#কমরেড_শায়লা ৭ম পর্ব
৮.০২.১৯
রাত বারটা। ল্যাব এইডের ইমার্জেন্সিতে বসে আছি। নিজের নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের শব্দ শুনছি চুপচাপ।
এক ঘন্টা আগের কথা। চোয়াল সই করে স্বামী নামক মানুষটার মুখে লাথি মারার এক মুহূর্ত পর আমি সামনে তাকিয়ে চমকে উঠলাম।
দেখি ফ্লোর রক্তে ভেসে যাচ্ছে। এত রক্ত দেখে আমি একটু কেঁপে উঠে স্তব্ধ হয়ে গেলাম! এত রক্ত! এত রক্ত কেন? আমিতো অত জোরে মারিনি। দেখি দরজার পাশে মানুষটা কেমন যেন নিথর হয়ে পড়ে আছে! রক্তের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমি থরথর কেঁপে উঠলাম। গা গুলিয়ে মাথা ঘুরে উঠল হঠাৎ। পৃথিবীটা ভয়ংকরভাবে দুলছে!
রক্তের রং মারাত্মক রকম লাল।
কাঁপা কাঁপা হাতে আব্বাকে ফোন দিলাম,
-আব্বা, রক্ত!
-কী হয়েছে মা?
-আব্বা অনেক রক্ত! আব্বা!
-কী হয়েছে মা,কোথায় রক্ত? কার রক্ত?
হ্যা,তাইতো, কার রক্ত?
এই যে মানুষটা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে মানুষটার নাম টা কী? মনে করতে পারছিনাত! কার রক্তের কথা বলব আমি?
-আব্বা আয়েশা,আয়েশার রক্ত! আব্বা…
আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম।
তৎক্ষনাৎ দেখলাম রক্তের ভেতর হতে মানুষটা উঠে বসার চেষ্টা করছে,
আমার চোখের সামনে বারো তের বছরের একটা মেয়ের স্কুল ড্রেস পরা রক্তাক্ত লাশ ভেসে উঠল। লাশটা র সামনে বসে আছে, দুই বেনী করা চুল, আরেকটা মেয়ে।
সেই মেয়েটার পাশে বসে কে যেন বলছে,
-কিচ্ছু হয়নি আমার। ইটস ওকে শায়লা। মাথা একটু ফেটেছে , ইটস ওকে! শান্ত হও। দুই মিনিট জাস্ট সেন্সলেস ছিলাম। ইটস ওকে! আস্তে আস্তে শ্বাস নাও!
ফোনের ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম আব্বা শান্ত কন্ঠে বললেন, শায়লা,আমি আসছি। আর কাউকে ফোন দেওয়ার দরকার নাই।
মানুষটা ততক্ষনে মাথার এক পাশ চেপে ধরে টলতে টলতে আমার কাছে এসে বসেছে।
আমার শ্বাস প্রশ্বাস দ্রুত তালে পড়ছে। মাথার ভেতরে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। সাইকোজেনিক হাইপারভেন্টিলেশন শুরু হয়ে গেছে আমার ।
এটা হলে দ্রুত শ্বাস নেওয়ার কারনে একটু পরই কার্বনডাইঅক্সাইডের ঘাটতি শুরু হবে আমার শরীরে। খিঁচুনি শুরু হয়ে যাবে তার পরপরই। আমি জোর করে শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়ন্ত্রনে আনার চেষ্টা করছি। পারছিনা। মানুষটা, যার নাম আমি মনে করতে পারছিনা, রক্তাক্ত শরীরে আমাকে জড়িয়ে ধরে আছে,
-শান্ত হও। আস্তে আস্তে শ্বাস নাও। পলিথিন আছে কোথাও?
আমি দ্রুত শ্বাস নিতে নিতে কোনমতে বললাম,আমার ডেস্কের ড্রয়ারে।
নিজের সাথে যুঝতে থাকলাম আমি। তার মাঝে ঝাপসা দৃষ্টিতে দেখলাম মানুষটা ছুটে গেল,ডেস্কের ড্রয়ার লন্ডভন্ড করে পলি ব্যাগ খুজে বের করল। তারপর আবার ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরল।
-নাও, এটার ভেতর মাথা ঢুকিয়ে শ্বাস নাও। আস্তে আস্তে। কোন তাড়াহুড়ো নাই।
আমি পলিব্যাগে মাথা ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে শ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। ধীরে ধীরে খুব ধীরে ধীরে আমার শ্বাস প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিক হয়ে এলো ।
আমি পলিথিন রেখে মুখ তুলে তাকালাম। শীতল দৃষ্টিতে মানুষটাকে ব্যবচ্ছেদ করতে চাইলাম যেন।
মানুষটার চুলে জমাট বাঁধা চাক চাক রক্ত।
-ঠিক লাগছে এখন একটু?
-আপনি জানেন কীভাবে আমার সাইকোজেনিক হাইপারভেন্টিলেশনের সমস্যা আছে?
শীতল কন্ঠে জানতে চাইলাম আমি।
মানুষটা চুপ করে রইল।
আমি হিংস্র কন্ঠে আবার জিজ্ঞেস করলাম
-কীভাবে জানেন? জবাব দিন!
মানুষটা নিরুত্তর। মাথা নত করে আছে।
একটুপর মাথা উঁচু করতেই দেখলাম তার চোখে জল চিকচিক করছে
-শায়লা,আয়েশা আমার ছোট বোন ছিল!
*
আধ ঘন্টার ভেতর আব্বা এলেন গাড়ি নিয়ে।
পিছনে ভাইয়া। আব্বা ছুটে এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। আমি আব্বার বুকে মুখ লুকালাম।
ভাইয়ার ভরাট কন্ঠ শুনলাম
-হাসান ঠিক আছো তুমি?
-জ্বি ভাইয়া।
-এমবুলেন্স ডাকা হয়েছে। ইট উইল বি অলরাইট নাউ।
*
সাল ২০০৩। হাইস্কুলের ক্লাস শুরু। নতুন স্কুলে একদম পিছনের বেঞ্চে বসা আয়েশা নামের শান্ত চেহারার মেয়েটার সাথে পানির বোতল দেয়া নেয়ার মাধ্যমে আমার বন্ধুত্বের শুরু হলো।
একসাথে হাঁটতে হাঁটতে, খেলতে খেলতে ও হয়ে উঠল আমার প্রাণের বন্ধু। আমি ওকে সব ধরনের গল্প করি। কিন্তু ও সারাটাদিন কেমন যেন চুপচাপ। ওর বাসায় যেতে চাইলে নিয়ে যেতে চায়না। আমি কত্ত চাইতাম ওর বাসায় ওর পুতুলগুলো দেখতে। ও শুধু ম্লান হাসত।
আমার বাসায় আমি মাঝে মাঝে ওকে নিয়ে যাই। আব্বা আম্মা আয়েশাকে অনেক আদর করেন। আমি,ভাইয়া আর আয়েশা একসাথে খেলি প্রায়ই, যেন আমরা দুই বোন,এক ভাই।
ক্লাস সেভেনে ওঠার পর এক বিকেলে আয়েশা প্রথমবারের মত তার কাঁধে জমাট বাঁধা রক্তের দাগ দেখাল আমাকে। তারপর মুখে একটা বিষন্ন হাসি ঝুলিয়ে বলল
-শায়লা, আমার আসলে তোমাকে দেখানর মত কোন পুতুল নাই। আমি নিজেই একটা ভাঙাচোরা খেলাঘরের ভাঙা পুতুল!
বলতে বলতে ফুঁপিয়ে কেদে ফেলল আয়েশা। কাঁদতে কাদতে বলল,ওর বাবা মায়ের কথা। ওর বাবার নিষ্ঠুরতার কথা। কেমন পশুর মত তিনি আয়েশাকে, ওর একমাত্র ভাইকে আর ওর মাকে প্রতিদিন সকাল বিকাল রুটিন করে মারধোর করেন। আয়েশার বাবা উনার অফিসেরই এক অধঃস্তনের সাথে পরকীয়ায় জড়িত ছিলেন। এ নিয়ে সারাদিন বচসা ওর বাবা মায়ের।
আয়েশা সেদিন আমাকে জড়িয় ধরে রেখে বলছিল সেসব কথা। আমি যদিও সব কথা বুঝতে পারছিলাম না। কারো বাবা কী করে কারো মাকে মারে? যেখানে আমার আব্বা কখনো আমার আম্মাকে ছাড়া ভাত খান না?
আয়েশা বলেছিল, ওর বাবা মায়ের বিচ্ছেদ হলে ওর মাকে অনেক কষ্ট পেতে হবে। কারন ওঁর বাবা মায়ের বিয়েটা ছিলভালবাসার বিয়ে।
আয়েশার বিশ্বাস ছিল ওর বাবা মায়ের হয়ত যেকোন সময় বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে যাবে। সেই ভয়ে সবসময় ও তটস্থ থাকত। ও চাইতনা ওর মা কষ্ট পাক।
একদিন, শুধু একদিন আমি আয়েশাদের বাসায় গিয়েছিলাম। ওর বাবা তখন ওর মাকে পরনের বেল্ট দিয়ে প্রহার করছিল। ঘরে ঢুকেই আয়েশা ওর বাবার সামনে একটা ভীত মুরগীর ছানার মত কাঁপতে লাগল। তার পরক্ষনেই আমার হাত ধরে এক ছুটে ঘর হতে বের হয়ে গেল ও। কাঠ ফাটা রোদে তেতে ওঠা রাস্তায় খালি পায়ে ধপ করে বসে পড়ল আয়েশা, তারপর পাগলের মত ফোঁপাতে লাগল।
এখনো চোখে ভাসে আমার। ওর আতংকিত মুখটা স্মরনে আসলে আমি সহ্য করতে পারিনা। ওর প্রতিটাদিনের কান্না মাখা হাহাকার আমার টিফিন ছুটিগুলোকে অশ্রু সজল করে দিত।
এর মাঝে আমাদের স্কুলের নতুন এক অংক স্যার এলেন। অংকের স্যার প্রতিদিন অংক বাড়ির কাজ ভুল করার কারনে ওকে ডিটেনশন দেয়া শুরু করলেন।
ফাল্গুনের এক বিকেলে আয়েশা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,”শায়লা আমি আসলে কখনোই অংক বাড়ির কাজ ভুল করিনি, জানো?”
বয়সের তুলনায় আয়েশা আমার চেয়ে মানসিকভাবে পরিনত ছিল। ওর কথাগুলোর অর্থ আমি তখন বুঝিনি। আমি আসলে অনেক কিছুই বুঝিনি।
বুঝলে হয়ত আয়েশাকে আমি জড়িয়ে ধরে রাখতাম, কোথাও যেতে দিতাম না,কোথ্থাও না
যেদিন আয়েশা স্কুলের ছাদ থেকে লাফ দিল,সেদিন ওর জন্মদিন ছিল। আমি ওকে জন্মদিনের উপহার দিতে স্কুল ছুটির পর দাঁড়িয়ে ছিলাম। তার বদলে স্কুল ছুটির পর আমি ওর লাশের সামনে উপহারটা রেখে বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম। পুলিশ এলো। সবার সাথে সাথে আমাকেও জেরা করল। আমি আব্বার বুকে মুখ লুকিয়ে থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জবাব দিচ্ছিলাম। আমি পুলিশকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম অংক স্যারের কথা। আমি জানতাম না পৃথিবীতে কিছু ভয়াবহ পশু থাকে যাদের চেহারাটা আসলে কতিপয় পুরুষরূপী মানুষের মত।
*
আয়েশার মৃত্যুর পর আমার পৃথিবীটা বদলে গেলো। আব্বা ভাইয়া সহ পৃথিবীর সমস্ত পুরুষকে আমি ভয় পেতে শুরু করলাম। কোন পুরুষকেই সহ্য করতে পারতামনা। ঢিল মেরে দারোয়ান চাচার মাথা ফাটিয়ে দিলাম একদিন।
আব্বা ছায়ার মত আমাকে আগলে রাখতে লাগলেন। অনেক দিন গেছে আমি আঁচড়ে কামড়ে আব্বাকে রক্তাক্ত করেছি। আব্বা জায়নামাযে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখে শুধু চোখের পানি ফেলেছেন।
আব্বা আমাকে একজন সাইকিয়াট্রিস্টের এর কাছে নিয়ে যেতেন নিয়মিত। স্কুলে যেতাম না। এক বছর সময় নষ্ট হলো। আমি একা একা কোথাও যেতে ভয় পাই, হাসতে ভুলে গেলাম। আব্বা বাসায় মহিলা শিক্ষক রেখে আমাকে পড়াশোনা করালেন। মেয়েদের একটা মার্শাল আর্ট শেখানর প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়ে দিলেন। নিজে আমাকে গাড়িতে করে দিয়ে আসেন নিয়ে যান। মেডিটেশন,ইয়োগা কোনকিছু বাদ রাখেননি তিনি।
আমি ধীরে ধীরে অনেক খানি স্বাভাবিক হলাম। আর আমার মনে হতে লাগল আয়েশার মত আরো অনেকেই আমার আশে পাশে আছে তাদেরকে আমার বাঁচাতে হবে। এজন্য বড়সড় একটা কিছু করা দরকার। পৃথিবীর বুকে আয়েশাদের স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। এই অধিকার আমাকে প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আমি ফেসবুকে গ্রুপ খুললাম। গ্রুপে ইভ টিজিং, নারী নির্যাতন সংক্রান্ত কোন খবর এলেই আমরা গ্রুপের কমরেডরা ছুটে যাই। নির্যাতিত নারীর খোঁজ পেলেই
তাকে আমরা সাহস যোগাই। আত্মরক্ষার ট্রেনিং নিতে সাহায্য করি,আইনী সহায়তা দেই। এত এত নির্য়াতিত নারীর সাহচর্যে এসে একসময় আমাদের মিশন দাঁড়ালো অত্যাচারী,দুশ্চরিত্র সব পুরুষকে পৃথিবী হতে নিশ্চিহ্ন করতে হবে।
কারন এই পৃথিবী কোন অসুন্দর পুরুষের জন্য নয়। এই পৃথিবী শুধু এবং শুধু মাত্র আয়েশাদের জন্য।
(কমরেড শায়লার ব্যক্তিগত জার্নাল আপাতত এখানেই শেষ)