলল,হায় খোদা এমন জোয়ান পোলাডার ভিতরে এমন ক্ষুদ দেহায় তো বুঝবার যায় না। কেমন চাঁন্দের লাহান…
রিনু কথা শেষ করতে পারলেন না, আলিয়া ক্ষিপ্ত হয়ে বললেন, এসব কোন ধরনের কথাবার্তা?নিজের কাজে মন দাও।
রিনু ভয়ে চুপসে যায়।আর তাকিয়া মুখ টিপে হাসে!তার ভিশন আনন্দ হচ্ছে এ কথা শুনে।
এদিকে ইসরাক যে কিনা তাকিয়া’র নামমাত্র স্বামী বাহির থেকে সদ্য ঘরে প্রবেশ করে তাকিয়া’র কথা গুলো শুনে বিষম খেয়ে গেল।
হঠাৎ কারো কাশির শব্দে তিন জনের নজর মেইন দরজার দিকে যায়।ইসরাকের অবস্থা বুঝতে পেরে আলিয়া পানির গ্লাস হাতে তুলে দেয়।আলিয়া আছে বলে,মাহেরা একটু আদুরে স্বরে বললো অগো তোমার কি হইছে?কে তোমারে গালা’গালি করছে বলো তো?যার কারণে তুমি এমনে বিষম খেয়ে গেলে।
ইসরাক চোখ রাঙিয়ে বলল একটু রুমে আসতে পারবে তোমার সাথে কথা ছিল?
-“এহন তো আন্টির সাথে গল্প করতাছি,পরে তোমার কথা শুনবো ঠিক আছে। তুমি বরং রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও ভালো লাগবে।
আলিয়া বললেন,
-“তাকিয়া তুই আগে ইসরাকের কথা শুনে আয়। আমার সাথে পরেও গল্প করতে পারবি। ছেলেটার কিছু লাগবে কিনা দেখ যা।
ইসরাক বাকা হেসে বললো,
-“এবার চলো আন্টি নিজেই অনুমতি দিয়ে দিয়েছেন।
তাকিয়ার উপর দিয়ে এখন কি সাই’ক্লোন যাবে সে তো একমাত্র সে-ই জানে।
এই ভন্ড টা কখন যে এসে পড়লো,নিশ্চই আমার সব কথা শুনে নিয়েছে। আন্টি তো আর জানে না এই ভন্ড এখন আমাকে নিয়ে গিয়ে কি করবে। এখন আমার একটাই বাক্য মনে আসছে “ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি”
“মনে মনে বাক্য গুলো আওড়ালো তাকিয়া”
কি ভাবছো মিসেস?কই চলো রুমে।
আমি জানি না ভাবছেন এতো মিষ্টি স্বরে কেন বলছেন? আমি এখান থেকে এক পা ও নড়ছি না “নিজের ওরনার আঁচল আঙুলে পেঁচাতে পেঁচাতে মনে মনে বলে চলেছে”
কিন্তু মনে মনে বললে তো হবে না, নিজেকে ধাতস্থ করে তাকিয়া বললো,
-“কি শুরু করলে বলো তো? আন্টি মনে মনে কি ভাববে? তুমি যাও না গিয়া বিশ্রাম করো। আমি একটু পরেই আসছি।
আলিয়া বললেন,
-“বোকা মেয়ের কথা শুন। আমি আবার কি ভাববো?আমি বলছি তুই এক্ষুনি ইসরাকের সাথে যাবি।
তাকিয়া ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,আন্টি বলছিলাম কি..
-“তাকিয়া আর কোন কথা নয়। তুই এক্ষুনি ইসরাকের সাথে যা।
আলিয়ার কথায় খুশিতে আটখানা হয়ে ইসরাক তাকিয়ার হাত ধরে টানতে টানতে রুমের দিকে নিয়ে যেতে লাগলো।আর ফিসফিস করে বললো,
-“আন্টি নিজেই বলেছেন আর কোন কথা নয়।সো চলুন ধানি লঙ্কা।
-“মিষ্টার ভন্ড আমাকে ছাড়ুন বলছি,না হলে কিন্তু আমি আপনারে..
রুমে নিয়ে এসে দরজা বন্ধ করে দুহাতে কাঁদে চেপে ধরে ইসরাক বললো,
-“আমাকে কি করবেন বলুন?
-“দে দেখুন মিষ্টার ভন্ড আমাদের মধ্যে কিন্তু শর্ত ছিল একে অপরকে টাচ করবো না। আপনি কিন্তু শর্ত ভঙ্গ করেছেন।
কিছুটা ভয়ার্ত কন্ঠে বলল তাকিয়া।
-“আপনি আমাকে টাচ করে আমার সম্পর্কে কতো কিছু জেনে গেলেন আর এখন আমি টাচ করলেই প্রবলেম?
ইসরাক এর এমন ধারা কথা শুনে,এক আকাশ বিষ্ময় নিয়ে তাকিয়া বললো,
-“কি বলছেন এসব?
-“কেন কিছু সময় আগেই তো আন্টিকে বললেন আমার নাকি শারীরিক প্রবলেম আছে যার ফলে আমাদের বেবি হচ্ছে না।তো সে অনুযায়ী আমাকে টাচ না করলে তো আপনি এরকম একটা কথা বলতে পারতেন না তাই না?
তাকিয়া শুকনো ঢুক গিলে বললো,
-“তা ছাড়া আর কি কইতাম আমি? আন্টি বার বার কইতাছে (বলছে)একটা বেবি নাও।তাই আন্টি যেন এ ব্যাপারে আর কিছু না কয়,তাই কইছি।
-“তাই বলে এরকম কথা?তাও আমাকে নিয়েই বলতে হলো আপনার।অন্য কিছু বলতে পারতেন বা আপনি তো নিজেকে নিয়েও বলতে পারতেন।
-“ক্যারে আপনার কথা কয়াতে(বলাতে) খুব বেশি অসুবিধা হইয়া গেছে? আর্পি জেনে যাবে বলে ভয় পাচ্ছেন বুঝি?
-“আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। সবসময় ফালতু কথা,কি দিয়ে তৈরি আপনি আল্লাহ জানেন।
তাকিয়া’কে ছেড়ে দিয়ে হনহন করে বাথরুমে ঢুকে গেল ইসরাক।
ইসরাকের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থেকে তাকিয়া বললো, আমি জানি আপনি যতই আমার সাথে রাগ দেখান না কেন আপনি যে অর্পি রে পছন্দ করেন সেটা আমি খুব ভালো কইরাই জানি।যাই হোক তাতে আমার কি? আমি তো আর সারাজীবন আপনার সাথে থাকছি না।আর এই মিথ্যা সম্পর্ক ও ভয়ে বেড়াতে হইবো না।হুহ..
_____
দ্বিতীয় বারের মতো বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে, শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে প্রান-প্রনে ছুটে চলেছে তাকিয়া। মায়ের ভাড়া করা গুন্ডা গুলো পিছু নিয়েছে সেই কখন থেকে। বিয়ের বেনারসি পরে দৌড়াতে খুবই ঝামেলায় পড়তে হচ্ছে, মনে হচ্ছে আজ আর শেষ রক্ষা হবে না।
অতিতের স্মৃতি গুলো এক ঝলক ভেসে ওঠে তাকিয়ার চোখের পর্দায়। দৌড়ানোর মাঝেই শ্বাস নিয়ে হেসে দেয়, এখন মনে হচ্ছে ইসরাক এর সাথে কাটানো ঐদিন গুলোই খুব সুন্দর ছিল।
ইসরাকের কথা মনে হতে,নিজেকে আরো শক্ত করে দৌড়াতে থাকে তাকিয়া। তাঁকে যে করেই হোক পালাতেই হবে, তাঁর মিষ্টার ভন্ড মহাশয়ের জন্য তাঁকে পালাতে হবে।
হঠাৎ সামনে একটা বাইক আসায়,থমকে দাঁড়ায় তাকিয়া।
“তাড়াতাড়ি পিছনে ওঠে বসুন”!
চোখে সানগ্লাস এবং মাথায় হুডি থাকায়, লোকটার ফেইস স্পষ্ট নয়। পিছনে লোক গুলো আর একটু হলেই ধরে ফেলবে, লোকটার কথা শুনা উচিৎ পরের টা পরে দেখা যাবে।
এই ভেবে মাহিয়ারা লোকটার বাইকে চড়ে বসলো।
বাইক ছাড়তেই,তাকিয়া পিছনে তাকিয়ে গুন্ডা গুলো কে ভেংচি কাটে।
একটা বাস স্টেশনে এসে বাইক থামে,তাকিয়া বাইক থেকে নেমে, হাতের মুঠোয় ধরে রাখা একটা কাগজের টুকরো খুলে দেখলো এটাই সেই বাস স্টেশন,যেখান থেকে তাকিয়ার বাসে ওঠার কথা। কিন্তু এই আগুন্তক জানলেন কিভাবে? একরাশ প্রশ্ন জেগে বসে তাকিয়ার মনে।তাই জিজ্ঞাসা করলো,
-“আপনি কিভাবে জানলেন,আমি এখানেই আসবো?
অদ্ভুত ব্যাপার লোকটা, কিছু না বলে বাইক নিয়ে চলে গেল।তাকিয়া কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে রইলো।পিছন থেকে একজন বিষ্ময় নিয়ে বললেন,
-“কোথায় যাবেন?
এরকম ভর-সন্ধা বেলায়, বিয়ের শাড়ি পরিহিত কোন নারীকে দেখে যে কেউ অবাক চাহনিতে দেখবে এটা স্বাভাবিক। তাকিয়া মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“আপনারে কইতাম কেরে?
এরকম সুন্দর মুখশ্রীর মুখে এরকম আঞ্চলিক ভাষা শুনে লোকটা বললো,
-“আপনার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায়?
ভ্রু বাঁকিয়ে তাকিয়া বললো,
-“আমার কোন গ্রামের বাড়ি নাই। আমি ঢাকায়া মেয়ে।
এই একই প্রশ্ন শুনতে শুনতে তাকিয়া বিরক্ত। স্কুল, কলেজে পড়াশোনা কালিন টিচার এবং সহপাঠীদের মুখে ও একই কথা ছিল_
“তোমার গ্রামের বাড়ি কোথায়?”
তাই মা’কে গ্রামের বাড়ির কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বরাবরই বলতেন তাকিয়া’দের কোন গ্রামের বাড়ি নেই।ছোট বেলা থেকেই,শুদ্ধ-অশুদ্ধ, আঞ্চলিক ভাষার সংমিশ্রণে কথা বলে তাকিয়া। অনেক চেষ্টা করেও কাকলি মেয়েকে শুদ্ধ ভাষা রপ্ত করতে পারেননি। কিছু কিছু অভ্যাস আছে যেগুলো জন্মগত, চাইলেও পরিবর্তন আনা যায় না।হয়ত সে কারণেই তাকিয়া চাইলেও শুদ্ধ ভাষায় অভ্যস্ত হতে পারেনি।
-“ওহ্ আচ্ছা। কোথায় যাবেন বলেন? আমি টিকিট দিচ্ছি।
তাকিয়া এবার বুঝতে পেরে,আর কথা না বাড়িয়ে বলল আমি মতলব উত্তরে যাবো।
ভদ্রলোক টিকিট দিতে দিতে বললেন, -“বিশ-পঁচিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে, আপনি ঐখানে যাত্রী ছাউনীর নিচে গিয়ে বসেন।
টিকিটের টাকা মিটিয়ে, লোকটার কথা মতো গিয়ে বসে তাকিয়া। আশেপাশের দোকানের লোক গুলো যেন চোখ দিয়েই গিলে খাবে, এরকম ভাবে কেউ তাকিয়ে আছে,আর কেউ সমালোচনা করে চলেছে।
এতো তাড়াহুড়োর মধ্যে শাড়ি পাল্টানোর মত সময় সুযোগ কোনোটাই ছিল না তাকিয়া’র। কোন রকমে একটা চাদর জড়িয়ে বেড়িয়ে পরে। বাসায় পরিহিত স্লিপার গুলো ও পাল্টানো হয় নাই।
এই মুহূর্তে আশেপাশের লোকজনের কথা হজম করে নেওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই, তাই তাকিয়া চুপচাপ বসে,বাসের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো।
অবশেষে,
মতলব এক্সপ্রেসের দেখা মিলল।বাম পাশের একটা সিটে গিয়ে বসে,প্রান ভরে দম নেয় তাকিয়া। কিছুক্ষণ পর ফোনে কল আসে। ফোনের স্ক্রিনে বাবা নাম টা দেখে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। এই একটা মানুষ সব কিছুতে তাকিয়া কে সাপোর্ট করে।আজকেও পালানোর সব ক্রেডিট এই মানুষটির।
তাকিয়া কল রিসিভ করে বললো,
-“আসসালামু আলাইকুম,
আমার কিউট বাবাটা।
মুহিব রহমান খুশিতে আটখানা হয়ে সালামের জবাব দিয়ে বললেন,
মামুনি গাড়িতে ঠিক ঠাক মত ওঠতে পেরেছিস তো? কোন ঝামেলা হয়নি তো?
-“আলহামদুলিল্লাহ বাবা।কোন ঝামেলা হয়নাই।
-“আলহামদুলিল্লাহ।আচ্ছা শোন, বাবাকে যদি ভালোবেসে থাকিস তাহলে নিজের পরিচয় এবং স্বপ্নের কথা কাউকে বলবি না।
-“এই একই কথা কতবার বলতে হবে বাবা? আমি বলছি তো কাউকে কইতাম না।
-“খুব ভয় হয় মামনি,তাই বলি।
-“তোমাদের কিসের এত ভয় বাবা?
আচ্ছা মামনি আমি এখন রাখছি, তোর আম্মু এবার আমাকে খুব সন্দেহ করে চলেছে। ভালো থাকিস”আল্লাহ হাফেজ”।
বাবা প্লিজ…
বরাবরের মতো আজও মেয়ের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন মুহিব রহমান।শত শত প্রশ্ন করেও কোন ফলাফল পাওয়া যায়নি,তাকিয়া’কে নিয়ে তাদের কিসের এত ভয়?
_______
শ্বশুর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকিয়া বাড়িটা অনেক পুরোনো দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তবে রং আর লাইটের আলোয় চারিদিকে গাছ-গাছালির ভিরেও জ্বলজ্বল করছে। সামনে পাথরে খোদাই করে লিখা “শবনাম ভিলা”
বাড়িটা একপলক দেখেই,তাকিয়ার চিনতে এতটুকু ভুল হলোনা। এই সেই বাড়ি যেটা গত আট বছর যাবত তাকিয়া স্বপ্নে দেখে আসছে! একটা ছোট্ট মেয়ে খিলখিল করে হাসছে আর দৌড়াচ্ছে। পিছন পিছন কেউ ডেকে চলেছে কিন্তু ঝাপসা স্পষ্ট নয়। শেষে বাচ্চা মেয়েটা মিমা বলে আর্তনাদ করে ওঠে…
স্বপ্নের সেই আর্তনাদ,তাকিয়া কানে বার বার প্রতিধ্বনি হতে থাকে।কানে হাত দিয়েও সেই আর্তনাদ রোধ করতে সক্ষম হয়ে উঠে না তাকিয়া। একসময় এই আর্তনাদ সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে তাকিয়া!….
#চলবে?
#আমার_প্রিয়দর্শিনী_তুমি
#সূচনা পর্ব
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)