#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব- ২৮
সুরমা

মেঘকে হাসপাতালে নেওয়া হলো। মেঘের অবস্থা খুবই খারাপ। তার শরীর থেকে অনেক ব্লেডিং হয়েছে। অবাক বুঝতেই পারেনি সে মেঘকে এতো বড় একটা আঘাত দিয়েছে। রাগের মাথায় বড্ড অন্যায় করা হয়েছে মেঘের সাথে। অবাক মনে মনে অনুতপ্ত হলো। অবাকের শরীর থরথর করে কাঁপছে। অবাক মনে মনে প্রার্থনা করছে, ‘হে প্রভু। মেঘকে ভালো করে দাও। এই মেয়েটার যেন কিছু না হয়। মেঘের কিছু হলে আমি নিজেকে কখনও ক্ষমা করতে পারবো না।’

মেঘকে ইমার্জেন্সি ব্লাড দেওয়া হলো। অবাক, বিলকিস বেগম আর বিন্তি আইসিইউর সামনে। বিলকিস বেগম মেঘের কথা ভেবে হয়রান হয়ে গেলেন। দুখি এই মেয়েটার কপালে বুঝি সুখ লেখা হলো না। অনেক স্বপ্ন আর ভালোবাসা নিয়ে মেয়েটাকে নিজের বাড়ির বউ করলেন এই আশায় যে, বাকি জীবনটা সুখে থাকবে। কিন্তু তিনি কখনও কল্পনা করেন নি নিজের ছেলেই তাকে অশান্তিতে রাখবে। আজ অবাকের প্রতি ঘৃণা লাগছে বিলকিস বেগমের।

অবাক নিজের মায়ের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারছে না। চোখে চোখ রেখে তাকাতেও নিজের প্রতি লজ্জা লাগছে। বিলকিস বেগমের মনে অবাকের জন্য অনেক অভিযোগ আর অভিমান জমা হলো। তিনি ভাবতেই পারেন নি নিজের ছেলে এতো বড় একটা জঘন্য কাজ করলো। বিলকিস বেগমের চোখ পানি যেন বাঁধ মানছে না। তিনি বড্ড ভালোবাসেন মেয়েটাকে। মেঘের পাগলামি, ছেলে মানুষী বিলকিস বেগমের হৃদয় শীতল করে দিতো। সারা ঘর মেয়েটা একাই মাতিয়ে রাখতো।

বেশকিছুক্ষণ পর ডাক্তার এলেন। বিলকিস বেগম চেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে এগিয়ে গেলেন। অবাক তার মায়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ায়। বিলকিস বেগম উতলা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

-ডাক্তার সাহেব, আমার মেয়েটা কেমন আছে? ও সুস্থ হয়ে যাবে তো? ওর কিছু হবে নাতো? আপনি আমার মেয়েটাকে সুস্থ করে দিন।
-উতলা হবেন না। উনাকে ব্লাড দেওয়া হয়েছে। আগের থেকে সুস্থ আছে। আমরা আশাবাদী খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে আপনাদের জন্য। দুঃসংবাদ কথাটা শুনে বিলকিস বেগমের শরীর কাটা দিয়ে উঠে। বিলকিস বেগম আতংকিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-দুঃসংবাদ?
-জ্বি। উনার বাচ্চাটাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। বাচ্চাটা নষ্ট হয়ে গেছে। পেটে মারাত্মকভাবে আঘাত লেগেছিল। যার কারণে এতো ব্লেডিং হলো। বিলকিস বেগম স্তব্ধ হয়ে গেলেন। অবাকের মাথা ঘুরে গেলো। অবাক আমতাআমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
-বাচ্চা? অবাকের কথা শেষ হতে না হতেই বিলকিস বেগম অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,

-মেঘ প্রেগন্যান্ট ছিল?
-জ্বি। উনি প্রেগন্যান্ট ছিলেন। অবাক পিছিয়ে গেলো কয়েক পা। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়াল। তার কেবল মনে হচ্ছে এই বুঝি বিল্ডিংটা উল্টে গেলো। বিলকিস বেগমের চোখ থেকে পানি ঝরতে লাগলো। অবাকের পৃথিবী যেন থমকে দাঁড়াল। চারপাশ অন্ধকার হয়ে এলো। বিলকিস বেগম আর্তনাদ করে উঠলেন,

-আল্লাহ এতো ভালো একটা সুখবর জানার আগেই তুমি সেটাকে দুঃসংবাদ করে দিলা। আমি একবারো কেন বুঝতে পারলাম না। তাহলে আমি আমার মেয়েটাকে একটু সময়ের জন্যও চোখের আড়াল করতাম না। বিলকিস বেগম আরো ভেঙ্গে পড়লেন।

সূর্যের সোনালি আলো পৃথিবী ছেঁয়ে গেলো। সূর্যটা হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে রইলো পৃথিবীর বুকে। মুক্ত আকাশে দলে দলে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিগুলো। ফজরের নামাজ পড়ে অনু আর বাসা থেকে বের হতে পারলো না। কেউ তাকে বাহিরে যেতে দিল না। অনু সূর্য আর আকাশের ভালোবাসা ব্যালকনি থেকে উপভোগ করতে লাগলো। তবে এই ভালোবাসা গুলো সবুজ ঘাসের উপর বসে উপভোগ্য হলে আনন্দ কয়েকগুণ যোগ হতো। কিন্তু মা সকাল সকাল মনটা খারাপ করে দিল।

রিমি ব্যালকনিতে এসে দেখে অনু আনমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রিমি বলে,
-কি ব্যাপার ননদিনী। রিমির কথা শুনে অনু চমকে উঠে। রিমি হেসে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-ভয় পেলে নাকি?

-ভয় পাইনি। তবে হঠাৎ কানের কাছে এসে কথাটা বললে তাই চমকে উঠেছি।
-এখানে কি করছো? আজ না তোমার গায়ে হলুদ। কোথায় শাড়ি পরে নিচে গিয়ে সবার সাথে বসবে। সবাই কি করছে দেখবে। তা না করে এখানে এভাবে একা একা দাঁড়িয়ে আছো।
-দেখনা ভাবি আজ সকালটা কি মিষ্টি। ফ্রেশ। অথচ আম্মু আমাকে নিচে গিয়ে হাঁটতে দিল না। একটু গেলে কি হতো?

-আরে বাবা আজ তোমার গায়ে হলুদ। আর কাল বিয়ে। বিয়ের আগে বাসা থেকে বের না হওয়ায় ভালো
-আমিতো গার্ডেনেই যেতাম। দূরে কোথাও তো যাচ্ছি না।

-একদিন না গেলে তেমন কিছু হবে না। মন খারাপ করো নাতো। অনু মুখ ভার করলো। রিমি অনুর দুই গাল টেনে দিয়ে বলল,
-আজকের দিনে মন খারাপ করতে নেই ননদিনী। হাসো বলছি। অনু হালকা হাসি দেয়। রিমি আবার বলে,

-শোন তোমাকে একটা কথা বলতে এসেছি।
-হ্যাঁ বলো।
-ইমন চাইছে হলুদের অনুষ্ঠান এখানে এসে করতে। আমি তোমার অনুষ্ঠানে থাকবো নাকি ওর ওখানে থাকবো। ও আবার আমাকে ছাড়া অনুষ্ঠান করতে চাইছে না। বুঝতেই পারছো। আমিও তো আমার মিষ্টি ননদিনীর গায়ে হলুদ মিস করতে চাইনা। এজন্য ইমন বলছে যে দুজনের অনুষ্ঠান এক মঞ্চে করতে। এখন তো প্রায় এরকম হয়। রিমির কথা শুনে অনুর চোখ বড় বড় করে ফেলে। অনু বলে,

-তারমানে হলুদের পুরো অনুষ্ঠানে আমাকে উনার সামনে মূর্তির মতো বসে থাকতে হবে? এবার রিমিরও চোখ কপালে চলে গেলো। সে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

-মূর্তির মতো বসে থাকতে হবে মানে কি?
-ভাবি ঐ লোকটা জানি কেমন। রিমি চোখ ঘুরায়,
-ঐ লোকটা আমার ভাই।
-এজন্য তো তোমার কাছেই বলছি।
-তুমি আমার ভাইকে খারাপ বলছো?

-আমি মোটেও তোমার ভাইকে খারাপ বলি নি। আমি তোমার উডবি ননদাইকে খারাপ বলছি। রিমি হেসে দেয়। অনুও হাসে। রিমি অনুকে জড়িয়ে ধরে বলে,
-আমার ভাই তোমাকে সুখেই রাখবে। দেখে নিও। এবার বলো অনুষ্ঠান সম্পর্কে তোমার কোন অভিযোগ আছে কিনা?

-তোমরা যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো। আমার কোন কিছুতে আপত্তি নাই। তবে তোমার ভাইকে বলে দিও, আমার দিকে যেন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে না থাকে।
-আচ্ছা বলে দিব। এবার তুমি গিয়ে একটা শাড়ি পর আর নিচে আসো। আজকে সবাই তোমাকেই খুঁজবে।

-এক্ষণি শাড়ি পরে কি করবো? গায়ে হলুদ তো সন্ধ্যায় হবে।
-তাতে কি? বাড়িতে কত লোকজন আসছে। তোমাকে কি এই সাজে দেখবে নাকি? জাস্ট শাড়িটা পর। সাজতে হবে না। অনু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,

-ওকে। বিয়ের সময় মেয়েরা হয় আজব প্রাণী। সারাজীবন দেখার পরও ওইদিন নতুন করে দেখার জন্য সবাই চলে আসে। আর মেয়েরা ভদ্র, শান্ত শিষ্ট মূর্তি হয়ে বসে থাকে। রিমি হেসে দিল। অনু গিয়ে একটা শাড়ি পরলো। সাথে হালকা কিছু অর্নামেন্টস আর সিম্পল একটা সাজ। তাতেই অনুকে বেশ লাগছে।

অনুর হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য চলছে তোরজোড়। সব মেয়েরা পরে হলুদ শাড়ি। আর ছেলেরা লাল পাঞ্জাবি। বাড়িটা ঝমঝম করছে লোকজনে। ইমনদের আগমনের জন্য অনুর বাড়ির ছেলে মেয়েরা ফুল হাতে মেইন গেইট থেকে দাঁড়ায় সারিবদ্ধভাবে। একজন ছেলে তারপর একজন মেয়ে।

দুই পাশ দিয়েই ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে মাঝখান দিয়ে রাস্তা তৈরি করে। ইমনের গায়ে সাদা পাঞ্জাবি। আর ইমনের সাথে আসা ছেলেদের গায়েও লাল পাঞ্জাবি। আর মেয়েরা হলুদ শাড়ি। ইমনকে গাড়ি থেকে নামতেই টিউবরোজ আর গোলাপ দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় প্রিতি। ইমনের সাথে আসা প্রত্যেক যাত্রীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। বাড়ির ছোট থেকে বড় প্রত্যেকটা লোক আজ লাল হলুদে রঙবিলাসি। অনুর অনুষ্ঠানের কোন রকম কমতি রাখেনি রিয়াদ।

ইমন সামনে সামনে হাঁটে। তার পাশে তার বাবা মা। ছেলেরা ইমনের মাথার উপর ফুলের পাপড়ি ছুড়ে দেয়। আর মেয়েরা প্রতেকের হাতে একটা করে ফুল দেয়। আবার কেউ দিচ্ছে সন্দেশ।

স্টেজ সাজানো হয়েছে কয়েক রকম ফুলের তোড়া দিয়ে। তার মধ্যে গোলাপ বেশি। গোলাপ ফুলের লাভশেইফের ভেতরে ফুল দিয়ে সুন্দর করে আকাঁ হয়েছে, “আজ ইমন আর অনুপমার হলুদ ছোঁয়া”। বেশ ঝমকালো হয়েছে সাজানো।

স্টেজের কাছে এসে হলুদের সাজে অনুকে দেখেই ইমনের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে যায়। অনুকে আজ মায়াবতী হলুদ পরীর মতো লাগছে। লাল হলুদ শাড়ির সাথে কাচা ফুল দিয়ে সেজেছে অনু। সাথে কাজল টানা দুটো চোখ আর হালকা মেকাপ। চুল গুলো ফুলিয়ে বাঁধা হয়েছে। এর আগে এমন অপরূপ সাজে দেখার সৌভাগ্য হয়নি ইমনের।

অনুকে দেখে ইমনের কেমন হিংসা লাগছে। অফ! মানুষ এতো সুন্দর, এতো মায়াবতী কিভাবে হয়। আল্লাহ জানে তিনি এই পরীটাকে কি দিয়ে তৈরি করলেন। এই মায়াবতীর একটু মায়া আমাকে দান করলে জীবন ধন্য হতো। ইমনের ভেতরে ডুমডুম বাজতে শুরু করে।

কাজল রেখাকেও হলুদ শাড়ি পরানো হলো । বাড়ির ছোট থেকে বড় সব মেয়েরা হলুদ শাড়ি পরেছে। কিন্তু কাজল রেখা পরতে রাজি ছিলেন না। কিন্তু প্রিতি নাছোড়বান্দা। সে মাকে শাড়ি পরিয়েই ছাড়ল।
প্রথমে ইমনের গায়ে একটু হলুদের ছোঁয়া দিয়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। কাজল রেখা প্রথমে অনুকে হলুদ ছোঁয়া দেয়। তারপর ইমনের মা বাবা। অনুকে একে একে সবাই হলুদ ছোঁয়া দিতে থাকে। অনুর কপালে ফুলের গায়ে লাগিয়ে অল্প করে হলুদ দেওয়া হয়। কিন্তু বিপত্তি হলো ইমনের। যেখানে অনুর কপালে হলুদের আলতো ছোঁয়া দেওয়া হচ্ছে সেখানে ইমনকে হলুদের গোসল করানো হচ্ছে। স্পেশালি ছেলেরা ইমনকে ছাড় দিচ্ছে না। ইমন মানা করলে তারা আরেকটু বেশি দেয়। রিমি ইমনকে হলুদ দিতে গেলে ইমন অসহায় মুখ করে বলে,

-আপু, আমি কি অপরাধ করলাম? অনুকে সবাই ফুলের গায়ে অল্প হলুদ লাগিয়ে কপালে অল্প ছোঁয়া দিচ্ছে সেখানে আমাকে ভূত বানিয়ে দিচ্ছে কেন? ইমনের কথা শুনে রিমি প্রিতি দুজনেই হেসে দেয়। অনুও মুচকি হাসে। প্রিতি বলে,

-ছেলেদের এসব একটু সহ্য করতে হয়। ভাইয়া তুমি কথা বলো না। চুপ করে থাকো। কথা বললে হলুদের পরিমাণ বেড়ে যাবে। প্রিতির কথা শুনে ইমনের চোখ বড় হয়ে যায়। ইমনের রিয়েকশন দেখে প্রিতি রিমি দুজনেই ফিকফিক করে হেসে দেয়। ইমন ঠোঁট ভেঙ্গে বলে,

-আমার সাথে অন্যায় করা হচ্ছে। আমার ফর্সা ইনোসেন্ট চেহারাটা কালো বানিয়ে দিল। আমার একটা ছবিও সুন্দর হবে না। প্রিতি উঠে গিয়ে ইমনের পাশে বসে বলে,

-নিজেকে ফর্সা বলে দাবি করে আমাদের অপমান করো নাতো।
-আরে ফর্সা না হলেও আমি কালো না। উজ্জ্বল শ্যামলা। আমার চেহারা চকচক করে। প্রিতি কুচা দিয়ে বলে,

-মোটেও তুমি উজ্জ্বল শ্যামলা না। তুমি পুরা চকলেট কালার। প্রিতির কথা শুনে আশেপাশের সাবাই হাসিতে ভেঙ্গে পড়ে। ইমন বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলে,
-বিয়ে করতে এসে কি অপমান।
-বিয়ে করতে আসোনি। হলুদ হচ্ছে। বিয়ে কাল।

মেঘের জ্ঞান ফিরেছে সকালে। নার্সের কাছে সে সবটা বিষয় জানতে পারে। মেঘের তখন পাগল প্রায় অবস্থা। তার মনে হচ্ছে পৃথিবীটা এখানেই থমকে গেছে। বিশ্বাস ভরসা সব শেষ। সে কাঁদেনি। কিছুক্ষণ পাগলামি করে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তারপর থেকে আর একবারও কথা বলেনি। বিলকিস বেগম মেঘের সাথে দেখা করেন। কিন্তু মেঘ আনমনে চেয়ে থেকেছে।

বিলকিস বেগম ভালোই বুঝতে পেরেছেন, মেঘের কোথায় আঘাত লেগেছে। বিলকিস বেগম কিছুক্ষণ চোখের পানি জড়িয়ে ক্যাবিন থেকে বের হয়ে আসেন। কিন্তু অবাক মেঘের সামনে যায় নি। মেঘের সামনে দাঁড়ানোর মতো সাহস, শক্তি তার কোনটাই নেই। সে অপরাধ করেছে। নিজের অপরাধের শাস্তি মেঘকে দিয়েছে।

তার জন্য একটা মেয়ে মাতৃত্বের স্বাদ থেকে বঞ্চিত। সে নিজেও পিতৃত্ব স্বাদ পেলো না। একটা নিষ্পাপ বাচ্চা পৃথিবীর আলো দেখার আগেই বিদায় নিলো। এই কষ্ট অবাককে খুরে খুরে খাচ্ছে। নিজেকে নিজের কাছেই জঘন্য লাগছে। কিভাবে এই মুখ নিয়ে মেঘের সামনে দাঁড়াবে?

বিলকিস বেগম কপালে হাত দিয়ে বসেছেন। সকাল থেকেই কারো মুখে পানি পড়েনি। সবার মাঝে কেমন নিস্তব্ধতা বিরাজ করলো। অবাক অপরাধীর মতো নিজের মায়ের সামনে হাটুতে ভর করে। অবাক মাথা নিচু করে মায়ের দিকে ঝুকতেই কয়েকফোটা পানি মায়ের পায়ে গড়িয়ে পড়ে। বিলকিস বেগম সাথে সাথেই কেঁপে উঠেন। অবাক তার মায়ে হাটুতে কপাল ঠেকিয়ে পা দুটো আঁকড়ে ধরে। বিলকিস বেগম কিছু বললেন না। তাঁর নিজের চোখও জলে ভিজে যায়। অবাক কেঁদে দিয়ে বলে,

-আম্মা আমি পাপ করেছি। আমি খুব বড় অন্যায় করেছি মেঘের সাথে। নিজের সাথে। তোমার সাথে। আমি জানি আমার এই অন্যায়ের কোন ক্ষমা হয়না। তবুও তোমরা আমাকে ক্ষমা করো। আমাকে শেষবার একটা সুযোগ দাও। সন্তান যেমনেই হোক। মা কখনও সন্তানের থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন না। মা জানে সন্তানের ভেতরের খবর। বিলকিস বেগম অবাকের মাথায় হাত রাখে। অবাক শব্দ করে কেঁদে উঠে। বিলকিস বেগম শীতল কণ্ঠে বলেন,

-আমি ক্ষমা করলেই কি? মেঘকি পারবে তোকে ক্ষমা করতে? তুই বরং মেঘের কাছে ক্ষমা চা। আল্লাহর কাছে ক্ষমা চা। কিন্তু আমি তোর থেকে কখনও এমনটা আশা করিনি। আমি ভাবিনি আমার সন্তান এতোটা নিচে নামবে। আমি খুব কষ্ট পেয়েছি তোর এমন আচরণে। অবাক বলার মতো কিছু পেলো না।

সে সত্যি খুব বড় অন্যায় করেছে। মেঘ নিতান্ত একটা সহজ সরল মেয়ে। বাচ্চামি একটা স্বভাব। কিছুটা পাগলামি। মাঝ রাতে এই খাব সেই খাব বলে বায়না করা। সুযোগ পেলেই তার বুকে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়া। ঘুমন্ত তার মুখে চুমু খাওয়া। এসবকিছু শুধুই পাগলামি ছিল না। ভালোবাসা ছিল। আজ অবাকের মনে হচ্ছে, এতো ভালোবাসা পেয়েও সে কিভাবে প্রতিনিয়ত অবহেলা করেছে।

অনুর সাথে অন্যায় করা হয়েছে। কিন্তু অনু নিঃসন্দেহ একটা বুদ্ধিমতি মেয়ে। সে নিজেকে সামলে নিয়েছে। নিজের সাথে হওয়া অন্যায়ের কথা একবারো বলেনি। বলেছে মেঘের সাথে অন্যায়ের কথা। অনু বিয়েটা করে নিজেকে একজন আদর্শ নারীর পরিচয় দিলো। কিন্তু মেঘ নির্দোষ হয়েও শাস্তি পেলো। মেঘের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। মেঘ অবশ্যই তাকে ক্ষমা করবে। অনু তাকে ক্ষমা করলো। যাকে মন থেকে ভালোবাসা হয় তাকে ক্ষমা করা কঠিন কিছু নয়। যদিও অবাক অনেক বড় একটা অন্যায় করলো। কিন্তু সেটা রাগের মাথায় হয়েছে। মেঘও ক্ষমা করবে। অবাক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।

অবাক কাঁপা পায়ে ঢুকলো কেবিনে। মেঘের সামনে যাওয়ার শক্তিটুকু পাচ্ছে না সে। কিন্তু মেঘের কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত সে শান্তি পাবে না। মেঘ শুয়ে আছে নিস্তেজ হয়ে। তার বাম হাতে স্যালাইন টানানো।

অবাক নিস্তব্ধ নিরবে মেঘের পায়ের কাছে বসে। মেঘ পলকহীন শূন্যে তাকিয়ে রইলো। চোখ দুটো ফুলে আছে। অবাক করুণ চাহনিতে কিছুক্ষণ মেঘকে দেখে। মেঘকে আজ বাচ্চা লাগছে না। মনে হচ্ছে সে হুট করে বড় হয়ে গেছে। মেঘের মুখে আজ আর কোনো বাচ্চামি ভাব নাই।

অবাক মাথা নিচু করে মেঘের ডানহাতটা নিজের দুহাতের মুঠোয় নেয়। মেঘ আগের মতই পলকহীনভাবে তাকিয়ে রইল। অবাক মেঘের হাতটা নিজের কপালে লাগায়। তবুও মেঘ নড়লো না। অবাক অসহায় কণ্ঠে বলে,

-মেঘ, আমি জানি আমি অনেক বড় একটা অন্যায় করেছি তোমার সাথে। এ অন্যায়ের ক্ষমা হয়না। তোমার কাছে ক্ষমা চাওয়ার মতোও যোগ্যতা টুকু আমার আজ নেই। তবুও তোমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছি।

আমাকে কি শেষবারের মতো একবার ক্ষমা করা যায় না? মেঘ, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পারবে না? তুমি আমাকে ক্ষমা না করলে আমি মরেও শান্তি পাবনা। মেঘ রেসপন্স করলো না। অবাক মেঘের দিকে আরেকটু এগিয়ে গেলো,

-এভাবে চুপ করে আছো কেন? কিছু একটা বলো। যা মন চায় বলো। কিন্তু চুপ করে থেকো না। তোমার চুপ করে থাকাটা আমায় খুব কষ্ট দিচ্ছে। একবার কথা বলো মেঘ। মেঘ কথা বললো না। মেঘের নীরবতা অবাককে কাতর করে দিলো।

তার চোখ থেকে টপটপ পানি পড়তে লাগলো। অবাকের ইচ্ছে করছিল মেঘকে একবার জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পারছে না। অবাক আবার বললো,
-মেঘ, তুমি আমাকে শাস্তি দিও। আমি তোমার দেওয়া সব শাস্তি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমার সাথে একবার কথা বলো।

অবাক বুঝতে পারছে মেঘ তাকে ক্ষমা করতে পারেনি। না পারাটা অস্বাভাবিক নয়। অবাক বেশকিছুক্ষণ মেঘের পাশে বসে থাকে। এক সময় সে হতাশ হয়ে বের হয়ে আসে।

রাত বাড়ছে। অনুর বাসায় মেহমানদের জন্য চুলপরিমাণ জায়গা ফাঁকা নেই। অনু একপাশে চুপটি করে বসে আছে। অনুর চারপাশে বসে আছে তার কাজিন আর ফ্রেন্ডসরা। সবার মুখে কথার ঝুরি। একমাত্র অনুই চুপ করে বসে আছে। তার মাথা ধরেছে। এতো হাউমাউয়ে অনুর মাথা শেষ।

অনুর হাতে মেহদি লাগিয়েছে। সে হাত দুটো মেলে বসে আছে। একটু যে রেস্ট করবে তারও উপায় নেই। তার ক্লান্তও লাগছে খুব। সারাদিনেও একবার বিছানায় গা এলায় নি। অনুর ফোন বাজছে। প্রিতি বলে,

-আপু কে কল দিচ্ছে রিসিভ কর। অনু নিজের হাত দেখিয়ে বলে,
-আমি কিভাবে ফোন রিসিভ করবো? অনুর এক বান্ধবী জিজ্ঞেস করে,
-কিরে, কে কল দিল এটা তো আগে দেখ? অনুর একজন কাজিন ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ইমনের নাম। অনুর কাজিন বলে,

-ওরে প্যায়ার। জিজু মাত্রই গেলো এক্ষণি মিস করছে আমাদের আপুমনিকে। তার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। অনুর আরেক বান্ধবী বলে,

-আরে ফোনটা রিসিভ কর। আর লাউডে দে। আমরাও শুনি জিজু কি বলে। অনু কিছু বলার আগেই প্রিতি ফোনটা নিয়ে কলটা রিসিভ করে। আর লাউড মুডে রাখে। রুমে সবাই একদম চুপ করে থাকে। ইমন বলে,

-হ্যালো মহারাণী। ইমনের কথার উত্তর কেউ দিলনা। সবাই অনুকে ফিসফিস করে বলে,
-কথা বল। অনুর বিরক্ত লাগছে। আল্লাহ জানে এই লোক এখন কি বলে ফেলে। ঘর ভর্তি লোকের সামনে তার মান সম্মান যায় কিনা। কিন্তু সবার রিকুয়েস্ট সে ফেলতেও পারছে না। অনু সবাইকে এক নজর দেখে ধীর কণ্ঠে বলে,

-জ্বি বলুন।
-আল্লাহ, এই একটু হ্যালো বলতে এতো সময় লাগে? আচ্ছা যাক। সমস্যা নাই। ধৈর্যের ফল মিষ্টি হয়। অনু চুপ করে থাকে। বাকি সবাই ভ্রু নাচায়। ইমন আবার বলে,
-আজ আপনাকে খুব সুন্দর লাগছিল অনুপমা। আমার মনে হচ্ছিল আমার পাশে স্বর্গের একটা হুরপরী বসে আছে। আমি কতো লাকি। এতদিন মনে হতো জীবনটাই বৃথা। এখন নিজের ভাগ্য দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাই। এতো সৌভাগ্যবান আমি।

আপনার মতো একটা লক্ষ্মী মেয়েকে সোলমেট হিসাবে পাচ্ছি। মহান আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া। অনু আবারও চুপ করে যায়। প্রিতি ফিসফিস করে বলে,

-আহা আহা। জিজুতো মজনুকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। প্রিতির কথা শুনে বাকি সবাই মুখ চেপে হাসে। ইমন প্রিতির কথাটা আবছা শুনতে পায়। সে জিজ্ঞেস করে,
-ম্যাডাম, আপনার পাশে কেউ আছে নাকি?
-হুম। প্রিতি, কাজিনরা, ফ্রেন্ডসরা আছে।
-কি করছে ওরা?
-মেহেদি পড়ছে।
-আপনিও পড়েছেন? অনু কিছু বলল না। ইমন কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,

– আপনি কিন্তু আজ বেশি রাত জাগবেন না। তাড়াতাড়ি ঘুমাবেন। নাহলে কাল ক্লান্ত লাগবে। আর চোখের নিচে ডার্কসার্কেল পড়বে। তখন দেখতে খারাপ লাগবে। আর আমি চাই আমার বউকে যেন কাল পরীর মতো লাগে। সবাই যেন আমার বউকে দেখে জেলাস ফিল করে। ইমনের কথা শেষ হতে না হতেই রুমের সবাই হাসিতে ফেটে পড়ে। অনুর একজন কাজিন বলে উঠে,

-আরে জিজু। তুমি তো দেখি এক্ষণি আপুর যে কেয়ার নিচ্ছ। তোমার ভালোবাসা দেখেতো আমিই ফিদা হয়ে গেলাম। ইমন একদম আবুল হয়ে যায়। কথাটাতো অনুকে বলেছে। ওরা শুনলো কেমনে? ইমন তড়িঘড়ি বলে,

-ফোন কি লাউডে দেওয়া? এবারও সবাই একজোটে হেসে দেয়। ইমনের আর বুঝতে বাকি রইল না। ওরা সব কয়জন মিলে দুষ্টামি করছে। আর ওরা যে ফাজিল মেয়ে, সুযোগ পেলেই তাকে জ্বালাবে। ইমন বলে,

-আমি ফোনটা রাখি। কথা শেষ করার সাথে সাথেই সে কল কেটে দেয়। অনুর কাজিন আর ফ্রেন্ডসরা মিলে মজা করতে শুরু করে। অনুকেও জ্বালানো শুরু করে দিয়েছে।

সকাল থেকেই চলছে সাজগোজের পর্ব। কার থেকে কে বেশি সাজবে চলছে সেরকম পাল্লা। শুধু চুপ করে বসে আছে অনু। তাকে সাজানো হবে সবার শেষে। পার্লার থেকে নয়জন মহিলা আসছে। মনে হচ্ছে আরো নয়জন আনা উচিত ছিল।

তাহলেও হয়তো সবার চাহিদা পূরণ হতো না। এই নয়জন মহিলাও বসে নেই। তারা হাত চালাচ্ছে দ্রুত। ভোর সকাল থেকে সাজানো হচ্ছে। এখনও আরো এগারোজন সাজার বাকি। তারপর অনুকে সাজানো হবে। অনু হা করে সবার কাণ্ড দেখছে। এতো সাজগোজ দেখে মনে হচ্ছে বিয়েটা তাদের হচ্ছে।

অনুর কাজিনরা নাচ গান হৈ হুল্লোর করার জন্য আয়োজন করে। কিন্তু কাজল রেখা কিছুতেই নাচ গানের বিষয়টা এলাউ করলেন না। বিয়ে বাড়িতে হৈ চৈ সব হোক। কিন্তু নাচ গান হওয়া চলবে না। এতে সবার মন কিছুটা খারাপ হয়। কিন্তু কিচ্ছু করার নেই

তিনি যখন একবার না করেছেন তখন না। তাদের সবার মতামত ছিল, বিয়ে বাড়িতে গান ছাড়া বিয়ে বাড়ি মনে হয়না। হলুদের অনুষ্ঠানেও তিনি গানের ব্যবস্থা করতে দেন নি। তখনও প্রথম সবার কিছুটা মন খারাপ হয়েছিল।

কিন্তু কিছুক্ষণ পর হলুদের অনুষ্ঠান জমে উঠায় সবাই গানের কথা ভুলেই যায়। প্রিতির সাজ কমপ্লিট। সে অনুর সামনে গিয়ে বলে,
-আপু দেখতো আমাকে গর্জিয়াছ লাগছে কিনা? অনু মিষ্টি হাসি হেসে বলে,

-হুম। খুব মিষ্টি লাগছে।
-সত্যি?
-হুম।
-একটু ভালো করে দেখ। কিছু বাদ আছে কিনা। আমার একমাত্র আপুর বিয়ে বলে কথা।
-সবতো ঠিক ঠাকেই আছে।
-আচ্ছা, তাহলে আম্মু ভাইয়া আর ভাবিকে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসি আমাকে কেমন লাগছে।

-আচ্ছা যা। প্রিতি চলে যায়। অনুর চোখ জলে ভরে উঠে। হঠাৎ করেই বুকটা হাহাকার করে উঠে। আজ ইমনের জায়গায় অবাকের থাকার কথা ছিল। কিন্তু নিয়তির কি নিষ্ঠুর খেলা। কখনো কল্পনাও ছিলনা এমন কিছু হবে। অনু বারবার চোখ মুছে। তবুও চোখ ভেজায় থেকে যাচ্ছে। অনু জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেয়। কিন্তু তার কান্নার গতি বাড়তে লাগলো। কান্নাটা আজ বেহায়া হয়েছে। এমন বাঁধ ভাঙ্গছে কেন? অনু কিছুতেই শান্ত হতে পারছে না।

কাজল রেখা অনুর রুমে এসেই অনুর কান্নার দেখলেন। তিনি বিচলিত হয়ে গেলেন। কাজল রেখা দ্রুত অনুর কাছে এসে বসলেন। অনু মাকে দেখে আরো ভেঙ্গে পড়ে। সে মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। কাজল রেখা অনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,

-কাঁদছিস কেন? একটু পরে মাথা ব্যথা শুরু হবে। শান্ত হো। অনু থামলো না। তার মন অশান্ত। কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ কান্নার পর অনু নিজ থেকেই থামে। কাজল রেখা অনুকে নিজের বুক থেকে তুলে চোখ মুছে দেন। অনু মাথা নিচু করে বসে। কাজল রেখা এবার বলেন,

-তুই যদি এভাবে কাঁদিস তাহলে তোর সাথে সাথে প্রিতিও এখন কান্না শুরু করবে। আমি নিজেও ঠিক থাকবো না। রিয়াদও কষ্ট পাবে। দেখছিস বাসার প্রত্যেকটা মানুষজন কতোটা আনন্দ করছে? সবার আনন্দ এভাবে নষ্ট করবি? অনু মাথা ঝাকাল। সত্যি সবাই খুব আনন্দ করছে। এই আনন্দটা নষ্ট করা ঠিক না। থাকনা কিছু কষ্ট মনের অগোচরে।

চলবে—-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here