#চাঁদ_সুন্দরী
সুরমা
পর্ব : ৪
পরাগ দৌঁড়ে গিয়ে আবার বাসে উঠে।মেয়েটা আগের মতোই আছে।নড়াছড়াও করছে না।পরাগ জুঁইকে কোলে তুলে নেয়।জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।শরীরে যা উত্তাপ।এক্ষণি মেয়েটার ট্রিটমেন্ট দরকার।এই উত্তাপে বেশিক্ষণ থাকলে ব্রেইনে নির্ঘাত চাপ পড়বে।অনেক সময় জ্বরে মানুষের ব্রেইন নষ্ট হয়ে যায়।পরাগ একটা টেক্সি ডেকে জুঁইকে নিয়ে নিজের বাসায় রওনা দেয়।পরাগ দরজার সামনে জুঁইকে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কলিং বেল বাজাচ্ছে।কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না।হয়তো তার মা রান্না ঘরে আছে।কিন্তু এভাবে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায়?।জুঁইয়ের শরীরের উত্তাপে পরাগের শরীর আগুনের মতো গরম হয়ে গেছে।পরাগ আরো কয়েকবার কলিং বেলে চাপ দেয়।কিছুক্ষণ পর পরাগের বোন আনিকা এসে দরজা খুলে দেখে পরাগ একটা মেয়ে খুলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আনিকা অবাক হয়ে বলে,,,
-ভাইয়া,এই মেয়েটা কে??পরাগ আনিকার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলে,,,,
-আম্মু কোথায় রে???
-ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে।
-আম্মুকে গিয়ে বল একটা পরিষ্কার রুমাল আর একটা বাটিতে ঠান্ডা পানি নিয়ে আসতে।
-এসব দিয়ে কি হবে?
-মেয়েটার শরীরে জ্বর।উত্তাপ অনেক বেশি।তুই গিয়ে আম্মু বল আগে আসতে।আনিকা আর কথা বাড়ায় নি।আনিকা গিয়ে তার মাকে ডেকে নিয়ে আসে।পরাগের মা এসে দেখে পরাগ আনিকার রুমে বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।আর একটা ফুটফুটে পরীর মতো মেয়ে বিছানায় শোয়ে আছে।পরাগের মা এসে পরাগের পাশে দাঁড়িয়ে বলে,,,,,
-এই মেয়েটা কে?
-চিনি না আম্মু।গাড়িতে আমার পাশের সিটে বসেছিল।সারা শরীর জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে।সাথে কেউ ছিল না।আর মেয়েটার সেন্সও নেই।এমন বিপদে একটা মেয়েকে ফেলে আসতে ইচ্ছে করলো না।তাই সঙ্গে নিয়ে আসলাম।তুমি তো জানো এখন দেশের কি পরিস্থিতি। এই অবস্থায় মেয়েটাকে ফেলে আসলে যেকোনো রকম বিপদে পড়তে পারতো।
-ভালো করেছিস।মেয়েটাতো খুব সুন্দর।মনে হচ্ছে একটা পরীর বাচ্চা।মাশ আল্লাহ। আমি এর আগে কখনও এতো সুন্দর মেয়ে দেখি নি।আল্লাহ জানে,কোন মায়ের গর্ভে এতো সুন্দর একটা ফুল জন্ম নিলো।কথাগুলো বলতে বলতে পরাগের মা জুঁইয়ের পাশে বসে জুঁইয়ের কপালে হাত রাখে।তারপর পরাগের মা আবার বলে,,,,
-ইশ!এতো অনেক জ্বর শরীরে।
-হুম,তাই তো বললাম।
-আমি মাথায় পট্টি দিচ্ছি।তুই ডাক্তারকে একটা কল কর।ডাক্তার এসে দেখে যাক।কি থেকে কি হয়েছে কে জানে।
-ঠিক আছে।আমি কল দিয়ে দিচ্ছি।তুমি এর দেখাশোনা করো।আমি অফিসে চলে গেলাম।আমার অনেক কাজ আছে।
-ঠিক আছে যা।টেবিলে ব্রেকফাস্ট তৈরি করে রেখেছি।খেয়ে যাস।পরাগ নিজের রুমে এসে ডাক্তারকে কল করে।ডাক্তার চলে আসবে খুব শীঘ্র। পরাগ ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা করে অফিসে চলে যায়।এ দিকে পরাগের মা আর বোন মিলে জুঁইয়ের খুব যত্ন করে।এতে জ্বরটা অনেকটা কমে আসে।ডাক্তার এসে জুঁইকে চেকাপ করে ওষুধ দিয়ে যায়।রাতে জুঁইয়ের জ্বরটা অনেকটা কমে যায়।পরাগের মা জুঁইয়ের পাশে থেকে জুঁইয়ের অনেক যত্ন নেয়।জুঁইয়ের জ্বরটা কমলে চোখ মেলে দেখে পরাগের মা বোন পাশে বসে আছে।জুঁই বিছানা থেকে উঠে বসতে বসতে বলে,,,,,,
-আমি এখন কোথায় ?জুঁইয়ের কথা শোনে পরাগের মা বলে,,,,,
-তুমি এখন ঢাকা।
-আমি এখানে আসলাম কি করে?পরাগের মা হেসে বলেন,,,,
-আমার ছেলে তোমাকে নিয়ে এসেছে।তোমার শরীরে প্রচুর জ্বর ছিল।আবার তোমার সাথেও কেউ ছিল না।একটা মেয়েকে রাস্তায় অসুস্থ অবস্থায় ফেলে আসলে কি থেকে কি হয়ে যায়।এই ভেবে তোমাকে বাসায় নিয়ে এসেছে।তুমি ভয় পেয়ে না।আমরা খারাপ লোক না।তুমি সেইফ আছো।শরীর এখন কেমন লাগছে?
-ভালো।জুঁই কিছুক্ষণ চুপ থাকে।তার বাসে উঠার কথা মনে পড়লেও পরের কিছুই মনে করতে পারলো না।এর বেশি সে কিছু চিন্তাও করতে পারছে না এই মুহূর্তে।শরীর দুর্বল লাগছে।মাথা চিন চিন ব্যথা করছে।পরাগের মা বলে,,,
-তোমার নাম কি?বাসা কোথায়??
-আমার নাম জুঁই।বাসা নেত্রকোনা।
-ঢাকা কোথায় যাচ্ছো?
-জানি না।
-জানি না মানে?কেউ তো আছে যার কাছে তুমি আসছিলে?
-না,ঢাকা আমার কেউ থাকে না।
-ওহহহহ,,ভুল করে বুঝি চলে এসেছো?আচ্ছা,তুমি চিন্তা করো না।আমার ছেলেকে বলবো তোমাকে তোমার বাসায় পৌঁছে দিতে।পরাগের মায়ের কথা শোনে জুঁই আঁৎকে উঠে।জুঁইয়ের চোখে পানি চলে আসে।জুঁই কান্না করে বলে,,,,
-আমাকে প্লীজ বাসায় দিয়ে আসবেন না।আমি বাসায় ফিরতে চাই না।আমি এক্ষণি আপনাদের বাসা থেকে চলে যাবো।আমার জন্য আপনাদের কোনো বিপদে পড়তে হবে না।জুঁইয়ের কথা শোনে পরাগের মা রীতিমতো অবাক হয়।তিনি বলেন,,,,,
-তুমি যে বললে ঢাকায় তোমার কেউ থাকে না।তাহলে তুমি কোথায় থাকবে???
-জানিনা কোথায় থাকবো।কিন্তু কিছুতেই বাসায় যাওয়া যাবে না।
– তুমি যে ঢাকা আছো তোমার বাবা মা জানে?তারা তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবে না???
-আমার বাবা মা নাই
-নাই মানে?
-ছোট বেলায় তারা মারা গেছেন।পরাগের মা কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করলেন।তিনি বললেন,,,
-তাহলে তুমি থাকতে কার কাছে??তোমার নিশ্চয় কেউ অভিভাবক আছেন।তারা জানেন তুমি যে ঢাকায় আছো?
-আমার চাচার কাছে।
-তারা তোমাকে নিয়ে চিন্তা করবেন না?তাদের কাছে তো ফিরে যাওয়া উচিত।পরাগের মায়ের কথা শোনে জুঁই আরো বেশি কান্না করতে থাকে।জুঁই পরাগের মায়ের হাত ধরে বলে,,,,,,
-আমি এক্ষণি চলে যাবো দয়া করে আমাকে আমার চাচার কাছে দিয়ে আসবেন না।আমি ঐখানে আর ফিরে যেতে চাই না।জুঁইয়ের কান্নার বেগ এতো বেড়ে গিয়েছিল যে,পরাগের মা বুঝতে পারছিলেন না তিনি কি বলবেন।পরাগ অফিস থেকে এসে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছিল।হঠাৎ কারো কান্নার আওয়াজ তার কানে ভেসে আসছিল।পরাগ দাঁড়িয়ে শোনে আনিকার রুম থেকে কান্নার আওয়াজটা আসছে।কিন্তু এটা আনিকার কান্নার শব্দ না।পরাগ আনিকার রুমের দিকে গিয়ে দরজার সামনে দাঁড়ায়।পরাগ হা করে জুঁইয়ের কান্না দেখছিল।জুঁই একদম বাচ্চাদের মতো কাঁদছিল।আর তার মা জুঁইকে শান্তনা দিচ্ছিল।পরাগ মুছকি হেসে মনে মনে বলে,,,,,
-কাঁদলেও যে কোনো মেয়েকে এতোটা সুন্দর লাগে এই মেয়েকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না।একদম কিউট বাবুদের মতো কান্না করছে।পরাগের কেন জানি খুবই ভালো লাগছে।ইচ্ছে করছে এখানে দাঁড়িয়ে থেকে এই মেয়েটার কান্নাটা উপভোগ করতে।পরাগের মা জুঁইয়ের চোখটা মুছে দিয়ে বলে,,
-পাগলী মেয়ে।এতো কান্না করার কি আছে?যেতে হবে না তোমাকে ঐ বাড়িতে।এখন চলো,হাত মুখটা ভালো করে ধুয়ে কিছু খেয়ে নিবে।কখন কি খেয়েছো কে জানে।এখন অল্প ভাত খেয়ে ওষুধ খেতে হবে।নয়তো আবার জ্বর আসবে।চলো।আনিকা,তুই জুঁইকে নিয়ে যা।আমি ভাত নিয়ে আসি।বলে পরাগের মা উঠে পড়ে।পরাগের মা এতোটা আন্তরিক যে,জুঁই অবাক হয়।কোনো অপরিচিত মানুষকে এতোটা আপন করা যায়।কেমন আপনজনদের মতো আচরণ করছে।মনে হচ্ছে কতোদিনের চেনা।অথচ কয়েক মুহূর্ত আগে কেউ কাউকে চিনতোও না।আনিকা জুঁইকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়।পরাগের মা রুম থেকে বের হতে গিয়ে দেখে পরাগ দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।পরাগের মা পরাগের কাছে এসে বলে,,,,
-তুই কখন এলি?মায়ের কথা শোনে পরাগের ধ্যান ভাঙ্গে।এতক্ষণ সে কোথায় হারিয়ে ছিল সেও জানে না।পরাগ কিছুটা থমথম খেয়ে বলে,,,,
-এইতো মাত্রই আসলাম।শোনলাম কেউ কান্না করছে।তাই এখানে আসলাম। এসে দেখি মেয়েটা কাঁদছে।সে কাঁদছিল কেন??
-হুম,আমি বলেছি তাকে তার বাড়িতে দিয়ে আসা হবে।এটা শোনে সে কান্না করছিল।
-বাড়ি যাওয়ার কথা শোনে কেউ কান্না করে নাকি?আজিব তো।
-আসলে মেয়েটার বাবা মা নেই।চাচা চাচীর কাছে থাকতো।হয়তো তারা মেয়েটার উপর অত্যাচার করতো।তাই সে ঐ বাড়িতে আর ফিরতে চায় না।না হলে কান্না করার তো কথা না।যা হোক,আগে সুস্থ হোক পরে দেখি কি করা যায়।পরে সব ডিটেইস জানবো।মেয়েটা কিন্তু খুব মিষ্টি।নামটাও মিষ্টি।ওর নাম জুঁই।চেহারাটা দেখলেই কেমন পবিত্র লাগে।একদম ফুলের মতো।আমারতো প্রথমেই খুব ভালো লেগেছে।যদি সে থাকতে চায় তাহলে আমাদের বাসায় থাকুক। আমার কোনো আপত্তি নেই।বয়সটা আনিকার মতোই হবে।দুজন একসাথে থাকবে।পরাগ তার মায়ের কথা শোনে কিছু বললো না।এই মেয়ে এ বাড়িতে থাকলে তার তো কোনো রকম অসুবিধা হবার কথা নয়।পরাগ নিজের রুমে চলে আসে।সারাদিন অনেক কাজ করেছে।এখন তার একটু রেস্ট খুবই দরকার।পরাগের মা একটা প্লেটে খাবার নিয়ে আবার আনিকার রুমে গিয়ে দেখে আনিকা জুঁইয়ের সাথে ভাব জমিয়ে ফেলেছে।দুজনে হেসে হেসে কথা বলছে।পরাগের মাকে দেখে জুঁই চুপ করে মাথাটা নিচু করে ফেলে।পরাগের মা জুঁইয়ের সামনে বসে বলে,,,,
-আমাকে দেখে এমন করার দরকার নেই।আমি তোমার মায়ের মতোই।পরাগের মা ভাত মাখিয়ে একটা লোকমা জুঁইয়ের মুখের সামনে এনে বলে,,,,
-হা করো।জুঁই অবাক হয়ে বলে,,,,
-আপনি আমাকে খাইয়ে দিবেন?
-কেন?আমি মাখিয়ে দিলে অসুবিধা হবে???
-না না,
-তাহলে?হা করো।জুঁই হা করলে পরাগের মা জুঁইকে নিজের হাতে খাইয়ে দিতে থাকে।তিনি খেয়াল করলেন,জুঁইয়ের চোখ থেকে পানি পড়ছে।তিনি বললেন,,,,
-খাবারে কি বেশি জ্বাল হয়ে গেছে?জুঁই মাথা নেড়ে বলে,,,
-না
-তাহলে কাঁদছো কেন??
-আসলে আমাকে কেউ কোনোদিন এতো যত্ন করে খাইয়ে দেয় নিতো।তাই আনন্দে আমার চোখে পানি চলে আসছে!!!!
চলবে——–