#কমরেড_শায়লা ৫ম পর্ব
৭.০২.১৯
ঘটনা জানলাম আজ সকালে। ভাইয়া ফোন দিয়েছিল।
-কীরে জনি সিন্স! বাসায় আয় আজকে।
ভাইয়া মাথা ন্যাড়া করার পর হতে জনি সিন্স বলে ডাকছে আমাকে। জনি সিন্স কী জিনিস জানতে গুগোলে সামান্য সার্চ দিয়েছিলাম। কী জিনিস আবিষ্কার করে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছি।
-আমাকে একজন কদর্য পুরুষের নাম ধরে এভাবে ডাকবেনা! আই অবজেক্ট!
-আচ্ছা আচ্ছা। বাসায় আয় আম্মা কান্নাকাটি করছে। আর বলছে, এটা কী বিয়ে না অন্য কিছু! বাপের জন্মে এমন কান্ডকারখানা দেখিনি। ছিঃ! আর কী মেয়ে পেটে ধরলাম মায়ের জন্য সামান্য মায়া মমতা নাই!
ভাইয়া অভিনয় করে কথাগুলো বলছিল আর আমার হালকা মন খারাপ বোধ হচ্ছিল। কিন্তু সাথে সাথে সেটা ঝেড়ে ফেললাম। আমাকে আবেগি হলে চলবেনা! কমরেডদের আবেগ থাকতে নাই! তাছাড়া আম্মাকে অামি অসংখ্যবার কমরেড বানানার চেষ্টা করেছি! পারিনাই! শেষবার আমাকে কান ধরে বাসা থেকে বের করে দিয়েছিলেন! তখন আমি ইউনিভার্সিটির ফাইনাল ইয়ারে।
-তুই নাকি সুজনের কাছে গিয়েছিলি মামলা করতে?
-হ্যা।
-সুজন তো হাসানের কলেজমেট। জানতি না?
ওহ! এই তাহলে কীহিনী! প্রচন্ড রাগে আমার মুখ দিয়ে আর কোন শব্দই বের হলোনা।
ফোন কেটে দিলাম।
আর না। ছ্যাঁচড়াটাকে আজকেই টাইট করব। কঠিনভাবে টাইট দিব!
ফেইক আইডির ইনবক্স খুলে দেখলাম আমার পাঠানো লুতুপুতু মেসেজটার নিচে অপঠিত মেসেজ।
ছ্যাঁচড়া একটা প্রত্যুত্তর দিয়েছে
“-শ্রদ্ধেয়া,আপনার আন্তরিক কুপ্রস্তাবে রাজি হতে পারছিনা বলে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। আমার গৃহে একজন সম্মানিত ন্যাড়া মাথার নববিবাহিতা রয়েছেন। আমি তার কাছে দায়বদ্ধ। তিনি ব্যতীত পৃথিবীর তাবত ছলনাময়ী দুষ্ট নারী সমাজের কাছ হতে আমি একশ হাত তফাতে থাকি। আমি নারী বিদ্বেষী মানুষ তবে ন্যাড়া মাথার জিন্স টপস পরিহিতা কাউকে দেখলে প্রবল ভালবাসা অনুভব করি।”
ভালবাসা শব্দটা পাঠ করে আমি হাত মুঠো করে বাতাসে বৃথা আস্ফালন চালালাম। শব্দটা দেখেই কেমন বিবমিষাবোধ হচ্ছে। এই লোকের সমস্যা কী? সে কী চায়? তার ভালবাসা থেকে বাঁচার জন্য কি এখন আমাকে উইগ আর শাড়ি পরে ঘুরে বেড়াতে হবে? দাঁত কিড়মিড় করলাম আমি।
*
সন্ধ্যায় বাসায় ফিরলাম। ছ্যাঁচড়া তার অংশের টেবিলে বসে মোটা একটা বই পড়ছিল।
আমি হাতমুখ ধুয়ে বিছানায় বসলাম। ল্যাপটপে আজকে আমার অনেক কাজ।
রাত আটটার দিকে ছ্যাঁচড়া বিছানার কাছাকাছি এসে কয়েকবার ঘুরঘুর করে গেল। আমি দুই ঠ্যাং ছড়িয়ে বসায় সম্ভবত সাহস করে বিছানায় উপবিষ্ট হতে পারছেনা। আমার ঠ্যাং সরিয়ে উপবিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করে দেখুক খালি একবার! ডাক্তারী বিদ্যেটা ভুলিয়ে দেব!
আমি গম্ভীরমুখে ল্যাপটপে গলদা চিংড়ি চাষের ভবিষ্যত নিয়ে ঘাটাঘাটি করছি আর চোখের কোনা দিয়ে ছ্যাচড়াকে পর্যবেক্ষণ করছি। যেকোন সময় আমার উপর শত্রুর ভয়াবহ আক্রমন হতে পারে। তাই আমি কমরেড শায়লা সর্বদা প্রস্তুত।
মৎসবিদ মনসুর আহমেদ এর সাথে আগামীকাল এপয়েন্টমেন্ট। বেটার সাথে কী কী প্রশ্ন করব তালিকা করেছি একটা।
১.গলদা চিংড়ির নাম গল দা হলো কেন? কেন গল “দি” নয়? এই দা কি পুরুষবাচক শব্দ নয়? নারী গলদা চিংড়িকে গলদি কেন বলা হবে না? কেন এই বৈষম্যের হাহাকার আজ চিংড়ি সমাজে?
২.আপামর নারী গলদি চিংড়ি সমাজের বৈষম্য নিরসনে কী কী মৌলিক অধিকারের বাস্তবায়ন থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
৩.আপনি কি নারী গলদা চিংড়িদের কখনো আলাদা প্রশিক্ষনের ব্যবস্থা করেছেন যাতে তারা প্রতিকূল পরিবেশে নিজেদের বাঁচাতে পারে?
৪. খামারেরর প্রতিটি গর্ভবতী গলদি চিংড়ির স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে কী কী পদক্ষেপ গ্রহন করছেন?
৫.অত্যাচারী, দুশ্চরিত্র পুরুষ গলদা চিংড়িদের দমনে আপনারা কী কোন আইন প্রনয়ন করেছেন?
-আমি কি বিছানায় বসে একটু কথা বলতে পারি!
আমি চোখ কপালের দুই হাত উপরে তুলে তাকালাম। বালিশের ওপারে তার সাম্রাজ্য। এপারে আমার। এপারে আমার জিনিসপত্র ওইপারে তার।
সে কি আজ সীমা লংঘন করতে চায়? সীমা লংঘন করলে আমি কমরেড শায়লা আজই তাকে গৃহ প্রবেশের মুখে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখব!
সাবধানী চোখে তাকালাম,
-শ্রদ্ধেয় বউ, আপনি কি রাতের খাবার খেয়েছেন?
চোখ কপাল থেকে দুই হাত উপরে উঠিয়ে ছ্যাঁচড়াকে জরিপ করলাম। “বউ” শব্দটা শুনে মাথার ভিতরে কোথাও একটা ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়েছে!
“বউ” একটা হয়রানিমূলক শব্দ। সেই শব্দের মাধ্যমে সম্বোধন করে আমাকে মানসিকভাবে অপদস্থ করা হচ্ছে, রোসো বাছা!
ল্যাপটপটা শব্দ করে কোল থেকে নামিয়ে পাশের ডেস্কে রাখলাম।
শব্দ শুনে ছ্যাঁচড়া ভড়কে গিয়ে আমার দিকে তাকাল!
আমি সব কটা দাঁত বের করে আমার সবচে নিষ্ঠুর হাসিটা দিয়ে খাট হতে মেঝেতে তায়াকেয়ান্দোর বিশেষ অবস্থানে দাড়ালাম। একবার এক ইভ টিজারকে এইভাবে মেরে হাসপাতালে পাঠিয়েছিলাম!
-হোয়াট ডু ইউ মিন বাই বউ! বউ কে এখানে? আমার সাথে ফাজলেমি করেন? যুগে যুগে নারীরা পুরুষের এসব বউ ডাকা ফাঁদে পড়েছে,নির্যাতিত হয়েছে,করেনি কোন প্রতিবাদ! বউ ফউ ডেকে নারীকে মানসিকভাবে দুর্বল বানিয়ে অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন যুগে যুগে অনেক হয়েছে! কিন্তু আর নয়! এবার হামলাআআআ…
আমি ত্বরিতগতিতে ছুটে গেলাম, উদ্দেশ্য ছ্যাঁচড়াকে মাথার উপর তুলে আছাড় মারব। কিন্তু ছুটে কাছাকাছি আসতেই শেষ মুহূর্তে কী যেন হলো! দেখি আমিই হঠাৎ আকাশের উপর উঠে যাচ্ছি। তারপর ধড়াম!
জ্ঞান হারানর আগে ছ্যাঁচড়াকে বলতে শুনলাম
-হায় আল্লাহ, এ আমি কী করলাম!
ফ্লোরের উপর পাউডার পরে ছিল। পাউডারে পা দেয়ায় চিৎপটাং হয়ে গেছি। আমি বাসায় আসার আগে ছ্যাঁচড়া পাউডার মেখে রূপ চর্চা করছিল খুব সম্ভবত। এতো দেখি রীতিমত অত্যাচারী পুরুষজাতির কলংক!
পাঁচমিনিট অজ্ঞান ছিলাম উঠে দেখি বিছানায় শুয়ে আছি, মাথার পিছনে প্রচন্ড ব্যথা।
মাথার কাছে উৎকন্ঠা নিয়ে কেউ একজন বলে উঠল
-মাননীয়া,দেখি এদিকে তাকান,এখানে আঙুল কয়টা?
আঙ্গুল? কোথায় আঙ্গুল? কার আঙ্গুল! কেন আঙ্গুল দেখাতে চায়?
মাথা পরিস্কার হতেই বুঝলাম কন্ঠটা ছ্যাঁচড়ার।
চোখের সামনে তার কদলী মার্কা আঙ্গুলগুলো ঝুলিয়ে রেখেছে!
আঙুল কয়টা মানে? এতগুলো আঙুল আমার চোখের সামনে ঝুলিয়ে কী বোঝাতে চায় সে? বিবাহিত স্ত্রীকে এ ধরনের অশ্লীল ইঙ্গিতপূর্ণ আচরনের জন্য আইনের কত নং ধারায় কী আছে এসব ভাবতে ভাবতে খেপে বোম হওয়ার আগেই থতমত খেলাম। গুনে গুনে দেখি ছ্যাঁচড়ার এক হাতে দশটা করে মোট বিশটা আঙ্গুল। এক দুই তিন… … আবার গুনলাম। আবারো বিশটা, ঘটনা কী?
মাথা চুলকাতে যেয়ে দেখি ডান হাত নাড়াতে গেলেই একটা কটকট শব্দ হচ্ছে।
-আপনার দুই হাতে বিশটা আঙ্গুল কেন?
বলেই তার মুখের দিকে তাকালাম। দেখি ছ্যাঁচড়ার মাথাও দুইটা দেখা যাচ্ছে। এবার হতভম্ব? মাথা দুইটা হলো কী করে? আরেকটা মাথা কে ফিট করে লাগিয়ে দিয়েছে?
-আমার হাতে বিশটা আঙুল না। আপনি সম্ভবত সবকিছু ডাবল দেখছেন,মাননীয়া।
ওহ! তাইতো! এজন্যই
কয়েকবার চোখ পিটপিট করতেই আস্তে আস্তে দৃষ্টি শক্তি স্বাভাবিক হতে লাগল আর
আমি দেখলাম ছ্যাঁচড়া উদ্বিগ্নমুখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
-আমি খুব দুঃখিত। ফ্লোরের উপর ফিনিশ পাউডার দিয়েছিলাম। গতরাতে তেলাপোকা উড়ছিল। আমি জোঁক আর তেলাপোকা খুব ভয় পাই।
অ। এই তাহলে কাহিনী!
শুনেই আমার ঠোঁটে হাসি ফুটল। ছ্যাঁচড়াকে শায়েস্তা করার একটা ভয়াবহ প্ল্যান মাথায় এসেছে।
-একটা নাপা খেয়ে নিন। আমি নিয়ে আসছি!
-খামোশ! আমি নিজেই নিয়ে খেতে পারব! আর আপনার এই কদলী মার্কা আঙ্গুলগুলো সরান চোখের সামনে থেকে! অশ্লীল লাগছে!
ছ্যাঁচড়া একটু ভ্যাবচেকা খেয়ে
সাথে সাথে আঙ্গুলগুলো পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল
-সরি!
-আর হ্যা আপনি আমাকে কথায় কথায় এত সম্মান দেখাচ্ছেন কেন? আমি শুনেছিলাম আপনি নারী বিদ্বেষী!
ছ্যাঁচড়ার মুখের দিকে তাকালাম। আমার চোখে “একদম কাঁচা খেয়ে ফেলব” দৃষ্টি।
এভাবে শুয়ে শুয়ে কথা বলতে কেমন যেন লাগছে। উঠে বসতে যেয়ে মনে হল গায়ের উপর কোন ট্রাক চলে গিয়েছিল,
আমাকে উঠে বসতে দেখে হা হা করে ছ্যাঁচড়া আমাকে ধরে ফেলল
-আপনি রেস্ট নিন। আমি নাপা আনছি।
-আগে প্রশ্নের উত্তর দিন।
ছ্যাঁচড়া চুপ করে রইলো।
-সত্যি কথা বলব?
সত্যি না বলে কই যাবা বাছা?
আমি দাঁত কিড়মিড় করলাম।
-ঘটনা কী খুলে বলেন!
ছ্যাঁচড়া একটু চুপ থেকে জবাব দিল, ,আপনি ছোটবেলায় যেদিন ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে আমার মাথা ফাটিয়েছিলেন, সেইদিন থেকে আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম ভবিষ্যতে নারী সমাজের কাউকে বিবাহ করতে বাধ্য হলে আপনাকে করব। আপনাকে ছাড়া আর কাউকে নয়। তাছাড়া আমি বিবাহ করছিলামনা দেখে বাসায় মা অনশন ধর্মঘট করছিল। এজন্যই!
বটে! আমি দাঁত কিড়মিড় করলাম।
-উত্তর পেয়েছেন। এখন নাপা নিয়ে আসছি। খেয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকুন।
ছ্যাঁচড়া পাশের রুমে গেল। ঠিক তখুনি দেয়ালের উপর ঠায় বসে থাকা তেলাপোকাটা চোখে পড়ল আমার। আর মাথায় সাথে সাথে একটা পরিকল্পনা খেলে গেল।
ইয়েস,মনে মনে হাতের উপর হাত দিয়ে কিল দিলাম আমি।
কষ্টেসৃষ্টে কোনমতে উঠে দাড়িয়ে তেলাপোকাটার শুড় ধরে হাতে ঝুলিয়ে রাখলাম। আমার তথাকথিত স্বামী ছ্যাঁচড়া এবার বুঝবে মজা! ঠোঁটে একটা নিষ্ঠুর হাসি ঝুলিয়ে রাখলাম। অতীত অভিজ্ঞতা হতে জানি তেলাপোকা যারা ভয় পায় তাদের গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দেয়াটা হলো পৃথিবীর সবচে নির্মম শাস্তি! ছ্যাচড়া রুমের দিকে আসছে পদশব্দ শুনছি। আমি কান খাড়া করে শুনছি আর গুনছি এক দুই তিন..
দশ গোনার সাথে সাথে ছ্যাঁচড়া হাসি হাসি মুখে রুমে ঢুকল। আর ঢুকতে না ঢুকতেই আমি তেলাপোকাটা ছুড়ে দিলাম ঠিক তার গাল বরাবর সই করে। এক সেকেন্ড হতচকিত হয়ে রইল ছ্যাঁচড়া তারপরই ছোটখাট একটা আর্তচিৎকার শোনা গেল!
-আআআআ তে তে তে… লা পোকা, বাঁচাও!
লক্ষী তেলাপোকাটা প্রচন্ড ভালবাসায় ছ্যাঁচড়ার নাকের ডগা জাপটে ধরে রেখেছে! আমি ছাড়া এই পৃথিবীতে এখন ছ্যাঁচড়াকে বাঁচানর কেউ নাই।
#কমরেড_শায়লা (৫ম পর্ব)