#চাঁদ_সুন্দরী
সুরমা
পর্ব : ৯
জুঁইয়ের কাণ্ড দেখে পরাগ আর আনিকা দুজনেই বোকার মতো জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে।জুঁই একবার নিজের হাতের চামচের দিকে,একবার পরাগ আর আনিকার দিকে আরেকবার পাশের টেবিলের দিকে তাকায়।বেচারী বুঝতেই পারে নি চিকেনটা এভাবে গিয়ে পড়বে।জুঁইয়ের মুখটা এতোটা কাঁচুমাচু করে রেখেছে যে,যে কেউ দেখলে মনে করবে জুঁইয়ের মাঝে এখন বড় ধরণের অপরাধবোধ কাজ করছে।পরাগের মুখে খাবার।সে খাচ্ছেও না ফেলছেও না।মুখের খাবার মুখে নিয়েই জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।পাশের টেবিলের লোকতো সেই রকম কেঁপে গেছে।তিনি নিজের টেবিল থেকে উঠে পরাগের সামনে এসে বলে,,,,,
-কে ফেললো আমার মাথায় চিকেনটা।লোকটা রেগেমেগে আগুন হয়ে গিয়েছিল।পরাগ তাড়াতাড়ি মুখের খাবার টা গিলে বলে,,,,
-সরি,কেউ ফেলে নি।
-ফেলে নি মানে?না ফেললে আমার মাথায় গিয়ে পড়লো কি করে?চিকেনের কি হাত পা আছে নাকি যে হেঁটে হেঁটে বা উড়ে গিয়ে আমার মাথায় পড়েবে?
-না মানে আসলে আমি বলতে চাইছি কেউ ইচ্ছে করে ফেলে নি।চিকেনটা কাটতে গিয়ে স্লিপ খেয়েছে।সরি।
-কাটতে গিয়ে পড়ে যায় এটা আজ ফাস্ট শোনলাম।খেতেই যেহেতু জানেন না তাহলে রেস্টুরেন্টে খেতে আসেন কেন?বাড়িতে খেলেই পারেন। এতো জোরে লেগেছে,বাপরে বাপ।জুঁই লোকটার কথা শোনে খেয়াল করে দেখে লোকটা মাথা ন্যাড়া করা।জুঁই আনিকার কানের কাছাকাছি মুখটা নিয়ে ফিসফিসের থেকে একটু জোরে বলে,,,,
-আনিকা দেখো,লোকটা মাথা ন্যাড়া বলেই ব্যথা পেয়েছে।চুল থাকলে একটুকুও ব্যথা পেতো না।জুঁইয়ের কথা শোনে লোকটা আরেকটু রেগে যায়।তিনি বলেন,,,,,
-বেয়াদব মেয়ে।একতো অন্যায় করেছো এখন আবার এই সেই বলা হচ্ছে??বড়দের সাথে কেমনে কথা বলতে হয় জানো না??পরাগ দেখলো রেস্টুরেন্টের প্রায় সব লোকজন তাদের দিকে চেয়ে আছে।পরাগ বিষয়টাকে সমাধান করার জন্য চেষ্টা করছে।লোকটার কাছে অনেকবার ক্ষমাও চাইলো।কিন্তু জুঁইয়ের কথা শোনে লোকটার মাথা আরো খারাপ হয়ে যায়।পরাগ বলে,,,,,
-ওর পক্ষ থেকে আমি ক্ষমা চাচ্ছি।পরাগ এতো করুন করে লোকটার কাছে ক্ষমা চাচ্ছিল যে,এই দৃশ্যটা দেখে জুঁইয়ের চোখে পানি চলে আসে।জুঁই দুই হাত জোর করে লোকটার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,,,
-আম সরি।আমি আসলেই কখনও এসব খাবার খাই নি। চামচ দিয়ে কেমনে খাবার খেতে হয় তাও জানি না।তাই এটা আপনার শরীরে গিয়ে পড়েছে।প্লীজ আপনার যা বলার আমাকে বলুন।উনাকে কিছু বলবেন না।উনার কোনো দোষ নেই।উনিতো কিছু করে নি।কথা গুলো বলতে গিয়ে জুঁইয়ের চোখে পানি চলে এসেছিল।মুখটা মেঘলা আকাশের মতো কালো হয়ে গিয়েছিল।হঠাৎ সূর্য উদিত হওয়া আকাশে মেঘ জমার মতো।জুঁইয়ের এমন মুখ দেখে লোকটার সব রাগ চলে গিয়েছিল।তিনি ভালো করে জুঁইকে দেখলেন।মেয়েটা বেশ সুন্দর।অপ্সরীর মতো।চেহারায় এক রকম মুগ্ধতার চাপ,মায়া মায়া ভাব।এমন ফুটফুটে একটা মেয়ের সাথে বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা সম্ভব না।তিনি একবার পরাগের দিকে তাকিয়ে আবার জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,,,,
-ঠিক আছে।আর ক্ষমা চাইতে হবে না।এর পর থেকে স্বাবধানে কাজ করবেন ।কথাগুলো বলে লোকটা চলে গেলে জুঁই মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।পরাগ আস্তে করে বলে,,,,
-বসো।জুঁই কিছু না বলে বসে পড়ে।তার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে।আনিকা জুঁইয়ের হাতের উপর নিজের হাত রেখে বলে,,,,,
-কাঁদছো কেন?
-আমার জন্য তোমাদের কতো গুলো কথা শোনতে হলো।শুধুমাত্র আমার বোকামির জন্য আজ তোমাদের এতো অপমান সহ্য করতে হলো।আমাকে ক্ষমা করো তোমরা।জুঁইয়ের চোখ দিয়ে আবার পানি পড়তে শুরু করেছিল।এবার তার কান্নার একটু শব্দ তৈরি হয়েছিল।পরাগের খারাপ লাগছিল।সাথে অস্বস্তিও লাগছিল।মেয়েটা কথায় কথায় এতো কাঁদে কেন?সে ইচ্ছে করে তো কিছু করে নি।পরাগের ইচ্ছে করছিল জুঁইকে শান্তনা দিতে।কিন্তু মনে সংকোচ কাজ করছিল।আনিকা জুঁইয়ের চোখ দুটি মুছে দিয়ে বলে,,,,
-কি যে বলো।তুমি কি ইচ্ছে করে কিছু করেছো নাকি?এটা একটা এক্সিডেন্ট। আর আমরা কেউ অপমানিত হই নি।হ্যাঁ,লোকটার কথা গুলোতে একটু খারাপ লেগেছিল।কিন্তু সব ঠিক আছে।প্লীজ কান্না থামাও।সবাই আমাদের ফলো করছে।প্লীজ।জুঁই মাথা তুলে তাকিয়ে দেখে সত্যি অনেকে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে।জুঁই সবাইকে এভাবে তাকিয়ে তাকতে দেখে ভীষণ লজ্জা পায়।পরাগের দিকে চোখ পড়তেই দেখে পরাগের মুখটা কেমন উজ্জ্বল হয়ে আছে।মুছকি মুছকি হাসছে।পরাগকে এভাবে দেখে জুঁইয়ের আরো লজ্জা লাগছিল।জুঁই তাড়াতাড়ি মাথাটা নিচু করে ফেলে।পরাগ ওয়েটারকে ডেকে আবার জুঁইয়ের জন্য খাবার অর্ডার করে।জুঁই বলে,,,
-আমি আর খাবো না।আপনারা খান।আমি বসে থাকি।জুঁইয়ের কথা শোনে আনিকা অবাক হয়ে বলে,,,,
-খাবে না মানে?কিছুই তো খেতে পারো নি।আমরা খাবো আর তুমি বসে থাকবে কেন??
-দেখো এমনি একটা ঝামেলা হলো।আর কোনো ঝামেলা করতে চাই না।আমি এসব জীবনেও খাই নি।আর খেতেও চাই না।এসব খাবার আমাদের জন্য নয়।তোমরা খাও।জুঁইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই পরাগ বলে,,,,
-সবার জীবনেই তোমার মতো একটা প্রথম দিন থাকে।মায়ের পেট থেকে কেউ খেয়ে আসি নি বা সব কিছু শিখে আসে নি।এভাবেই একটু একটু করে শিখে।আর এক্সিডেন্টলি একটা ঘটনা ঘটে গেছে বলে এই নয় যে বারবার সেইম ঘটনা ঘটবে।আর জীবনের প্রথম যেকোনো কাজ থেকেই মানুষ শিক্ষা গ্রহণ করে।তুমিও করবে।কোনো জিনিস পারি না বলে পিছিয়ে আসা উচিত নয়।বারবার চেষ্টা করতে হবে।ঠিক আছে?পরাগের কথা শোনে জুঁই আর কিছু বলার মতো পেলো না।শুধু অবাক হয়ে পরাগকে দেখলো।পাঁচ মিনিট পর জুঁইয়ের খাবার চলে আসে।জুঁই এবার খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে।ভয়ে চামচ গুলো হাতে নিতে পারছে না।মনে হচ্ছে আবার কারো মাথায় গিয়ে ঠুস করে পড়বে।আর সেই লোকটা এসে তাকে ইচ্ছে মতো ঝাড়বে।জুঁই অপলকে খাবারটা দেখছিল।পরাগ জুঁইয়ের বিষয়টা বুঝতে পেরে জুঁইয়ের প্লেট থেকে চামচ গুলো নিয়ে বলে,,,,
-চামচ গুলো এভাবে ধরো।পরাগের দেখানো স্টাইলে জুঁই চামচ গুলো হাতে নেয়। পরাগ আবার বলে,,,
-ডান হাতের চামচটা চিকেনে স্কিপ করবে আর বাম হাতে চিকেন নিবে।তাহলে আর প্রবলেম হবে না।এবার খাও।জুঁই পরাগের দেখানো মতো খাবার খেতে থাকে।এবার সত্যি তার কোনো রকম সমস্যা হয়নি।দু একবার একটু আনইজি লাগছিল।কিন্তু পরে আর তেমন লাগে নি।এবার ভালো ভাবে খাবারটা খেতে পেরে জুঁইয়ের ভালো লাগছিল।খাবারটা অনেক টেস্টি ছিল।জুঁই বারবার আড় চোখে পরাগকে দেখছিল।ছেলেটা সত্যি অসাধারণ।এর আগে ভালো করে তাকে দেখাও হয়নি।স্নিগ্ধতায় ভরপুর।প্রথম দেখাতেই হৃদয় ছোঁয়ে যাবার মতো মুখখানি। তার উপর খুবই ভদ্র,আর আন্তরিক।তার জন্য একটা লোক পরাগকে এতো গুলো কথা শোনিয়ে গেলো।এই মুহূর্তে যেকোনো ছেলের রাগ উঠা স্বাভাবিক ছিল। সেখানে পরাগ ঠাণ্ডা মাথায় সব হেণ্ডেল করার চেষ্টা করলো।এমনকি জুঁইকেও শান্তনা দিলো।এই মুহূর্তে জুঁইয়ের খুবই ভালো লাগছিল পরাগের কথা ভাবতে।তাদের খাওয়া দাওয়া শেষ হলে পরাগ জুঁই আর আনিকাকে নিয়ে বাসায় ফিরে আসে।আয়েশা বেগম জুঁই আর আনিকার জন্য ডয়িং রুমে বসে অপেক্ষা করছিল।দুইটা মেয়ে কখন থেকে মার্কেটে গিয়েছে।কোনো খোঁজ খবর নেই।আয়েশা বেগম আনিকাকে অনেকবার কল করে।কিন্তু আনিকা একবারো কল রিসিভ করে নি।মেয়েটা এমনেই।সব সময় ফোন সাইলেন্ট করে রাখে।সময়ে কল করলেও পাওয়া যায় না। পরে বলবে,ইশ মোবাইল সাইলেন্ট ছিল।কিন্তু আজ একটু বেশি টেনশন লাগছে।দুইটা মেয়ে একসাথে।বিপদ বলে কয়ে আসে না।আয়েশা বেগম মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন,’পরাগকে বলবে জুঁইয়ের জন্য যেন একটা মোবাইল কিনে আনে।’এখন থেকে তো জুঁই আর আনিকা এক সাথেই থাকবে।একজন ফোন রিসিভ করলেই তাদের আপডেট নিউজ পাওয়া যাবে।প্রায় দুপুরের দিকে জুঁই,পরাগ আর আনিকা তিনজন একসাথে অনেক গুলো শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে বাসায় প্রবেশ করে।আয়েশা বেগম তাদের দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন।যাক,ভালোভাবে তারা বাসায় ফিরে আসলো।আর কিছুক্ষণ লেট হলে হয়তো আয়েশা বেগমের প্রেশার ফল ডাউন করতে শুরু করতো।আনিকা গিয়ে সব গুলো শপিং সোফায় রেখে আয়েশা বেগমকে জড়িয়ে ধরে বলে,,,,
-আম্মু,নিউ কালেকশন। তাই অনেক ড্রেস কিনেছি।সব গুলো সুন্দর।আয়েশা বেগম হেসে দিয়ে বলেন,,,,,
-মনে হচ্ছে মার্কেটটা সাথে করে নিয়ে এসেছিস।
-আম্মু,ড্রেস গুলো দেখো।আজ না আনলে এগুলো থাকতো?কেউনা কেউ ঠিক কিনে ফেলতো।তাই নিয়ে এসেছি।আর যে ড্রেসটা দেখি সেটাই ভালো লেগে যায়।আমি কি করবো বলোতো।জুঁইয়ের হালকা ভয় লাগছিল।সব গুলো ড্রেসের প্রাইজ এতো বেশি কল্পনাও করা যায় না।একটা জামার প্রাইজ যে এতো টাকা হতে পারে আগে কখনও শোনে নি জুঁই।এই ড্রেসের জন্য এখন আবার আয়েশা বেগম কিছু বলে কিনা কে জানে।জুঁই ভয়ে ভয়ে বলে,,,
-আমি বলেছিলাম এতো ড্রেস না কিনতে।আমরা ছোট বলে দোকানের লোকটাও আমাদের ঠকিয়েছে।একেকটা ড্রেসের দাম ১৫/১৬ হাজার টাকা।লোকটা যত টাকা বলেছে আনিকা ততই দিয়ে দিয়েছে।আমি বলেছিলাম আমাদের ঠকাচ্ছে। কিন্তু আনিকা আমার কথা শোনে নি।জুঁইয়ের কথা শোনে আয়েশা বেগম না হেসে পারলেন না।মেয়েটা নিতান্ত সহজ সরল।তিনি জুঁইয়ের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-কেউ তোদের ঠকায় নি।এগুলোর দাম বেশি।এগুলো ফিক্সড প্রাইজ।
-আমার জন্য এতো দামি জামার দরকার ছিল না।২০০/৩০০ টাকার জামা হলেই হতো।আমি দু তিনশো টাকার জামাই পড়ি।অযথায় আমার জন্য আপনাদের অনেক গুলো টাকা নষ্ট হলো।জুঁইয়ের কথা শোনে আয়েশা বেগম কড়া গলায় বললেন,,,
-এই বাড়ির মেয়ে যা পরবে তুইও তাই পরবি।তুই কোনো দিক দিয়েই আলাদা না।যখন বলেছি তুই এই বাড়ির মেয়ে তখন তুই এই বাড়ির মেয়ের মতোই থাকবি।এ নিয়ে আর কোনো কথা না।যা,সারাদিন বাইরে ছিলি।শরীরে অনেক ডাস্ট। ফ্রেস হয়ে নে।আমি নুডলস ভেজেছি।
চলবে———