#যে_জীবন_ফানুসের
#পর্বঃ৭
#রেহানা_পুতুল
ওরা তিনজন একসাথে ক্ষেপাস্বরে জানালো,আমরা ওকে না নিয়ে দোকান থেকে বের হবনা। আপনার সমস্যা কি? মেন্টাল নাকি?
আমিও হুংকার দিয়ে বললাম, বদমায়েশি স্বভাব এখনো গেলোনা আপনার? মানুষ হবেন কবে?
সে শীতল গলায় বলল, আমি মানুষই আছি। শুধু তোমার জন্যই তোমার কাছে অমানুষ।
আমি বিধবা নই বর্তমানে। সধবা।
শুনেই সে হোহো করে হেসে উঠলো উম্মাদের মতো। হাউ ফানি? স্বামী না মরতেই বিয়ে হয়ে গেলো? আমাকে বোকা বানাচ্ছ?
ওরা কপাল ভাঁজ করে আমার কাছে জানতে চাইলো,
উনি তোর পূর্ব পরিচিত নাকি ঝুমুর?
হ্যাঁ উনাকে যখন থেকে চিনি, তখন ফয়সালকেও চিনতামনা।
ওরা তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলো। দৃষ্টি বিনিময় করে বুঝে নিলো তাহলে কাহিনী আছে। বেটা এমনি এমনি হাত ধরেনি।
এদিকে সে ভিতর থেকে তার দোকানের গ্লাস বন্ধ করে দিয়েছে। ওরা তিনজন তিনটি টুল নিয়ে বসে আছে।
হিমা বুদ্ধি করে আমার হাত থেকে আস্তে করে ফোনটা টেনে নিলো। আমি যা বুঝার বুঝলাম। ওদের কারো কাছেই আবিদের নাম্বার নেই। আমার ফোন থেকে আবিদের নাম্বার নিয়ে হিমা তার ফোন থেকে মেসেজ দিলো সম্ভবত।
আমরা চারজন। সে একজন। আমাদের দল ভারী। হার্ডলি ট্রাই করলে আমরা বের হতে পারি। কিন্তু আমি চাই আবিদ আসুক। এর একটা কঠিন শিক্ষা হোক।
সে আমাকে নানাভাবে বোঝানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। ঝুমুর মিথ্যা বলে গুনাহ কামাও কেন? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ভালোবাসি। আমি কোন বাজে লোক নই। যে কারণে তুমি আমাকে খারাপ জানো। তোমার সে জানায় ও দেখায় ভুল আছে। এটা আমার দোকান। তোমার হাজব্যান্ড মারা গিয়েছে শুনেই রাতে তোমাকে মেসেজ দিলাম। তা না হলে এতদিন কোন বিরক্ত করেছি? কারণ আমি এমন মানুষ নই। এখন তুমি সিংগেল বলেই বিয়ে করতে চাচ্ছি। এটা কি আমার অপরাধ? কিছু একটা বল। সিলেট কবে এলে ঘুরতে?
এভাবে নানাকথায় সময় গড়ালো ঘন্টার মতো। রিমা গ্লাস টেনে বের হয়ে গেলো। একটু পর আবিদ সহ দোকানে ঢুকলো। আবিদকে দেখে আমার কলিজায় পানি এলো যেনো। এত ভালো লাগছে ভাষাতীত।
আবিদ দোকানে ঢুকেই ভদ্রভাবে তাকে বলল অন্যের বউকে জোর করে বিয়ে করতে চাওয়া কোন অপরাধের আওতায় পড়ে জানেন?
আপনি যে এখন অভিনয় করে ঝুমুরকে বাঁচাতে এসেছেন। তা বেশ বুঝেছি। আমার দিকে চেয়ে, বাহ! শুধু আমি খারাপ? স্বামী না মরতেই আরেকজন জুটিয়ে ফেললে? বলল সে।
আবিদ ক্ষিপ্ত হয়ে তার শার্টের কলার টেনে ধরলো। সে আবিদকে ঘুষি মেরে বসলো বুকে। আমি আবিদকে টেনে ছাড়ালাম।
আবিদ আমাকে জিজ্ঞেস করলো, কে এই বেয়াদব?
এ রাজিব। আমাদের গ্রামের। ফয়সালের আগে থেকেই আমার পিছনে ঘুরতো প্রেম করার জন্য। নানাভাবে উক্তক্ত করেছে। পরে তাদের পরিবার দিয়ে আমাদের বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। ততদিনে ফয়সালের সাথে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়। তাই বিয়ের প্রস্তাব নাকোচ হয়। এরপর আর কোন ঝামেলা করেনি। ফয়সাল যে আমাকে আরো আগেই ডিভোর্স দিয়েছে। সে জানেনা। আবার তোমার সাথে যে আমার বিয়ে হয়েছে তাও জানেনা। ভেবেছে আমি সিংগেল। তাই আমাকে দেখামাত্রই আটকে ফেলে তার এই দোকানে। আর বিয়ে করার জন্য ফোর্স করে।
রাজিব বলল, ফয়সাল যে তোমাকে ডিভোর্স দিয়েছে। এটা জানতাম না।
আবিদ বলল, বিষয়টা এবার ক্লিয়ার হয়েছেন? আর কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে জোর করে বিয়ে করে সুখী হওয়া যায় জীবনে? চাইলে আপনাকে এখন অন্যের স্ত্রীর মানহানি করা বা হেনস্তা করা এই মর্মে থানায় দিতে পারি। দিলাম না।
কারণ এর চেয়েও বড় শাস্তি আপনি ঝুমুরকে না পেয়ে পাচ্ছেন। তো এই শাস্তিই অব্যাহত থাকুক আপনার জন্য। আর নতুন করে শাস্তি দেওয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে করিনা।
রাজীব বুক টানটান করে বলল। বুঝতে পেরেছি। তবে ঝুমুর আপনার স্ত্রী বা তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে এটা বিশ্বাস হচ্ছেনা। মানুষ কাউকে সেভ করার জন্য আরো বেশী কিছুও বানিয়ে বলে।
আবিদের মেজাজ এবার চড়ায় উঠলো হিমালয়ের পর্বতের মতো। নিঃশ্বাস উঠানামা করছে। মুখ শক্ত আকার ধারণ করেছে। আমাকে চেয়ার থেকে টেনে দাঁড় করালো।
আমার গালের দুপাশ চেপে ধরলো। আমার দুঠোঁটে তার দুঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। গাঢ় লম্বা চুমু খেলো। আমি লজ্জায় মরে যাই দশা।
আবিদ রাজিবের দিকে চেয়ে এবার নিশ্চয় প্রমান পেয়েছেন ঝুমুর আমার বিয়ে করা বউ। আর সে আমার বউ কখন হলো কেন হলো কিভাবে হলো এটা আপনার না জানলেও চলবে।
ঘটনার আকস্মিকতায় উপস্থিত বাকি সবাই অবাক হয়ে গেলো। আবিদ এই চলো বলে আমাদের নিয়ে পা বাড়াচ্ছে। তখনি রাজিব শান্তভাবে টেবিলের পাশ ঘুরিয়ে আবিদের সামনে এলো। দুহাত চেপে ধরে আবিদকে বললো, দুঃখিত ভাই আমার অনাকাঙ্ক্ষিত কৃতকর্মের জন্য। এখন বিশ্বাস করেছি ঝুমুর আপনার স্ত্রী। আগে থেকে জানলে এমন কখনোই করতামনা। ঝুমুর আমার এলাকার মেয়ে। সে হিসেবে একটা টান আছেই ওর প্রতি।
আমার দিকে চেয়ে বলল,ঝুমুর ভুল বুঝনা আর রাগ করনা। মানুষ মাত্রই ভুল। ভুল ত্রুটির উর্ধ্বে কেবলমাত্র একজন। জোর করে এ পৃথিবীতে সব পাওয়া গেলেও কারো মন পাওয়া যায়না। আজ এটা বুঝলাম। আসলে অনেকদিন পরে পরে তোমাকে চোখের সামনে দেখে মাথা ঠিক রাখতে পারিনি। আমার দোকান থেকে একটা ব্যাগ উপহার হিসেবে নিলে ভালোলাগবে আমার।
নাহ লাগবেনা বলে বেরিয়ে এলাম তার দোকান থেকে। আমরা সবাই চলে এলাম হোটেলে। ওরাও আমাদের রুমে আসলো। রিমা বলল,মাগগো মা। একটা তুফান গেল আচমকা।
তুই আমাদেরকে এই রাজিবের বিষয়ে বলিসনি কেন আগে? অভিযোগের সুরে বলল সায়না।
আমি নাক কুঁচকে বললাম, জনে জনে বলার মত কি এটা?সেই কবে ঘুরতো। আর রিমাকেতো বলছি আমাদের গ্রামের একটা ছেলে আমাকে খুব জ্বালায়। আমার সাথে প্রেম করতে চায়। নাম বলা হয়নি। তাই রিমা বুঝতে পারেনি এই সেই ইভটিজার।
ওরা হেসে উঠলো। হিমা বলল,যা ঘটে ভালোর জন্যই ঘটে। একটা বিহিত হয়ে গেল। আর সে অনুতপ্ত হয়েছে এটা খুব ভালোলেগেছে আমার। বোঝা গেলো মনুষ্যত্ববোধ আছে তার ভিতরে।
সায়না বলল,আবিদ ভাইর মনে হয় লাগছে খুব তার ঘুষিতে।
আবিদ পাশ থেকে বলল, সেও একটা দিয়েছে আমিও একটা দিয়েছি। শোধবোধ।
হিমা বলল,ভাই যা দেখালেন ভিলেনকে বাংলা সিনেমার নায়কের মতো। এক কথায় ফাটাফাটি।
আবিদ বলল,এটা না করলে সে তর্ক করেই যেত। তাই উইকেট ফেলে দিলাম এক বলেই।
আমি কুকঁড়ে যাচ্ছি আবিদের বেশরমপানা দেখে। ওরা বলল,
ওহ হো। আমাদের ফুল আনতে হবেনা? এই চল নিচে নামি।
আমি থামিয়ে দিলাম ওদের। এই প্লিজ আজ না। কাল। আজ আমার মুড অফ। তোরা রুমে যা। রেস্ট নে। আমিও রেস্ট নিব। ক্লান্ত লাগছে। সকালে দেখা হবে।
ওরা বলল। আচ্ছা কাল। যাই আমরা।
ওরা চলে গেলো। আবিদকে বেশ আনন্দিত দেখাচ্ছে। ওর সাথে কোন কথা বলছিনা। নিঃশ্চুপ হয়ে আছি।
সে জিজ্ঞেস করলো,
রাতে ডিনার কি আনবো?
আমার পেট ভরা। বাইরে এটা সেটা অনেককিছু খেয়েছি। তুমি পরে গিয়ে খেয়ে এসো। মাত্রতো সন্ধ্যা বিদায় নিলো।
আমার ও মন ভরা। বাইরে থেকে অনেক খেয়ে এসেছি। তাই রাতে খেতে হবেনা।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, বাইরে কি এমন অমৃত খাবার খেলে যে মন ও এত্ত ভালো?
কেন সে খাবারতো তুমিই খাওয়ালে।
আমি ঠোঁট কামড়ে ধরে কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে গেলাম। কাঁথার নিচে গুটিয়ে যাচ্ছি শামুকের খোলসের মতো।
সে আমাকে শুনিয়ে বলছে, হ্যাঁ হ্যাঁ লজ্জা নারীরই ভূষণ। পুরুষের নয়। ঠিক আছে ওভাবেই থাক গর্তের ভিতর গাপটি মেরে লুকিয়ে থাকা ইঁদুরের মতই। আর বের হতে হবেনা। আমার প্রশ্রয় পেয়েই এত কুয়ারা বেড়ে যাচ্ছে।
আমি কাঁথার ভিতর থেকে শব্দ করে বললাম আমি ঢাকায় গিয়েই গ্রামে মায়ের কাছে যাব।
এসব বলে ক্ষুধার্ত বাঘের মন মেজাজকে অন্যদিকে ডাইভার্ট করা যায়না। সামনে সুস্বাদু কত লোভনীয় খাবার অথচ খেতে পারিনা। শুধু খাবারের জৌলুশ দেখেই দিন মাস পার করতে হচ্ছে।
আমি কাঁথার ভিতর থেকে দুঠোঁট কাত করে ভেংচি কাটছি আবিদকে। কিছুসময় বাদে চোখজুড়ে তন্দ্রা নেমে এলো।
” ভালো আমি বাসি যারে,পাবো কি তারেএএএ…
সে থাকে আমারি পাশের বেডেরেএএ…সে থাকে আমারি পাশের বেডেরেএএএ..
একটু ফিরে সে তাকায় নারেএএএ…একটু ফিরে সে তাকায়নারেএএএ…”
কানে স্লো মোশনে গানের আওয়াজ আসছে। তন্দ্রা ছুটে গেলো। কান পেতে শুনি আবিদ গাইছে। শুনতে ভালই লাগছে। নিজে নিজে হাসছি কাঁথার নিচে লুকিয়ে। তাকে বুঝতে দিলামনা।
ভাবছি, আবিদ আমাকে রাজিবের বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞেস করার কৌতুহলবোধ করলনা।
যেটা প্রায় অনেকেই করে থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নানাপ্রশ্ন করে বিরক্ত ধরিয়ে দেয় মনে। একটিবার ও এটা চিন্তা করেনা ,
যে মানুষটা নিজেই বিষয়টাকে এড়িয়ে চলে, সেই বিষয়ে বারবার জিজ্ঞেস করে তাকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দেয়া কোন সভ্য মানুষের কাজ নয়।
পালা করে আবিদের প্রতি ভালোলাগা বেড়েই চলছে। এই মানুষটার সাথে একজনম কাটিয়ে দেওয়ার জন্য বোধ হয় এই ভালোলাগাটুকুই যথেষ্ট।
পরেরদিন সময় রাত ৯ টা। হিমা রিমা সায়না বেশকিছু কাঁচাফুল নিয়ে আমাদের রুমে ঢুকলো। এক বেডের উপরে সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখলো। বাকি বেড়কে ফুলসজ্জায় রূপান্তরিত করতে তিনজন উঠে পড়ে লেগেছে। আমি কাঁচুমাচু করতে করতে ওদের রুমে চলে গেলাম। বেশকিছু সময় ওরাও এলো। বলল,তাসের ঘর কমপ্লিট সখী। এবার তোমাকে সাজাবো।
সায়না গুনগুনিয়ে, আজ মধুরাত আমার ফুলসজ্জা এ গানটি গাইতে লাগলো।
ওদের উদ্দেশ্য বিরক্ত হয়ে বললাম,তোরা অতিরিক্ত করে ফেলছিস। এসবের একদম দরকার ছিলনা।
রিমা বলল, “দাম্পত্যটা একটা আর্ট প্রতিদিন একে নতুন করে গড়বার চাই।” রবীবাবু ‘শেষের কবিতা ‘ উপন্যাসে এটা বলছে।
রাত ১১ টায় ওরা আমাকে আমাদের রুমে দিয়ে বের হয়ে গেলো। বধুবেশে বসে আছি সজ্জিত বিছানার মাঝ বরাবর। আবিদ বারান্দা থেকে এলো আমার সামনে। পাঞ্জাবী ও জিন্সে আবিদকেও বেশ সুন্দর লাগছে। আমি লাজুক মলিন মুখে দুই হাঁটু ভাঁজ করে মাথা ঝুঁকে বসে আছি। বুকের ভিতর বাড়াবাড়ি রকমের ধুকপুকানি চলছে। ফয়সালের সময় ও এমনটা হয়েছে। এই মুহুর্তটাই বুঝি এমন। অথচ দুজনই আমার বহুদিনের কাছের মানুষ ছিলো।
আবিদ বেডে উঠে এলো। আমাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিতেই আমি মাগো বলে কিঞ্চিৎ চিৎকার দিলাম।
সে কি হলো বলতেই ইশারা দিয়ে সামনে কিছু দেখালাম।
এরপর সেও সামনে তাকিয়ে যা দেখলো,
চলবে…