#রজনীগন্ধা
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
#পর্ব_৫
সাতদিন কেটে গেছে। আজ শুক্রবার। জুম্মার নামায শেষে বাড়ির পথে হাঁটছে অভি। তাদের বাড়িতে উঠান আছে। উঠানের একপাশে রাস্তা, অন্য পাশে টিনের দোচালা বাড়ি। তাদের এলাকাটাও গ্রাম্য। দেখলে মনে হবে এখানে এখনো সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি। অভি রাস্তা থেকেই শুনতে পেল, বাড়ির ভেতর থেকে তর্কাতর্কির আওয়াজ আসছে। সে দ্রুত ঘরের দিকে পা বাড়ালো।
জহুরা বেগম পারছেন না, দোলার গালে ঠাস ঠাস করে বসিয়ে দেন। অনেকটা রেগে গেছেন তিনি। রাগের কারণ,দোলাকে বলেছিলেন ভাত বাড়তে, দোলা স্পষ্ট জবাবে বলেছে, ‘আমি পারতাম না। আপনে বাড়েন। সামান্য ভাতটাও আমার বাড়তে হইবো?’
জহুরা বেগম দোলার দিকে বিস্মিত নয়নে ক্ষণকাল তাকিয়েই রইলেন। এক সপ্তাহ হয়েছে এসেছে, আর এখনি তার মুখের উপর ‘না’ বলা! দোলাকে তিনি কিছু বলেননি। কিন্তু একা একাই রাগে গজগজ করতে লাগলেন। দোলাকে উদ্দেশ্য করে এটাসেটা অনেক কথা শুনিয়ে দিলেন। দোলা কোনো জবাব দিল না। চুপচাপ নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে রয়েছে। অভিকে উঠানে দেখতে পেয়ে জহুরা বেগম দৌঁড়ে আসেন। তারপর বলেন, দোলার কত সাহস বেড়েছে- সব শুনে অভি নির্বিকার। ঘরে এসে গা থেকে পাঞ্জাবি টা খুলতে খুলতে নিস্তরঙ্গ গলায় অভি বলল, ‘আম্মার মুখের উপর কথা কইয়ো না।’
দোলা উঠে বসল, ‘তাই বইলা উনি যাই বলব সব করতে হইব? আমার এইটা কী শরীর না?’
–‘বুঝাইয়া বলবা। ডাইরেক্ট মানা করবা না। নাইলে তোমারই খারাপ লাগব। এই যে কত উল্টাপাল্টা কথা বলতেছে, খারাপ লাগতেছে না শুনতে?’
দোলা ধীর স্বরে বলল, ‘লাগতেছে।’
–‘এই জন্যেই বললাম, বুঝাইয়া বলবা। তাইলে বুঝব।’
–‘উনি জীবনেও বুঝব না। আপনের আগের বউরে বুঝছিল? বলেন।’
–‘ওর কথা এর মধ্যে আসতেছে কেন?’
–‘গতকাল পাশের বাসার টুম্পা ভাবির থেইকা সবই শুনছি আমি। সে বলছে আমারে সবকিছু। আপনের আগের বউ কারো সাথে ভাইগা যায় নাই। তার বাচ্চা হইত না এই জন্যে আপনি মাইরা ঘর থেইকা বাইর কইরা দিছেন। কথা কী সত্যি না?’
অভি একটুক্ষণ চুপ থাকে। তারপর বলল, ‘হুম, সত্যি।’
–‘আর আপনের মায় বিয়ার আগে কইছে, অন্যজনের লগে গেছে গা। যাইহোক, তারে ডাক্তার দেখাইছিলেন? ডাক্তার কী একদম বন্ধ্যা কইছিল তারে?’
–‘ডাক্তার দেখায়নি।’
–‘তাইলে বুঝলেন কেমনে হেয় মা হইতে পারব না?’
–‘এত কিছু তোমার জাইনা লাভ কী? চুপ থাকো। ভাত দিবা না?’
দোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নিল। তারপর এগিয়ে এসে অভির দুই কাঁধে তার হাত জোড়া তুলে দিয়ে গায়ের সঙ্গে গা মিলিয়ে দাঁড়াল। অভি টাল সামলাতে দোলার কোমরে নিজের হাত গুঁজে দিল। দোলা আহ্লাদী কণ্ঠে বলল, ‘যদি আমার কোনোদিন বাচ্চা না অয়, তাইলে কী আমারেও মাইরা ভাগাইয়া দিবেন?’
–‘এগুলা কইয়ো না তো। ভাত দিতে আসো।’ বলে কোমর থেকে হাত ছাড়িয়ে নেয় অভি। ঝাঁকি দিয়ে দোলাকে সোজা করে নিজে সরে যায়। প্যান্ট বদলানোর জন্য লুঙ্গিটা তুলে নেয় আলনা থেকে। দোলা মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘কোনো রসকষ নাই! কেমন ব্যাটা মানুষ! মাবুদ..’ তারপর গটগট আওয়াজ তুলে বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। অভি হাসে, নিঃশব্দ সেই হাসি। দোলাকে এই অল্প কয়দিনেই দারুণ ভাবে মনে ধরেছে তার। এই মেয়েটি রজনীর চেয়েও ভীষণ মিষ্টি। কী ডাগর ডাগর চোখ! এরকম একটা মেয়েকে আগের জামাই কী করে ধরে ধরে পিটাতো? কে জানে! অভি ভাবনা স্থগিত করে। বিকেলের দিকে দোকান দেখতে যেতে হবে তাকে। দোলার বাবার দেওয়া তিন লাখ টাকা দিয়ে একটি মুদি দোকান সঙ্গে ফ্ল্যাক্সিলোডও করা হবে- এমন একটি দোকান দিতে চায় অভি। ইতিমধ্যে কয়েকটি ভালো জায়গায় দোকান দেখা হয়েছে। আজকে আরও একবার দোকানের খোঁজে বের হবে। দোকান দিলেই তো হবে না, ভালো প্লেসে দিতে হবে।
★
মাত্র কয়েকটা দিন, অথচ রজনী অর্থিকে দেখলে মনে হয় এদের পরিচয় না জানি কত আগের! অর্থি- যে কীনা সবসময় গম্ভীর মুখে থাকত, মেপে কথা বলা ছাড়া একটি শব্দও উচ্চারণ করত না, নিজের পাপার সঙ্গেও যে দূরে থেকে মিশতো, সবসময় একাকীত্বের জগতে বিচরণ ছিল যার- সেই অর্থি আজ রজনীর সাথে মিলে প্রাণ খুলে হাসে। রজনীর সঙ্গে থেকে থেকে কত যে পাগলামি শিখেছে। সেদিন অনেক রাত করে বাড়ি ফিরে আদ্র। একটা ম্যাগাজিনের ফটোসেশান ছিল। বাড়ি ফিরেই লম্বা সময়ের শাওয়ার নেয় সে। তারপর যেই না ওয়াশরুম থেকে বের হবে, ওমনি অর্থি দরজার একপাশ থেকে ‘ভাউউউউ’ বলে চেঁচিয়ে লাফিয়ে সামনে আসে। তার পা অবধি লম্বা সাদা ফ্রক। মেঝেতে ফ্রকের শেষাংশ গড়াগড়ি খাচ্ছে। চোখমুখ অত্যন্ত সাদা। আদ্র পরে জেনেছে,ওগুলো পাউডারের কর্ম। চুলগুলো সামনে এনে একদম ছোট্ট ভূত সেজেছিল অর্থি। সত্যি বলতে, আদ্র ভীষণ চমকে উঠেছিল। বুকের ভেতর আচানক ভূমিকম্প হয়। সে আঁতকে লাফিয়ে উঠে পেছনে সরে যায়। তাই দেখে খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়েছিল অর্থি। এগাল-ওগাল হাসি, পেট চেপে হাসছিল। আর একটু হলেই গড়াগড়ি খাবে এমন অবস্থা।
আদ্র’র রাগ হয়েও হয় না। এত উৎফুল্ল কখনো দেখা হয়নি অর্থিকে। তাই সে রাগ চেপে গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিল, ‘এসব কার কারসাজি অর্থি?’
অর্থি হাসতে হাসতেই জবাব দিয়েছিল, ‘ননা মা..’
অর্থি না বললেও আদ্র বেশ ভালো করেই বুঝেছিল, এসব রজনীর শেখানো… রজনী ছাড়া আর কেইবা আছে এত দুষ্টবুদ্ধি সম্পন্ন এ-বাড়িতে? কার সাহস আদ্রকে ভয় দেখায়? আদ্র মৃদু শ্বাস ফেলে সেদিন রাতে ঘুমোতে যায়। তবে ভালো ঘুম হয়নি বেচারার। ঘরের বাতি জ্বালিয়ে ঘুমানোর পরেও একটু পর পর ঘুম ভেঙেছিল তার। অর্থির হঠাৎ ওমন আগমন তাকে সত্যি বেশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল।
বিকেলের পর পরই আদ্র বাড়ি ফিরে আজ। নাইট টাইম শ্যুটিং ছিল আজকে। কিন্তু নায়িকার মায়ের হঠাৎ অসুস্থতায় শ্যুটিং অফ করে দেওয়া হলো। ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেয় আদ্র। চয়ন নামের একটি ছেলে এসে তাকে কফি দিয়ে গেল। অন্তরাকে বদলে চয়নকে রাখা হয়েছে, আজ নিয়ে তিনদিন। সেই রাতে অন্তরাকে বেশ কড়া ভাবেই আদ্র ওয়ার্নিং দিয়ে দিয়েছিল, যেন রজনীকে আর কখনো কোনো অপমানজনক কথা না বলে। আর রজনীর কাছে মাফ চায়। অন্তরা মাফও চায়নি। উল্টো আবারও রজনী-অর্থির সম্পর্ক নিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলেছে। সে বলেছে,রজনী অর্থির ননা মা না, আসল মা হতে চায়। এই জন্যে এত গলায় গলায় ভাব লাগাচ্ছে। আদ্র সাহেবও নাকি রজনীকে প্রায়োরিটি দিয়ে মাথায় তুলছে। সঙ্গে আরও নোংরা নোংরা কথা। যা শুনে আদ্র’র ব্রক্ষ্মতালু রাগের আগুনে জ্বলতে শুরু করে। সে তৎক্ষনাৎ অন্তরার চাকরি আউট করে দেয় এবং চয়ন নামের এই ছেলেটিকে রাখে। অন্তরা যাওয়ার আগে কনফেস করে যায়, সে আদ্রকে কখনো নায়কের চোখে দেখেনি, দেখেছে প্রেমিকের চোখে! সে আদ্রকে ভালোবাসে! আদ্র হেসেছিল এসব শুনে। ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রিতে এসে কতই না এরকম পাগল দেখেছে সে তার জন্য!
অন্তরাকে বিদায় করার জন্য রজনী খুশি হয়েছে কী হয়নি- তা বোঝা না গেলেও, অর্থি যে দারুণ খুশি হয়েছে- সেটা স্পষ্টই বোঝা গেছে। এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই কফিটা শেষ করে আদ্র। তারপর অর্থির খোঁজ করে। অর্থির রুমে সে নেই, অর্থির জন্য যে আলাদা খেলার ঘর আছে, সেখানেও সে নেই। গেল কোথায়? রজনীর রুমে এসে একবার ঘুরে গেল আদ্র, ঘরের দরজা খোলা, ভেতরে কেউ নেই। আদ্র একটু অবাক হলো। বাইরে ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির শব্দ আদ্র’র কানে আসছে। আষাঢ় মাস, যখন তখন বৃষ্টি গড়িয়ে নামে। চয়নকে দেখা গেল, কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আদ্র কিছু বলার আগেই চয়ন বিনীত স্বরে বলল, ‘স্যার, কাকে খুঁজছেন?’
–‘অর্থি কোথায়?’
–‘ছোট ম্যাডাম তো রজনী ম্যামের সঙ্গে আছে।’
–‘কোথায় আছে?’
–‘ছাদে।’
–‘ছাদে!’ আদ্র অবাক, তারপরই একপ্রকার ছুটে ছাদের দিকে গেল। বাহিরে সব কিছু ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি নেমেছে, আর এরা দু’জন ছাদে করছেটা কী? আদ্র’র এত রাগ হয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নেয়, আজকে রজনীকে কিছু কড়া কথা বলবে। তার জন্যে অর্থির যদি কোনো ক্ষতি হয়, তবে আদ্র একদম ছেড়ে কথা বলবে না।
ছাদের মধ্যিখানে সিমেন্টের বড় ছাতা, সেই ছাতার নিচে গোল টেবিল, তার উপর পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে ছোট্ট অর্থি। তার গায়ে আসমানী রঙের হাতাকাটা ফ্রক, এলোমেলো চুলগুলো ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে। বাতাসের তোড়ে বৃষ্টি একেকবার একেকদিকে বেঁকে যাচ্ছে। বাতাসে উড়ছে অর্থির চুলগুলো। দারুণ মিষ্টি দেখাচ্ছে তাকে। রজনী কোথায়? আদ্র ছাদের দরজায়। একটা ছাতা না আনলে অর্থির কাছে যাওয়া যাবে না। আদ্র ছাতার জন্য যেই না নিচে নামতে যাবে, ওমনি শুনলো একটা উৎসুক কণ্ঠস্বর। আদ্র ফিরে তাকিয়ে স্তব্ধ বনে গেল।
রজনী এই বাড়িতে এসেছিল একদম এক কাপড়ে। তার সাথে দ্বিতীয় কোনো কাপড় ছিল না। তাই আদ্র পরদিনই একজন লেডি সেলার ঘরেই নিয়ে আসে। তার থেকে রজনী নিজের পছন্দমতো কিছু কাপড় রেখে দেয় পরার জন্য। তন্মধ্যে কয়েকটা শাড়িও ছিল বোধহয়। সেই শাড়িগুলোরই একটি এখন তার গায়ে। শাড়িটির রঙ একদম সাদা। সাদা জমিনে সাদা পাথরের অল্পস্বল্প কাজ। চুলগুলো হাত খোঁপা করা। তার মাথা বেয়ে বৃষ্টির জল প্রথমে ভ্রুতে, তারপর চোখের পাতায় গড়ায়, পলক ফেলতেই জল ফোঁটা টুপ করে ঝরে যায়। কী অপূর্ব! বিমোহিত চোখজোড়ায় ঘোর লাগে। প্রকৃতি এমনি, তার নিজস্ব জাদু বলে মানুষের মন নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা তার আছে। রাত দেখলে মনের গহীনের লুকায়িত দুঃখগুলো আপনাতেই বেরিয়ে আসে। আবার পড়ন্ত বিকেলের নির্মল বাতাসে মানুষের শরীরে এক ধরনের আবেশ তৈরি হয়। সকালের প্রথম সূর্য দেখলে কর্মক্ষমতা কেমন যেন দ্বিগুণ হয়ে যায়। আবার বৃষ্টি দেখলে ছেলে-বুড়ো সবাই বাচ্চা হয়ে যায়!
রজনী বাচ্চাদের মতোন দু’দিকে হাত তুলে গোল গোল ঘুরে। তারপর থামে, হাসে। বৃষ্টির ঝমঝম শব্দের সঙ্গে তার হাসির শব্দ মিলে এক অন্যরকম মায়াজাল তৈরি করছে। সেই মায়াজাল থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন, বিশেষত পুরুষদের জন্য। আদ্র নিজের অজান্তেই ছাদের গায়ে পা রাখল। এক পা এক পা করে একটু এগোতেই খোলা আকাশের নিচে এসে পড়ল সে। বৃষ্টির ফোঁটা বেগ নিয়ে তার গায়ের উপর পতিত হতেই আদ্র’র হুশ ফিরে আসে। সে আকাশের দিকে চমকে তাকাতে গিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে। ঠিক তখন আবার ভেসে আসে রজনীর কণ্ঠস্বর, ‘আপনিও ভিজবেন? এদিক আসুন। ভালো লাগছে, তাই না?’
শোনা যায় অর্থি গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, ‘ইয়ে.. পাপাও ভিজবে, পাপাও ভিজবে।’
আদ্র ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাল। রজনী ততক্ষণে দোলনায় গিয়ে বসেছে। নিজেই নিজেকে দোল দিতে লাগল। কিন্তু রজনীর চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে, দোল খাওয়ায় মজা পাচ্ছে না। সে উঠে আসে। আদ্র’র কাছাকাছি এসে বলল, ‘আপনি এরকম ভ্যাবদার মতো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? এক জায়গায় স্ট্যাচু হয়ে ভিজতে থাকা আবার কোন ক্যাটাগরির ভেজার স্টাইল?’
আদ্র বলল, ‘আমি ভিজতে আসিনি।’
–‘ওমা তাহলে কেন এসেছেন!’ বলে এক হাত গালের সঙ্গে ঠেস দিল রজনী। কেমন পাগলাটে পাগলাটে ভাব তার। বৃষ্টি দেখে এই মেয়ে খুশিতে পাগল হয়ে যায়নি তো? আদ্র’র সন্দেহ হয়।
–‘অনেক ভিজেছেন। এখন নিচে চলুন।’
–‘না, যাব না। আর একটুক্ষণ থাকি?’
–‘অনেক তো ভিজলেন। অর্থির ঠান্ডা লেগে যাবে তো। আপনার কারণে ও নিচে যাবে না। আপনি গেলে ও যাবে।’
–‘ও তো ছাতার মধ্যে আছে রে ভাই! ঠান্ডা লাগবে না।’
–‘ভাই?’ ভ্রু কুঁচকালো আদ্র।
–‘তো কী? জান ডাকব? আপনি আমার জান?’ বলে হো হো শব্দে হাসিতে মেতে উঠে রজনী। আদ্র এবার ড্যাম শিউর, এই মেয়ের মাথার দু-একটা তার ছিঁড়ে গেছে। যেরকম বৃষ্টি আসলে কারেন্টের তার ছিঁড়ে যায়, ওরকম।
আদ্র অনুরোধ করল, ‘আপনি অনেকক্ষণ যাবত ভিজছেন। আপনার পুরো শরীর ভিজে জবজব করছে।’
–‘আপনি আমার শরীরও দেখেছেন?’ দুই ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে রজনী। আদ্র থতমত খেল।
–‘না মানে…’
–‘আর কী দেখেছেন? হুঁ? বলুন, আর কী কী দেখেছেন?’
–‘আমি আপনার কিছুই দেখিনি। ফর গড সেক, নিচে চলুন।’
–‘যাব না।’ বলে দোলনায় গিয়ে বসে রজনী। আদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছাতার মধ্যে গিয়ে ঢুকে। অর্থিকে বলল, ‘মামনী নিচে চলো।’
–‘কেন পাপা? আমি আরও থাকব।’
–‘ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে। একটুপর সন্ধ্যা নামবে।’
–‘নামুক, ননা মায়ের সঙ্গে যাব।’
আদ্র রাগ রাগ কণ্ঠে বলল, ‘তোমার ননা মা পাগল হয়ে গেছে। উনি নামবেন না। তুমি আসো।’
–‘উঁহু.. ননা মা থাকলে আমিও থাকব। উনি ভিজবে, আমি দেখব। তুমি যাও পাপা, ডিস্টার্ব করো না তো।’
আদ্র হতবাক! এরই মধ্যে অর্থিকে একদম হাত করে নিয়েছে। তার মেয়ে, অথচ তারই কথা শুনছে না! আদ্র’র মেজাজ খারাপ হয়। সে আবার রজনীর কাছে গেল। রজনী দোলনায় পা ঝুলিয়ে বসে বসে গুনগুন করছে। আদ্র গিয়ে বলল, ‘আপনি নামবেন না?’
–‘না।’ সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেয় রজনী।
–‘শেষবারের মতো বলছি, আপনি নামবেন কী-না?’
রজনী কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ‘নামব। আগে আমাকে কয়েকবার জোরে জোরে দোল দিন, তারপর।’
–‘মানে কী!’
–‘মানে আমি দোলনায় ভালোমতো চড়ে তবেই নিচে নামবো।’
আদ্র’র এতটা রাগ লাগছে যে…
তার ইচ্ছে করছে গটগট করে নিচে চলে যেতে। তারপর যত ইচ্ছে তত ভিজতো এই মেয়ে। কেউ মানা করত না। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে অর্থি। রজনী না নামলে ও নামবে না। আবার ওকে ছাদে এই পরিবেশে রেখে আদ্র শান্তি পাবে না। আদ্র’র নিজেকে চিপায় পড়া- অবস্থার মতোন লাগছে। সে নিজের ক্রোধ সামলে রজনীকে কয়েকবার জোরে জোরে দোল দেয়। রজনী হৈচৈ করে পুরো ছাদ মাতিয়ে দোল খেতে লাগল। বৃষ্টির ধারা তখনো ভূমিতে পতিত হচ্ছে। ছাদে ইতিমধ্যে গোড়ালি সমান পানি জমে গেছে। পানি সরছে না কেন? একবার দারোয়ান কে ইনফর্ম করতে হবে বিষয়টা- ভাবে আদ্র।
দোল থামিয়ে আদ্র বলল, ‘এবার হইছে? এখন চলেন।’
–‘যাব না…’ বলে ফিক করে হেসে উঠে রজনী। আদ্র আগুন গরম চোখে তাকাল। কিছু কঠিন কথা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রজনী উঠে দাঁড়ায়। গাল ভর্তি হাসি নিয়ে বলে, ‘যাচ্ছি… আর জ্বালাব না।’
★
রাতের খাওয়া শেষে অর্থির ঘরে উঁকি দেয় আদ্র। অর্থিকে ঘুম পাড়াচ্ছে রজনী। তার গায়ে হালকা বেগুনি রঙের সুতি থ্রি-পিস। আদ্রকে দেখে রজনী জড়সড় হয়ে উঠে দাঁড়াল।
আদ্র বলল, ‘অর্থি ঘুমিয়ে গেছে?’
–‘হুঁ।’
–‘আপনি এরকম গুটিশুটি মেরে আছেন কেন? হোয়াট হ্যাপেন্ড?’
রজনী অপরাধী কণ্ঠে বলল, ‘সরি। ওই সময়ে আপনার সাথে কেমন বেয়াদবের মতো আচরণ করেছি। আসলে বৃষ্টি আমার খুব পছন্দ। তাই খুশির ঠ্যালায়…’
–‘খুশির চোটে আপনার মাথা বিগড়ে গেছিল। আপনি পাগল হয়ে গেছিলেন, তাই তো?’ হাসি হাসি মুখ করে প্রশ্ন করল আদ্র। রজনী লজ্জা পেয়ে মাথা ঝাঁকালো, মুখে কিছু বলল না।
–‘ইটস ওকে। পাগলদের আচরণ ধরতে নেই। তাই আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি।’
–‘ধ..ধন্যবাদ।’
আদ্র চলে গেল। রজনী আরও কিছুক্ষণ অর্থির সঙ্গেই থাকল। তারপর অর্থির শরীর ভালোমতো চাদরে ঢেকে দিয়ে সে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। তার শরীরটা কেমন যেন লাগছে। সত্যি না জ্বর উঠে!
অনেকদিন পর এত ভিজলো রজনী।
একটার দিকে আবার ঝমঝম শব্দ হয়। আদ্র বুঝলো বৃষ্টি পড়ছে। সে তখনো ঘুমোয়নি। লেপটপে শুয়ে শুয়ে মুভি দেখছিল। আদ্র উঠে ঘরের জানালা গুলো আঁটকে দেয়, তখনি ভীষণ আলোয় সারা আকাশ আলোকিত হয়ে উঠে। কানে তালা লাগানো শব্দে বিদ্যুৎ চমকায়। আদ্র দ্রুত জানালা আঁটকে অর্থির ঘরে গেল। অর্থি ঘুমোচ্ছে। বজ্রপাতের শব্দ সে শুনতে পায়নি। গাঢ় গভীর ঘুম, আদ্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে, রজনীকে ডেকে বলবে অর্থির সাথে ঘুমানোর জন্য। পরে যদি জেগে যায় বাচ্চাটা? আদ্র তৎক্ষনাৎ নিচে নামে। পুরো ডাইনিং স্পেসে মৃদু হলুদাভ আলো। বাড়ির সবাই ঘুমোচ্ছে। আদ্র রজনীর দরজায় দুই বার টোকা দিল। কিন্তু রজনীর কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। আদ্র দরজায় আস্তে করে ধাক্কা দিতেই দরজার পাল্লা খুলে গেল। আদ্র ঘরের ভেতর উঁকি দিয়ে দেখল, কেমন কাচুমাচু হয়ে ঘুমোচ্ছে রজনী। গায়ের উপর মোটা চাদর। আদ্র কোনোকিছু না ভেবেই ঘরে ঢুকল। রজনীকে কয়েকবার ডাকার পর রজনী সাড়া দেয়, ‘হুঁ..’
তারপর আবার ঘুম। আদ্র কাছে যেতেই বুঝতে পারে, রজনী ঠিক নেই। সামথিং ইজ রং!
আদ্র আলতো ভাবে রজনীর কপাল ছুঁতেই চমকে উঠল। জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে। এত গরম! আদ্র কোনোকিছু ভাবল না। রজনীর একদম কাছে গিয়ে দাঁড়াল। মৃদু স্বরে বারবার রজনীর নাম ধরে ডাকল। কিন্তু রজনীর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আদ্র বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ল, সেই সঙ্গে রাগও লাগল। সে মানা করেছিল ভিজতে, তবুও ভিজেছে। এখন বুঝুক মজা!!
(চলবে)