#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি
পর্ব ১২
আজ প্রায় দেড় মাস দিশানের সাথে নেহালের কোন যোগাযোগ নেই। ঐদিন একরকম জোর করেই নেহাল রাজি করিয়েছে দিশানকে তার থেকে সম্পূর্ণভাবে দূরে থাকতে। শেষ দিকে দিশান অভিমান করেই কথা দিয়েছে যে সে কোনপ্রকার ফোন বা ম্যাসেজ দিবেনা,মরে গেলেও দিবে না। নেহাল বলেছে, “তোমাকে মরতে দিলে তো, আমার তোমাকে এখনো অনেক জ্বালানোর বাকি তো,কোথায় পালাতে দিবো তোমায়?থুরথুরে বুড়ো হওয়া অবধি একসাথে বাঁচার তৌফিক চাই আল্লাহর কাছে প্রতিদিন। সুতরাং ভালোভাবে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্যই পড়বে। ”
দিশান মেনে নিয়েছে নেহালের কথা। একটা লম্বা ব্রেকের পর পুরোপুরি আগের মতো পড়ায় মন বসাতে পেরেছে। নেহালের কথা মেনে তাদের রুমটাতে যায়নি একবারও। নেহালের মাথার বালিশটা নিয়ে এসেছে সে,ঐটা জড়িয়ে ঘুমায় যেন দুই মাসেও এই বালিশ থেকে নেহালের গন্ধ মিলিয়ে যায়নি এমনটা মনে হয় দিশানের। এতগুলো দিনে একটাবারও নেহালের গলাটা শোনে নি সে । দিশানের মা-বাবাকে নেহাল নিয়মিতই ফোন দেয়,অডিও কল বলে সেই কন্ঠ আর দিশানের কান অব্দি পৌছুতে পারে না।
তবে আজ দেড়মাস পর কন্ঠটা যখন তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো,সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো।হাত পা কাঁপতে লাগলো তার। কদিন ধরেই নায়রা আর সে মিলে একসাথে টেস্ট পেপার সলভ করছে। আজও সকাল থেকেই সেইদিকেই মনোযোগ তাদের। তাই নেহালের আম্মুর what’s app রিংটোনে মস্তিষ্কে কোন বিকার হলো না। কিন্তু ফোনটা ধরে উনি যখন “উঠছিস বাবু?” বলে হাঁটতে হাঁটতে ড্রইং রুমের দিকে এগুতে থাকলো,শব্দ তরঙ্গে ভেসে এলো দিশানের সেই বহু আরাধ্য স্বর,সদ্য ঘুম ভাঙা আলসে গলায় নেহালের কণ্ঠ,
– আজ তো উইকএন্ড, কেবল উঠলাম। তুমি কি করো?
কথা বলতে বলতেই মা রুমে ঢুকে গেলো। দিশানের চোখ জোড়া জলে ভরে উঠলো। কোনরকমে কান্নার দমক আটকে বইয়ে মন দিতে চাইলো। মিনিট পাঁচেক পর মা রুমে এসে নায়রাকে ফোন দিয়ে গেলো,
– কি করিস ভাইয়া?উঠিস নি এখনো? কি আরাম জীবনে! আমরা সকাল থেকেই পড়তে পড়তে ঢুলছি।
– একটা চাট্টি লাগাবো মাথায়,এখন পড়বি না তো কবে পড়বি,বাকী আছে কয়দিন পরীক্ষার?
– তো পড়তেই তো আছি। আমি আর দিশান মিলে সেই সকাল থেকে তো পড়ছিই।
– দিশান তোর পাশে?
– হ্যাঁ তো।
মনটা চঞ্চল হলো নেহালের৷ বউটাকে কবে থেকে দেখে না।দিশান তো অভিমানে রাগে ফুলে আছে। তার নিজের ভেতরে কেমন লাগছে সেটা এই পাগলী কী বুঝবে!
– নায়রা,ফোনটা দিশান কে দে তো। আর শোন,তুই আম্মুর রুম থেকে ঘুরে আয় যা,তোর রুমের দরজাটা চাপিয়ে দিয়ে যা৷
– যো আজ্ঞা বস৷ এনজয় ইউর প্রাইভেসি!!
বলে দিশানের দিকে ফোকাস করে ফোনটা বইয়ে হেলান দিয়ে রেখে চলে গেলো।
দিশান কাঁপছে এখনো। রাগে উত্তেজনায় বা আবেগে। নেহাল তৃষিত চোখে দিশানের টপাটপ চোখ দিয়ে জল পড়া দেখছে। দিশান এখনো তাকায় নি স্ক্রিনে। এত নিষ্ঠুর মানুষকে দেখার ঠ্যাকা পড়ে নি তার।
– তাকাবে না দিশান?
দিশানের বুকের ভিতর ভেঙে এলো। কতদিন পর লোকটা তাকে ডাকলো। আস্তে করে চোখ তুলল এবার।
– কেমন আছে আমার বিল্লিটা?পড়ছে ঠিকমতো?
মাথা নাড়লো দিশান।
– আমাকে বুঝি তার কন্ঠটা শুনতে দিবে না।
এবার মাথা নেড়ে না করে দিলো। কথা বলবে না।
– তাহলে আর কি!রেখে দেই ফোন, বাই।
– না,একদম ফোন রাখবেন না।
– তো কথা না বললে আমি একা কি বলবো?
– আমি রাগ করে কথা বলছি না।
– তাই নাকি?তা এত দূর থেকে কি করলে রাগটা ভাঙবে শুনি?
– আমি বলবো কেন?
– ওকে, তুমি গুনে রাখো কয়টা রাগ জমা করলে। আজকের টা দুই নাম্বার দিয়ে শুরু করো,এক নাম্বার হলো যেদিন তোমাকে ফোন করতে মানা করেছি ঐদিন হবে। এভাবে তুমি রাগ জমা করো,২৫% সুদে আসলে সেইসব রাগ আমি এসে ভাঙবো। চলবে নাকি মুনাফার হার আরো বাড়াতে হবে?
– ২৫% এই চলবে কিন্তু শর্ত আছে।
– ভ্যাট বসাবে নাকি?
– না,শর্ত হলো রাগের সংখ্যা ১০ হবার আগেই এসে ভাঙাতে হবে। ১০ পার হয়ে গেলে সুদের হার অনেক বেড়ে যাবে৷
– প্লিজ ম্যাডাম,একটু সুদের হার কমিয়ে ধরেন, নিরীহ মানুষ আমি,এত সুদের বোঝা কেমন করে চুকাবো?
– কোন ধানাই পানাই নেই, ১০ এর বেশি হলে ৫০%, ১৫ এর বেশি হলে ১০০%, ২০ এর বেশি হলে ২০০%। এই হার ধরে হলে মেনে নিবো নয়তো না।
– একটু দয়া করেন ম্যাডাম।
– নো ওয়ে। আর রাগ ভাঙানোর কোয়ালিটি যেন ভালো হয়। আমি কোয়ানটিটিতে না,কোয়ালিটিতে বিশ্বাসী।
এবার ফিসফিস করে নেহাল বললো,
– ম্যাডাম, আপনি কেমন কোয়ালিটি চাচ্ছেন একটু যদি উদাহরণ বা ডেমো দিতেন? মানে আদরের গভীরতা কতটুকু হবে কিংবা চুমুর স্থায়িত্ব এসব ব্যাপারে যদি একটু ভেঙে বুঝিয়ে বলতেন বা নিজে করে একবার দেখিয়ে দেন তাহলে কথা দিচ্ছি আমি তার চেয়ে ভালো করে দেখাবো।
লজ্জা রাঙা দিশানের বদলে দুষ্টু হাসি ঠোঁটে দিশান বললো,
– যাবার সময় যেমনটা স্যাম্পল দেখিয়ে ছিলেন এর চেয়ে কম কিছু হলে সেই সংখ্যা কাউন্ট হবে না। আরো কিভাবে বেটার করা যায় তা ভাবুন।
নেহাল গলা আরো খাদে নামালো।
– আর যে ভাবতে পারবো না দিশান। এত দূর থেকে তোমাকে ভেবে আরো কতদিন কাটাবো জানি না। এমনিতেই যে এলোমেলো হয়ে আছি আমি তোমাকে দূরে রেখে,এরচেয়ে বেশি ভাবলে আমি সত্যিই সব ছেড়ে চলে আসবো। আর এবার আসলে ভালোবাসার যে অগ্নুৎপাত হবে তাতে তোমার সব সংখ্যা, সুদ ভেসে যাবে দিশান।
দিশান চোখ বন্ধ করে বললো,
– আমি যে সেই আগুনে পুড়ে ভেসে যাবার দিন গুনছি নেহাল।
অবশেষে পরীক্ষা শুরু হলো তাদের। নেহাল আগে থেকেই ম্যাসেজ দিয়ে রেখেছিলো যেন নেহালকে কল দিয়ে বের হয়। নেহালের ওখানে তখন প্রায় মধ্যরাত হলেও জেগে ছিলো সে। দিশান বের হবার আগে কল দিয়ে দোয়া চেয়ে নিলো।
এভাবে একটা একটা করে পরীক্ষা এগিয়ে যাচ্ছে। নেহাল এখন একটু সহজ করে দিয়েছে যোগাযোগটা। পরীক্ষার মাঝে কোন কষ্ট যেন মনে না থাকে। আর দিশানের মতো সিরিয়াস ছাত্রী হয়তো নতুন পড়া প্রেমে খেই হারিয়েছিলো,কিন্তু এখন যেহেতু পরীক্ষা চলছে তাই অন্তত তাল হারাবে না। টুকটাক কথায় দিশান জানিয়ে দিলো নেহাল এবার এলে একটা সারপ্রাইজ আছে তারজন্য। নেহাল দুষ্টু হেসে বললো,
– কি বলো?শুধু মোবাইলে কথা বলে কিভাবে সম্ভব?
– আপনি এত খারাপ!খালি উল্টাপাল্টা চিন্তা।
– মানে বউ যখন এভাবে সারপ্রাইজের কথা বলে তখন তো এমন কিছুই ভাববো না?
– না, ভাববেন না। কারণ এমন কিছু আমাদের মধ্যে হয়েছে কি যে বাপ হবার খবর আশা করেন?
– আসলেই। কি ভুলটাই যে করে এলাম! এখন কপাল চাপড়াই।
– হইছে আপনার কুমিরের কান্না। দূর থেকে আহ্লাদ করতে হবে না। তাড়াতাড়ি দেশে এসে সারপ্রাইজ নিন।
কিন্তু দিশান জানে না তার জন্য কত বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে আছে৷
চলবে….