#চাঁদ_সুন্দরী
সুরমা
পর্ব : ১
জুঁই ওয়াশরুমে ঢুকে শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে খুব কান্নাকাটি করলো। বুক ফেটে কষ্ট গুলো বের হয়ে আসতে চাইছে। কিছুতেই আজ কান্নাটা থামতে চাইছে না। এতো কষ্ট কি করে জমা হলো বুকের ভেতরে বোঝতে পারছে না জুঁই।
কান্না করতে করতে এক সময় চোখ থেকেও আর পানি বের হচ্ছে না।জুঁই ফ্রেশ হয়ে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।চোখ গুলো ফোলে গেছে।মাথাটা ভারী হয়ে গেছে।বিছানায় শুতে দেরি হলেও চোখে ঘুম আসতে তার একটুকুও দেরি হয় নি।
জুঁইয়ের যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন সে অনুভব করলো তার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।জুঁই চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে শ্বাশুড়ি আয়েশা বেগম তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন। জুঁই শোয়া থেকে উঠে বসে।
শাশুড়ি মা খেয়াল করে দেখে জুঁইয়ের চোখ মুখ ফোলে গেছে। তিনি খুব ভালো করে বুঝতে পারছেন জুঁই কান্না করে ঘুমিয়েছে। আয়েশা বেগম বলেন,,,,,,
-কি হয়েছে তোর? আয়েশা বেগমের কথা শোনে জুঁই কিছুটা হকচকিয়ে বলে,,,,,
-ক,ই? কিছু হয় নিতো। কেন??
-কিছু না হলে কান্না করেছিস কেন? জুঁই মুখটা হাত দিয়ে মুছে বলে,,,
-ই,য়ে না মা,নে
-পরাগের সাথে ঝগড়া হয়েছে? পরাগ তোকে কিছু বলেছে?? এবার যেন জুঁইয়ের কান্নাটা বেড়ে গেলো। তার কলিজার ভেতরটা দুটো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়তে থাকে। জুঁই বৃথা চেষ্টা করলো চোখের পানিটা লুকাতে।কিন্তু বৃষ্টি আসলে যে সহজে লোকের চোখ এড়ানো যায় না।
জুঁইও আয়েশা বেগমের চোখ এড়াতে পারলো না। জুঁইকে এতোটা ডিফরেশনে দেখে শাশুড়ি মা কিছুটা ঘাবড়ে গেলেন। মেয়েটা এতোটা কষ্ট পাচ্ছে কেন? তাহলে কি পরাগ কিছু বলেছে? কিন্তু কেন? হাজারটা প্রশ্ন আসলো আয়েশা বেগমের মনের মধ্যে। যে মেয়েটা সব সময় নেচে খেলে চলতো। সেই মেয়েটা ইদানীং কেমন যেন হয়ে গেছে। রুম থেকেও বেশি বের হয় না।
আগে সুযোগ পেলেই শ্বাশুড়ি মায়ের সাথে গল্প জুড়ে দিতো। কিন্তু কয়েকদিন যাবৎ সে শ্বাশুড়ি মায়ের রুমেও যাচ্ছে না।তিনি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন, পরাগ বাসায় আসলেই তিনি পরাগের সাথে এটা নিয়ে কথা বলবেন। আয়েশা বেগম জুঁইয়ের চোখের জল মুছিয়ে দিলেন।তারপর আদুরে কণ্ঠে বললেন,,,,,,
-পরাগ বাসায় আসুক।আমি বকে দিবো।আর কাঁদিস না।তোকে কাঁদতে দেখলে খারাপ লাগে।আজকে দেখিস,ওকে কান ধরে এক পায়ে দাঁড় করিয়ে রাখবো।আয়েশা বেগমের কথা শোনে জুঁই দুহাত দিয়ে চোখ মুছে আর নাক টানতে টানতে বলে,,,,
-না না,উনাকে কোনো শাস্তি দিয়ো না।উনি কিছু বলে নি আমাকে।
-তাহলে কাঁদছিস কেন??
-আসলে,আমি উনাকে বলেছিলাম আজ একটু দিনের বেলায় বাসায় আসতে।দুজন একটু বাইরে ঘুরতে যাবো।কিন্তু উনি আসেন নি।তাই কান্না পেলো।জুঁইয়ের কথা শোনে শ্বাশুড়ি মা বলেন,,,,,
-এই সামান্য বিষয়ে তুই এতো কাঁদলি?দেখ,চোখ মুখের কি অবস্থা করলি।পাগলি মেয়ে।তুই আর বড় হবি না।হয়তো ভুলে গেছে।তুই কল করে বলতি।
-করেছিলাম কিন্তু রিসিভ করে নি।
-ওহ,,,তাহলে হয়তো কাজে বিজি আছে।আচ্ছা বাদ দে।আজ আমি ওকে বকে দিবো কেমন?কিসের এতো কাজ হুম।আগে বউকে সময় দিতে হবে।পরে কাজ।আসলে কান দুটো মলে দিবো।কেমন?এখন চল,কিছু খাবি।আমিতো ভয় পেয়ে গেছিলাম। মনে করলাম তুই অসুস্থ। শোন,আর কোনোদিন যেন তোকে এভাবে কাঁদতে না দেখি ।
তাহলে কিন্তু আমি খুব করে শাস্তি দিবো।মনে থাকবে তো??আয়েশা বেগমের কথায় জুঁই মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে।
-তাহলে যা,চোখে মুখে পানি দিয়ে আয়।আমি তোর প্রিয় নুডলস ভেজেছি।
-ঠিক আছে।তুমি যাও আমি আসছি।
-ঠিক আছে।তাড়াতাড়ি আয়।আয়েশা বেগম রুম থেকে চলে গেলে জুঁই মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরাগকে কল করে।কয়েকবার রিং বাজলে কলটা রিসিভ করে।জুঁই অনেকটা আগ্রহ নিয়ে হ্যালো বলতে যাবে তার আগেই অপর পাশ থেকে মেয়ে কণ্ঠে হ্যালো শব্দটা ভেসে আসে।পরাগের ফোন কোনো মেয়ের হাতে?
জুঁইয়ের বুকে ধুম করে মারাত্মক আঘাত লাগে।সাথে সাথে সে কলটা কেটে দেয়।এবার আর সহ্য হলোনা জুঁইয়ের।শব্দ করে কান্না করে দেয়।জুঁইয়ের কান্নার আওয়াজ আয়েশা বেগমের কানে আসতেই তিনি সোফা থেকে উঠে দাঁড়ান।তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে জুঁইয়ের রুমে এসে দেখে জুঁই ফ্লোরে বসে কান্না করছে।তিনি এসে জুঁইকে শান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
-আবার কি হয়েছে?কাঁদছিস কেন?
-ভ্যাঁ ভ্যাঁ ভ্যাঁ
-আরে বলবি তো কি হয়েছে?না বললে আমি বুঝবো কি করে বলতো।আমারো তো টেনশন হয় নাকি?তোরা মনে হয় আমাকে বাঁচতে দিবি না।বল কি হয়েছে তোর।জুঁই এবার এতোটা কান্না করেছে যে,কাঁদতে কাঁদতে তার হেচকি উঠে যায়।জুই কাঁদতে কাঁদতে বলে,,,
-আমি এখন উনাকে কল করেছিলাম।
-তো কি হয়েছে?রিসিভ করেনি?বললাম তো হয়তো কাজে বিজি।পরে দেখবি সময় করে কল করবে।এটার জন্য কান্না করতে হবে??পাগলী মেয়ে।এমন অবুঝের মতো করছিস কেন।ইশ।পিচ্চি ছিলি এখনও আছিস।কবে যে বড় হবি।আসলে এতো পিচ্ছি মেয়েদের বিয়ে দেওয়া উচিত নয়।জুঁই চোখ কচলে বলে,,,
-কলটা রিসিভ করেছিল।
-ওহ,রিসিভ করেছিল তাহলে কাঁদছিস কেন?এতক্ষণ কাঁদলি,কেন রিসিভ করছে না তার জন্য।আর এখন কাঁদছিস,কেন রিসিভ করলো তার জন্য।
-তোমার ছেলে রিসিভ করে নি।একটা মেয়ে রিসিভ করেছে।উনার ফোন মেয়েদের কাছে কেন?
-তাতে কি হয়েছে?হয়তো পরাগ মিটিং এ আছে।তাই কোনো স্টাফের কাছে ফোনটা রেখে গেছে।এই সামান্য বিষয়টা নিয়ে এতো নার্ভাস হলে হবে?চল,এখন কিছু খাবি।তার পর দেখছি মেয়েটা কে।এখন কান্নাটা থামা।
-আমি খাবো না।তুমি খাও।বলে জুঁই আরো জোরে কান্না করতে থাকে।জুঁইয়ের কান্না কিছুতেই আয়েশা বেগম থামাতে পারে নি।তিনি বললেন,,,,
-আচ্ছা দাঁড়া।আমি পরাগকে কল করে দেখছি।তুই চুপ করে বস।আয়েশা বেগম উঠে নিজের রুমে চলে আসেন।মোবাইলটা হাতে নিয়ে পরাগকে অনেকবার কল করেন।কিন্তু রিসিভ করে নি।এদিকে জুঁই ফ্লোর থেকে উঠে দরজাটা ভেতর থেকে লক করেূ দেয়।
আয়েশা বেগম জুঁইয়ের রুমে এসে দেখে দরজা লাগানো।তিনি অনেকবার দরজা নক করলেও জুঁই দরজা খুলে নি।বাধ্য হয়ে তিনি ফিরে আসলেন।ডয়িং রুমে বসে পরাগের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।আয়েশা বেগমও অনেকটা ঘাবড়ে যান। জুঁইয়ের আচরনে।
পরাগ নিজের সব কাজ শেষ করে রাত ১১টায় বাসায় ফিরে আসে।কলিং বেলে চাপ দিতেই আয়েশা বেগম দরজা খুলে দেন।পরাগের মনে হলো তার মা এতক্ষণ দরজার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলো।নয়তো এতো তাড়াতাড়ি দরজা খোলা সম্ভব হতো না।পরাগ রুমে ঢুকতেই আয়েশা বেগম কড়া গলায় বললেন,,,,
-এতক্ষণে বাসায় আসার সময় হলো?বাসায় যে বউ আছে সেটা কি মনে পড়ে না??পাগল হয়ে তো বিয়ে করলি।তাহলে এখন ঠিকঠাক মতো দায়িত্ব টুকু পালন করতে পারছিস না কেন??মায়ের কথা শোনে পরাগ গম্ভীর গলায় বলেন,,,,,
-কেন কি হয়েছে??
-কি হয়েছে জানিস না?মেয়েটা তোকে বলে নি আজ তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসতে??
-হু,বলেছিল।কিন্তু অফিসে প্রচুর কাজ ছিল।তাই আসতে পারি নি।তো????
-আগে ঘর পরে অন্যকিছু। আর আসতে যেহেতু পারিস নি তাহলে একটা কল করে বলতে তো পারতি?নাকি সেটারও সময় ছিল না?তুই সেটাও করিস নি।উল্টে জুঁই কল করেছিল আর কোন মেয়ে কল রিসিভ করেছিল।এই শোনে তখন থেকে কান্না করে যাচ্ছে।এখন তো দরজাও ভেতর থেকে লাগিয়ে দিয়েছে।এর পর যদি আর কোনোদিন তোকে এতটা ইরেসপন্সিপল হতে দেখি তাহলে দেখিস আমি তোকে কি করি।
পরাগ দাঁড়িয়ে থেকে তার মায়ের বকা গুলো শোনছিল এতক্ষণ।পরাগের জুঁইয়ের উপর রাগ উঠতেছে জুঁইয়ের উপর।মেয়েটা এতোটা স্টুপিড যে পরাগ কি বলবে বুঝতে পারছে না।একতো সারাদিন এক প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করেও সেটা ব্যর্থ হলো।এই নিয়ে এমনিতেই মাথা হ্যাং হয়ে আছে।আর এখন মায়ের কাছে বকা গুলো শোনে পরাগের রাগে মাথা ফোটে যাচ্ছে।পরাগ কোনো মতে রাগটা চেপে রেখে নিজের রুমের কাছে এসে দেখে দরজা ভেতর থেকে লাগানো।পরাগ দরজায় নক করে বলে,,,
-জুঁই,দরজা খুলো।ভেতর থেকে জুঁই পরাগের কণ্ঠ শোনে এক লাফে বিছানা থেকে উঠে দরজা খুলে দেয়।পরাগকে দেখে জুঁই পাখির মতো উড়ে এসে পরাগের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।হাউমাউ করে কান্না করে দেয় সে।জুঁইয়ের জানটা যেন কোথাও থেকে ফিরে আসে।
চলবে——–