#মেঘবরণ কন্যা

লিখা: সুরমা
পর্ব : ৩

নতুন বাসায় সব কিছু গুছিয়ে নিতে সময় লাগেনি মিহির।বাড়িওয়ালা এবং প্রিয় বান্ধবীর সহায়তায় মিহি সব কিছু গুছিয়ে নিয়েছে।যদিও নতুন বাসায় তেমন কিছুই আনেনি সে।শুধু কাপড়চোপড় আর কিছু নৃত্য প্রয়োজনীয় জিনিস এনেছে।মিহির ভয় ছিল,একদম নতুন একটা জায়গায় হিয়া মানিয়ে নিতে পারবে কিনা সেটা নিয়ে।কিন্তু এখানে আসার পর হিয়ার কোনো রকম প্রবলেম হয়নি।বরং সে আগের মতই নরমাল। হিয়ার এমন বিহেভে মিহি বেশ শান্তি পেলো।এর জন্যই মিহির এখনও বেঁচে থাকা।এর জন্যই এতো সংগ্রাম।এই একটা মেয়ের জন্যই নিজের ফ্যামিলি ছেড়ে এতো দূরে চলে আসা।তবে এতো কিছুর পরও মিহির মনে সামান্য তম কষ্ট নেই।বরং শান্তি আছে।সুখ আছে।হিয়ার মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই মিহির সমস্ত দুঃখ কষ্ট ধোয়ে মুছে চলে যায়।

জেমি হিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয়।সত্যি মেয়েটা অসাধারণ। মায়াবী।ঠিক যেন একটা পুতুলের মতো।তোতাপাখির মতো কথা বলে।কণ্ঠে মায়া জড়ানো।তার সদ্য ফুটন্ত আদো আদো কথায় মন প্রাণ মাতাল হয়ে যায়।কোনো মানুষের পক্ষে এর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়।মিহিও পারেনি।এমন ফুটফুটে একটা বাচ্চাকে যেকোনো মানুষের সব সময় কাছে পেতে ইচ্ছে করবে।ইচ্ছে করবে ওকে বুকে নিয়ে আগলে রাখি। জেমিও খুব লোভ লাগছে।হিয়াকে বুকে জড়িয়ে আদর করার লোভ।জেমি সোফায় বসে আছে।তার একপাশে হিয়া খেলা করছে।আর একটু দূরেই দাঁড়িয়ে হিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে মিহি।জেমি মিহির দিকে তাকিয়ে বলে,,,,
-একটা কথা বলি তোকে??
-হ্যা বল।
-আমি একটু হিয়াকে কোলে নিতে চাই।
-কোলে নিবি এটা বলার কি আছে?কোলে নিবি নে।
-আসলে তুই কি মনে করিস তাই আগে তোকে বললাম।
-মনে করার কি আছে,নেয়।জেমি এগিয়ে গিয়ে হিয়াকে কোলে তুলে নেয়। হিয়াকে কোলে নিয়ে জেমি হিয়ার মুখে একের পর এক চুমু খেতে থাকে।আর হিয়া একদম কাদা মাটির মতো জেমির কোলে লেপ্টে থাকে।

মিহি আজ জয়েন করেছে।অফিসে একদম নতুন সে।সব কিছু অচেনা,অজানা। চারপাশে লোকজনের অভাব নেই।কিন্তু এতো লোকের ভীরে একটা মুখও চেনা লাগছে না মিহির।তবে সে একটুকুও নার্ভাস নয়।কিভাবে নিজেকে সামলে নিতে হয় খুব ভালো করেই জানে মিহি।অল্পতে ভেঙ্গে পড়ার মতো মেয়েও না সে।বা অল্প আঘাতে তার মনও খারাপ হয়না এখন।মন খারাপ হতে বিশেষ কারণের প্রয়োজন হয়।তবে তার মুখে হাসি আসার জন্য অল্প কারণেই যথেষ্ট। হিয়া কাছে আসলেই যেন মিহির দুনিয়া জুড়ে আলোয় আলোয় খেলা শুরু করে।এক রাজ্যের হাসি মুখে এসে জড়ো হয়।মিহি হিয়াকে বুকে জড়িয়ে পৃথিবীর সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়।ম্যানেজার মিহিকে সব সেলারের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়।শপটা বেশ বড়।এগারো তলা বিশিষ্ট শপ।মিহি সিক্স ফ্লোরে কাজ করবে।এক ফ্লোরে অনেক সেলার কাজ করে।ছেলে মেয়ে কমবাইন্ড।সবাই খুব ভালো।মিহির সাথে সবাই নরমাল বিহেভ করেছে।সবার সাথে বন্ধুত্ব করতে বেশি সময় লাগে নি মিহির।শপে প্রচুর কাজ।দাঁড়িয়ে থাকার দুমিনিটও সময় নেই।তবে মিহির চোখ একটা জায়গায় বার বার আটকে যাচ্ছে। একটা খুব স্মার্ট ছেলে শপের এক পাশে দাঁড়িয়ে তার দিকে কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে।শপে আসার পর থেকেই দেখছে এ ছেলেটা তাকে ফলো করছে।প্রথমে মিহির মনে হয়েছিল হয়তো সে ভুল ভাবছে।কিন্তু না,সে ঠিক ভাবছে।ছেলেটা তার দিকেই তাকিয়ে আছে।তবে এতে মিহি একটুকুও নার্ভাস হয়নি।বরং রিলেক্সে কাজ করে যাচ্ছে।

ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ যাবত মিহিকে ফলো করলো।তারপর মিহির সাথে আলাপ করতে তার দিকে এগিয়ে গেলো।ছেলেটাকে এগিয়ে আসতে দেখে মিহি স্থির হয়ে দাঁড়ালো।তার মনটা হঠাৎ করে টিপটিপ করতে শুরু করলো।কি অদ্ভুত।মনটা হঠাৎ এমন করছে কেন?মিহি নিজের মনকে শান্ত করার জন্য জোরে জোরে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিলো।এতে খুব সহজেই মন শান্ত হয়ে গেলো।মন খারাপ বা হঠাৎ করে অস্থির হয়ে গেলে মনকে শান্ত করার উপায় হলো জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়া,বা কিছুক্ষণ হাঁটা।হাটলেও মন শান্ত হয়।মিহি আবার কাজে মন দিলো।সে রিলাক্সে কম্পিউটারে কাজ করতে লাগলো।ছেলেটা এগিয়ে এসে মিহির পাশাপাশি দাঁড়িয়ে বললো,,,,
-এক্সকিউজমি ম্যাম,,,,,
ছেলেটার কথা শোনে মিহি জাস্ট একবার মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে আবার কম্পিউটারের দিকে নজর দিল।মিহির রিয়েকশন দেখে বুঝা যাচ্ছে এই ছেলেটার প্রতি তার কোনো রকম ইন্টারেস্ট নেই।এই ছেলেটা একজন কাস্টমার হতে পারে এমনটাও সে ভাবছে না।সাধারণত শপে কোনো লোক আসলেই সেলাররা নম্রতা, বিনয়ের সাথে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে,বলুন স্যার বা ম্যাম আপনার কি লাগবে?কিন্তু এই ছেলেটার ব্যপারে তেমন কিছুই হলো না মিহির।ছেলেটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,,,,,
-আমি তো এখানের একজন কাস্টমার হতে পারি।আপনি আমার বিষয়ে তেমন ইন্টারেস্ট নন কেন??আমার তো আপনার হেল্পেরও প্রয়োজন হতে পারে,তাইনা?এবার মিহি মাথা তুলে তাকালো।ছেলেটাকে ভালো করে দেখে নিয়ে বললো,,,,,,,,
-প্রথমত আপনি আমাদের কাস্টমার নন।তাই আপনার প্রতি ইন্টারেস্ট দেখিয়ে টাইম নষ্ট করতে চাই না।মিহির কথায় ছেলেটা বেশ অবাক।বলতে গেলে অবাকের শেষ সীমানায় পৌঁছে গেছে।তার চোখে মুখে এক রকম কৌতুহল।মিহি সেই চোখে একবার তাকিয়েই বুঝে ফেলেছে কি বলতে চায় সেই চোখ।মিহি শান্ত গলায় বললো,,,,,,
-এতো অবাক হওয়ার তো কিছু নেই।আপনিও জানেন আপনি এখানে কিছু কিনতে আসেন নি।তবুও যদি বলেন আমার হেল্প আপনার প্রয়োজন তাহলে বলুন আমি আপনাকে কি হেল্প করতে পারি।এবার ছেলেটা মুচকি করে হাসলো।তার খুবই মজা লাগছে মিহির কথায়।একটা মেয়ে এতোটা ইন্টারেস্টিং কিভাবে হতে পারে?সে দেখতে যতটা মায়াবতী,তারচেয়ে বেশি রহস্যময়ী। সে নিচের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বললো,,,,,,
-আমার শরীরের কোথাও কি লিখা আছে আমি কাস্টমার না??আপনি এতোটা সিউর হলেন কেমনে,আমি এখানে কিছু কিনতে আসিনি।
-আপনার শরীরে কিন্তু এটাও লেখা নেই,আপনি কাস্টমার।তাছাড়া আপনি এখানে কিছু কিনতে এলে ২/৩ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতেন না।এবার ছেলেটার চোখ ছোট হলো।তার মুখ দেখে বুঝা যাচ্ছে সে মিহির কথায় বেশ মজা পাচ্ছে। সে আবার বললো,,,

-আমি লেখক,,,,,মিহি কথার মাঝেই বললো,,,,
-তাই?তাহলে আপনি এই শপে কি খুঁজতে এসেছেন??আই মিন,লেখকরা তো বনে,পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়।তাদের ছন্দ খুঁজে।আপনি এই ইট পাথরের মাঝে কোন ছন্দ খুঁজে বেড়াচ্ছেন???তাছাড়া আমরা কিন্তু কোনো ছন্দ সেল করি না।
এবার লেখক সাহেব বেশ মজা পেলো।সে রীতিমত হাসলো।তারপর বলল,,,,
-জ্বি না।আমি এখানে কোনো ছন্দ খুঁজতে আসিনি বা কিনতে আসিনি।আর না আমি কোনো রাইটার।আমার নাম লেখক।আরবান চৌধুরি লেখক।এবার মিহি ভ্রু দুটো কুঁচকে উপরে তুলে বললেন,,,,,
-সিরিয়াসলি???
-ইয়েস,
-কারো নাম লেখক হতে পারে এটা আগে জানা ছিল না।তা আপনার বাবা মায়ের কি স্বপ্ন ছিল আপনি বড় হয়ে রাইটার হবেন???
-না,তাদের এমন কোনো ইচ্ছা ছিল বলে আমার জানা নেই।

শপে আবার লোকজনের বেশ আনাগোনা শুরু হয়ে গেছে।এদিকে লেখক সাহেবের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেলো লেখক সাহেবের পেছনে লম্বার পেমেন্টের সিরিয়াল।বিষয়টা মিহির নজর এড়ায় নি।মিহি কখনও নিজের দায়িত্বের প্রতি অনিহা বা অবহেলা করেনা।সে নিষ্ঠার সাথে নিজের কাজ করে এসেছে।আর এখন এই লেখক সাহেবের সাথে কথা বলে মিহিরও বেশ ভালো লাগছে।কিছু কিছু লোক এতটা ইন্টারেস্টিং হয় যে,তাদের সাথে কথা বলতে ইন্টারেস্ট আরো তৈরি হয়।তবে বেশিক্ষণ কথা বলা যাবে না।তাহলে আজকেই জব শেষ।মিহি লেখকের উদ্দেশ্যে বললো,,,,
-এবার বলুন আমাকে কি প্রয়োজন আপনার??আমার কাজ আছে।আপনার পেছনে লম্বা সিরিয়াল।আপনার কিছু বলার থাকলে বলুন নাহলে এখন আসুন। মিহির কথা শোনে লেখক পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে সত্যি লম্বা লাইন।লেখন হালকা একটু হেসে বললেন,,,,
-আপনি অনেক সুন্দর।লেখকের কথায় মিহির চেহারায় কোনোরূপ পরিবর্তন আসেনি।বরং সে আগের মতোই রিলাক্সে উত্তর দেয়,,,,,
-আমি জানি আমি সুন্দরী।কারো প্রশংসা করলে এমন কিছু দিয়ে প্রশংসা করবেন যেটা সে জানে না।আপনি এখন আসুন।

লেখক কিছুটা দূরে গ্লাসের সাথে হেলে দাঁড়িয়ে আছে।চোখ দুটো মিহির উপর।মেয়েটা সত্যি অসাধারণ।কথার পিঠে কথা বলে।কথা বলার ধরনটাও সুন্দর।কথার মাঝেও এক ধরনের মায়া জড়িয়ে থাকে।তাছাড়া কাজল কালো দুটো মায়াবী চোখে পৃথিবীর সমস্ত সুখ যেন এসে জড়ো হয়েছে। যেকোনো মানুষ এই চোখের মায়ায় হারিয়ে যাবে।এখানে ডুবে মরতে ইচ্ছে করবে।প্রথম পলকে লেখকও ঘায়েল করেছে এই হরিণ টানা মায়াবী দুটো চোখ।কোনো মেয়ে এতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে লেখকের জানা নেই।ভার্সিটি লাইফে অনেক মেয়ের সাথেই লেখকের পরিচয় হয়।কিন্তু কারো প্রতি এতো টান অনুভব হয়নি।যতটা টান অনুভুত হচ্ছে এই মেয়েটার জন্য।

চলবে——-

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here