#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ২২
সুরমা

অবাক আর মেঘ সেন্টমার্টিনের জন্য বের হয়। রিসোর্টের সামনে এসে দেখে সাকিল আর প্রমি দুজন একসাথে বসে আছে। মেঘ কিছু না বলে দৌঁড়ে তাদের কাছে যায়। প্রমি মেঘকে দেখে বলে,
-কি ব্যাপার। এখনও একা? মেঘ মন খারাপ করে বলে,

-না আপু। উনিও আছে। আমরা চলে যাচ্ছি। প্রমি বসা থেকে উঠে বলে,
-বাসায় চলে যাচ্ছ নাকি?
-না। সেন্টমার্টিন যাচ্ছি।
-ও আচ্ছা। আমরাও যাবো। তবে কাল সকালে। ভাগ্যে থাকলে আবার দেখা হবে।
-ওকে আপু আসি। উনি দাঁড়িয়ে আছেন।
-আচ্ছা যাও। ভালো থেকো।

-তোমরাও ভালো থেকো আপু। মেঘ আবার অবাকের কাছে ফিরে আসে। অবাক জিজ্ঞেস করে,
-আজব! কিছু না বলে কোথায় দৌঁড় মেরেছিলে?
-প্রমি আপু আর সাকিল ভাইয়াকো বলে আসলাম আমরা চলে যাচ্ছি।
-এই সাকিল ভাইয়া আর প্রমি আপুটা কে?
-সেদিন রাতে আমরা যাদের সাথে ডিনার করেছিলাম। ওরা।

-তুমি ওদের কিভাবে চিনো?
-আজ সকালে ওদের সাথে সমুদ্রে ঘুরতে গেছিলাম। তখন পরিচিত হয়েছি। অবাক কিছুক্ষণ মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেঘ মুখ কালো করে বলে,
– পানিতে একটু সাঁতারও কাটতে পারলাম না। অবাক মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
– তুমি কি সাঁতার জানো যে সাঁতার কাটার কথা বলছো?

– জানি নাতো কি হয়েছে। আপনি আমাকে শক্ত করে ধরে রাখতেন। আর আমি হাত পা নাড়াচাড়া করতাম। বিস্ময়ে অবাকে চোখ বড় হয়ে যায়।
– আমি তোমাকে ধরে রাখবো?
– হুম
– হাউ ফানি। কখনই এটা করবো না।
– কেন করবেন না?

– কেন কথার উত্তর নেই। চলো। অবাক টেকনাফ যাওয়ার জন্য মাইক্রো রিজার্ভ করে। রিসোর্টের সামনে মাইক্রো দাঁড় করানো। অবাক আর মেঘ মাইক্রোতে উঠে। কিছুদূর যেতেই মেঘ খেয়াল করে অনেক লোক জিপগাড়িতে উঠছে। মেঘ আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করে,

– ওরা জিপে করে কোথায় যাচ্ছে?
– টেকনাফ
– তাহলে আমরা মাইক্রো দিয়ে যাচ্ছি কেন? অবাক মেঘের দিকে তাকিয়ে বলে,
– এটা কেমন প্রশ্ন? যে যেভাবে পারে সেভাবে যায়। কেউ বাস, কেউ জিপ কেউ মাইক্রো দিয়ে যাচ্ছে।
– আমরাও জিপগাড়ি দিয়ে যাবো। অবাক চোখ ছোট করে মেঘের দিকে তাকায়। মেঘ অবাকের বাহু ঝাকিয়ে বলে,

– চলুন না আমরাও জিপে করে যাই। চলুন না। অবাক চোখ লাল করে তাকালে মেঘ অবাকের হাত ছেড়ে দেয়। ভয়ে ভয়ে বলে,
– আমার কোনো ইচ্ছেই আপনি পূরণ করেন না। মেঘ গাল ফুলিয়ে বাহিরের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।

অবাকের গাড়ি এসে থামে টেকনাফ। মেঘ গাড়ি থেকে নেমে দেখে চারপাশে ট্রলার আর পিচবোর্ড। কিছু ট্রলার আর পিচবোর্ড টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিনের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। নদীর উত্তাল ঢেউয়ের কারণে ট্রলার গুলো হেলেদোলে যাচ্ছে।

দৃশ্যটা দেখে মেঘের শরীর কেঁপে উঠে। মেঘ এক দৌঁড়ে অবাকের কাছে গিয়ে হাঁপাতে থাকে। অবাক গাড়ির ভাড়া মিটাতে গিয়ে মেঘকে খেয়াল করে। অবাক কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘ জিজ্ঞেস করে,
– অবাক বাবু আমরা কি দিয়ে সেন্টমার্টিন যাবো?
– ট্রলারে যাবো। তুমি চাইলে পিচবোর্ডেও যাওয়া যায়। এবার মেঘের শরীরের লোমকূপ গুলো নাড়া দিয়ে উঠে। মাঝপথে গিয়ে যদি ট্রলার বা পিচবোর্ড ডুবে যায় তাহলে নির্ঘাত মৃত্যু। মেঘ অসহায় ভঙ্গিতে বলে,

– আমি যাবো না। ট্রলার আমার ভয় করে। অবাক ব্যাগপত্র নিয়ে এগিয়ে যায়। মেঘ অবাকের পেছনে প্রায় দৌঁড়াতে থাকে আর বলতে থাকে,
– আপনি শোনতে পাচ্ছেন না? আমি ট্রলারে যাবো না। অবাক হাঁটতে হাঁটতে বলে,
– তাহলে পিচবোর্ড আছে।
– আমি পিচবোর্ডেও উঠবো না। আমি সাঁতার জানি না। অবাক দাঁড়ায়।

– সাঁতার জানো না তো কি হয়েছে? ট্রলার বা পিচবোর্ডের সাথে সাঁতার জানা না জানার কি সম্পর্ক?
– যদি ট্রলার বা পিচবোর্ড ডুবে যায় তখন কি করবো?
– তখন পানিতে সাঁতার কাটবে। কক্সবাজার তো পানিতে সাঁতার কাটার ইচ্ছে টা আমি পূরণ করতে পারিনি। তখন না হয় পূরণ হবে। মেঘ কাঁদো কাঁদো হয়ে যায়। তার চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা জলও গড়িয়ে পড়ে। অবাক মেঘের চোখের পানি দেখে বিচলিত হয়ে যায়।

– আরে কাঁদছো কেন? কান্না করার কি আছে? আজব তো। ট্রলার ভ্রমণ এডভেঞ্চার হবে। তোমার খুব ভালো লাগবে। আর আমি তো আছি নাকি? এবার মেঘের কান্না আরো বেড়ে যায়। সে নাক টেনে বলে,
– আমি মরতে চাইনা। আমি যাবো না।
– এখানে মরার কথা আসছে কোথায় থেকে?

– আমি ট্রলারে যাবো না। আমি লঞ্চে যাবো।
– এখন লঞ্চ পাওয়া যাবে না। লঞ্চ সকাল নয়টা সাড়ে নয়টায় ছাড়ে। আর ট্রলার ভ্রমণ আমি করেছি। লঞ্চের থেকে বেশি মজা পাবা। মেঘ নাছোড়বান্দা কণ্ঠে বলে উঠে,
– আমি যাবো না মানে যাবো না। আপনি আমাকে রিসোর্টে নিয়ে যান। নাহলে আমি চিৎকার করে কাঁদবো।

অনু বসে আছে পাত্রপক্ষের সামনে। তারা ২টার দিকে অনুদের বাসায় আসে। ছেলে, তার মা, বোন, ভাবি, দুলাভাই এসেছে। সবার মুখ কেমন কালো হয়ে আছে। সকাল থেকে বাসায় যতটা জমজমাট ভাব ছিল সেটা এখন আর নেই। পাত্রপক্ষের কিছু কথা শোনে অনুদের বাসার সবার মুড অফ হয়ে যায়। রিয়াদও চুপ করে মাথা নিচু করে একপাশে বসে থাকে। ছেলের মা আবার বলেন,

-দেখুন আপনার মেয়ের আগে এক ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল। আপনাদের প্রতিবেশীরা বলল সেই ছেলে নাকি আপনাদের বাসায়ও এসেছে। আবার ছেলে মেয়েকে এক সাথে ঘুরাঘুরিও করতে দেখেছে। তাদের সম্পর্কও অনেক গভীর ছিল। আমরা তো জানি ছেলেমেয়েরা প্রেম ভালোবাসার নামে কি করে বেড়ায়। আমি জেনে শোনে এমন একটা মেয়েকে ঘরে তুলতে পারবো না। রিয়াদ ফুসে উঠে।

-দেখুন, আপনারা অনেক্ষণ ধরে আমার বোনের নামে যা নয় তা বলে যাচ্ছেন। আমরা সব মুখ বুজে শোনছি। এখন আর চুপ করে থাকতে পারছি না। আপনারা একের পর একজন আমার বোনের দিকে খারাপ ইঙ্গিত দিচ্ছেন। আমরা তো আপনাদের ছেলের ঘাড়ে আমার বোনকে চাপিয়ে দিচ্ছি না। আপনারা নিজে থেকেই এসেছেন।

-আপনার বোনের নামে আমরা কোনো খারাপ ইঙ্গিত করছি না। যা সত্যি তাই বলছি। আপনারা অস্বীকার করতে পারবেন আপনার বোন অন্য একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল না? দিনরাত ছেলেটার সাথে ঘুরতে যায় নি?

-আমরা তো অস্বীকার করছি না। আমার বোনের একটা সম্পর্ক ছিল। তাই বলে যে সে খারাপ এটা তো আপনারা বলতে পারেন না।
-এই কথা আমাদের আগে জানালেই পারতেন। আমরা কষ্ট করে তাহলে আর আসতাম না।

-এখন যখন জেনেছেন তখন বসে থেকে এতো কথা না বলে চলে গেলেই তো পারেন। আপনাদের কোনো রাইট নেই আমার বোনের দিকে খারাপ ইঙ্গিত করার। মুখ বন্ধ রেখে সসম্মানে চলে যান। রিয়াদের কথা শোনে পাত্রপক্ষের সবাই উঠে পড়ে। ছেলের দুলাভাই বলে,

-আমাদের এভাবে এনে অপমান না করলেও পারতেন। আর আমরা মুখ বন্ধ রাখলেও প্রতিবেশীরা কিন্তু মুখ বন্ধ করে রাখবে না। তারা যা দেখেছে তা বলবেই। আর কুকথা কখনও ঢেকে রাখা যায় না। রাগে দুঃখে রিয়াদের চোখ লাল হয়ে যায়। অনু মাথা নিচু করেই বসে থাকে। কাজল রেখা বলেন,

-আমি এই ভয়টাই পাচ্ছিলাম। আমার মেয়েটাকে আর বিয়ে দিতে পারবো না। আজ একজন এসে অপমান করে গেলো। কাল যখন অন্য কেউ আসবে তারাও এসব কথা বলবে। মান সম্মান যা ছিল সব শেষ। অনুর সাথে সাথে প্রিতির জীবনটাও নষ্ট হয়ে যাবে। আজ প্রতিবেশী, কাল সমাজের সবাই আঙ্গুল তুলবে। কাজল রেখা হতাশা প্রকাশ করেন। প্রিতি বললো,

-আম্মু এতে আপুর দোষ কোথায়? আপু তো খারাপ কিছু করেনি। একজনকে ভালোবেসেছিল। স্বয়ং আল্লাহ চায়নি বলেই বিয়েটা হয়নি। তাছাড়া সব ছেলেরা কি এক? যে ছেলে সব জেনে শোনে বিয়ে করবে তার সাথেই হবে।
-রিলেশনের কথা শোনলে এখন কোনো ছেলেই বিয়ে করতে চাইবে না। এখন রিলেশন গুলোকে কেউ ভালোচোখে দেখে না। সবাই খারাপ নজরে দেখে।

‘আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি অনুকে বিয়ে করতে চাই।’

কাজল রেখার কথা শেষ হতে না হতেই ধ্বনিটা এসে সবার কানে লাগে। সবাই চমকে তাকায়। অনুর বুকটা হঠাৎ করেই ধক করে উঠে। সবাই সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে ইমন তাদের থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। ইমনকে দেখে রিমি বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। ইমন এগিয়ে এসে কাজল রেখার সামনে দাঁড়িয়ে আবার বলে,

– আমি সব কিছু শোনেছি। আপনাদের সবার যদি মত থাকে তাহলে আমি অনুপমাকে বিয়ে করতে চাই। রিমি ইমনের হাত টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে বলে,
– ভাই, তুই এসব কি বলছিস? সব বুঝে বলছিস তো? ইমন বিস্মিত চোখে তাকিয়ে বলে,
– কেন আপু? তোর কি এই বিয়েতে আপত্তি আছে?
– আপত্তির কথা আসছে না। কিন্তু তুই কি বলছিস তা জেনে বুঝে বলছিস কিনা সেটা আগে জানার দরকার।

– আমি সব জেনে বুঝে স্বজ্ঞানে বলছি। আর তোর আপত্তিটা কোথায় সেটা বল শোনি। আমি অনুপমার যোগ্য না নাকি অনুপমা আমার যোগ্য না? কোনটা?
– ভাই, অনুর অবাকের সাথে সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিন। এটা তুই জানিস?
– জানি। এখন কি একটু আগে আসা পাত্রপক্ষদের মতো তোরও মনে হচ্ছে অনু ভালো মেয়ে না?
– না। আমি এটা মিন করছি না। অনুর মতো মেয়ে হয়না। ও মেয়ে হিসাবে রত্ন। তুই যদি সত্যি মন থেকে ওকে বিয়ে করতে চাস তাহলে আমি বলবো তুই ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছিস। আর বিয়েটা যদি হয় তাহলে আমি বলবো তোর ভাগ্যটা খুব ভালো। লাকি ভাগ্য। অনুর মতো মেয়ে সব ছেলের ভাগ্যে থাকে না। আমি শুধু যাচাই করতে চাইছি তুই সব কিছু নিজ থেকে জেনে বুঝে বলছিস কিনা। তোর মত থাকলে আমি নিজেই বাসায় কথা বলবো।

অবশেষে অবাক মেঘকে নিয়ে রিসোর্টে ফিরে আসতে হয়। অবাক মেঘকে জোর করে ট্রলারে তুলেছিল। ট্রলারে লোকজনে ভর্তি। ট্রলারে পা রাখতেই মেঘের মনে হলো ট্রলার এদিকওদিক হেলে যাচ্ছে। এই বুঝি ট্রলার লোকজনসহ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। মেঘ চোখ বন্ধ করে অবাককে জড়িয়ে ধরে জোরে চিৎকার করতে শুরু করে । ট্রলারের লোকজন মেঘের কাণ্ড দেখে প্রথমে বিস্মিত হলেও পরে সবাই হাসাহাসি শুরু করে।

বাধ্য হয়ে অবাক মেঘকে নিয়ে ট্রলার থেকে নেমে আসে। আবার গাড়ি ঠিক করে কক্সবাজার ফিরে আসে। কারণ, অবাক বুঝতে পেরেছে মেঘকে নিয়ে এতো এডভেঞ্চার ভ্রমণ ঠিক হবে না। মেঘ প্রচণ্ড পরিমাণ ভয়ে আছে। মেঘের স্থির হতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগে। ট্রলার থেকে নামার পরও তার শরীর থরথর করে কাঁপছিল। অবাক রুমে এসে দেখে মেঘ বিছানায় বসে বিড়বিড় করছে। অবাক স্বাভাবিক ভাবে জিজ্ঞেস করে,

-এখনও ভয় লাগছে? মেঘ অবাকের দিকে তাকিয়ে মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে,
-ভয় লাগবে না। আরেকটু হলে আমি তো মরেই যাচ্ছিলাম। মেঘের কথা শোনে অবাক হো হো করে হেসে দেয়। অবাকের হাসি দেখে মেঘের মুখটা করুণ হয়ে যায়। সে করুক স্বরে বলে,

-আমি মরে যাবো শুনে আপনি হাসছেন? অবাকের আরো হাসি পেলো। কিন্তু এখন হাসলে ভয়ংকর ব্যাপার হবে। অবাক নিজের হাসি আটকে বলে,
-ট্রলারে উঠলেই কেউ মরে যায় না। তুমি ভয় পাচ্ছ তাই এমনটা মনে হয়েছে।
-আপনি সাংঘাতিক লোক। নাহলে আমাকে ট্রলারে করে সেন্টমার্টিন নিয়ে যেতেন না। অবাক আবার হেসে দেয়। মেঘ বলে,

-আপনি কি আমাকে পানিতে ফেলে মারার প্ল্যান করেছিলেন? মেঘের কথা শোনে অবাকের মুখটা কালো হয়ে যায়। এভাবে কেউ কথা বলতে পারে অবাকের জানা নেই। অবাক কিছুটা রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,

-তোমাকে মারার প্ল্যান থাকলে অবশেষে রিসোর্টে ফিরে আসতাম না। আর ট্রলার ভর্তি লোকজন ছিল। কোনো খুনি পাবলিকের সামনে খুন করে না। মেঘ ভালোই বুঝতে পারছে অবাক রেগে গেছে। আর সেও কথাটা ঠিক এভাবে বলতে চায়নি। মেঘের চোখে পানি চলে আসে। মেঘ কান্না ভরা কণ্ঠে বলে,
-সরি। অবাক মেঘের দিকে তাকায়। মেঘের করুণ স্বরটা অবাকের বুকে গিয়ে লাগে। মেঘের এমন করুণ কণ্ঠস্বর অবাকের ভেতরে জন্ম নেওয়া সব রাগ ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলে। সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে মেঘ এক্ষণি কেঁদে দিবে। অবাক শীতল কণ্ঠে বলে,
-ঠিক আছে। আমি কিছু মনে করি নি।

অনু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে। কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইমন। অনু বাহিরের দিকে তাকিয়ে বলে,
-আপনি জানেন আমার একজনের সাথে রিলেশন ছিল। তারপরও কেন আমাকে বিয়ে করতে চাইছেন? ইমন মৃদু হাসে। অনু বিস্মিত চোখে ইমনের দিকে তাকায়। ইমন বলে,

– কারণটা তুমি খুব ভালো করেই জানো অনু। তুমি যাকে ভালোবাসো তার সাথে যদি আজ তোমার বিয়ের কথা হতো তাহলে আমার কিছু করার ছিল না। আমিতো তোমার আশা ছেড়েই দিয়েছিলাম। তোমাকে ছেড়ে অনেকদূর চলেও গিয়েছিলাম। মনে করেছিলাম দূরে চলে গেলে হয়তো তোমাকে ভুলে যেতে পারবো। কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম।

ভালোবাসা সম্পূর্ণ মনের ব্যাপার। কাছে থাকা বা দূরে যাওয়ার সাথে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আর আল্লাহ মনে হয় তোমাকে আমার কপালে লিখে রেখেছিল। তাই হয়তো আমি আরো একটা সুযোগ পেয়েছি। অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ইমন রেলিং এ হেলে দাঁড়ায়।

-তবুও তোমার মতামত জানতে চাই। আমাকে বিয়ে করতে কি তোমার কোনো আপত্তি আছে? থাকলে আমাকে নির্দ্বিধায় বলতে পারো। অনু দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
-আমার এখন কোনো কিছুতেই আপত্তি নেই। আম্মু ভাইয়া আছে। ওরা যা সিদ্ধান্ত নিবে তাই।

-অনুপমা আমি কখনও তোমার উপর জোর কাটায় নি। ভবিষ্যৎ এও কাটাবো না। আর আমি আমার সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করবো তোমাকে সুখি করার। তবে বলতে পারবো না তোমাকে সুখি করতে পারবো কিনা। কিন্তু আমি চেষ্টার ত্রুটি রাখবো না। অনু চুপ করে থাকে। ইমন নিচে নেমে আসে। কাজল রেখা, রিয়াদ, প্রিতি রিমি এখনও ড্রয়িংরুমে বসে আছে। তবে কেউ কোনো কথা বলছে না। ইমনকে আসতে দেখে প্রিতি বসা থেকে উঠে যায়। ইমন গিয়ে কাজল রেখার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,

-আন্টি আপনাদের যদি আপত্তি না থাকে তাহলে সামনের সপ্তাহেই বিয়ের কাজটা শেষ করতে চাই।
কাজল রেখা বলেন,

– ইমন আমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলে দেখি। গুরুজন ছাড়াতো কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না। আর অনু আমার খুব আদরের মেয়ে। আমার খুব ইচ্ছে ছিল দুমদাম করে অনুর বিয়ে দিবো। তাই সবার মতামত নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের আয়োজন করবো ইমন মাথা নিচু করে। নিজের একহাত দিয়ে আরেকহাত কচলে বলে,

– আচ্ছা ঠিক আছে। আপনারা যেমন মনে করবেন। আমি মা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে কাল আবার আসবো। উনারা অনুপমাকে ঘরের বউ করে তুলতে আপত্তি করবেন না। আজ আমি আসি। ইমন বিদায় নিয়ে চলে যায়।

অনু আগের মতই দাঁড়িয়ে থাকে। আজ সব কিছু অন্যরকম লাগছে। জীবনটাকে অচেনা লাগছে। ইমনকে নিয়ে কখনই এরকম কল্পনাও করেনি। কখনও মনেও হয়নি এই মানুষটা তার জীবনের সাথে যুক্ত হতে পারে। আজ অনুর মনে পড়ছে ইমনের সাথে দেখা হওয়া প্রথম দিনগুলোর কথা।

তার ভাই রিয়াদ কেবল নতুন বিয়ে করেছে। ইমনদের বাসায় একদিন রিয়াদ আর রিমি বেড়াতে যায়। সাথে অনুকেও নেয়। তখন অনু খেয়াল করেছে ইমন সুযোগ পেলেই তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে। বিষয়টা অনুর কাছে বিরক্তিকর লাগে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতেও পারছিল না।

দুদিন থাকার পর সবাই বাসায় চলে আসবে এমন সময় ইমন অনুকে একা পেয়ে প্রপোজ করে বসে। অনু অনেকটা বিস্মিত হয়েছিল সেদিন। কারণ, এভাবে কেউ কাউকে প্রপোজ করে অনুর জানা ছিল না। এর আগে অনুর সাথে ইমন কোনোরকম কথাও বলেনি। প্রথম কথায় প্রপোজ করে ফেলে। অনু তখন ইমনের প্রপোজাল রিজেক্ট করে। তার প্রধান কারণ ছিল অবাক। তখন অবাকের সাথে তার রিলেশন অলরেডি চলছিল। অনু নিঃসঙ্কোচে ইমনের কাছে অবাকের কথা বলে। সেদিনের পর অনু আর ইমনদের বাসায় যায় নি। কিছুদিন পর ইমনও দেশের বাহিরে চলে যায়। এর পর আর দুজনের কথা হয়নি।

অনু হঠাৎ করেই চমকে উঠে। প্রিতি বলে,
– আপু ইমন ভাইয়াকে তোর বিয়ে করতে কি আপত্তি আছে? অনু হ্যাঁ না কোনো উত্তর দেয়না। প্রিতি আবার বলে,
– ইমন ভাইয়া কিন্তু খারাপ না। দেখতে সুন্দর। আর আমার মনে হয় ইমন ভাইয়া তোকে খুব ভালোবাসবে। এবারো অনুর রেসপন্স পাওয়া গেলো না। এবার প্রতি টপিক চেঞ্জ করে বললো,

– আপু তুই এভাবে চমকে গেলি কেন?
– হঠাৎ করে এভাবে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলে তো চমকানোরেই কথা।
– আমিতো কতবারই তোকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছি। তবে আর বেশিদিন হয়তো এই সুযোগটা পাবো না।
– কেন পাবি না?

– তোর বিয়ে হয়ে গেলেতো এ বাড়ি থেকে তুই চলে যাবি। তখন কি আর ইচ্ছে হলেও পারবো? অনু কথা বলে না। তবে তার চোখে পানি চলে আসে। প্রিয়জনদের থেকে আলাদা হতে হবে ভেবেই অনুর বুক কেঁদে উঠে। তখন চাইলেও মা, ভাইবোনকে দেখতে পারবে না। মহান আল্লাহর কি নিয়ম। জন্মের পর যাদের কাছে থেকে এতো ভালোবাসা আদর পেলো সব ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে।

সেই ঠিকানায় কোন সুখ পড়ে আছে তা স্বয়ং আল্লাহ জানেন। প্রিতি অনুর কাঁধে নিজের চিবুক রাখে।
– আপু তোর বিয়ে হয়ে গেলে কি আমাদের ভুলে যাবি? আমাদের মিস করবি না? প্রিতির কথা শোনে অনু নিঃশব্দে কেঁদে উঠে। তার শরীরে কাঁপুনি তৈরি হয়। প্রিতি ভালোই বুঝতে পারছে অনু কাঁদছে। প্রিতি অনুকে নিজের দিকে ঘুরায়। অনু এক ঝটকায় প্রিতিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়। প্রিতিও কেঁদে উঠে।

বিকেলের দিকে অবাক নিজ থেকে মেঘকে সমুদ্রের পাড়ে ঘুরতে নিয়ে আসে। লোকজন সমুদ্রের পানিতে সাঁতার কাটছে। ছুটাছুটি করছে। সমুদ্রের চারপাশ লোকজনে ভরপুর হয়ে আছে। যেদিকে তাকায় শুধু মানুষ আর মানুষ। এসব দেখে মেঘের খুব ভালো লাগছে। মেঘ অবাকের দিকে তাকিয়ে বলে,

-আমিও পানিতে ভিজবো। অবাক স্বাভাবিকভাবে বলে,
-আচ্ছা যাও ভিজো। তবে শরীরে জ্বর আসলে আমি দায়ী না। মেঘের মন খুশিতে ভরে উঠে। সমুদ্রের পানিতে উত্তাল ঢেউ। কিছুক্ষণ পর পর ঢেউ এসে লোকজনকে ডুবিয়ে দিচ্ছে। যারা পাড়ের দিকে বসে আছে তাদের মাথার উপর দিয়ে ঢেউ উপরে চলে যাচ্ছে। এতো ঢেউ দেখে মেঘের কিছুটা ভয়ও লাগছে।

যদি ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে যায়! তবে সমুদ্রের পানিতে গাঁ ভিজিয়ে নেওয়ার তীব্র ইচ্ছাও দূর হচ্ছে না মন থেকে। মেঘ মুখটা অসহায় করে বলে,
-আপনিও চলুন। আমি একা ভিজবো না।
-একা ভিজবে কেন? দেখো কতো লোকজন ভিজতেছে। তুমিও তাদের সাথে ভিজবে। তবে গভীরে যাবে না। কিনারায় থাকবে। আমি এখানেই দাঁড়িয়ে আছি। মেঘ বায়না করে,

-আপনিও চলুন। আমার একা ভয় লাগে। চলুন না। মেঘ অবাকের হাত ধরে টানতে শুরু করে। বাধ্য হয়ে অবাকও পানিতে নামে। মেঘ হাটু পর্যন্ত পানিতে নেমেই পানির সাথে খেলা করতে থাকে। এই প্রথম মেঘ সমুদ্রের পানিতে নেমেছে। তার আনন্দ কে দেখে। অবাক প্যান্ট হোল্ড করে নামে। মেঘের আবদার রাখতে এই পদ্ধতি। নাহলে অবাকের সমুদ্রে নামার ইচ্ছে ছিল না।

অবাক মেঘের থেকে হাত দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে মেঘের কাণ্ড গুলো দেখতে থাকে। মেঘ সমুদ্রের পানিতে ভিজে একাকার। একটা ঢেউ এসে মেঘের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। স্রোতের পানিতে অবাকও ভিজে যায়। আচমকা ঢেউ আসার কারণে মেঘের পেটে কিছুটা পানিও ঢুকে যায়। এমনকি স্রোতের টানে মেঘ কিছুটা গভীরেও চলে যায়।

মেঘ খেয়াল করে দেখে দূরে থেকে আরো একটা ঢেউ উপরে উঠে আসছে। মেঘ চিৎকার শুরু করে দেয়। অবাক বিচলিত হয়ে দৌঁড়ে এগোয়।
-কি হয়েছে? চিৎকার করছো কেন? মেঘ আচমকা অবাকের বুক জড়িয়ে ধরে বলে,

-আমাকে শক্ত করে ধরে রাখুন। নাহলে ঢেউ আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমাকে ধরে রাখুন। অবাক হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারলো না। এই মেয়ে এতো ভয় পায় আবার আসছে সাঁতার কাটতে। অবাক মেঘকে জড়িয়ে ধরার আগেই ঢেউ তাদের একসাথে ভিজিয়ে দিয়ে যায়। মেঘ অবাকের বুকে মুখ গুজে। স্রোত নেমে গেলে মেঘ হাঁপাতে হাঁপাতে বলে,

-মাগো মা। কি ঢেউ। আরেকটু হলেতো আমাকে নিয়েই যেতো। মেঘের কাণ্ড দেখে অবাক হেসে দেয়। মেঘ মুখটাকে বাচ্চাদের মতো করে বলে,
-হাসছেন কেন? অবাক হাসি আটকিয়ে ফেলে।
-তুমিতো অনেক সাহসী। তাই আমি হাসছি।

সূর্য পশ্চিম দিকে হেলে গিয়েছে। সূর্যের লাল আবরণ পানির উপর পড়তেই পানি চিকচিক করে উঠে। সূর্য অস্ত যাওয়ার দৃশ্য যে এতো সুন্দর হয় তা মেঘ কখনও কল্পনা করেনি। এমন একটা মনোমুগ্ধকর দৃশ্য মেঘের হৃদয় ঠাণ্ডা করে দেয়।

চলবে——

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here