#প্রহেলিকা
#পর্ব_২৮
#আসরিফা_মেহনাজ_চিত্রা
(অনুমতি ছাড়া কপি করা নিষেধ)
———————–
টুপটুপ করে রক্ত ঝরছে ফ্লোরে। হাতের কাছে কোনো অয়েন্টমেন্টও নেই। ইনশিতা উঠে দাঁড়িয়ে ব্যালকনির দরজায় দাঁড়াল। সে নিজেও বুঝতে পারছে না এই মুহুর্তে ঠিক কী হচ্ছে। তবুও অজস্র ভয় আর সীমাহীন চিন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্যালকনিতে দাঁড়ানো মানুষটির দিকে কয়েক পলক চেয়ে নির্বিকার দৃষ্টিতে হাতের দিকে একবার তাকাল। খুব সাবধানে পা ফেলে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতের রক্ত ধুয়ে বের হলো। ব্যথায় হাতের শিরা উপশিরা চিলিক দিয়ে উঠছে তবুও টু শব্দটি না করার আপ্রাণ চেষ্টায় আছে সে।
ড্রয়ারে এইড বক্স খুঁজেছে কিন্তু পায়নি। তাই কাপড়ের ছোট টুকরা ক্ষত স্থানে ভালোভাবে বেঁধে নিলো। লম্বা কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করল। আসলে ইনশিতা নিজেকে বাহিরে থেকে যতটা স্বাভাবিক দেখাচ্ছে ততটা নয়। তার মনে পৃথিবী তোলপাড় করে দেওয়া অশান্ত ঝড় বইছে। কিন্তু তার বহিঃপ্রকাশ ঘটাচ্ছে না। এই বাড়িতে আর কেউই নেই। সে আর জেহের। জেহেরের এমন অবস্থায় সে নিজেও যদি অশান্ত হয়ে পড়ে তাহলে জেহেরকে সামলাবে কে? তাই নিজকে শান্ত রাখার প্রয়াস চালাচ্ছে।
রুমের ভাঙ্গা কাঁচের টুকরোগুলো নিঃশব্দে পরিষ্কার করতে লাগল ইনশিতা। মনে মনে ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে যে, জেহের যেই রুমে থাকবে সেই রুমে কাঁচের জিনিস একদমই রাখবে না। কাঁচের জিনিস পরিষ্কার করতে কষ্ট ভীষণ। বিনে ফেলতে গিয়েই হুংকারে কেঁপে উঠে ইনশিতা। ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। মৃদু আওয়াজে জেহেরকে ডেকে ওঠে। তবে জেহের সাড়া দেয় না। সে মাথা চেপে ধরে বারবার এপাশ ওপাশ হাঁটছে আর কিছুক্ষণ পর পর হুংকার ছাড়ছে। ইনশিতা কাছে এলেই সে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় কিংবা গলা চেপে ধরে। তাই ইনশিতা কাছে যাওয়ার সাহস পায় না।
ইনশিতা যখন জেহেরের অবাধ্য হয় তখন জেহের রুমের অবস্থা বেহাল করলেও তাকে তেমন কিছু করে না। অথচ আজ জেহেরের আচরণ দেখে ইনশিতা নিজেই হতবাক। জেহেরকে দেখে বোঝা যাচ্ছে তার মাথায় ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে। রক্তলাল চোখ ঝিমিয়ে পড়ছে। বড় বড় শ্বাস ফেলে গর্জে উঠছে।
.
ইনশিতা তখন গোসল করে বের হলে দেখে জেহের খাটের সাথে হেলান দিয়ে নিচে বসা। পুরো ফ্লোরময় কাঁচে ছড়াছড়ি। একদৃষ্টিতে জেহের তাকিয়ে ছিল ইনশিতার দিকে। যেন সে এই লাল চোখ দ্বারাই গিলে খাবে ইনশিতাকে। ইনশিতা জানে না তার কপালে কী আছে। তবুও ভাবল আজকে যেভাবে হোক জেহেরকে সামলে নিবে। তাই জেহেরের কাছে এগিয়ে এলো। তার চলার সাথেও জেহেরের নজর তার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে সে। সাদা শার্টের উপরের সব বোতাম খোলা, তার মধ্য থেকে লোমহীন ফর্সা বুক উঁকি দিচ্ছে। ইনশিতা জেহেরের হাত থেকে কাঁচের ভাঙা গ্লাসটা সরিয়ে নিতে চাইলে আচমকা ইনশিতার হাত টেনে নিয়ে বড় একটা পোঁচ মেরে দেয়। ইনশিতা চিৎকার দিয়ে উঠলে জেহের পৈশাচিক আনন্দ পায়। যেন এই কাজটি সবচেয়ে মজার কাজের একটা। ইনশিতা উঠতে নিলে হাত চেপে নিজের কোলে বসিয়ে দেয়। ইনশিতা তখন চোখের জল ফেলতে ব্যস্ত। জেহের নিজের তর্জনী দিয়ে ইনশিতার গাল আলতো স্পর্শ করতে থাকে। হুট করে গাল চেপে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,
-“আমার কথার নড়চড় যে করে তাকে আমি দুনিয়াতে শান্তিতে থাকতে দেই না। আর সেখানে তুমি আমার স্ত্রী হয়ে আমাকে ধোঁকা দিয়ে পালিয়ে যাও! গুড!”
বলে ক্লান্ত চোখে বাঁকা ঠোঁটে হাসল জেহের। এরপর গম্ভীর স্বরে বলল,
-“কারো বুকের পাটা নেই যে এই জেহেরকে বেঁধে তাকে ফাঁকি দিবে। আর এই যে, এই বুকে প্রচুর সাহস।”
জেহের ইনশিতার গলার নিচে নজর দিলো। ইনশিতা দ্রুত ওড়না নিচে টেনে নামাল। জেহের ইনশিতার গাল ছেড়ে দুই বাহু আলতো চেপে ধরল।
-“জেহেরের ওয়াইফ হিসেবে ইউ আর দ্যা পারফেক্ট লেডি। আমাকে বশ করার, আমাকে বেঁধে রাখার, আমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার সব গুণ আছে তোমার মধ্যে। তাও আমি তোমাকে কিছু করতে পারি না। কেন জানো? কজ আই লাভ ইউ। আমার ভালোবাসাকে কষ্ট দিলে তো আমি নিজেই কষ্ট পাবো। কিন্তু তুমি যখন আমাকে কষ্ট দাও তুমি কি নিজে তখন কষ্ট পাও রোজ? পাও না। এই যে আমাকে সারাটাদিন বেঁধে রেখে নিজে ঠিকই বেরিয়ে এসেছো। ফুর্তি করে এসেছো।”
কথাটা বলেই হঠাৎ চোয়াল শক্ত হয়ে গেল তার। চোখমুখ শক্ত করে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইনশিতাকে জোরে চেপে ধরে বলল,
-“ওয়েট এ মিনিট! ফুর্তি করে এসেছো? কার সাথে? সেই বাস্টার্ড কে?”
এক মিনিট চুপ থেকে কড়া স্বরে বলল,
-“রাফিদ তাই না? তোমার প্রাক্তন আশিক রাফিদ হু? ওকে দুনিয়া থেকে সরাবার ব্যবস্থা করছি ওয়েট।”
বলে ইনশিতাকে সরিয়ে নিজে উঠে দাঁড়াল। টলমল করছে তার পা। যেন এক্ষুনি পরে যাবে। ইনশিতা নিজের ব্যাথা ভুলে দ্রুত জেহেরকে ধরল। ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,
-“আমি কারো সাথে ফুর্তি করে আসিনি জেহের। আ-আমি শুধু বাড়িতেই গিয়েছি। বি-বিশ্বাস করুন। আমাকে ক্ষমা করুন জেহের। আমি আপনাকে আর কোনোদিন ফাঁকি দিবো না, আপনার সব কথা শুনব। এখন আপনি একটু শান্ত হয়ে বসুন জেহের।”
জেহের কঠিন দৃষ্টিপাত করল ইনশিতার দিকে। ইনশিতা কিছুটা নিভল। হাত ছেড়ে দিলো জেহেরের। জেহের গর্জে উঠে বলল,
-“সবসময়ই তো এই একই কথা বলো। ‘আপনার সব কথা শুনবো জেহের’ অথচ কোনদিন শুনেছ আমার কথা? নিজ ইচ্ছা মতোই তো ঘুরে বেড়াও। আজ আবার নিজের হাজব্যান্ডকে বেঁধে আশিকের সাথে দেখা করতে গিয়েছ। আর যাতে সেই আশিকের কাছে যেতে না পারো সেই ব্যবস্থা করব। তোমাকে কিছু করব না। বাট তোমার আশিককে কী করি জানি না। ছাড়ব না আমি।”
টলতে টলতে জেহের রুমের বাইরে বের হলো। ইনশিতা শব্দ করে খাটে বসে পড়ল। মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। সে তো সবসময়ই জেহেরের কথা মানে। আজ মাত্র অবাধ্য হয়েছে। আজকের সেই নোংরা ঘটনাটা সে ইচ্ছে করেই চেপে গেছে জেহেরের কাছে। জেহের জানলে নিজের আপন ভাই বোনকে মেরে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করবে না। আর যেখানে রাফিদের কারণে সে বেঁচে গেছে সেখানে রাফিদকেই জেহের মারতে যাচ্ছে! ইনশিতা দ্রুত উঠে দাঁড়াল। নাহ, সে কখনোই এমনটা হতে দিবে না। জেহেরকে থামাতে হবে। দৌড়ে রুমের বাহিরে আসতেই দেখল জেহের রান্নাঘর থেকে ছুরি হাতে দরজার দিকে যাচ্ছে।
জেহেরকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে থামায় ইনশিতা। কান্নাজড়িত কন্ঠে বলে,
-“আপনি রাফিদকে কিচ্ছু করবেন না জেহের। আপনি যদি এমন কিছু করে থাকেন তা-তাহলে আমি আপনার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দেব।”
জেহের কানে নিলো না সেই কথা। দরজা খুলে হাঁটতে লাগল গেটের দিকে। ইনশিতা চিৎকার করে জেহেরকে থামতে বলল কিন্তু থামার নাম নেই জেহেরের। আচমকা জেহের ছুরি ফেলে মাথা চেপে ধরল। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে। ইনশিতা জেহেরের কাছে দৌড়ে গিয়ে বলতে লাগল,
-“জেহের, প্লিজ ঘরে চলুন। জে…”
জেহের ইনশিতার হাত জড়িয়ে ধরে নিজের মাথায় রাখল হঠাৎ। আর্তনাদের মতো করে বলল,
-“আমার মাথায় খুব যন্ত্রণা করছে রোজ। খুব ব্যাথা করছে। একটু ম্যাসাজ করে দাও তো। মাথাটা-মাথাটা মনে হচ্ছে কেটে ফেলে দেই একদম। অসহ্য!”
ইনশিতা কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে রইল। হঠাৎ কী হলো জেহেরের? এমন করছে কেন?
-“কী হয়েছে আপনার?”
জেহের করুণ চোখে তাকাল। ইনশিতার বুকটা ধ্বক করে উঠল।
-“সহ্য করতে পারছি না রোজ। মাথায়…উফ!”
জেহের মাথা শক্ত করে চেপে ধরল। ইনশিতা তাড়াতাড়ি জেহেরকে উঠিয়ে ঘরে নিয়ে আসতে লাগল। ইনশিতা ভাবল জেহের আজ সারাদিনে কিছু খায়নি, আর জেহের না খেয়ে থাকতে পারে না। তাই হয়ত যন্ত্রণা করছে। সোফায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
-“আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি আপনার জন্য কিছু বানিয়ে আনছি।”
ইনশিতা চলে যেতে নিলে জেহের হাত ধরে আটকায়। ক্ষীণ কন্ঠে বলে,
-“কোথাও যেও না। আমার কাছে বসে একটু ম্যাসাজ করে দাও রোজ। প্লিজ।”
ইনশিতার কষ্ট হতে লাগল। আজ তার জন্যই সবটা হয়েছে। জেহেরের সামনে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
-“একটু অপেক্ষা করুন। আমি আপনার জন্য এক্ষুনি খাবার আনছি।”
হাত ছাড়িয়ে ইনশিতা রান্নাঘরে চলে গেল। চিন্তায় পড়ে গেল কী বানাবে সে? জেহের লাঞ্চ কিংবা ডিনারে অর্ডারকৃত খাবার খায়। অফিসে গেলে সেখানে লাঞ্চ করে সেখান থেকেই নিজের ডিনার নিয়ে এনে ফ্রিজে রাখে। কেমন সেদ্ধ, আধসেদ্ধ খাবার সেসব। ইনশিতা সেসব বানাতে পারে না। এখন কী করবে? ভাবতে ভাবতে এক গ্লাস গরম দুধ বানিয়ে আনল।
জেহেরের সামনে গ্লাস এগিয়ে দিতে জেহের হুট করে গ্লাসটা ছুঁড়ে মারল। ফর্সা হওয়ায় পুরো মুখ লাল বর্ণ ধারণ করেছে। আর চোখ দুটোও অসম্ভব লাল। জেহেরের হঠাৎ এমন আচরণের কারণ খুঁজে পেল না সে। একটু আগেই না অন্যরকম ছিল, তাহলে এখন? জেহেরের মাথায় হাত দিয়ে বলতে লাগে,
-“কী হয়েছে জেহের? দুধটা ফেলে দিলেন কেন?”
জেহের গরগর শব্দ করছে। ভয়ানক লাগছে ইনশিতার কাছে। জেহের ইনশিতাকে ধাক্কা দিয়ে হঠাৎ ফেলে দিলো। ব্যাথা না পেলেও অবাক হলো ইনশিতা। জেহের মাথা চেপে ধরে আর্তনাদ করতে লাগল। ইনশিতার কাছে জেহেরের আজকের আচরণটা খুবই অস্বাভাবিক ঠেকল। জেহের কখনো তার উপর রেগে গেলে অন্তত এমনটা করে না। তাহলে আজকেই হঠাৎ এত অস্বাভাবিক লাগছে কেন জেহেরকে? জেহের তখন একবার রুমে, ব্যালকনিতে মাথা চেপে গর্জন করতে শুরু করল। চোখমুখ দেখে বুঝতে পারছে ইনশিতা যে জেহেরের খুব কষ্ট হচ্ছে।
ইনশিতা নিজেকে শান্ত রাখলো। আজকে তার উপর যেই ধকল গেছে তাতে তার সারাদিন বিশ্রাম নেওয়ার কথা। অথচ হচ্ছে তার ঠিক উল্টো।
.
.
হঠাৎ ডোরবেলের আওয়াজে ইনশিতা ব্যালকনি থেকে চোখ ফেরাল। সে কী ভুল শুনছে? না, ঐ তো আবার ডোরবেল বাজছে। জেহেরের সেই ধ্যান নেই। সে তখন বিড়বিড় করে মাথা চেপে আছে। যেন মনে হচ্ছে সে যদি পারত তাহলে সিওর মাথা কেটে ফেলত। ইনশিতা মেইন দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। এই বাড়িতে সে আর জেহের ছাড়া আর কেউই কখনো আসে না। আর এত রাতেই বা কে ডোরবেল বাজাবে? এই বাড়ির ঠিকানা কার জানা আছে?
ইতস্তত করতে করতে সে দরজা খুলেই ফেলল। দেখল জেহেরের একজন গার্ড একটা প্যাকেট হাত দাঁড়িয়ে আছে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে গার্ড মাথা নিচু করে মিনমিন স্বরে বলে,
-“স্যারের জন্যে খাবার এনেছি ম্যাডাম। আসলে ম্যাডাম, আমাদের স্যার সবসময় যেই খাবার খায় সেটা শহরেই পাওয়া যায় আর স্যার দুপুরে না খেয়ে থাকতে পারে না। আজকে স্যার অফিসে আসেনি তাই স্যারের খাবার নিয়ে এসেছি। স্যার তো এই খাবার ছাড়া অন্য কিছু খেতে পারে না।”
ইনশিতা মনে মনে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলো গার্ডকে। এই মুহুর্তে যেন এটারই প্রয়োজন ছিল। ইনশিতা ধন্যবাদ জানিয়ে খাবার নিলো। গার্ড চলে যেতে নিলে সে আবার জিজ্ঞেস করে,
-“আপনি এ বাড়ির ঠিকানা কোথায় পেলেন? যতদুর জানি এই বাড়ির খবর কেউই জানে না।”
গার্ড আগের ন্যায়ই মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
-“স্যারের এ বাড়ির খবর ওনাদের ঘরের কেউ জানে না কিন্তু আমরা স্যারের গার্ডরা জানি। কারণ অনেক সময় স্যার এই বাড়িতে আসলে আমাদের আগে থেকেই সব গুছিয়ে রাখতে হয়।”
গার্ড চলে গেলে ইনশিতা দরজা আটকে খাবার রেডি করে নেয়। ভয়ে ভয়ে জেহেরের কাছে এগিয়ে হাতটা ধরে। জেহের ভয়ঙ্কর দৃষ্টিতে তাকালে ইনশিতা একবার বুকে থুথু দিয়ে নেয়। নরম কন্ঠে বলে,
-“এক্ষুনি আপনার মাথা ব্যাথা ঠিক হয়ে যাবে। চলুন আমার সাথে।”
জেহের ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। তাকে আগের চেয়েও ভয়ানক ক্লান্ত লাগছে। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার। ইনশিতা হাত ধরে আস্তে আস্তে টেনে নিয়ে টেবিলে বসায় জেহেরকে। আর জেহেরও যেন রোবটের মতো ইনশিতার পিছু পিছু আসে। তার চেহারা অনুভূতিশূন্য। ইনশিতা জেহেরকে নিজ হাতে খাইয়ে দেয়। জেহের নিজেও কোনো কথা না বলে খেয়ে নেয়। অথচ চোখের দৃষ্টি পুরো ইনশিতার দিকে আবদ্ধ। যেন কত জনম দেখে না তার রোজকে।
জেহেরকে খাইয়ে দিয়ে ইনশিতা শুইয়ে দেয়। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে জেহেরের মাথা ব্যাথাও যেন চলে গেছে। চুপচাপ শুইয়ে দিলে জেহের নিজের দু’হাত ইনশিতার দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইনশিতা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো হেসে জেহেরের বুকে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ে। যত কিছুই হোক, জেহের ইনশিতাকে বুকে না নিয়ে ঘুমোতেই পারে না। জেহের খুব দ্রুত ঘুমালেও ইনশিতার চোখে ঘুম নেই। একটু মাথা তুলে জেহেরের মুখপানে তাকায় সে। চোখের নিচে কালো দাগ পড়ে গেছে এই একদিনেই। মুখটাও কেমন ফ্যাকাশে লাগছে। আজকের জেহেরের এই অদ্ভুত আচরণের কথা ইনশিতাকে ভাবাতে থাকে।
.
.
সকালে আজ কেউই জগিংয়ে যায়নি। জেহের একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠেছে। তবে ঘুম থেকে ওঠার পর ইনশিতার সাথে একটা কথাও না বলে বেরিয়ে গেল অফিসের জন্য। আজকের ব্যবহারে ইনশিতা দ্বিতীয় দফা অবাক হলো। খাওয়ার সময়ও জেহের চুপচাপ নিজে খেয়ে ইনশিতাকে খাইয়ে দিয়ে চলে গেছে। ভাবটা এমন যেন গতকালের কথা কিছুই মনে নেই জেহেরের।
তবে ইনশিতা বেশিক্ষণ জেহেরের কথা ভাবতে পারল না। গতকাল সন্ধ্যের ঘটনাটা মাথাচাড়া উঠেছে তার। একা বাড়িতে যেন ভয়টা আরও বেশি করে ঝেঁকে ধরেছে। জিহাদের নোংরা কাজটির কথা ভাবলেই আতঙ্কে পুরো শরীরে কাঁটা দেয়। নিজেকে ঐ সময় ঠিক কতটা অসহায় লেগেছে সেটা একমাত্র যে ঐ অবস্থার সম্মুখীন হয়েছে সে-ই বলতে পারবে। নয়নিকার কথাটা ভাবলেই ইনশিতার চোখে অশ্রু এসে ভীড় করে। এমন ব্যবহার নয়নিকার থেকে সে কখনোই আশা করেনি। যার সাথে নিজেকে বেশি সেইফ ভাবে সে-ই গতকাল খুব খারাপ কাজে তাকে ঠেলে দিয়েছে। জিহাদ যখন ইনশিতাকে নিয়ে রুমে এসেছিল তখন নয়নিকার মুখে সে বিভৎস হাসি দেখতে পায়, যা তীরের মতো বুকে বিঁধে ইনশিতার। ইনশিতার ইচ্ছে করছে জেহেরকে কালকের ঘটনা সব বলে দিতে। তবুও কেন জানি বলতে পারছে না।
গতকালের ঘটনাটা ভেবে ভেবে ইনশিতা ডিপ্রেশনে চলে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে মায়ের কোলে মাথা রেখে কাঁদতে। মা যদি মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিতো তাহলে সে গতকালের ঘটনা নিমিষে ভুলে যেত। ইনশিতার ভাবনার মাঝে ফোনের রিংটোন বেজে উঠে। ইনশিতা চকিতে খাট থেকে নেমে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে। ফোনটা সাইলেন্ট করতে ভুলে গিয়েছিল সে। ভাগ্যিস জেহের নেই। নাহলে ফোনটা দেখলেই তুলকালাম কান্ড ঘটাতো আবার।
ফোন নিয়ে দেখল রাফিদ ফোন করেছে। বড় একটা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল ইনশিতা। ফোন রিসিভ করে নেয় সে।
-“কেমন আছো ভাইয়া?”
ঐ পাশ থেকে কোনো আওয়াজ আসে না। কিছু মুহুর্ত নিরবে কেটে গেলেই রাফিদের কন্ঠ ভেসে আসে,
-“হু! ভালো আছি। তুমি?”
ইনশিতা একটু হেসে বলে,
-“আমিও।”
-“মিথ্যে বলছো কেন ইতু? গতকালের ঘটনার পর তুমি কতটা ভালো আছো সেটা কী এখন মিথ্যে বলে বোঝাতে হবে আমায়?”
ইনশিতা চুপ থাকে। রাফিদই একমাত্র তার মনের অবস্থা বুঝতে পারছে। ইনশিতা কখন ভালো থাকে আর কখন মন খারাপ থাকে সব রাফিদ বুঝে যায়। কীভাবে যে বুঝে যায়? তার মতো কেন নয় জেহের? কেন সে ইনশিতার মনের অবস্থা বুঝতে পারে না। দুপাশের নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে যায় ইনশিতার কন্ঠে,
-“আমি জানি না রাফিদ ভাইয়া। কেন আমার সাথেই এমন হয় সবসময়! আমি তো কারো কোনো ক্ষতি করিনি। তাহলে? তাহলে কেন কালকে এমন বাজে ঘটনা ঘটল আমার সাথে?”
ইনশিতা আবারও কান্নায় ভেঙে পড়ল। রাফিদ বুঝতে পারল এখন এই টপিকে যাওয়াটা ঠিক হবে না। টপিক পাল্টায় রাফিদ। বিভিন্ন কথার মাঝে ইনশিতাকে হাসি খুশি রাখার চেষ্টা করল সে। যাতে কোনোভাবেই গতকালের কথা ইনশিতার মনে না পড়ে। এখন যদি ইনশিতা কাছে থাকত, তাহলে সে জড়িয়ে ধরে ইনশিতার মাথায় হাত বুলিয়ে সব কষ্ট ভুলিয়ে দিত। দীর্ঘশ্বাস চেপে ইনশিতাকে খুশি রাখার চেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে রাফিদ। ইনশিতার খুশি মানেই তার কাছে সব।
আজ পুরোটা দিন কাটল রাফিদের কথা বলে। সকাল থেকে বিকেল অবধি একটু পর পর কথা ফোন করেছে রাফিদ। হাসি ঠাট্টায় কাটলো পুরোটা দিন। এক মুহুর্তের জন্য সে ভুলে গেল গতকালের ভয়াবহ ঘটনা।
-“গান শুনবে ইতু?”
-“শোনা যায়।”
-“কী গান।”
-“তোমার যেটা ইচ্ছা।”
-“আচ্ছা, ওয়েট।”
রাফিদ গিটার নিয়ে ফোনটা কাছে রেখেই গাইতে শুরু করে। রাফিদের কন্ঠে গান শুনতে এত ভালো লাগে যে ইনশিতার মনে হয় রাফিদকে সামনে বসিয়ে সবসময় খালি গানই শুনতে। রাফিদ ইনশিতাকে উদ্দেশ্যে করেই গান গায়। সে তো সব গানই ইনশিতাকে উদ্দেশ্য করে গায়। ইনশিতা কী বুঝে তা?
Juda hum ho gaye mana
Magar yein jaan lo janaa(2)
Kabhi mein, yaad aaun to
Chale aana, chale aana
Tumhe mein vul jaunga
Yein baate dil mein na lana
Kabhi mein, yaad aaun to
Chale aana, chale aana…
Tha kon mera ek tu hi tha
Sason se jeyada zo jaruri thaa
Tere liye main kuch nehi lekinn
Mere liye tu mera sab kuch thaa…
Nehi jaana vula karke
Yein batein tum he kehte the
Nehi khushiyan nehi meri
Ki tum bhi waqt jaise the
Tumhara tha rahega abhi
Kare kya dil hain dewanaa
Kabhi main yaad aaun to
Chale aana, chale aana…
.
.
চলবে…