#ধারাবাহিক_গল্প #হ্যাঁ_তোমায়_ভালোবেসেছিলাম ০৪
#আসেফা_ফেরদৌস
আরফান এপাশ ওপাশ করছে এমন সময় খুট করে একটা শব্দ হলো। ফিরে তাকাতেই চোখে পড়ল মল্লিকা পায়ে পায়ে এসে ঘরে ঢুকেছে।
লাফ দিয়ে বিছানায় উঠে বসল ছেলেটা। বিস্মিত হতবিহব্বল চেহারায় বলল, আ- আপনি এখানে কেন এসেছেন? চলে যান!
তোমার জীবন থেকে তো অনেক আগেই চলে গিয়েছি। আজ ভাগ্যক্রমে আমার বাড়িতে খানিকক্ষণের জন্য দেখা হলো, তারপরও কি চলে যেতে বলবে?
উত্তর নেই।
এভাবেই চুপচাপ কেটে গেল কয়েক মিনিট, একপর্যায়ে এগিয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে আরফানের মুখোমুখি বসল মল্লিকা।
এবার অবশ্য বাধ্য দেয়া হয়নি তবে দুজনের কেউই চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাবার পর আরফান বলল, এখানে এভাবে বসে থেকো না। তোমার বাড়িভর্তি মানুষ, কেউ দেখে ফেললে ভালো হবে না ব্যাপারটা!
মা, বাবা, মামা, সবাই ঘুমোচ্ছেন, ফয়সাল, ফাইজা শামীমের ঘরে দাবা খেলায় মত্ত, টুটুলও ঘুমিয়ে গেছে। আসবেটা কে শুনি?
ফয়সাল ভাই খুঁজতে আসতে পারেন তোমাকে।
না, এমন কিছু হবে বলে মনে হয় না। দাবা খেলার সময় ওর মনোযোগ খেলার মাঝেই নিবদ্ধ থাকে তার উপর আদরের ছোটো বোন আর বোনের হাসবেন্ড আছে সঙ্গে, এসময়ে আমাকে হয়ত মনে পড়বে না। এতটা অবসরই বা কোথায়!
আবার কিছুক্ষণ নীরবতা। একপর্যায়ে আরফান বলল, আমাদের বলার মতো কোনো গল্প নেই, তারপরও কেন এখানে এভাবে বসে আছ?
তোমাকে দেখতে এসেছি! মাঝখানে অনেকগুলো বছর দেখা হয়নি আমাদের, ভাবলাম একটু দেখা করে যাই। কেমন আছ অন্তর?
হাসছে আরফান, বলল, যেমনটা দেখছ!
উত্তরটার অর্থ কী দাঁড়াল, ভালো, না মন্দ? মল্লিকার প্রশ্নে স্পষ্ট বেদনা।
সব উত্তরের অর্থ খুঁজতে নেই! তারচেয়ে বরং বলো, তুমি কেমন আছ মিতু?
মিতু দু অক্ষরের একটা নাম, একটা শব্দ, কিন্তু সেই শব্দটাই মল্লিকার ভেতর নাড়িয়ে দিয়েছে। খানিকটা সময় নিয়ে বলল, আশ্চর্য, আমি যে নামটা ভুলতে বসেছি তুমি তা দিব্যি মনে নিয়ে বসে আছ!
তোমাকে নিয়ে এমন অনেক ঘটনাই আছে যা আমি ভুলতে পারিনি মিতু। তাছাড়া, এই নামেই তো ডাকতাম তোমাকে। মনে আছে, আমাদের ক্লাসে তিনজন মল্লিকা ছিল চেনার সুবিধার্থে কথায় কথায় একদিন কাজল জানতে চেয়েছিল, তোমার কোনো ডাক নাম নেই?
-হ্যাঁ আমিও লজ্জায় পড়ে বললাম আমার ডাকনাম মিতু। আসলে দাদি এ নামটাই রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্ত মায়ের ভীষণ পছন্দের নাম ছিল মল্লিকা, অবশেষে আমার নাম মল্লিকাই হয়ে গেল। আসলে মৌনী আপুর নাম দাদিই রেখেছেন সেজন্যই হয়ত আমার বেলায় মায়ের পছন্দ প্রাধান্য পেয়েছে।
গল্পটা তো আগেও শুনেছি, কিন্তু তুমি যে আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না
কোন প্রশ্ন?
কেমন আছ?
দেখে কী মনে হয়?
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফান। খানিক দম নিয়ে বলল, তোমার চোখে চোখে তাকিয়ে মন বুঝে নেয়ার অভ্যেসটা আমি অনেক আগেই বাদ দিয়েছি, এবার যে মুখেই বলতে হবে!
বাহ্ বেশ ভালো তো! কিন্তু অন্তর, চাইলেই কি কিছু অভ্যাস ঝেড়ে ফেলা যায়? আসল কথা বলো, আসল ব্যাপারটা হচ্ছে তুমি আমার সম্পর্কে কিছুই জানতে চাও না! তোমার অভিমান বা জেদ সম্পর্কে আমার তো বেশ ভালো ধারণা আছে, আমি পরিস্কার জানি তুমি এখন ঠিক কেমন অনুভব করছ! তারপরও ভদ্রতার খাতিরে যখন জানতে চেয়েছ, আমিও ভদ্রতার খাতিরেই বলে দেই, না, তুমি যতটা ভাবছ, ততটা খারাপ আমি নেই!
তুমি সুখী হয়েছ?
শব্দ করে হাসল মল্লিকা। উত্তর দিলো না।
আরফান একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। একপর্যায়ে বলল, তুমি বললে তোমাকে নিয়ে ভাববার খুব একটা অবসর ফয়সাল ভাইয়ের হবে না, কিন্তু মনে তো হলো তিনি তোমাকে ভীষণ ভালোবাসেন। তাছাড়া, ফয়সাল ভাই চমৎকার মানুষ, তারপরও তুমি প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর দিতে পারছ না, আশ্চর্য মিতু! তুমি কি সুখী হওনি?
উত্তরে আবারও হাসি। মেয়েটা বলল, এই প্রশ্নগুলোর সরাসরি উত্তর তোমাকে কি দিতেই হবে? তারচেয়েও বড়ো কথা, কোন অধিকারে জানতে চাইছ?
মুহূর্তেই চেহারা বিবর্ণ হয়ে গেল আরফানের। ধাক্কাটা সামলে নিয়ে বলল, না, তেমন কোনো অধিকার নেই অবশ্য, এমনি প্রশ্ন করলাম! তুমি তো খুব ছাত্রী ছিলে, কিন্তু মাস্টার্স করলে না, কোনো চাকরি কি করো?
মাথা ঝাঁকিয়ে না বলল মল্লিকা।
আশ্চর্য! গৃহিণী হয়েই থেকে গেলে শেষ পর্যন্ত! কেন? তোমার তো অনেক স্বপ্ন ছিল! আরফানের কন্ঠে বিষ্ময়।
জানোই তো, আমার প্রিয় কিছু স্বপ্ন ভেঙে গিয়েছে, আর কিছু স্বপ্নের পেছনে আমি নিজেই ছুটতে চাইনি!
ছুটতে চাওনি, না ছুটতে দেয়া হয়নি?
আমি চাইনি। ফয়সালের সামনে এমন কোনো আবদার তো আমি করিইনি! ওর দেয়া না দেয়া সে অনেক পরের ব্যাপার।
কেন?
ইচ্ছেগুলো মরে গিয়েছিল আমার! নিজের প্রিয় মানুষগুলো যখন আপন জেদে অটল, তখন কিছুটা জেদ তো আমিও দেখাতে পারি।
সময় কাটে কীভাবে তাহলে?
তুমি একজন গৃহিণীকে প্রশ্ন করছ তার সময় কীভাবে কাটে! জানো না? তোমার মায়ের সময় কীভাবে কাটত? মল্লিকার প্রশ্নে কিছুটা যেন রাগ, সামলে নিয়ে বলল, সংসার, ব্যস্ততা, পরিবার, মুকুল, সবকিছু মিলে কেটে যায় একরকম। আর অবসর সময়ে প্রকৃতি দেখি, ঘুরে বেড়াই কখনো অতীত নিয়ে ভাবি, এভাবেই চলছে।
আক্ষেপ হয়? গভীর আগ্ৰহ নিয়ে জানতে চাইল আরফান।
কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজা আমি বন্ধ করে দিয়েছি অন্তর, জীবনে সুখে থাকার জন্য সেটা জরুরি।
ছেলেটা হাসছে চুপচাপ। একটু নীরবতা, প্রসঙ্গ পরিবর্তন করে বলল, আংকেল, আন্টি, মৌনী আপু, দুলাভাই,সবাই কেমন আছেন?
ভালো।
মৌনী আপুর ছেলে মেয়ে?
এক ছেলে, এক মেয়ে।
বাহ্ উনি এখন দু সন্তানের মা? চমৎকার। সবসময় বলতেন না, আমি আমার মায়ের মতো দায়িত্ববান হতে পারব না। তা কেমন মা হয়েছেন তিনি?
ভালো, সংসার, চাকরি, ছেলেমেয়ে, দুলাভাই, সবাইকে আগলে রেখেছে।
আর তুমি, তুমি কেমন মা?
তার উত্তর আমি কেন দেবো, মুকুল বা ফয়সালকে জিজ্ঞাসা করো।
কোন অধিকারে? আরফানের প্রশ্নটা যেন বড়ো বেশি ধীরস্থির।
মল্লিকার চোখে টলটলে জল, উত্তর দেবার মতো কোনো শব্দ যেন জানা নেই।
ছেলেটা তাকিয়ে আছে চুপচাপ। একপর্যায়ে বলল, ঐ যে রিকশা থেকে পড়ে যাবার পর আন্টির গোড়ালিতে ব্যথা হতো সেটা কি ভালো হয়েছে?
না, একদম ভালো হয়নি, এখনো মাঝে মাঝে হয়।
আংকেলের মেজাজটা? তার কী অবস্থা, রাগ এখনো আগের মতোই?
এ প্রশ্নের পর দুজনের মাঝে হালকা হাসাহাসি, মল্লিকার দৃষ্টি নিচের দিকে। একপর্যায়ে বলল, হ্যাঁ অনেকটাই।
আচ্ছা, সেদিন যদি, বাবা আর আংকেলের মধ্যে ঝগড়াটা না হতো, ধরো, বাবা যদি অর্থের দম্ভ না দেখাতেন কিংবা যদি আমাদের দুজনের মধ্যে যেকোনো একজন অপরজনের যুক্তি মেনে নিতাম, যদি সবকিছু স্বাভাবিক থাকত, তবে আমাদের গল্পটা কি অন্যরকম হতো?
হয়ত বা! তবে এসব প্রশ্ন এখন অবান্তর। একদম সরাসরি উত্তর মল্লিকার।
আচ্ছা, আমরা দুজনেই তো জানতাম যে আমাদের এই জেদ ভবিষ্যত জীবনে সুখের রঙকে বদলাতে পারে, তবে কেন এমন অদ্ভুত জেদ করেছিলাম বলতে পারো? আরফানের প্রশ্নে স্পষ্ট হাহাকার।
উত্তর এলো আরো সরাসরি। মল্লিকা বলল, অতীত অতীতই অন্তর, আজকের বর্তমানে দাঁড়িয়ে এসব নিয়ে আমি আর ভাবতে চাই না। তুমি হাজারবার প্রশ্ন করতে পারো, উত্তর মিলবে না!
দীর্ঘশ্বাস ফেলল আরফান। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। খানিক বিরতিতে আবারও প্রসঙ্গ পরিবর্তিত হলো, ছেলেটা বলল, আন্টির হাতের খিচুড়ি আর ইলিশ মাছ ভাজাটা মিস করি এখনো, আমার খুব পছন্দ ছিল!
তাই? জানতাম! তুমি মুখে না বললেও আমরা আঁচ করে ফেলেছিলাম।
হ্যাঁ আমাদের সম্পর্কটা তো এমনই ছিল, মুখের কথার চেয়ে মনে মনে কথা হতো বেশি।
হাসছে মল্লিকা। টলটলে চোখে বলল, থ্যাংকস অন্তর।
কেন?
না, এতদিন পরও তুমি আমার পরিবার নিয়ে আপন ভেবে এতকিছু জানতে চাইলে, ভালো লাগল বেশ! এসব কথা ইদানীং কমই শোনা হয়!
আশ্চর্য! ফয়সাল ভাই তোমার পরিবারের ব্যাপারেও উদাসীন নাকি?
কেন, আমি কি এমন কিছু বলেছি? কন্ঠে ভাবলেশ নেই মল্লিকার।
আরফানের ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ছড়িয়ে পড়েছে। বলল, না তা তুমি বলোনি, কিন্তু জোর দিয়ে অস্বীকার করেছ এমনটাও তো না!
মল্লিকা হাসল একটু, কিন্তু উত্তর দিলো না।
একটু সময় নিয়ে মেয়েটা বলল, আংকেল আন্টি কেমন আছেন?
আছে, আজকাল অসুস্থই থাকে বেশিরভাগ।
তুমি কী করছ ইদানীং?
না, তেমন বলার মতো কিছু করতে পারিনি। প্রাইভেট একটা কোম্পানিতে আছি, তাও চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছি। জার্মানিতে ছোটো চাচ্চুর কাছে চলে যাব আমি কিছুদিনের মধ্যেই।
বিয়ে করোনি?
না সূচক মাথা নাড়ল আরফান।
কেন?
উত্তরে ছেলেটার ঠোঁটে বেদনার্ত হাসির ঝিলিক। খানিক্ষণ চুপ থেকে বলল, বিয়ে সংসার, সন্তান, মনের মতো জীবন, এসব কারো কারো ভাগ্যে জোটে না মিতু! জানি না, আমার ভাগ্যে কী আছে! তবুও পরিবার থেকে চেষ্টা তো করছেই, আসলে মনের মতো কাউকে পাইনি এখনো।
আমাকে ভুলে যাও প্লিজ! বুঝতে চেষ্টা করো, এ বেদনায় কোনো প্রাপ্তি নেই! বিয়ে করো, সংসারী হও, নতুন কাউকে নিয়ে জীবন সাজাও, সত্যি বলছি, সংসার বড়ো অদ্ভুত জিনিস, আবার প্রেম যদি তোমার নাও হয় তবুও মায়ায় পড়ে যাবে।
জানি না, কীভাবে, কতটা, কী হবে! তবু, দেশ ছেড়ে যাবার আগে তোমাকে দেখে গেলাম, তোমার পরিবার দেখে গেলাম, জেনে গেলাম তুমি ভালো আছ, স্বস্তি পেয়েছি বেশ!
শব্দ করে হাসল মল্লিকা। বলল, কেন মিথ্যে বলছ, তোমাকে আমি চিনি অন্তর, আমার সামনে অন্তত এই অভিনয়ের প্রয়োজন নেই!
হাসল আরফান। বলল, যাক, এখনো তাহলে আমাকে বুঝতে পারো, ভালো লাগল। ভালো লাগল যে ,আমার ডাকনামটা ধরে এতক্ষণ আগের মতোই কথাগুলো বললে তুমি মিতু!
মল্লিকা তাকিয়ে আছে। বলল, তোমার ভালো লেগেছে জেনে খুশি হলাম। তবে একটা অনুরোধ অন্তর, আমাকে যদি খানিকটাও বুঝে থাকো, তাহলে এ বাড়িতে আর কখনো আসবে না প্লিজ! ফয়সালের সঙ্গে বন্ধুত্বটা তোমার না রক্ষা করলেও চলবে। জীবনে অনেক কষ্টে শান্তি খুঁজে নিয়েছি সেই শান্তিটা বিঘ্নিত নাহলেই স্বস্তি পাব আমি।
আরফান চোখ নামিয়ে নিয়েছে। কিছুক্ষণের অস্বস্তিকর নীরবতা। একপর্যায়ে মল্লিকা বেরিয়ে গেল।
এরপর আর বেশিক্ষণ থাকেনি ছেলেটা, ফয়সাল রাজি করাতে কষ্ট হয়েছে যদিও সে বারবার বলছিল বিকেলে চা নাশতা খেয়ে তারপর যেয়ো।
আরফান মানতে চায়নি। বলেছে, হঠাৎ করে ফোন এসেছে জরুরি একটা কাজে এক্ষুনি যেতে হবে।
চলবে।