#জীবনে_তুমি_সেরা_সত্যি

পর্ব – ৭

ডাক্তারের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিলো বিকেল চারটায়। নেহাল তাই লাঞ্চেই ফিরে এলো বাসায়। এবার এসে বাসায় লাঞ্চ করার সুযোগই হয়নি এ অবধি। মায়ের হাতে রান্না একটু বেশিই খাওয়া হয়ে গেলো। বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই মনে পড়লো মোবাইলটা কোথায় রাখলো। আশপাশ খুঁজে যখন পেলো না,দেখলো দিশানের মোবাইলটা বিছানার মাথায় রাখা। ওটা থেকে কল দিলেই বোঝা যেতো কই বাজে। ফোনটা ধরা কি ঠিক হবে? কিন্তু আলসেমির জয় হলো। সে তো আর কোন কিছুতেই ঢুকবে না। শুধু কন্টাক্টে নাম্বারটা বের করে রিং দিবে ব্যস। হাতে নিলো দিশানের ফোনটা। লক করা না থাকায় হোম পেইজ চলে এলো। দিশানের বউ সাজের একটা ছবি সেট করা। কন্টাক্ট লিস্টে ঢুকে কোথাও খুঁজে পেলো না ‘Nehal’ নামটা। ডায়াল প্যাডে নাম্বার টুকে ডায়াল করতেই স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে উঠলো
” KitKat ”
সিরিয়াসলি!!! কিটক্যাট কেন? জানতে হবে তো। এই মেয়ের সব কিছুতেই পাগলামী মাখা। যাক,মোবাইলটা কম্বলের ভাঁজ থেকে অবস্থান জানান দিলো। বালিশে মাথা দিতেই দিশানের আগমন।
– আমরা কখন বের হবো?
– ঠিক তিনটা ত্রিশে। আমাকে পনেরো মিনিট আগে ডেকে দিবে। আমি একটু ঘুমাই। তুমি কিন্তু একদম তৈরী হয়ে যাবে এই সময়ের ভিতরে৷
দুই হাতের বুড়ো আঙুল তুলে ওকে বুঝিয়ে দিলো দিশান।

– তিনটা পনেরো বাজে। উঠবেন না? আমি কিন্তু রেডি।
অসময়ের ঘুম বলে এক ডাকেই ছুটে গেলো। তবুও দিশান কি বলে ডাকে শুনতে ওভাবেই পড়ে রইলো। দিশান এবার ধাক্কা দিলো৷ তবুও নড়লো না। নেহাল ভাবলো দেখি না কি নামে ডাকে। কিন্তু দিশান কিছুক্ষণ চেষ্টা করে যখন উঠলো না,তখন একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে চিৎকার দিলো,
– উঠুন…….
লাফ মেরে উঠতে হলো নেহালকে। উঠেই থমকে গেলো সে। দিশান আজ একদম অন্যরূপে সামনে। বরাবরই দিশানকে সে কুর্তি-প্যান্টে দেখে অভ্যস্ত, বিয়ের পর পর কয়বার শাড়ি পরে দেখাও হয়ে গেছে৷ কিন্তু নতুন বউয়ের ভারী শাড়ি গহনাতে আসল দিশানকে চোখে পড়েনি। আজ হালকা আকাশী জামদানী কামিজে যেন আসল দিশান ফুটে বেরিয়েছে। চোখে কাজল টেনেছে, কানে গলায় ছোট্ট রূপার গয়না। তারউপর দুই ভ্রুএর মাঝে শিশিরবিন্দুর মতো ছোট্ট সাদা পাথরের টিপ। হালকা গোলাপী লিপগ্লসে কী মোহনীয় লাগছে তার দিশানকে। এই দিশান থেকে এমনিতেই চোখ ফেরানো ভার। আর এটা তো তার বউ সুতরাং চোখ ফেরানোর প্রশ্নই আসে না। নেহাল মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো তার বাচ্চা বউটার দিকে । দিশান বললো,
– আরে এখনো বসেই আছেন যে,উঠুন, তৈরী হয়ে নিন। আমি কতক্ষণ অপেক্ষা করবো আর।
নেহাল হাত টেনে দিশানকে সামনে বসিয়ে বলল,
– জনম ভর অপেক্ষা করবে। আমি আগে মন ভরে তোমাকে দেখবো,তারপর বের হবো।
সাথে সাথে হেসে উঠলো সে,
– সুন্দর লাগছে না বলুন? ইউটিউবের টিউটোরিয়াল দেখে এভাবে সেজেছি। আমাদের ক্লাসমেটদের মাঝে অনেকে প্রেম করে তো,ওরা এমন ইউটিউব খুঁজে সাজ দেখে পরে নাকি সেজেগুজে দেখা করতে যায়। আমিও তাই আজ সেজেছি আপনার সাথে যাব বলে। আরেকটা সাজও পছন্দ হয়েছিলো,ওটাকে ‘রেট্রো লুক’ বলে। ওটাও আরেকদিন সেজে আপনাকে দেখাবো, কেমন?
নেহালের এসব কথা মাথায় ঢুকছে না। সে প্রথম লাইনটার উত্তরই কেবল দিলো।
– তোমাকে সুন্দর লাগছে কি না মুখে বলতে হবে আরো? আমি চোখ ফেরাতে পারছি না দিশান। তুমি আমার মুগ্ধতা টের পাচ্ছো না?
দিশান স্বভাবসুলভ চপলতা ধরে রেখে বললো,
– সেইম কথা মাও বলেছে জানেন? মা বলেছে আমার দিশান মামনীকে কি সুন্দর লাগছে,চোখ ফেরানো যাচ্ছে না!!
নেহাল ভাবলো মেয়েটা কী পাগল! কিসের সাথে কী মেলাচ্ছে! মেয়েটার এই সাজের সাথে চপলতার চেয়ে লাজুকতা মানাবে বেশি। তাই দিশানের গাল দুটোতে লাল আভা ছড়িয়ে দিতে দিশানের ঠোঁটের উপর তর্জনী ঠেকিয়ে চোখে চোখ রেখে গাঢ় স্বরে বললো
– একটা কথা না আর,চুপটি করে বসে থাকো তো মেয়ে। মুখে বলছি এখন, না মানলে এরপর যদি হাসব্যান্ড হয়ে অন্যকোন ভাবে তোমার মুখ বন্ধ করতে হয় তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।
দিশান যেন কেঁপে উঠলো। সারা মুখে ভর করলো লাজরাঙা আভা। চোখ নামিয়ে নিলো সাথে সাথে৷ আবার তাকিয়ে দেখে নেহালের সেই আগের মতেই মাদকতা ভরা দৃষ্টি। এই দৃষ্টির সাথে এখনো পরিচিত নয় সে। তার অস্বস্তি লাগতে লাগলো। দিশানকে বাঁচাতেই বোধহয় রুমের বাইরে থেকে “নেহাল ভাইয়া,নেহাল ভাইয়া ” ডাক শোনা গেলো। ঘোর কাটলো নেহালের। গলা শুনে বুঝলো তাদের খালাতো ভাই সামিনের গলা। নেহালের চেয়ে বছর তিনেকের ছোট। বয়সের পার্থক্য থাকলেও ওরা পাঁচ কাজিন ভাই খুবই ক্লোজ, বন্ধুর মতো । নেহালের মুখে হাসি ফুটতে নিয়েও মিলিয়ে গেলো,মাথার নিউরন গুলো পুরান এক কথা মনে করিয়ে দিলো।বছরখানেক আগে ওদের এক আড্ডায় সামিন বলেছিলো,” নেহাল ভাইদের বাসায় যাবার ব্যাপারে আমি এক পা এগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। কারণ নায়রার বান্ধবীটার উপর বিশাল ক্রাশ খাইছি ভাই৷ মেয়েটা এত্ত সুন্দর কেন? নায়রাকে ঘুষ খাইয়েও এই মেয়ের নাম্বার পাই নাই। বান্ধবী তার কাছে ভাইয়ের চেয়ে বড়৷ ধ্যুত! ” কথাটা মনে পড়তেই সামিনের আসার খুশীটা বিরক্তিতে রূপ নিলো। এরই মধ্যে সামিন রুমের দরজায় আবার টোকা দিলো। আজ এই অপ্সরী সাজেই দিশানকে সামিনের সামনে পড়ার দরকার ছিলো?
দিশান সরে যেতে নিলে হাত ধরে টেনে আবার বসিয়ে দিলো নেহাল। গলা চড়ালো,
– আয় রে সামিন।
সামিন ভিতরে ঢুকেই একে তো দিশানকে দেখে,দ্বিতীয়ত এভাবে নেহালের হাতের ফাঁকে দিশানের হাত দেখে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।
– অসময়ে আসলাম নাকি ভাইয়া?
– কিছুটা। কারণ তোদের ভাবীকে নিয়ে বের হবো। দিশান,সামিনকে চেনো তো? সামায়রার বড় ভাই, মেজো খালার ছেলে।
দিশান হাসলো একটু কোনরকমে ৷ বেচারীকে নেহাল একদম নাজেহাল করে দিয়েছে।
সামিন কোন রকম জড়তা ছাড়াই হাসতে হাসতে বললো,
– ভাবী,নিরদ্বিধায় বলি তুমি কিন্তু আমার পছন্দ ছিলে আগে থেকেই, মানে ভাইয়ার জন্য না,আমার নিজের জন্য আরকি৷ কিন্তু মাঝখান থেকে কোন কথা নেই ভাইয়া এসে তোমাকে জিতে নিলো। অথচ আমি যখন বলেছিলাম তোমার কথা তাদের কাছে ভাইয়া কি বলেছিলো জানো? বলেছিলো এই মেয়ে তো আহ্লাদের কৌটা। তুলায় মুড়িয়ে রাখতে হবে। এ বৌ হিসেবে যায় না। তা এখন গেলো কিভাবে শুনি?
নেহালের মন চাইলো সামিনের মাথায় একটা চাটি মারতে৷ নেহালের আগের কথাগুলো কি না তুললেই হতো না। দিশানের সামনে কেমনটা লাগে?
তাড়াতাড়ি প্রসঙ্গ পাল্টাতে চাইলো নেহাল। বললো,
– তুই রাতে থেকে যা আজ এখানে,আমরা ফেরার পথে সাময়রাকে নিয়ে নিবো। আর দেখি কে কে ফ্রি আছে৷ রাতে আড্ডা হবে তাহলে।
– না ব্রাদার, আজ হবে না। অন্য সময় প্ল্যান করতে হবে।
– ওকে ফাইন। তাহলে এবার বোধহয় আর দেখা হবে না তোর সাথে। আমাদের ও আর দেরি করার সু্যোগ নেই।
– তোমরা আগাও,খালার সাথে দেখা করে আমাকেও বের হতে হবে। গেলাম ভাবী,দেখা হবে পরে।
নেহাল হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো৷দিশানের মনোভাব বোঝা গেলো না। যাও ভেবেছিলো সেইম কালারের পোষাকটা বদলানো যায় কিনা ভাববে, আর ঘাটাতে সাহস পেলো না৷ দিশানের পছন্দ করা শার্টটা হাতে নিয়েই তৈরী হতে চলে গেলো৷

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here