#অবাক_মেঘের_বাড়ি

পর্ব : ৯
সুরমা

অনু কেমন আনমনে শুয়ে আছে। তাকিয়ে আছে উপরে ছাদের দিকে। তার চোখের পলক পড়ছে না। প্রিতি কাত হয়ে শুয়ে আছে অনুর দিকে তাকিয়ে। প্রিতি বুঝতে পারছে অনু এখন অবাকের কথাই চিন্তা করছে। প্রতিদিন তো এই সময় দুজন ফোনে কথা বলে।

হঠাৎ করে মানুষের রুটিন চেঞ্জ হলে ফিলিংসও চেঞ্জ হয়। এতদিনের একটা অভ্যাস ভুলতে কষ্ট হবেই। প্রিতি অনুর মুড চেঞ্জ করার জন্য বলে,,,,,

– আপু। প্রিতির ডাকে অনু প্রিতির দিকে নিস্তেজ হয়ে ফিরে তাকায়। প্রিতি বলে,,,,
– আমি তোকে জড়িয়ে ধরি? প্রিতির কথা শোনে অনু ভ্রু কুঁচকায়। প্রিতি হালকা হেসে অনুকে জড়িয়ে ধরে। একেবারে অনুর উপর হাত পা তুলে ফেলে। অনু বলে,,,,,

– আগেতো কখনও এভাবে জড়িয়ে ধরিস নি। আজ হঠাৎ কি হলো?
– আগে সুযোগ হয়নি তাই ধরিনি। আজ সুযোগ পেয়েছি তাই ধরেছি। অনু আর কিছু বলেনি। সেও চুপ করে থাকে। প্রিতি আহ্লাদী কণ্ঠে বলে,,,,

– আপু, তোর মনে আছে, আমরা ছোটবেলায় এভাবে জড়াজড়ি করে ঘুমাতাম। আমার খুব ভালো লাগতো তখন। শান্তি লাগতো। আজও শান্তি লাগছে। এবার একটা গল্প বলতো। অনু বিস্মিত হয়ে বলে,,,,,

– আমি কি গল্প বলবো?
– যা খুশি বল।
– না, আমি এসব গলটল্পটল্প বলতে পারি না। তুই বল আমি শুনি। প্রিতি গল্প বলছে।
– একদেশে এক রাজা ছিল,,,,অনু প্রিতিকে থামিয়ে দিয়ে বলে,,,,,

– এসব না। এসব ভাল্লাগেনা।
– তাহলে কি বলবো তুই বলে দে।
– যা খুশি বল। তবে কোনদেশে কি ছিল এসব আমি শোনতে চাইনা। প্রিতি বললো,,,,,

– আচ্ছা তাহলে নিউ কিছু বলি। একদম মজার গল্প। এক লোকের গুড় প্রিয় খাবার ছিল। তার সব সময় গুড় লাগতো। ভাত খেতে হলেও তার প্লেইটে গুড় থাকতে হবে। তাই অনেক চিন্তা ভাবনার পর সে গুড়ের ব্যবসা শুরু করে। অনু বলে,,,,

– গুড় প্রিয় তাই ব্যবসা দিয়ে দিতে হবে? একেমন কথা? তাহলে তো তোরও ফুচকা, ঝালমুড়ি, আইসক্রিমের ব্যবসা শুরু করা উচিত। প্রিতি অনুকে ছেড়ে বলে,,,,

– দূর। এভাবে গল্প বলা যায়। এটা কেন, ওটা কেন বললে গল্প বলা হবে না। গল্পতো গল্পই হয়। যা বলবো শুধু শোনবি। মাঝে মাঝে হুম হ্যাঁ করবি। অনু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,

– হু, হ্যাঁ করবো কেন?
– তাহলে গল্প বলতে সুবিধে হয়। আমিও বুঝতে পারবো তুই জেগে আছিস।
– আচ্ছা বল। প্রিতি আবার অনুকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,
– কি যেন বলছিলাম,,,,
– গুড়ের ব্যবসা শুরু করেছে।

– ওও হ্যাঁ। তখন লোকটা গুড়ের ব্যবসা শুরু করে। এতে তাঁর খাওয়াও হবে ব্যবসাও হবে। গুড় রাখার জন্য একটা ঘর তৈরি করে। সেখানে একটা চৌকিতে সারি করে গুড় রাখে। তার ব্যবসা ভালোই চলছিল।

একদিন ঘর পরিষ্কার করার জন্য চৌকির নিচে যায়। গিয়ে দেখে একটা জায়গায় কতোটা গুড় হালকা আঠালো হয়ে পড়ে আছে। লোকটা ভাবলো এতোটা গুর এখানে নষ্ট হয়ে আছে।

তারচে এটা খেয়ে ফেলি। অপচয় রোধ হবে। তাই সে আঙ্গুল দিয়ে গুড়টা তোলে মুখে দেয়। মুখে দেওয়ার পর সে বুঝতে পারে এটা গুড় ছিল না। এটা পোয়াতি মুরগির পায়খানা ছিল। বলেই প্রিতি ফিকফিক করে হাসতে শুরু করে। অনু তাকায় চোখ গরম করে। প্রিতি হাসি থামিয়ে বলে,,,,,,

-গল্পটা মজার ছিল না? অনু মুখটা বানিয়ে বলে,,,,
– ওয়াক, বিশ্রী গল্প। আমার পেট মোচড় দিয়ে উঠেছে। এসব বিশ্রী কথা কোথায় থেকে শিখছিস? ছিঃ। প্রিতি মুখটা কালো করে বলে,,,,,

– তুই এমন করছিস কেন? আমি কি বিশ্রী বললাম? গল্পতো গল্পই।
– ভালো গল্পও আছে। ভালো গুলো বলতে পারিস না?

– মাঝে মাঝে এগুলোও বলতে হয়। প্রিতি অনুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। অনু বলে,,,,
– ইশ, সরতো।

– এমন করিস কেন? আমি কি সব সময় এভাবে জড়িয়ে ধরি নাকি। আজকে আমি এভাবেই ঘুমাবো। তোর উপর আমার একটা অধিকার আছে না? অনু আর কিছু না বলে চুপ করে থাকে। প্রিতিও চুপচাপ শুয়ে থাকে।

কিছুক্ষণ পর অনু প্রিতির ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ শোনতে পায়। অনু মাথা ঘুরিয়ে দেখে প্রিতি ঘুমিয়ে পড়েছে। অনু জানে, প্রিতি এতক্ষণ এসব করছে তার জন্যই। তার মন ভালো করার জন্যই। কিন্তু বিষণ্ণ মনের সদ্য লাগা দাগ কি এতো তাড়াতাড়ি সারে?

ক্ষত শোকাতে সময় লাগে। অনুর চোখ দিয়ে টপটপ পানি পড়তে শুরু করে। অনুও প্রিতিকে জড়িয়ে ধরে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকে। মুখ চেপে রাখে। বুক ধরফর করতে থাকে। আজ তার চোখে ঘুম নেই। অন্যদিন এই সময় অবাকের সাথে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে যায়। অবাক কতো করে বলতো আর একটু জেগে থাকো। কিন্তু তখন জেগে থাকতে পারতো না। আর আজ সে ঘুমাতে চায়। কিন্তু ঘুম আসছে না। চোখের পানি মুছে দিয়েছে চোখের ঘুম।

হসপিটালে রোগীদের জন্য আলাদা আলাদা কেবিন। হাইফাই রুম। এক একটা রুমের জন্য দশ হাজার টাকা পে করতে হয়। রুমের সাথে এটাচ বাথরুম। কেবিনে প্রবেশ করলে কেউ বলবে না সে হসপিটালে আছে। মনে হবে সে হয়তো কোনো রিসোর্ট বা বাসায় আছে।

প্রত্যেকটা রুমে সোফা, টিভি আছে। রোগীদের জন্য আছে সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসা ব্যবস্থা। অবাক টেনশনে শেষ। মায়ের অবস্থা ভালো না। ছোট মামাও সাথে আছে। চিকিৎসা করছে হসপিটালের বড় ডাক্তাররা। অবাক ছোট মামার কাছে গিয়ে বলে,,,,,,,

-মামা, আম্মা সুস্থ হবে তো?
-আল্লাহ ভরসা। সবাই চেষ্টা করছে। টাকার জন্য কোনো কিছুর ত্রুটি রাখবো না আমরা। বাকিটা আল্লাহ্‌ ভালো জানেন। কিন্তু আপার হঠাৎ অবস্থা এতো খারাপ হলো কিভাবে? অবাক কাঁদতে কাঁদতে বললো,,,,,

-আমি কিছু জানি না মামা।
-আপার তো প্রেশারের সমস্যা। ডায়াবেটিস। হার্টেও ব্লক। যদি কোনো বিষয় নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন করে তাহলে এরকম হওয়ার কথা। ডাক্তার তো বলেছেন স্টোক করেছে।

কিন্তু এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না। অবাক দেয়ালের সাথে মাথা ঠুকে কাঁদতে শুরু করে। ছোট মামা অবাকের কাঁধে হাত রেখে বলে,,,,

-এভাবে কাঁদিস না। আপার জন্য দোয়া কর। যেন আল্লাহ এই বিপদ থেকে আপাকে রক্ষা করেন।
-মামা আম্মা ছাড়াতো আমি শেষ হয়ে যাবো। তুমি যেভাবে পারো আম্মাকে সুস্থ করে দাও।

আম্মাকে আরো কিছুদিন বেঁচে থাকতে হবে। আমার জন্য আম্মাকে সুস্থ হতে হবে। সারাদিন কাজ শেষে যখন বাসায় ফিরে যাই আম্মার মুখটা দেখে সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। সকালে যখন আম্মার কণ্ঠে কোরআন তিলাওয়াত শোনি মনটা ফ্রেশ হয়ে যায়।

ছোট মামা নিজের মতো করে অবাককে শান্তনা দিলেন। তিনি বললেন,,,,,

-তুই এখানে বস। আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলছি। অবাক গিয়ে সোফায় বসে। দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রাখে। চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।

বিন্তি হসপিটালটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। এটা হসপিটাল নাকি কোনো ফ্ল্যাট বাসা বুঝতে পারছে না সে। রুমের বাহিরে কোনো লোকজন নেই। হসপিটাল তো এমন হয়না। হসপিটালের আশেপাশে লোকজন থাকে প্রচুর।

গমগম শব্দ সব সময় লেগেই থাকে। কিন্তু এখানে একদম অন্য রকম পরিবেশ। নিরিবিলি। বিন্তি অবাকের কাছে গিয়ে বলে,,,,,,,

-ভাইজান, এটাই কি হাসপাতাল? নাকি আমরা কোনো বাসায় আছি? অবাক মাথা তুলে তাকায়। চোখ মুছে বলে,,,,,,

-বাসা না। এটা হসপিটাল।
-এতো সুন্দর হাসপাতাল। ভাইজান, আপনে চিন্তা করবেন না। আম্মা সুস্থ হয়ে যাবে। এতো সুন্দর হাসপাতালে আনছেন। ভালো না হয়ে পারবে না।
-দোয়া করো আম্মা যেন সুস্থ হয়ে উঠে। বিন্তি বলে,,,,,
-ভাইজান, হাসপাতালে টিভি দিছে কেন?
-দেখার জন্য।
-রোগী মানুষ আবার টিভি দেখবো কেমনে। এরাতো দেহি বোকা মানুষ।

রোগীরাতো এমনি রোগ নিয়ে আসে। ওদের মনে কি আর এতো শান্তি আছে যে হাসপাতালে শুয়ে শুয়ে টিভি দেখবো। অবাক উঠে দাঁড়ায়। এমনিতেই এখন মন ভালো না। এই সময় বিন্তির আজাইরা বকবক একদম ভালো লাগছে না তার।

মায়ের টেনশনে মুখটুক শুকিয়ে গেছে তার। মাথাও ব্যথা করছে। অবাক ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত তিনটা বাজে। এখন আর অনুর কথা মনে পড়ছে না। এখন মায়ের চিন্তায় বিভোর সে। মনে একটাই প্রার্থনা, আল্লাহ যেন খুব তাড়াতাড়ি মাকে সুস্থ করে দেন।

অনু শুয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয়ে গেছে। ঘুমও আসছে না। অনু প্রিতির হাত পা সরিয়ে বিছানা থেকে উঠে ব্যালকনিতে আসে। চাঁদের আলোয় চারপাশ সাদা হয়ে আছে।

লাইট অফ করে রাখলেও ছোট ছোট জিনিসগুলো স্পষ্ট দেখা যাবে। আগে কোনোদিন এতো রাত জাগা হয়নি তার। অবাকের বলা একটা কথা অনুর আজ খুব মনে পড়ছে।

বহুদিন আগে তাদের এক কাজিনের বিয়ে ছিল। সেখানে অনু অবাক দুজনেই উপস্থিত ছিল। বিয়েতে সব ছেলে মেয়েরা রাত জেগে গান, নাচ করে। কিন্তু রাত একটা বাজার সাথে সাথেই অনু ঘুমে ঢুলতে থাকে।

তাই সে আড্ডা থেকে বিদায় নেয়। অবাকও তাকে অনেক রিকুয়েস্ট করে তাদের সাথে থাকতে। কিন্তু অনু থাকলো না। সে বললো, ‘ আমি একটু ঘুমিয়ে আসি। ততক্ষণ তোমরা থাকো।’

অনুর কথা শোনে অবাক বলেছিল, এমন একদিন আসবে যেদিন তুমি রাত জেগে থাকবে। কিন্তু একা একা। সেদিন আমাদের কথা মনে পড়বে। আজ হয়তো সেইদিন। আজ সে জেগে আছে ঠিক। কিন্তু সঙ্গী কেউ নেই। সময় কি নিষ্ঠুর। নাকি মানুষ নিষ্ঠুর? এর উত্তর হয়তো এখন পাওয়া সম্ভব হবে না।

অবাক বিলকিস বেগমের হাত ধরে বসে আছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে। বিলকিস বেগমের অবস্থার তেমনন কোনো উন্নতি হয়নি। ডাক্তার বলেছে আল্লাহ যদি অশেষ রহমত দান করে তবে তিনি বেঁচে যাবেন।

তবে হয়তো আগের মতো সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। শরীরের এক পাশ অবশ হয়ে আছে। ডাক্তাররা নিজেদের মতো চেষ্টা করবেন। তবে গ্যারেন্টি দিয়ে এখন কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। অবাক কাঁদছে আর ফিসফিস করে বলছে,,,,,,

-আম্মা তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হও। তোমাকে আমার প্রয়োজন। তোমাকে যে সুস্থ হতেই হবে। তোমার ছেলের জন্য সুস্থ হতে হবে। অবাক মাথা নিচু করে মায়ের হাতে চুমু খায়।

অনু মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখে এতক্ষণে অবাক একবারো কল করে নি। তাহলে কি সে তাকে ভুলে যাচ্ছে? অনুর বুক ফেটে ফরফর করে কান্না আসতে চাইছে। কিন্তু সে নিজেকে সামলে নেয়। অবাক তাকে ভুলে যাবে এটাই স্বাভাবিক।

এতে এতো কষ্ট পাওয়ার কি আছে। অনু শোয়া থেকে উঠে ওযু করে নামাজ পড়ে। সকালটা বিষণ্ণ লাগছে। কিছুই তার ভালো লাগছে না। অনু ওড়না দিয়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাগানে গিয়ে কিছুক্ষণ হাঁটে।

সকালের স্নিগ্ধ শীতল বাতাসে নিজের মন সতেজ করার চেষ্টা করে। বাগান ভর্তি ফুলে ফুলে। সকালের ফ্রেশ বাতাস আর ফুলের ঘ্রাণ অনুর হৃদয় ছুঁয়ে যায়। মনটা কিছুটা হালকা হয়।

কিছুটা সময় বাগানে কাটিয়ে আবার বাসায় ফিরে আসে। এসে দেখে রিমি সকালের নাস্তার ব্যবস্থা করছে। অনু এগিয়ে যায় রিমির দিকে। অনুকে দেখে রিমি মৃদু হাসে। অনুও হাসে। অনু যতটা পারে সবার সামনে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। তার জন্য বাসার অন্যরা কষ্ট পাবে তাতো হয়না। অনু শীতল কণ্ঠে বলে,,,,

-শুভ সকাল ভাবী
-শুভ সকাল ননদী
-তুমি কি এখন নাস্তা বানাবে?
-হুম। কেন?
-এমনি। আজকে সকালের নাস্তাটা আমি বানাই? অনুর কথা শোনে রিমি ভ্রু কুঁচকায়। অনু আবার বলে,,,,,

-আমি বানাই। অনেকদিন কিছু রান্না করি না। তুমি আজ রেস্ট নাও। রিমি বুঝতে পারছে অনু নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছে। নিজের কষ্ট গুলোকে এভয়েট করতে চাইছে। রিমি মুচকি হেসে বলে,,,,

-আচ্ছা বানাও। অনু কিছুক্ষণ ঝিম ধরে থেকে বলে,,,,
-কি বানাবো?
-যা বানাতে মন চায় বানাও। সমস্যা নাই। আমিও তোমাকে হেল্প করি।
-না। তোমাকে হেল্প করতে হবে না। আমি একাই বানাতে পারবো। তুমি যাও। রিমি আর কিছু না বলে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে আসে। অনুও কাজ করতে শুরু করে।

সকাল আটটায় মা, ভাই বোন সবাই নাস্তা করতে টেবিলে আসে। টেবিলে আজ নতুন আইটেম। রিয়াদ বলে,,,,
– আজ কি স্পেশাল কোনো ডে যে ব্রেকফাস্টের আইটেম সব নতুন। রিমি অনুর দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
– না। আসলে আজ অনু ব্রেকফাস্ট তৈরি করেছে। রিমির কথা শোনে সবাই অনুর দিকে তাকায়। কাজল রেখা দেখলেন আজ মেয়েকে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তিনি মনে মনে খুশি হলেন। অনু যদি অবাককে তাড়াতাড়ি ভুলে যায় তাহলেই মঙ্গল।

সারা রাতে অবাক একটুকুও মায়ের থেকে দূরে যায় নি। সব সময় তার চোখ দিয়ে পানি পড়েছে। বিলকিস বেগম সুন্দর করে ঘুমিয়ে আছেন। তাঁর শরীর একবারের জন্যও নড়ে নি। অবাক বলে,,,,

-আম্মা, একবার চোখ মেলে তাকাও। আমিতো তোমার কাছেই আছি। কোথাও যাইনি। আম্মা তুমি কি আমার উপর রেগে আছো? আমার কথায় কষ্ট পেয়েছো?? আম্মা আমাকে শেষ বারের মতো কি মাফ করা যায় না?

আর কখনও তোমাকে কষ্ট দিবো না। এবার তো চোখ মেলে তাকাও। আমার উপর অভিমান করে তুমি আমাকে এমন কোনো আঘাত দিও না যে আঘাতে সারা জীবন নিজেকে অপরাধী মনে হয়। আম্মা প্লীজ উঠো।

ছোট মামা কেবিনে এসে দেখে অবাক কাঁদছে। অবাককে এই একদিনেই বড্ড এলোমেলো লাগছে। চুল গুলো উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। কেউ দেখলে মনে হবে কতদিন ধরে সে গোসল করে না এমন অবস্থা। চোখ গুলো রক্তের মতো লাল। মুখ শরীর ধূসর হয়ে আছে। ছোট মামা গিয়ে বললেন,,,,

-এভাবে ভেঙ্গে পড়ছিস কেন? আপা খুব শীঘ্র সুস্থ হয়ে উঠবে। তুই এভাবে কাঁদিস না। আর একবার নিজের দিকে তাকিয়ে দেখ শরীরের কি হাল করেছিস একদিনে । যা বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হো। আপার জ্ঞান ফিরলে তোকে এরকম দেখলে আপাতো কষ্ট পাবে।

-আম্মার জ্ঞান না ফিরা পর্যন্ত আমি কোথাও যাবো না মামা। আমি এখানেই বসে থাকবো।
-কি সব পাগলামি করছিস। কাল থেকে তোর পেটে কিছু পড়ে নি। এভাবে থাকলে দেখা যাবে তুই নিজেও অসুস্থ হয়ে গেছিস। চল। তুই বাসা থেকে ঘুরে আয়। আমি আছি এখানে।

অবাক না চাইলেও তাকে ছোট মামা জোর করে বাসায় পাঠায়। অবাক বাসার উদ্দেশ্যে বের হতেই অনুর কথা মনে হয়। সে তাড়াতাড়ি গাড়ি থামিয়ে মোবাইল বের করে। অনুকে কখন থেকে কল করা হয়নি। অনু হয়তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। অবাক ফোন বের করে অনুকে কল করতে থাকে।

কিন্তু অনু ফোন রিসিভ করছে না। অবাকের টেনশন বেড়ে যায়। তার চোখ দিয়ে আবার অঝোরে পানি পড়তে শুরু করে। সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয় অনুদের বাসার দিকে। অনুর সাথে কথা বলা দরকার। আজ যেভাবেই হোক অনুর সাথে কথা বলতেই হবে।

অনু ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। রুমে মৃদু বলিউমে গান বাজছে। সে আনমনে দাঁড়িয়ে আছে রেলিং ধরে। মাথা রেলিং এ ঠেকানো। তার মনে হচ্ছে গানটা তার জন্যই তৈরি হয়েছিল।

মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে,
বেধনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।
মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে রঙে রঙে ছবি আঁকে।

মনে পড়ে যায়, মনে পড়ে যায়,
মনে যায় সেই প্রথম দেখার ও স্মৃতি,
মনে আয় সেই হৃদ্যয় দেওয়ার প্রিতি।
দুজনার দুটি পথ মিসে গেলো এক হয়ে,
নতুন পথের ও বাকে।

মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে,
বেধনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।

সে এক নতুন দেশে,
দিন গুলি ছিল যে মুখর কতো রঙে।
সেই সুর কাঁদে আজ ই আমার প্রানে,
ভেঙ্গে গেছে হায়, ভেঙ্গে গেছে হায়।

ভেঙ্গে আজ সেই মধুর ও মিলন মেলা।
ভেঙ্গে গেছে আজ সেই হাঁসি আর রঙের ও খেলা।
কোথায় কখন কবে কোন তারা ঝরে গেলো,
আকাশ কি মনে রাখে।

মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে,
বেধনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।

মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে,
স্মৃতি যেন আমার হৃদয়ে,
বেধনার রঙে রঙে ছবি আঁকে।

তার খুব মনে পড়ছে অবাকের সাথে কাটানো প্রথমদিন গুলোর কথা। কি সুন্দর ছিল সেই দিনগুলো। কিভাবে অবাক তাকে প্রপোজ করেছিল। কিভাবে একে অপরকে আপন করে নিয়েছিল। আজ যেন সব চোখের সামনে ভাসছে।

তখন সে ইন্টার প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। সে অবাককে মনে মনে খুব পছন্দ করতো। যতক্ষণ অবাক তার চোখের সামনে থাকতো লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে দেখতো সে। অবাকের সাথে কথা বলতে তার বুকের ভেতরটা কেমন ধুকপুক করতো।

তাই সে অবাকের থেকে দূরে দূরে থাকতো। একদিন অবাক তাদের বাসায় আসে কোনো একটা কাজে। অবাক রিয়াদের রুমে বসে কথা বলতে থাকে। আর অনু বাহিরে দাঁড়িয়ে থেকে রুমে উঁকিঝুঁকি দিতে তাকে অবাককে দেখার জন্য।

কিন্তু কিছুতেই সে অবাককে দেখতে পাচ্ছে না। অবশেষে অনু মন খারাপ করে নিজের রুমে যাওয়ার জন্য ঘুরে দাঁড়াতেই থমকে যায়। তার চোখ কপালে উঠে যায়। কারণ তার সামনে অবাক দাঁড়িয়ে আছে। সে তো ভাইয়ার রুমে ছিল। তাহলে এখন এখানে আসলো কিভাবে???

অনুর শরীর থরথর করে কাঁপতে শুরু কর। সে ঘেমে একাকার হয়ে যায়। অবাক নিজের চোখ ছোট করে নির্মল কণ্ঠে বলে,,,,,

-কি, রুমে এমন উঁকিঝুঁকি মারছিলে কেন? আমাকে দেখার জন্য? অবাকের কথা শোনে সে বিস্মিত। অবাক জানলো কি করে? অনু ঢোক গিলতে থাকে। আর এক হা দিয়ে অন্য হাত মুচড়াতে শুরু করে।

তার কেমন জানি ভয় ভয় লাগছে। অনু নিজের রুমে যেতে নিলে অবাক পথ আটকে দাঁড়ায়। এবার অনুর সমস্ত শরীর নিস্তেজ হয়ে যায়। অনু কাঁদো কাঁদো মুখ করে তোতলাতে তোতলাতে বলে,,,,,,,

-আ,মি রুমে যাবো। আমাকে যেতে দিন। অনুর অবস্থা দেখে অবাকের খুব হাসি পায়। অবাক নিজের হাসি কন্ট্রোল করে বলে,,,,,

-আমি কি তোমায় আটকে রাখবো নাকি। তার আগে আমাকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর দাও। আমাকে দেখলেই এমন লুকোচুরি করো কেন? সামনে না এসে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখো কেন? অবাকের কথা শোনে অনুর চোখ ছানাবড়া।

সে ভেবেই কূল পাচ্ছে না অবাক কিভাবে জানলো সে লুকিয়ে তাকে দেখে। অনু কোনো কথা বলছে না। সে নিজের চোখ নিচে নামিয়ে নিজের নখ কোঁচাতে থাকে। অবাক মৃদু পায়ে এগিয়ে যায় অনুর দিকে। অবাককে এগোতে দেখে অনু পিছিয়ে যেতে থাকে।

অনুর পিঠ গিয়ে দেয়ালে আটকায়। অবাক কিছুটা দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায়। অনু ঘেমে একাকার। হার হার্ট চলছে ফুল স্পিডে। বুক কাঁপছে। অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। অনু চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলে,,,,

-প্লীজ আমাকে যেতে দিন। আমি আর কখনও আপনাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখবো না। অনুর কথা শোনে অবাক হেসে দেয়। অবাকের হাসির শব্দ পেয়ে অনু চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়ে দেখে অবাক হাসছে। অবাকের চোখ চিকচিক করছে। লজ্জায় অনু মাথা নিচু করে ফেলে। অবাক হাসি থামিয়ে বলে,,,,

-কি ম্যাডাম। ভালোবাসেন আমায়?? অবাকের কথা শোনে অনু আবুলের মতো কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে অবাকের মুখের দিকে। অবাক অনুর এমন নিরীহ চাহনি দেখে কয়েকবার নিজের ভ্রু নাচায়। অনু চোখ নামিয়ে নেয়। অবাক আরেকটু অনুর দিকে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ায়। অবাক আস্তে করে বলে,,,,

-আমাকে কি ভালোবাসা যাবে? অবাকের কথা শোনে অনুর শরীর আবার কাঁপতে শুরু করে। এবার মনে হচ্ছে হার্ট এটাক্ট হয়ে যাবে। অবাক আবেগময় কণ্ঠে আবার বলে,,,,

-অনু, ইউ কিল মাই হার্ট। কখন যে আমি তোমার নেশায় হারিয়ে গিয়েছি নিজেও জানি না। আমি ফিল করি তুমিও আমাকে পছন্দ করো। যদি ভুল না হয় তাহলে তুমিও আমাকে ভালোবাসো।

কিন্তু আমি তোমার মুখ থেকে শোনতে চাই। অনু চুপ করে অবাকের কথা শোনছে। তার মনে হচ্ছে এখন সে স্বপ্ন দেখছে। অবাক আবার বলে,,,,,,
-কি হলো মহারাণী কিছুতো বলো? অনু মাথা নিচু করে লাজুক হেসে বলে,,,,

-জানি না। অবাক কিছু বলতে যাবে তার আগেই অনু অবাককে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দৌঁড় দেয়। অবাক পিছন থেকে চিল্লিয়ে উঠে,,,,,,,

-জানি না বললে হবে না। জানতে হবে। আর আমাকে মনের কথা জানাতে হবে। অনু আর ফিরে তাকায় নি। সোজা নিজের রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে দরজার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে শুরু করে।

মনে মনে অনু বেশ খুশি। অবাকের মতো কেউ একজন তাকে ভালোবাসে এটা ভেবে। তার মতো সুখি হয়তো আর কেউ নেই। ছোট বেলা থেকে যাকে পছন্দ করে সেই মানুষটাই তাকে ভালোবাসে। এর চেয়ে সুখের আর কি হয়। তখন থেকেই একটু একটু করে গড়ে উঠে দুজনের প্রেমের রাজ্য।

চলবে——

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here