#অবাক_মেঘের_বাড়ি
পর্ব : ২৩
সুরমা
অবাক মেঘকে জোর করে পানি থেকে তুলে আনে। মেঘ বলে,
– আমাকে এভাবে টেনে তুলছেন কেন? আরেকটু সাঁতার কাটলে কি হয়? আমি আরেকটু সাঁতার কাটবো।
– অনেক সাঁতার কেটেছো। আর না। এরপর জ্বর আসলে আমার বিপদ হবে। একটা বাচ্চাকে সামলানো কম কথা নয়।
– আমাকে বাচ্চা বলবেন না। আমি অনেক বড়। ছাড়ুন আমায়। আমার জ্বর আসে না। অবাক হেসে বলে,
– আচ্ছা যাও। তুমি অনেক বড়। তবুও আর পানিতে থাকা যাবে না।
– আরেকটু সাঁতার কাটলে আমি সাঁতার শিখেই ফেলতাম। অবাকের হাসি পায়। পানিতে থাকা অবস্থায় একবারের জন্যও মেঘ তাকে ছাড়েনি। কোমর পর্যন্ত পানিতে থেকেও এক হাত দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছিল তাকে। আর এক হাত দিয়ে পানিতে খেলা করেছে। এখন আবার বলছে সাঁতার শিখে ফেলতো। অবাক বলে,
– আর সাঁতার শিখতে হবে না। তুমি যে বীর সাহসী। বাপরে, তুমি যদি সাঁতার শিখো তাহলে সাঁতারুদের অবস্থা খারাপ হবে। অবাক মেঘকে টেনে পাড়ে নিয়ে আসে। ভেজা শরীরে মেঘকে অন্যরকম লাগছে। ভেজা শাড়ি শরীরের সাথে লেগে আছে। এমন অবস্থায় মেঘকে খুব আবেদনময়ী লাগছে। এই অবস্থায় মেঘকে দেখে অবাকের শরীর কেঁপে উঠে। এর আগে কখনও কোনো মেয়েকে এভাবে দেখেনি অবাক।
অবাক নিজের চোখ সরিয়ে ফেলে। সাথে অবাকের কিছুটা রাগও জমা হয়। এখানে লোকজনের কোনো সীমা নেই। অনেকেই মেঘের দিকে তাকাচ্ছে। এই ভেজা শাড়ি নিয়ে রিসোর্ট পর্যন্ত গেলে সবাই নিশ্চয় মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকবে। শাড়ি পরে কেউ পানিতে নামে?
যারা পানিতে সাঁতার কেটেছে কারো পরনে শাড়ি নেই। পানিতে সাঁতার কাটার জন্য শাড়ি কমফোর্টেবল নয়। তার জন্য আলাদা ড্রেস ইউজ করতে হয়। মেঘের জন্য আগেই কিছু জামা কাপড় কিনা উচিত ছিল। বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে। কিন্তু এই মুহূর্তে অবাকের মাথায় কিছুই আসছে না। অবাক কিছুক্ষণ চিন্তিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের শার্ট খুলে পানি নিগড়ে বলে,
– এই শার্ট টা পরো। আর নেক্সট টাইম শাড়ি পরে পানিতে নামবে না। আমি তোমাকে ড্রেস কিনে দিবো। মেঘ ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে বলে,
– কেন? কি হয়েছে?
– লোকজন তোমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর ভেজার কারণে তোমারের অঙ্গগুলোও আলাদা বুঝা যাচ্ছে। মেঘ নিজের শরীর ভালোকরে দেখে বলে,
– কোথায় দেখা যাচ্ছে? অবাক কিছুক্ষণ ঝিম ধরে দাঁড়িয়ে থেকে বলে,
– তোমাকে বুঝাতে আমার সারাটা দিন লাগবে। তবুও তুমি বুঝতে পারবে কিনা আমার সন্দেহ আছে। শার্ট টা পরো। আর চুপচাপ চলো।
– আমি শার্ট কেন পরবো? অবাক দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
– আমি বলছি তাই পরবে। নাও। মেঘ অবাকের হাত থেকে শার্টটা নিয়ে ভালো করে দেখে বলে,
– এতো বড় শার্ট। এটা আমি পরলে তো পাঞ্জাবি মনে হবে। মেঘ অবাকের দিকে তাকিয়ে দেখে অবাক চোখ লাল করে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ চুপচাপ শার্ট টা পরে নেয়। অবাকের গায়ে জাস্ট একটা হাতাকাটা গেঞ্জি।
অবাকের শার্টটা গায়ে দিয়ে মেঘের মন আনন্দে ভরে উঠে। এই শার্টে অবাকের গায়ের ঘ্রাণ মিশে আছে। অবাকের ছোঁয়া লেগে আছে। মেঘ শার্টের কলার টেনে নাকের কাছে এনে ঘ্রাণ নেয়। আনন্দে মেঘের চোখে জল চলে আসে। এতো ভালোবাসা মিশে আছে অবাকের পরিহিত শার্টে মেঘ বলে বুঝাতে পারবে না।
রিসোর্টে এসে অবাক আগে ফ্রেশ হয়ে আসে। মেঘ ভেজা কাপড় নিয়েই বিছানায় বসে থাকে। অবাক বলে,
– যাও ফ্রেশ হয়ে আসো।
– আরেকটু বসে থাকি।
– ভেজা কাপড় নিয়ে আরেকটু বসে থাকি মানে? যাও ফ্রেশ হয়ে যত খুশি বসে থাকো। মেঘের ইচ্ছে করছে না গা থেকে অবাকের শার্টটা খুলতে। তবুও তাকে উঠতে হবে। নাহলে অবাক রেগে যাবে। মেঘ তাকিয়ে দেখে অবাক রেডি হচ্ছে। মেঘ জিজ্ঞেস করে,
– আমরা কি আবার বের হবো?
– হুম
– কোথায় যাবো?
– মার্কেট।
– মার্কেট কেন?
– তোমার জন্য কাপড় কিনতে।
– আমারতো অনেকগুলো কাপড় আছে। আর লাগবে না।
– যা আছে সব শাড়ি। এখন জামা কিনতে যাবো। সেন্টমার্টিন গিয়ে কি কাপড় নিয়েই ভিজবে? মেঘ আনন্দে লাফিয়ে উঠে।
– সেন্টমার্টিনও পানিতে নামবো? ওয়াও! তখন কিন্তু আমি সাঁতার শিখেই ছাড়বো। আপনি আমাকে টেনে নিয়ে আসতে পারবেন না। আমি আসবো না বলে দিলাম। মেঘ দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। আর অবাক একা একাই হাসতে থাকে।
পরদিন ভোরবেলা মেঘ আর অবাক সেন্টমার্টিনের জন্য বের হয়। নয়টার আগে টেকনাফ থাকতে হবে। নয়টা থেকে সাড়েনয়টায় টেকনাফ থেকে সব জাহাজ সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। তারপর আর কোনো জাহাজ পাওয়া যায় না। তারা নয়টার আগেই টেকনাফ চলে আসে। অবাক জাহাজের টিকিটও সংগ্রহ করে। জাহাজে উঠেই সাকিল আর প্রমির সাথে দেখা হয় মেঘের। প্রমি মেঘকে দেখেই এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,
– কি ব্যাপার তোমরা? তোমাদের তো গতকাল চলে যাওয়ার কথা ছিল। মেঘ মাথা নিচু করে। অবাক মৃদু হেসে বলে,
– যেতে পারিনি। মেঘ ট্রলারে ভয় পায়।
– অহ! আসলে মেঘ বাচ্চা মানুষতো তাই। প্রমি সাকিল অবাক তিনজন হেসে দেয়। মেঘ মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,
– আপু তুমিও আমাকে বাচ্চা বলছো? বলছি না আমি বড়। মেঘের কথা শুনে প্রমি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,
– অহ সরি। আমি ভুলে গেছিলাম। সমস্যা নাই। তুমি বড়ই থাকবা। আমি বললেও ছোট হবে না।
জাহাজ চলছে। লোকজন দাঁড়িয়ে আছে জাহাজের চারপাশ ঘিরে। কিন্তু অবাক মেঘ, সাকিল আর প্রমি ভেতরে বসে আছে। প্রমি বলে,
-মেঘ চলো আমরা ছাদে উঠি। ছাদে করে সমুদ্র দেখতে দেখতে সেন্টমার্টিন যাওয়ার মজাই আলাদা। অবাক মেঘের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
-যাবে? মেঘ মাথা নাড়ে। সে যাবে না। প্রমি বলে,
-কেন? আমরা যাচ্ছি তুমিও চলো আমাদের সাথে।
-আমি যাবো না। পড়ে গেলে মরে যাবো। আমি সাঁতার জানি না। প্রমি হেসে বলে,
-পড়বে কেন? চলো তো। তুমি অযথা ভয় পাচ্ছ। একবার গেলে আর নামতে চাইবে না। অবাক বলে,
-পড়বে না। আমরা মাঝ বরাবর বসবো। তোমার খুব ভালো লাগবে। তিন ঘণ্টা এখানে বসে থাকলে বোর হয়ে যাবে। ছাদ থেকে সমুদ্রের সুন্দর্য অপরূপ লাগে। ছাদে গিয়ে দেখো কতো মানুষজন বসে আছে। গল্প করছে। মেঘ অবাকের দিকে ছলছল চোখে তাকায়। অবাক আশ্বাস দিয়ে বলে,
-আমি আছিতো।
-আমাকে কিন্তু শক্ত করে ধরে রাখবেন। অবাক মৃদু হেসে বলে,
-আচ্ছা ধরে রাখবো। মেঘ অবাকের হাত আঁকড়ে ধরে ছাদে আসে। ছাদেও জায়গা নেই। ছাদ থেকে সমুদ্রের অপরূপ সুন্দর্য দেখে মেঘকে মোহিত করে। ছাদে না আসলে সত্যি এই দৃশ্যটা দেখা থেকে বঞ্চিত হতো। নীল আকাশের নিচে সমুদ্রের পানি নীল হয়ে আছে।
আর হাজারে হাজারে পাখি উড়ছে। কেউ কেউ পাখিদের খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছে। আর পাখিগুলো ঝাক বেঁধে উড়ন্ত খাবার তুলে নিচ্ছে। মেঘের মন থেকে ভয় জিনিসটা চলে যায়। অবাকের হাত ছেড়ে কিনারায় এসে দাঁড়ায়। অবাকও মেঘের পেছনে দাঁড়ায়। মেঘ বলে,
-আমিও পাখিদের খাবার দিবো। প্রমি আর সাকিল তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ায়। সাকিলের হাতে চিপসের প্যাকেট। অবাক সাকিলের হাতের প্যাকেট দেখে মনে হয় সে মেঘের জন্য কিছু নিয়ে আসে নি। মেঘ আবার বলে,
-অবাক বাবু আমি পাখিদের খাবার দিবো। কিছু খাবার এনে দিন না আমায়।
-আমার তো মনেই ছিল না কিছু নিয়ে আসতে। আর এখনতো কিছু আনাও যাবে না। মেঘের মন খারাপ হয়। মেঘ ঠোঁট ভেঙ্গে বলে,
-আপনি খুব কিপ্টে লোক। সবাই কতো কিছু নিয়ে এসেছে। আপনি কিছুই আনেন নি।
ইমন সকাল সকাল তার বাবা মাকে নিয়ে অনুদের বাসায় হাজির। অনুর মাথায় প্রিতি জোর করে মেহেদিবাটা দিয়ে দেয়। অনু বসে ছিল ড্রয়িংরুমে। পায়জামার পা উপরে উঠানো। একদম এলোমেলো হয়ে বসে ছিল সে । হঠাৎ ইমন আর তার বাবা মাকে দেখে অনু দৌঁড়ে নিজের রুমে চলে আসে। ইমন আর তার বাবা মা হা করে অনুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
অনু ওয়াশরুমে ঢুকে মাথায় শ্যাম্পু করে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাচ্ছে। সে ভাবতেই পারেনি এই সাতসকাল ওরা চলে আসবে। কাজল রেখা আর ইমনের মা বাবা বসে ড্রয়িংরুমে। কাজল রেখা বলেন,
-আপনারা এতো তাড়াতাড়ি চলে আসবেন ভাবতেই পারিনি। ইমনের মা বলেন,
– আসতেই হলো। ছেলের আবদার বলে কথা। আর আপনার এমন লক্ষ্মী একটা মেয়েকে আমার ঘরে তোলার মতো সৌভাগ্য হয়েছে। তাই আর দেরি করলাম না।
– ভালো করেছেন। রিয়াদ অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হয়ে ড্রয়িংরুমে এসে তাদের দেখে। রিয়াদ হেসে শ্বশুর শাশুড়িকে সালাম দেয়। সবাই বসে বিয়ে নিয়ে আলোচনা করে। বিয়ের অনুষ্ঠান হবে জমজমাট। সারা এলাকার মানুষকে জানিয়েই বিয়ে হবে। বিয়ের ঠিক হয় ২তারিখ। ইমনের বাবা মায়েরও ইচ্ছে একমাত্র ছেলের বিয়েটা বড় করে অনুষ্ঠান করে দিতে।
যার কারণে হাতে বেশি সময় রাখে। ইমন সবকিছু চুপচাপ বসে শোনে। তার ইচ্ছে ছিল অনুকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিজের করে নিতে। কিন্তু এটাও ঠিক। বিয়ে একবারেই হয়। আর মেয়েদের নিজের বিয়ে নিয়ে অনেক স্বপ্ন থাকে। অনুরও আছে। আর ভালো কিছু পেতে যদি একটু অপেক্ষা করতে হয় তাতে ইমনের আপত্তি নেই। ইমন বলে,
– আপনারা কথা বলুন। আমি আসছি। ইমন উঠে অনুর রুমে চলে আসে। এসে দেখে অনু ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসে মাথার চুল মুচ্ছে। ইমন দরজায় হেলে দাঁড়ায়। অনু ঘুরে দেখে ইমন দাঁড়িয়ে আছে। অনু আমতাআমতা করে বলে,
– আপনি এখানে?
– সরি অনুমতি ছাড়া চলে এলাম। এখন কি ভেতরে আসতে পারি? অনু কিছু বলে না। ইমন রুমে ঢুকে। অনুর পরনে ব্লাক থ্রিপিছ। এলোমেলো হওয়া ভেজা চুলে অপরূপ লাগছে তাকে। স্নিগ্ধ চেহাটা আরো মায়াবী লাগছে। ইমন অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,
– তোমাকে খুব মায়াবী লাগছে। অনু চোখ তুলে তাকায় ইমনের দিকে। ইমন হেসে বলে,
– একটু আগে আরো সুন্দর লাগছিল। আর দৌঁড়ের কথা কি বলবো। ভিডিও করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নাহলে বাঁধায় করে রাখতাম। অনু লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। সত্যি তখন এভাবে দৌঁড়ানো উচিত হয়নি। অনু অন্যদিকে ফিরে বলে,
– আপনি কি এই কথাটা বলার জন্য আমার রুমে এসেছেন?
– না। একটা কথা জিজ্ঞেস করতে এসেছি।
– বলুন কি জিজ্ঞেস করতে চান।
– আসলে আব্বু আম্মু এসেছে বিয়ের কথা বলতে। ২ তারিখ বিয়ের ডেট ঠিক করেছে। তোমার কি কিছু বলার আছে? থাকলে আমাকে বলতে পারো।
বিয়ের কথা শোনে অনুর সারা শরীর কেঁপে উঠে। লোমকূপ গুলো কাড়াকাড়া হয়ে যায়। চোখেও জল চলে আসে। অনু মাথা নাড়িয়ে না বলে। ইমন পেছন থেকে বলে উঠে,
– অনু তুমি কি কাঁদছো? অনু তাড়াতাড়ি চোখ মুছে ফেলে। এই লোকটা কিভাবে বুঝলো? ইমন অনুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– কাঁদো। বিয়ের যে কয়দিন বাকি আছে কেঁদে ফেলো। বিয়ের পর আর তোমাকে কাঁদতে দিবো না। আমার বউয়ের চোখের জল এতো সস্তা হবে না। যে, যখন তখন চোখ থেকে গড়িয়ে পড়বে। কথাটা বলেই ইমন বের হয়ে আসে।
৩ ঘণ্টা সমুদ্র ভ্রমণের পর তারা সেন্টমার্টিন পৌঁছায়। সাকিল প্রমি আর অবাক মেঘ একই রিসোর্টে উঠে। তাদের রুমও পাশাপাশি। মেঘ রুমে ঢুকেই বিছানায় লম্বা হয়ে শোয়। অবাক বলে,
-ফ্রেশ না হয়েই শুলে কেন? যাও আগে ফ্রেশ হও।
– কত সুন্দর একটা জার্নি করলাম। আরো দূর হলো না কেন সেন্টমার্টিন? তাহলে আরো কিছুক্ষণ থাকতে পারতাম। অবাক জোরে নিঃশ্বাস ছাড়ে। এই মেয়ে বুঝা খুব কঠিন। প্রথমে সমুদ্র পথে জার্নি করতেই রাজি না পরে আর আসতে চায়না। অবাক মাথা ঝাকায়।
– মেঘ এখানে ২টার পর খাবার পাওয়া যায় না। আর এখন খাবার খেলে ভালো খাবার পাবে। সো যদি খেতে চাও তাহলে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসো। অবাক লাফিয়ে উঠে।
– আমি খাবো। ওমা কতক্ষণ না খেয়ে আছি।
– খাও নি মানে? সারা পথ তো খেতে খেতে আসছো।
– আপনিতো কিছুই নেন নি। যা খেয়েছি সেগুলো সাকিল ভাইয়া নিয়েছিল।
– আমার মনে ছিল না। তার জন্যতো সরি বলেছি অনেকবার। মেঘ মুখে ভ্যাংচিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। মেঘের মুখের রিয়েকশন দেখে অবাক হা করে থাকে। কি মেয়েরা বাবা। মেঘ ফ্রেশ হয়ে এসে বলে,
– চলুন তাড়াতাড়ি। আমার খুব খুদা পেয়েছে। অবাক বলে,
– দাঁড়াও আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
– আমি প্রমি আপুকে নিয়ে আসি। আপনি ফ্রেশ হোন। অবাক ওয়াশরুমে ঢুকে আর মেঘ প্রমিদের রুমে যায়। মেঘ প্রমিদের রুমের কলিং বেল চাপে। সাথে সাথেই প্রমি এসে দরজা খুলে। মেঘ বলে,
– আপু তোমরা খাবে না?
– হ্যাঁ খাবো।
– তাহলে চলো একসাথে যাই।
– একটু অপেক্ষা করো। সাকিল ফ্রেশ হচ্ছে।
চারজন একসাথে খেতে যায়। অবাক প্রমি আর সাকিলের দিকে তাকিয়ে বলে,
– মাছ অর্ডার করি? প্রমি আর সাকিল দুজনেই সায় দেয়। অবাক মেঘকে জিজ্ঞেস করে,
– ভাত কি দিয়ে খাবে? মেঘ বলে,
– আমি মাংস খাবো।
– মাছ খাও। এখানে সব রকম মাছ পাওয়া যায়। আর খুব ভালো হয় মাছের আইটেম গুলো। মেঘের মুখ কালো করে বলে,
– আপনিতো খুব কিপ্টা। মাংসের দাম বেশি বলে মাছ খেতে বলছেন? অবাক বেকুবের মতো সাকিল আর প্রমির দিকে তাকায়। তারা দুজনেই হাসে। মেঘ আবার বলে,
– আমি মাংসই খাবো। অবাক কথা না বাড়িয়ে মেঘের জন্য মাংস অর্ডার করে। তিনজনের জন্য আসে বিভিন্ন রকমের মাছের আইটেম। মেঘের জন্য মাংস। সবাই খেতে শুরু করে। সাকিল বলে,
– ওয়াও! এদের খাবার সব সময় ভালো হয়। প্রমিও খাবারের প্রশংসা করে। মেঘ ঠোঁট ভেঙ্গে বলে,
– অবাক বাবু। অবাক মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
– আরো মাংস লাগবে?
– না
– তাহলে?
– আমি মাছ খাবো। সাকিল প্রমি এবার দুজনেই জোরে হেসে দেয়। অবাক জানতো মেঘ এমন কিছু বলতে পারে। তাই তার জন্য সব কিছু একটু বেশি বেশি অর্ডার করে। অবাক ভাবলো মেঘের সাথে এখন একটু মজা করা যাক। সে মিটমিট হেসে বলে,
– তোমার জন্য মাছ নাই। আমিতো শুধু আমাদের জন্য বলেছি। আর এখন মাছ অর্ডার দিলেও দিবে না। রাতে মাছ খাওয়াবো। এখন বরং মাংস দিয়েই খাও। মেঘ মুখটা কাঁচুমাচু করে। অসহায় ভঙ্গিতে বলে,
-তাহলে আপনি আমার মাংসটা খেয়ে ফেলুন। আমি খাবো না। আমি মাছেই খাবো। মেঘ অবাকের প্লেটে নিজের মাংসটা ঢেলে দেয়। আর অবাকের প্লেট থেকে মাছটা নিজের প্লেটে নিয়ে নেয়। অবাক আবুল হয়ে বসে থাকে। মেঘের কাণ্ড দেখে সাকিল আর প্রমি দুজন মিটমিট করে হাসতে থাকে। মেঘ মাছ খেয়ে দেখে সত্যি মাছগুলো সব সুস্বাদু। মেঘ হাসি হাসি মুখ করে বলে,
– এখন থেকে আমি সব সময় মাছ খাবো। আমি অনেক গুলো মাছ খাবো। মেঘের কথা শোনে অবাক হেসে দেয়। চলছে খাওয়ার পর্ব। খাওয়ার মাঝে চলছে সাকিল প্রমির খুনসুটি প্রেম। সাকিল প্রমিকে কয়েক লোকমা ভাত খাইয়ে দেয়। পাতের মাছের কাটা বেছে দেয়। অবাক মেঘ দুজনের দৃষ্টি কাড়ে তাদের খুনসুটি প্রেমের দৃশ্য।
মেঘের মন খারাপ হয়। কিছুক্ষণ ছলছল চোখে অবাকের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার আর খেতে ইচ্ছে করছে না। মেঘ মনে মনে বলে, ‘ অবাক বাবু কেন আমাকে একটু ভালোবাসে না? আমি কি এতটাই খারাপ?’ মেঘ বাকি খাবারটা রেখে উঠে দাঁড়ায়। অবাক অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– কি হলো? উঠলে কেন? মেঘ ধরা গলায় বলে,
– আমি আর খাবো না। অবাক কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে রুমে চলে আসে।
সাকিল আর প্রমি অবাকের দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। সাকিল জিজ্ঞেস করে,
– মেঘ এভাবে চলে গেলো কেন? অবাক মাথা নিচু করে। সাকিল প্রমির দিকে তাকালে প্রমি কাঁধ ঝাকায়। সেও বুঝতে পারছে না মেঘ কেন দৌঁড়ে চলে গেলো। অবাকও উঠে দাঁড়ায়।
– তোমরা খাও আমি আসছি। অবাক ব্যস্ত পায়ে রুমে আসে।
অবাক রুমে এসে দেখে মেঘ কাঁদছে। অবাক কাটের কাছে দাঁড়ায়। কিন্তু মেঘকে কি বলবে বুঝতে পারে না। অবাকের নিজের খারাপ লাগছে মেঘকে দেখে। সে জানে মেঘ কেন কাঁদছে। তবুও স্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
– মেঘ এভাবে চলে এলে কেন? আর কাঁদছই কেন? মেঘ নালিশে মুখ গুজে। সে কথা বলবে না এই লোকটার সাথে। অবাক কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেও কোনো উত্তর পেলো না। তাই নিঃশব্দ পায়ে ব্যালকনিতে গিয়ে বসে। মেঘের কান্নার কারণ আছে। কিন্তু সেই কান্না থামানোর ওষুধ তার কাছে খুবই কঠিন। মেঘ কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ে।
অনুদের বাসায় চলছে বিয়ের প্ল্যানিং। প্রিতি দাওয়াতি লোকজনদের লিস্ট তৈরি করছে। সাজানোর প্ল্যানিং করছে রিয়াদ। রিয়াদ অফিস থেকে ছুটি নিয়েছে বিয়ে পর্যন্ত। একা হাতে সব কিছু করতে হবে। কিন্তু বোনের বিয়েতে কোনো রকম ত্রুটি রাখবে না সে। যেমন স্বপ্ন দেখেছিল সেরকম অনুষ্ঠান হবে। পুরো বাড়িটা সাজানো হবে কাচা ফুল দিয়ে। আর প্রত্যেক জায়গায় লেগে থাকবে অনুর প্রিয় ফুলের ঘ্রাণ। পুরো বাড়িটা লাইটিং করা হবে। যাতে এলকার লোকজনের চোখে বিস্ময় লেগে যায়। রিয়াদ কাজল রেখার দিকে তাকিয়ে বলে,
– আম্মা বাসার ডেকোরেশন হবে জমকালো। এলাকার লোকজনদের কে দেখিয়ে দিবো তারা এতো কিছু করেও আমার বোনের বিয়ে আটকাতে পারেনি। আর আমার বোনকে আমরা কোনো নর্দমায় ফেলে দিচ্ছি না। উপযুক্ত ছেলের হাতেই তুলে দিচ্ছি। প্রিতি হেসে বলে,
– ভাইয়া ওদেরকে মুখ দিয়ে অপমান করার দরকার নেই। বুদ্ধিমান লোকদের অপমান করতে কিছুর প্রয়োজন হয়না। আশা করি বিয়ের আয়োজন দেখেই সবার চোখা মুখ বোচা হবে।
রিমি কোনো দায়িত্ব নেয় নি। তার মন খারাপ। কার বিয়েতে থাকবে বুঝতে পারছে না রিমি। একদিকে নিজের ভাই অন্যদিকে প্রিয় ননদিনী। একজনকে ছেড়ে আর একজনকে ধরতে পারছে না। কাজল রেখা রিমিকে দেখে বললেন,
– বউমা তুমি এতো চিন্তা করছো কেন বলোতো?
– আমি বুঝতে পারছি না কার বিয়েতে থাকবো। এখানেও থাকতে মন চাইছে আবার বাসায় যেতেও মন চাইছে। আমি এখন কি করবো মা? প্রিতি বলে,
– আমি তোমাকে ভালো আইডিয়া দিতে পারি ভাবি।
– তাহলে দিচ্ছ না কেন? তাড়াতাড়ি আইডিয়াটা বলো শোনি। রিমির অবস্থা দেখে রিয়াদ হাসে। বেচারি পড়ছে গেঁড়াকলে। প্রিতি বলে,
– যেদিন গায়ে হলুদ হবে সেদিন তুমি চলে যাবে তোমাদের বাসায়। ইমন ভাইয়ার হলুদ অনুষ্ঠান শেষ করে হলুদ নিয়ে চলে আসবে আমাদের বাসায়। তখন আপুর হলুদ হবে। তুমি দুইটায় উপভোগ করবে। পরদিন বিয়ে। সেদিন আমাদের বাসায় থাকবে। কারণ, সেদিন সবাই এখানেই আসবে। এখানে বিয়ের সম্পূর্ণ কাজ শেষ হলে যাওয়ার সময় তুমিও তাদের সাথে চলে যাবে। তারপরদিন তোমাদের বাসায় অনুষ্ঠান হবে। এভাবে তুমি দুইটাই উপভোগ করলা। প্রিতির আইডিয়া রিমির ভালো লাগে। রিমি বলে,
– দ্যাটস গুড আইডিয়া। আমার ভালো লেগেছে। আমি তাই করবো। কাজল রেখা হাসেন। রিয়াদ বলে,
– তোমার ভাইয়ের বিয়ে আমাকে কিন্তু কেউ দাওয়াত দেয়নি। আমি কিন্তু যাবো না।
– তোমাকে বললেও যাবে না। তাই বলবও না।
– বললে চিন্তা করে দেখতাম। যেহেতু আমাকে কেউ বলেনি সো যাওয়ার প্রশ্নই আসে না।
– শোন আমি জানি তোমাকে দাওয়াত না দিলেও ৩ তারিখ তুমি ঠিকই আমাদের বাসায় চলে যাবে। এজন্য দাওয়াত দেইনি। রিয়াদ চোখ বড় বড় করে। ঠিক মারটাই দিয়েছে রিমি।
মেঘের ঘুম ভাঙ্গে বিকেলের দিকে। অবাক মেঘের একপাশে বসে মোবাইল টিপতে থাকে। মেঘ বিছানায় গড়াগড়ি করতে গেলে মেঘের হাত লেগে অবাকের হাত থেকে মোবাইলটা মোবাইলটা ছিটকে যায়। অবাক হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা ধরতে নিলে নিজেও নিচে পড়ে যায়। মেঘ ধরফরিয়ে উঠে বসে। নিচে তাকিয়ে দেখে অবাক নিচে পড়ে আছে। মেঘ চোখ কচলে বলে,
– একি আপনি নিচে শুইলেন কেন? বিছানায়তো জায়গা আছে। আসুন বিছানায় আসুন। অবাকের রাগ উঠে। বেয়াদব মেয়ে। নিজে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে আবার বলছে নিচে শুইছেন কেন? অবাকের ইচ্ছে করছে একটা চড় মেরে মেঘের মুখ বাকিয়ে দিতে। অবাক উঠে বসে বলে,
– আল্লাহ এই মেয়েটাকে তুমি কোথায় থেকে আমার কাছে নিয়ে এসেছো?
– আপনি আমার বাসা চিনেন না? এখান থেকে গিয়ে আমি আপনাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো কেমন। এখন উঠুন তো। অবাক মেঘের হাত ধরে টেনে তুলতে নিলে অবাক মেঘের হাত ছাড়িয়ে বলে,
– সরো। আমাকে ফেলে দিয়ে আবার আসছো টেনে তুলতে। মেঘ বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
– ওমা আমি কখন ফেলে দিলাম? আমি কিছু করি নি। অবাক মোবাইলটা হাতে নিয়ে বলে,
– না তুমি কিচ্ছু করো নি। আমাকে একটা পেত্নী ফেলে দিয়েছে। ভাগ্যিস মোবাইটার কিছু হয়নি। নাহলে আজ আর পেত্নীটার খবর করে দিতাম। মেঘ কাঁদো কাঁদো ভাব নিয়ে বলে,
– আপনি আমাকে পেত্নী বললেন? আমাকে পেত্নীর মতো লাগছে?
– তোমাকে পেত্নী বলতে যাবো কেন? আমাকে যে ফেলে দিয়েছে আমি তাকে পেত্নী বলেছি। মেঘ ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে দেয়। অবাক বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
– নিচে পড়ে ব্যথা পেলাম আমি। আর কাঁদছো তুমি। আজব মেয়ে। মেঘ দুহাত দিয়ে চোখ কচলে বলে,
– আমি আম্মাকে বলবো আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসে বকা দিয়েছেন। অবাক কপালে হাত দিয়ে বলে,
– আল্লাহ এখানেও আম্মা। এই মেয়ে এতো ব্রেকমেইল করে কেন সব সময়। রুমের কলিং বেল বাজছে। অবাক মেঘের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
– শোন এখন আর কেঁদো না। কেউ হয়তো এসেছে।
– আপনি যে আমাকে পেত্নী বলেছেন?
– আরে তোমাকে বলিনি। তুমি পেত্নী হবে কেন? তুমিতো কিউট কিউট নাদান বাচ্চা। এখন কান্না বন্ধ করলে আমি তোমাকে এখানের বিখ্যাত আচার খাওয়াবো। মেঘ চোখ মুছে বলে,
– আচ্ছা তাহলে আর কাঁদবো না। অবাক দরজা খুলে দেখে সাকিল দাঁড়িয়ে আছে। অবাক বলে,
– ভেতরে আসো।
– অবাক সাহেব ফ্রি থাকলে চলুন সবাই মিলে পশ্চিম বীচে গিয়ে বসি।
– চলুন।
চলবে—–