#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ১৩
সুরমা

অনু কাঁদছে। মুখ চেপে কাঁদছে। চোখ দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে। আজকে তার জীবনের সব স্বপ্ন সব চাওয়াপাওয়ার চির সমাপ্তি হলো। যাকে এতদিন ভালোবাসলো আজ থেকে সেই মানুষটা অন্য একটা মেয়ের ঘর। অন্য একজন মানুষের বর।

প্রিয়মানুষটাকে আর কখনও নিজের বলে দাবী করা যাবে না। তার কথা চিন্তা করাও এখন পাপ। অথচ এক সময় এই মানুষটাকে তার জীবনের সব উজাড় করে দিয়েছিল। এই মানুষটাকে নিয়ে দিন রাত স্বপ্ন দেখতো।

অনু রেলিং শক্ত করে চেপে ধরে তাতে মাথা ঠেকায়। আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ। চাঁদের আলোয় চারপাশ ঝলমল করছে। রাত গভীর থেকেও গভীর হচ্ছে। দুটো চোখে আজ ঘুম নেই। মনে শান্তি নেই। অনু ভাবনায় মগ্ন।

কারো স্পর্শে হঠাৎ অনু চমকে উঠে। পিছনে তাকিয়ে দেখে প্রিতি দাঁড়িয়ে আছে। অনু তাড়াতাড়ি নিজের ভেজা চোখ মুছে ফেলে। কাঁপা কণ্ঠে বলে,,,
– এতো রাতে তুই কি করছিস?

– প্রশ্নটাতো আমার। এতো রাতে তুই এখানে কি করছিস? অনু প্রিতির দিকে তাকায় নি। মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
-ঘুম আসছেনা। তাই এখানে এসে চাঁদ দেখছিলাম।

– আপু তোর এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় লাগছে না? প্রিতির কথা শোনে অনু প্রিতির দিকে ফিরে তাকায়। প্রিতির চোখে ঘুম লেগে আছে। অনু চাপা হেসে বলে,,,,,
– কিসের ভয়?

– ভূতটুত যদি আসে? অনু তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে,,,,,
– মৃতপ্রায় মানুষকে ভূতও ভয় পায়। যারা মরলে সব মানুষ শান্তি পায় তারা দেখবি সহজে মরবে না। তাদের যদি আবর্জনায়ও ফেলে রাখা হয় তখনও দেখবি পৃথিবীর এই অসহায় মানুষগুলো তিনটা শিরার উপর দাঁড়িয়ে থাকবে।

অনুর কথা শোনে প্রিতির মন কট্ করে উঠে। প্রিতির চোখ জলে ভরে উঠে। প্রিতি হুট করে অনুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদো হয়ে বলে,,,,,
– আপু, তুই এসব কি বলছিস? কেন বলছিস আপু? তুই মোটেও অবহেলিত না। তুই আমাদের সবার কলিজা।

তুমি আমাদের খুব প্রিয় আপু। অনু প্রায় চমকে উঠে। এতক্ষণ কি বলছিল সে? তার জন্য পরিবারের লোকজনদের কষ্ট দেওয়ার কোনো অধিকার নেই তার। কেন এসব আবেগময় কথা বলছে সে? অনু প্রিতির হাত দুটো ধরে মিথ্যা হাসি হেসে বলে,,,

-আমি জানি আমি সবার খুব প্রিয়। এখন যা গিয়ে ঘুমা।
– আপু তুইও চল। অনেক্ষণ চাঁদ দেখেছিস। আর দেখতে হবে না। প্রিতি অনুর হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসে। অনু আর কিছু না বলে চুপচাপ গিয়ে বিছানায় শোয়। প্রিতি গিয়ে অনুকে জড়িয়ে ধরে অনুর এক হাতের উপর মাথা রাখে। অনু বলে,,,,,

– ইশ এতো শক্ত করে ধরছিস কেন? ছাড়। আমারতো দম বন্ধ হয়ে যাবে।
– দম বন্ধ হবে কেন? আমিতো আলতো করে জড়িয়ে ধরছি। অনু আর কিছু না বলে চুপ করে থাকে। প্রিতি অনুর কোমড় দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে। প্রিতি মাথা তুলে অনুর মুখটা দেখে অনুর কাঁধে মাথা রেখে ফিসফিসের চেয়ে একটু জোরে বলে,,,,,

– আপু? অনু ছোট করে উত্তর দেয়,,,
– বল
– তুই খুব কষ্ট পাচ্ছিস তাইনা? অনু মাথা ঘুরিয়ে প্রিতির দিকে ফিরে। কিন্তু প্রিতির মুখ দেখা যাচ্ছে না। তার মাথা অনুর মুখ বরাবর। অনুর লুকানো ব্যথাটা চিনচিন করতে শুরু করে। সে কষ্ট চাপাদিয়ে মৃদু স্বরে বলে,,,,,

– কষ্ট পাচ্ছি না। কষ্ট পাবো কিসের জন্য?
– পাচ্ছিস তো। কেউ না জানলেও আমি জানি তুই কষ্ট পাচ্ছিস। আমি দেখেছি রাতে তুই নীরবে কাঁদিস। অবাক ভাইয়ার ছবি দেখে কাঁদিস।

সারারাত জেগে থাকিস। অবাক ভাইয়া খুব খারাপ কাজ করেছে। বেঈমানি করেছে। প্রতারক একটা। তোর সাথে অন্যায় করেছে। খুব অন্যায় করেছে। অনুর চোখ ভেয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে থাকে। বুকের ভেতরে কান্নার ঢেউ বইতে থাকে। অনুর বুকের কাঁপুনি প্রিতি ঠের পাচ্ছে। প্রিতি অনুর বুকে হাত দিয়ে বলে,,,,,,,

– কাঁদিসনা আপু। কোনো বেঈমানের জন্য দামী চোখের জল খরচ করিস না। আল্লাহ তোকে সুখি করবে দেখিস।

অনু ধরা গলায় বলে,,,,
– অবাক বেঈমান না। অবাক খুব ভালো। ওও বেঈমানি করেনি। ওও ওর মায়ের কথা রক্ষা করেছে। মায়ের আদেশ মেনেছে।

– আর তুই? তোকে কথা দেয়নি? তোর ভালোবাসার কোনোই মূল্য নাই তার কাছে? তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস?

– তুই শুধু আমার কষ্টটাই দেখছিস। ওর কষ্ট তো কেউ দেখে না। ওতো কষ্টে আছে। তাছাড়া আসল কথা হলো আল্লাহ নিজেই তো আমাদের একে অপরের জন্য সৃষ্টি করেনি। আল্লাহ চায়নি বলেই আমরা এক হতে পারেনি। অযথা একটা মানুষকে দোষ দিয়ে কি লাভ?

আল্লাহ চাইলে কেউ বাঁধা হয়ে দাঁড়াতো না। প্রিতি মাথা তুলে অনুর মুখের দিকে তাকায়। অনু তাড়াতাড়ি নিজের চোখ মুছে মৃদু হেসে বলে,,,,,,
– ঘুমা। একটু পর ভোর হয়ে যাবে। প্রিতি চোখে জল চলে আসে। সে অনুকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরিয়ে বলে,,,,,

– আপু তুই খুব ভালো। তুই খুব ভালো। পৃথিবীর মধ্যে আমার আপুনিই বেস্ট। আল্লাহ আমার এতো ভালো আপুটাকে এতো কষ্ট কেন দিলো? আল্লার প্রতি আমার অনেক অভিযোগ আছে। অনেক। অনু প্রিতিকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,,

– পাগলিটা। তুই বড্ড অবুঝ আছিস এখনও।
– আপুনিটা, আমি তোকে খুব ভালোবাসি। আমাকে যতটুকু ভালোবাসি তোকেও ততটুকু ভালোবাসি।
– আমিও আমার এই ছোট বোনটাকে খুব ভালোবাসি।

অবাক সোফায় গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। চোখে জল মনে অনু। বেহায়া মনটা আকুল হয়ে আছে একটিবার অনুর মুখটা দেখার জন্য। একটিবার প্রিয়মানুষটার কণ্ঠটা শোনার জন্য। কতদিন প্রিয় মানুষটার থেকে দূরে আছে।

তার কেবলি মনে হচ্ছে মেয়ে হয়ে নয়। ছেলে হয়ে জন্ম নেওয়াই বড় পাপ। মনের কথাগুলো কাউকে বলতেও পারে না আর চাপা পড়া কষ্ট গুলো কেউ বুঝতেও পারে না। মনের কষ্ট গুলো না বললে কেউ বুঝে না। কেউ না। তার কতটা কষ্ট হচ্ছে পৃথিবীর লোকে কখনই বুঝবে না।

মেঘ শুয়ে আছে বিছানায়। তার চোখেও ঘুম নেই। কষ্ট হচ্ছে খুব। পৃথিবীর সমস্ত কষ্ট মনে হয় তার। জীবনটাই তার গেলো কষ্টে কষ্টে। এতটুকু বড় হয়েছে কষ্ট নিয়ে। নতুন জীবনটাও শুরু হলো কষ্ট নিয়ে।

এজীবনে কি আর সুখের দেখা মিলবে? যাকে নিয়ে এতদিন স্বপ্ন দেখলো। যে মানুষটার জন্য এতদিন গোপনে প্রেম ভালোবাসা জমিয়ে রাখলো। সেই মানুষটাও তাকে দূরে সরিয়ে দিলো।

প্রথম দিনেই কেমন অমানবিক আচরণ করলো। মেঘের চোখদিয়ে পানি পড়তে থাকে। তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বেশি কষ্ট লাগছে প্রিয় মানুষটার জন্য। তার চোখে কেন পানি? কোন কষ্টে মানুষটা এতো কষ্ট পাচ্ছে?

উত্তর খুঁজে পাচ্ছেনা মেঘ। রাতটা শেষ হচ্ছে না। কষ্টের রাত এতো বড় হয় কেন? রাতের বেলায় কষ্ট গুলো এভাবে আঘাত করে কেন? মেঘ ঘুরে তাকায় অবাকের দিকে। অবাক বাচ্চাদের মতো অন্যদিকে ফিরে শুয়ে আছে।

সে কি ঘুমিয়ে পড়েছে? মেঘের ইচ্ছে হলো উঠে অবাকের কাছে যেতে। কিন্তু সাহস হলো না। যদি আবার রাফ বিহেব করে? না না। এই কষ্ট আর নেওয়া যাবে না। মেঘ কোলবালিশে মুখ গুজে শুয়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর তার চোখ লেগে যায়।

দূর থেকে আযানে ধ্বনি ভেসে আসতেই মেঘের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে অবাক আগের মতই শুয়ে আছে। এই মানুষটাকে কি নামাজের জন্য ডাকবে? আম্মাতো বলেছিল উনি ফজরের নামাজ পড়েন প্রতিদিন।

তাহলে আজ উঠছেন না কেন? মেঘ দ্বিধায় পড়ে যায়। ডাকবে কি ডাকবে না বুঝতে পারছে না সে। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে চিন্তা করে মৃদু স্বরে ডাক দেয়,
-শোনছেন? মেঘ অনেকবার ডাকার পরও অবাকের কোনো রেসপন্স পায়না।

বাধ্য হয়ে সে অবাকের শরীরে আলতো করে স্পর্শ করে। সাথে সাথে অবাক চোখ মেলে তাকায়। চোখের সামনে মেঘকে দেখে তার শরীরে আবার রাগ চেপে বসে। অবাকের চোখ টকটকে লাল। অবাকের চাহনি দেখে মেঘ ভয়ে কাঁপতে শুরু করে। সে মাথা নিচু করে কাঁপা কণ্ঠে বলে,,,,,,,

-নামাজের জন্য ডেকেছিলাম। অবাক দাঁত কটমট করতে করতে বলে,,,,,,
-তোমাকে বলেছি আমাকে ডাকতে? মেঘ ভয়ে ভয়ে বলে,,,,,,,,
-না মানে আম্মা বলেছিল আপনি সব সময় নামাজ পড়েন। আজ উঠছেন না বলে ডাক দিয়েছি।

-তোমাকে আগে বলিনি আমার কোনো বিষয়ে নাক গলাবে না? আমি নামাজ পড়বো কি পড়বো না সেটা সম্পূর্ণ আমার বিষয়। আমাকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। নেক্সটাইম আমার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলতে আসবে না। তোমার মতো তুমি থাকবে।

মেঘ আর কিছু না বলে চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। অবাক আবার আগের ভঙ্গিতে শুয়ে পড়ে। অবাকের আচরণ খারাপ লাগলেও মেঘ সেটাকে ইগনোর করে। সে জায়নামাজ পেতে নামাজে দাঁড়ায়। নামাজ পড়ে কোরআন শরীফ নিয়ে বসে।

মেঘের কোরআন তিলাওয়াত শোনে অবাক উঠে বসে। মেঘের দিকে কিছুক্ষণ বিরক্তি নিয়ে চেয়ে সে ওয়াশরুমে ঢুকে। ফ্রেশ হয়ে চুপচাপ বাসা থেকে বের হয়ে যায়।

মেঘ কোরআন তিলাওয়াত শেষ করে রুম থেকে বের হয়। বাসায় কোনো লোকজন নেই। কাল বাসার একমাত্র ছেলের বিয়ে হয়েছে অথচ তার কোনো রকম চিহ্ন পর্যন্ত বাসায় নেই। মেঘ বেশ বিস্মিত হয়। এ কেমন বিয়ে? মেঘ এদিক ওদিক দেখতে থাকে। মেঘকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিন্তি এগিয়ে এসে বলে,,,,,,

-বউমনি আপনে এখানে দাঁড়িয়ে কি করছেন? বিন্তিরর কথা শোনে মেঘ চমকে উঠে। পেছনে তাকিয়ে দেখে বিন্তি দাঁড়িয়ে আছে। মেঘ স্বাভাবিকভাবে বলে,,,,,,
-কিছু না। এমনি।
-ও আচ্ছা।

-আম্মার রুম কোনটা?
-আপনে আম্মার রুমে যাবেন?
-হুম
-আসেন আমি লইয়া যাই। আম্মার রুম ঔদিকে। বিন্তি বিলকিস বেগমের রুমের দিকে পা বাড়ায়। মেঘও বিন্তির পেছন পেছন যায়।

বিলকিস বেগম বিছানায় খাটের মাথায় হেলে বসে আছেন। পা দুটো চাঁদর দিয়ে ঢাকা। মেঘকে রুমে দেখে তিনি মৃদু হাসেন। মেঘও বিলকিস বেগমের সাথে তাল মিলিয়ে হাসে। বিলকিস বেগম আনন্দিত কণ্ঠে বলেন,,,,,,,

-আয় আমার কাছে আয়তো দেখি। মেঘ এগিয়ে গিয়ে বিলকিস বেগমের পা ছুঁয়ে সালাম করে। বিলকিস বেগম অধীর হয়ে বলেন,,,,,

– থাক থাক সালাম করতে হবে না। আমি এমনি তোর জন্য দোয়া করি। তুই চিরসুখী হো। আর আমার ছেলেটাকেও সুখী কর। মেঘের মনটা হালকা খারাপ হয়। ছেলেকে সুখী করতে পারবে কিনা আল্লাহ ভালো জানেন। মেঘ গিয়ে বসে বিলকিস বেগমের কোমর বরাবর। বিলকিস বেগম সোজা হয়ে বসে বলেন,,,,,

– এতো সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে পড়লি যে? ভালো ঘুম হচ্ছে না?? মেঘ জোরপূর্বক হেসে বলে,,,
– আমি তো সব সময় এমন সময় উঠি। তোমার শরীর এখন কেমন আছে আম্মা?

– আলহামদুলিল্লাহ ভালো। অবাক কি এখনও ঘুমাচ্ছে? মেঘ মাথা নিচু করে বলে,,,,
– না। উনিতো উঠে পড়েছেন।
– তাহলে তুই ওকে রেখে আমার কাছে আসলি কেন? যা অবাকের সাথে গিয়ে গল্প কর। ওও যতক্ষণ বাসায় থাকবে ততক্ষণ ওর সাথে থাকবি। মেঘ মাথা তুলে মৃদু কণ্ঠে বলে,,,,,,

– উনি এখন রুমে নাই। মনে হয় বাইরে গেছে। বিলকিস বেগমের মনটা কেমন করে উঠলো। অবাকতো প্রতিদিন বাহিরে যাওয়ার আগে তার সাথে দেখা করতে আসতো। আজ আসলো না কেন?

প্রতিদিন তার পাশে বসে কোরআন তিলাওয়াত শোনে। এখন না হয় কোরআন তিলাওয়াত শোনতে এলো না। কিন্তু একবারতো চোখের দেখাও দেখতে এলো না। বিলকিস বেগম গোপনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। শীতল কণ্ঠে বলেন,,,,,

– ওহ। অবাক হয়তো হাঁটতে বের হয়েছে। প্রতিদিন সকালে ও হাঁটতে বের হয়। মেঘ কিছু না বলে চুপচাপ বসে থাকে। বিলকিস বেগম মেঘের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেন,,,,,,

– তোর কি মন খারাপ? খারাপ লাগছে এখানে?
– না খারাপ লাগছে না। আম্মা একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
– হ্যাঁ কর।
– বাসায় কোনো লোকজন নাই কেন? বিয়েতে কেউ আসে নি?

– না। কাউকে বলার সুযোগ পাইনি। আমিতো বেশকিছুদিন হসপিটালে ছিলাম। হুটহাট করেই তো বিয়েটা হয়ে গেলো। তুই কিছু চিন্তা করিস না। আমি একটু সুস্থ হলে বড় করে তোদের রিসিপশন করবো।

ছেলের বিয়ে নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিল। তার কিছুই হলো। এক্সিডেন্টে সব এলোমেলো করে দিল। বিলকিস বেগম জোরে নিঃশ্বাস ছাড়লেন। মেঘের ইচ্ছে হলো শাশুড়ি মাকে জিজ্ঞেস করতে অবাকের এই বিয়েতে মত ছিল কিনা।

কিন্তু শাশুড়ি মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করতে সাহস পেলো না সে। মেঘ বিলকিস বেগমের সাথে বেশকিছুক্ষণ ভালোমন্দ গল্প করে। এর মাঝে বিন্তি আবার ফিরে আসে। মেঘকে উদ্দেশ্য করে জিজ্ঞেস করে,,,,,

– বউমনি, আপনে ব্রেকফাস্টে কি খাবেন? বিন্তির কথায় বিলকিস বেগম এবং মেঘ কথা থামিয়ে পিছনে ফিরে তাকায়। মেঘ কিছু বলার আগেই বিলকিস বেগম বলেন,,,,

– মেঘের জন্য বিরিয়ানি আর মাংস রান্না কর। মেঘ বিরিয়ানি আর মাংস খেতে খুব পছন্দ করে।
– আচ্ছা ঠিক আছে। আর আপনের জন্য কি করুম? অবাকভাইজান কি খাইবো কিছু তো বললো না।

– মাছ কর অবাকের জন্য। আর আমার জন্য তেমন কিছু করতে হবে না। আমি বেশি কিছু খেতে পারি না। যা করবি তা থেকেই আমি কিছু খাবো। মেঘ বিলকিস বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে,,,,,

– আম্মা, আমি রান্না করি? মেঘের কথা শোনে বিলকিস বেগম ভ্রু কুঁচকে বলেন,,,,,
– ওমা, তুই রান্না করবি কেন? তুই নতুন বউ। তাছাড়া তোকে কখনই রান্না ঘরে যেতে হবে না। তুই শুধু খাবি, ঘুমাবি আর আমার ছেলেটার কেয়ার করবি।

– আম্মা আমি রান্না করতে পারি। আমার রান্না করতে ভালো লাগে। করিনা?
– না না। তোকে করতে হবে না। হাতটাত পুরিয়ে ফেলবি।
– পুড়াবো না। বাসায় তো সব সময় আমিই রান্না করতাম।

– আরে,,,,,,
– প্লীজ করি না? মেঘ অসহায় হয়ে বিলকিস বেগমের দিকে তাকায়। বিলকিস বেগম আর কিছু না বলে আবার খাটে হেলে বসেন। জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলেন,,,,,

– আচ্ছা কর। বিন্তি তোকে হেল্প করবে। সাবধানে করিস। হাতটাত পুড়াস না আবার। মেঘ আনন্দের হাসি হেসে বলে,,,,,
– আচ্ছা। মেঘ বিন্তির সাথে যায়।

অবাক দাঁড়িয়ে আছে অনুদের বাসার সামনে। ভেতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছে না তার। কিন্তু অনুকে দেখার জন্য তার মনটা উতলা হয়ে আছে। অবাক অনুদের বাসার দিকে পা চালায়। ভয়ে পা কাঁপছে তার। কে কি বলবে এটা ভেবে শরীরও কাঁপছে।

তবুও সে এগিয়ে যাচ্ছে। কারণ অনুকে একনজর দেখতে মন চাচ্ছে। দরজার সামনে গিয়ে নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছে অবাকের। হাঁত কাঁপছে। সে কাঁপা হাতে কলিং বেলে চাপ দেয়। দুবার বেল বাজার পর কাজল রেখা এসে দরজা খুলেন।

ফুফিকে দেখে অবাক মাথা নিচু করে ফেলে। অবাককে এই সকাল বেলায় দেখে কাজল রেখার মেজাজ বিগড়ে যায়। তিনি কঠিন গলায় প্রশ্ন করেন,,,,,,,

– তুমি এখানে কেন এসেছো? আর কি চাই তোমার? ফুফির কথা শোনে অবাক অসহায় ভঙ্গিতে মাথা তুলে তাকায়। করুণ স্বরে বলে,,,,,,

– ফুফি, আমি একবার অনুর সাথে দেখা করতে চাই।
– আমার মেয়েটার এতো ক্ষতি করেও তোমার তৃষ্ণা মিঠে নি? তুমি কোন মুখে আবার আমাদের বাসায় আসলে? তোমার কি লজ্জা বলতে কিছু নেই?

– ফুফি,,,,
– চুপ করো তুমি। তোমার জন্য আমার মেয়েটা এতো কষ্ট পেলো। তোমাকে আমাদের বাসার আশেপাশেও যেন আর না দেখি। কথাটা বলেই কাজল রেখা অবাকের মুখের উপর ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেন।

সাথে সাথে অবাকের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। নিজেকে আজ বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। খুব বড় অন্যায় করেছে। এই অপরাধের তো শাস্তি হওয়ায় উচিত। কিন্তু অনুর সাথে একবার দেখা করা দরকার। ক্ষমা চাইতে হবে মেয়েটার কাছে। নাহলে মরলেও সে এতটুকু শান্তি পাবে না সে।

অবাক আরো কয়েকবার কলিং বেল বাজায়। কিন্তু কেউ দরজা খুলে নি। অবাক অনুদের বাসার গেইটের সামনে গিয়ে অনুকে কল করে। রিং হচ্ছে। কিন্তু রিসিভ করছে না কেন?

অনু বিছানায় আনমনে শুয়ে আছে। তার কিছু ভালো লাগছে না। মাথাটা কেমন ভার ভার হয়ে আছে। তাই সে চোখ বন্ধ করে রাখে। অনুর মোবাইলের রিংটোনটা বেজে উঠতেই সে চোখ মেলে তাকায়। এখন কে কল করছে? তার বিরক্ত লাগছে।

ইচ্ছে করছে না কলটা রিসিভ করতে। তাই সে আবার অন্যদিকে ফিরে শোয়। একবার রিং হয়ে কলটা কেটে যায়। সাথে সাথে আবার মোবাইলের রিংটোনটা বেজে উঠে। অনু অনেকটা বিরক্ত হয়ে মোবাইলটা হাতে নেয়।

মোবাইলের স্কিনে অবাকের নাম দেখে সে হুরমুর করে উঠে বসে। মনে মনে বলে, অবাক কল করছে! অবাক! আনন্দে অনুর চোখ জলে ভরে উঠে। অনু উল্লাসিত হয়ে কলটা রিসিভ করে বলে,,,,

– হ্যালো। অনুর কণ্ঠ শোনে অবাক আনন্দে ডুবে যায়। সে মোবাইলটা দুহাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে। অনু কল রিসিভ করেছে। অবাকের চোখে জল মুখে হাসি। অবাক কান থেকে মোবাইলটা মুখের সামনে ধরে। ১ ২ ৩ ৪ করে সেকেন্ড চলছে। অনু আবার বলে,,, ,,,,

– হ্যালো অবাক? হ্যালো? অবাক আবার মোবাইলটা কানে নেয়। কিন্তু কিছু বলে না। তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। কিন্তু চোখ থেকে পানি বের হচ্ছে। অনু জোরে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,,,,,,,

– কথা যখন বলবে না তখন কল দিলে কেন? অনুর কথা শোনে অবাক আবেগ আপ্লুত হয়ে বলে,,,,,,
– অনু, একবার ব্যলকনিতে আসবে? অবাকের কথার প্রতিউত্তরে অনু বলে,,,,,,,
– কেন ব্যলকনিতে কেন?

– তোমাকে একনজর দেখবো। আসোনা একটু ব্যলকনিতে। অনু প্রায় লাফ দিয়ে বিছানা থেকে নামে। দৌঁড়ে ব্যলকনিতে যেতে নিয়ে দরজার কাছে যেতেই তার পা আটকে যায়। অনু ব্যলকনির দরজায় পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে ভেজা চোখে বলে,,,,,,,

– কি দরকার এক নজর দেখে মায়া বাড়ানোর??? অনুর কথাটা অবাকের হৃদয়ে গিয়ে লাগে। অবাক অসহায় হয়ে বলে,,,,,,

– তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে অনু। একটি বার আসো। একনজর দেখেই চলে যাবো। আসো। প্লীজ অনু আসো। অনু জানালার পর্দা সরিয়ে বাহিরের দিকে তাকায়। অবাক ব্যলকনির দিকে মুখ করে তাকিয়ে আছে।

তাকে কতটা অসহায় লাগছে আজ। কতোটা করুণ লাগছে। অনুর চোখ বেয়ে জল পড়তে শুরু করে। তার অবাককে তো কখনও এভাবে দেখেনি। আজ তার কি অবস্থা হয়েছে। অনুর বুক হাহাকার করে উঠে। অনু জানালার কাঁচে মাথা ঠেকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করে। অবাক ধরা গলায় আবার বলে,,,,,
– অনু তুমি আসবে না? একটিবার দেখা দিবে না? অনু কষ্ট করে বুকের ভেতরে নিজের কান্না লুকিয়ে বলে,,,,,,
– তুমি ফিরে যাও অবাক। আর কখনও এসো না। আমি তোমার মুখ দেখতে চাইনা। অনুর কথাটা অবাকের বুকে তীরের মতো গিয়ে লাগে। অবাক আতঁকে উঠে। সে প্রায় কেঁদেই দেয়। অবাকের কান্নাটা অনুর হৃদয়ে কঠিন আঘাত করে। অবাক কান্না জড়িত কণ্ঠে বলে,,,,,,

– অনু, তুমি এতটা নিষ্ঠুর হয়ো না। ফুফিও আজ আমাকে তোমাদের বাসায় ঢুকতে দেয়নি। তাড়িয়ে দিয়েছে আমাকে। তুমিও তাড়িয়ে দিতে চাইছো? সবাই আমাকে পর করে দিলে আমি কোথায় যাবো? আমার যে যাওয়ার মতো কোনো জায়গা নেই। প্লীজ অনু। অন্তত তুমি আমাকে একটু বুঝো। অনু নিজেকে শক্ত করে কঠিন গলায় বলে,,,,,,

– তুমি না কাল বিয়ে করেছো? তোমার না ঘরে বউ আছে? তুমি কি জানো না বউ রেখে অন্য মেয়েদের দিকে নজর দেওয়া পাপ? আর নিজের জন্য অন্য একটা মেয়েকে কষ্ট দিলে আল্লাহ নারাজ হবে। তুমি আর কখনও আমাকে নিয়ে ভাববে না।

এখন থেকে বউকে নিয়ে ভাববে। আমাকে ভুলতে তোমার কষ্ট হবে না। দ্বিতীয়বার আমাকে কলও করবে না। আর এভাবে আমার বাসার সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকবে না। তোমাকে দেখলে লোকজন আমার নামে কুকথা বলবে।

তখন আমার মরা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। তুমি কি চাও আমি এমন কোনো ডিসিশন নেই? অনুর কথা শোনে অবাকের বুক ব্যথায় লাফিয়ে উঠে। অবাক চোখ বড় বড় করে বলে,,,,,,

-এসব তুমি কি বলছো অনু? এসব কথা বলো না। তুমি এমন কিছু করবে না। তাহলে আমি জিন্দা লাশ হয়ে যাবো অনু। এসব বলো না।

– তাহলে নেক্সট টাইম আমার বাসায় আর এসো না। কথাগুলো বলেই অনু ফোনটা কেটে দেয়। জানালার কাঁচে হাত রেখে অবাকের দিকে তাকিয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে অনু।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here