#সুরমা_কালো
#ঝিনুক_চৌধুরী
#পর্ব- ৪ ( শেষ পর্ব )
সকালে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। রাশেদ গোসল শেষে কাজে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। আজ সে ব্যবসার কাজে ঢাকায় যাবে তাই তাড়াতাড়ি তৈরী হচ্ছে ।
হঠাৎ একেবারে সিনেমার মতো ঘটনা ঘটে গেল।
রাশেদ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তৈরী হচ্ছিল আর আমি ওর পাশ দিয়ে যেতে হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়তে নিলাম ওমনি রাশেদ আমাকে ধরে ফেললো। যেনোতেনো ধরা না একেবারে সিনেমা স্টাইলে কোমরে জড়িয়ে আমাকে কাছে টেনে নিলো।
নিজেকে রাশেদের এতো কাছে আবিষ্কার করে আমার দম বন্ধ হয় হয় অবস্থা। কোনোভাবে রাশেদের দিকে তাকিয়ে দেখি রাশেদ আমাকেই দেখছে।
এই প্রথম আমার চোখের দিকে সরাসরি তাকালো রাশেদ। আমিও তাকিয়ে আছি ওর দিকে। আমার চোখ যেন রাশেদের চোখে আটকে গেছে। ওর চোখের সমস্ত ভাষা আমি পড়তে থাকি। এ চোখদুটোতে আমার প্রতি এতো মুগ্ধতা, এতো ভালোবাসা! কেন সে তা লুকিয়ে রাখে আমার কাছে?
আমি কি পাগল হয়ে ওর ভালোবাসার অপেক্ষায় ছিলাম অথচ ও ওর সবটুকু ভালোবাসা গোপন করে কেবল আমার পাশে থেকেছে। আজ এ চোখাচোখি লগ্নে রাশেদ যদি চোখ সরিয়ে নিতে চায় তবে আমি তার কলার টেনে ধরবো। আমার কাছ থেকে দৃষ্টি লুকিয়ে পালাতে আর দিবো না।
নাজিলার চোখে চোখ রেখে আজ অন্য ভুবনে চলে গেছে রাশেদ। মন চাইছে এভাবেই সারাদিন নাজিলাকে ধরে রাখতে। নাজিলার অবাক চাহনী রাশেদকে দূর্বল করে দেয়। মনে হচ্ছে নাজিলাকে দেয়া কথা আজ আর রাখতে পারবে না। এতো কাছে নাজিলা, রাশেদ যেন নিজেকে থামাতে পারে না। নাজিলাকে আরো কাছে টেনে আনে।
শেষে নিজেকে দমন করে শুধু কপালে চুমু খেয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
**
রাশেদ আমার কপালে চুমু দিয়ে বের হয়ে গেলে
আমি দাঁড়ানো থেকে বিছানায় ধপ করে বসে পড়ি। দুহাত দিয়ে মুখ লুকাই। পুরো শরীরে শিরশির অনুভূতি। খেয়াল করি আমার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ছে কিন্তু আমার মুখে হাসি। হাসি কান্না মেলানো কেমন এক অনুভূতি!
আমি.. আমি রাশেদকে ভালোবাসি। অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি।
নিজের কাছে নিজে স্বীকার করে আমার খুব হাল্কা লাগছে।
আমি এখন কি করবো? আমার এ আনন্দ এ ভালোলাগা কাকে বলবো! আমার চোখের পানি যেন থামতেই চাইছে না। ভালোবাসায় বুঝি এতো আনন্দ!!
হঠাৎ ছোট চাচীর কথা মনে পড়লো। আজ এ অনুভূতিটা জানার প্রথম অধিকার রাখে আমার ছোট চাচী। আমি তাকে কল দেই।
বিয়ের চৌদ্দ দিন পর আমার কল পেয়ে অবাক হবারই কথা।
চাচী ফোন ধরেই কাতর সুরে বলেন, নাজিলা, এতোদিন পরে কল দিলি?…আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছিস? আমি তোর ক্ষতি চাইনি রে…
কেমন আছো ছোট চাচী… বলতেই চাচী হু হু করে কেঁদে উঠেন।
আমিও কাঁদতে থাকি।
–চাচী, বিয়ের দিন তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি, তোমাকে কটু কথা বলেছি আমাকে তুমি ক্ষমা করে দিও। তুমি আমাকে কেন এখানে বিয়ে দিয়েছো তা আমি বুঝে গেছি। আমি জীবনে এতো ভালো, এতো মনের মতো শ্বশুড়বাড়ি পাবো আমি তা কখনোই ভাবিনি। এর পুরো কৃতিত্বই তোমার চাচী।
চাচী আস্তে করে বলে, রাশেদকে কেমন লেগেছে? তুই ওকে আপন করে নিতে পেরেছিস? ও কিন্তু অনেক ভালো ছেলে নাজিলা।
আমি ইচ্ছা করে মুখে ভারি ভাব এনে বলি, হ্যাঁ, আমি রাশেদের বিবাহিতা স্ত্রী। আমার তো তাকে মেনে নিতেই হবে।
— এভাবে বলছিস কেন? তুই একটু মনের চোখ দিয়ে দেখ নাজিলা! রাশেদ তোকে অনেক সুখে রাখবে।
—-চাচী, সংসারে একে অন্যকে ধারণ করা খুব স্বাভাবিক কিন্তু একে অন্যকে না ছুঁয়েও পাশাপাশি থেকে নীরবে ভালোবেসে যাওয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন অনুভূতি।
ভালোবাসার এ অনুভূতি আমি রাশেদের কারণে অনুভব করেছি, চাচী। কাগজে কলমে আমরা স্বামী স্ত্রী হয়েছি চৌদ্দ দিন আগে। কিন্তু জোর করে অধিকার আদায় না করে কি ভাবে ভালোবাসা জেতা যায় তা আমি রাশেদের কাছ থেকে শিখেছি। আমি এখন শুধু ওর স্ত্রী নই ওর জীবনসঙ্গিনী।
মুচকি হেসে ফিসফিস করে আমি বলি, চাচী, আমি তোমার বন্ধুর প্রেমে পড়ে গেছি। আমি রাশেদকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি।
চাচী আনন্দের হাসি হেসে বললেন, আমি জানতাম তোর আর রাশেদের খুব সুন্দর ভালোবাসার জুটি হবে। আজ আমি অনেক খুশি রে!
—আচ্ছা চাচী, তুমিও তো পড়াশোনায় অনেক ভালো ছিলে। তোমারও নিশ্চয়ই অনেক স্বপ্ন ছিল, তুমি কি ছোট চাচাকে নিয়ে সুখী?
ছোট চাচী হেসে বললেন, তুই নিজেকে সবার সাথে গুলিয়ে ফেলিস না। তোর স্বপ্ন আলাদা আমার স্বপ্ন আলাদা। আমি পড়াশোনায় ভালো ছিলাম কিন্তু আমার স্বপ্ন ছিল সুন্দর একটা সংসার। তোর ছোট চাচা আমাকে সে সংসার দিয়েছে, সম্মান ও ভালোবাসা দিয়েছে। আমি সুখী হবো না কেন? একেকজনের স্বপ্ন একেক রকম, প্রাপ্তির সুখও একেক রকম। বুঝলি?
— হুম!
–তুই রাশেদকে বলেছিস তোর ভালোবাসার কথা?
–না। আজ বলবো।
–বোকা মেয়ে! সবার আগে তো রাশেদকে জানাবি! যা আগে ওকে জানা! অনেক দোয়া রইলো তোদের প্রতি।
–চাচী শুনো! বড় চাচাকে জানিয়ে দাও আমি কদিনেই তোমাদের জামাইকে নিয়ে বাড়ি বেড়াতে আসবো।
–সবাই খুব খুশি হবে রে। রাখি।
****
আজ মা আর স্বর্ণার সামনে যেতে আমার কেমন অস্বস্তি লাগছে। স্বর্ণা তো বলেই বসল, ভাবি তোমার চেহারায় আজ কেমন যেন আলাদা উজ্জ্বলতা। কি হয়েছে?
আমি লজ্জা পেয়ে একবার মার দিকে তাকাই। দেখি মা মুচকী হেসে কাজ করছেন।
গোসল শেষে আজ বেগুনি শাড়িটা পরেছি।
মা আর স্বর্ণা দেখে অবাক যদিও কেউ কিছু বলে নি।
কিন্তু আমি ওদের সামনে যেতেই পারছি না। কেন জানি মনে হচ্ছে আমি রাশেদের প্রেমে পড়েছি সবাই জানলে হাসতে থাকবে।
শাড়ি পরে কিছুক্ষণ পর পর আয়নায় নিজেকে দেখছি। আজ নিজেকে খুব সুন্দরী লাগছে। নিজেই একা একা হাসি আবার নিজেই লজ্জা পাই।
স্বর্ণের ছোট দুল আর চেইন তো গলায় আছেই সাথে চোখে কাজল টেনে দেই। নিজেকে দেখতে দেখতে একসময় কাঁপা হাতে রাশেদকে কল দেই।
-হ্যালো!
-আমার জন্য শুধু শাড়ি আনলেন, ম্যাচিং টিপ আর চুড়ি আনলেন না যে!
-আনতে হবে?
-হুম। সবুজ টিপ আর সবুজ কাচের চুড়ি। সাথে খোঁপায় দেয়ার জন্য বেগুনি ফুল।
-কিন্তু আমার তো খোলা চুলেই তোমাকে বেশি ভালো লাগে।
লাজে আড়ষ্ট আমি চুপ করে থাকি।
আমি চুপ হয়ে আছি বলে রাশেদ নিজেই বলে, বেগুনি ফুল কোথায় পাবো?
-তা তো জানি না। ভালোবাসার মানুষের জন্য এটুকু করতে পারবেন না— বলেই আমার মনে হলো কি বললাম আমি! জিব কেটে তাড়াতাড়ি লাইন কেটে দেই।
অপর পাশ থেকে লাইন কেটে দিলেও রাশেদ মোবাইল কানে ধরে বসে আছে। বুকের মাঝে কেমন চিনচিন ব্যথা! নাজিলা পাশে থাকলে, ওর সাথে কথা বললে বুকের এ ব্যথাটা রাশেদ অনুভব করে। এ ব্যথা সুখের ব্যথা। ভালোবাসা নামক বুকের এ ব্যথাটা পুষতে রাশেদের ইদানিং বেশ ভালো লাগে।
***
সন্ধ্যার পর থেকে আমার বুকের ধকধকানি বেড়ে গেছে। যেকোন সময় রাশেদ আসবে। আমি কি ওর সামনে এই বেগুনি শাড়ি পরে দাঁড়াতে পারবো? আজ আমার লুকোচুরি খেলা চলছে মা আর স্বর্ণার সাথে। নিজের মধ্যেই আজ বুদ হয়ে আছি আমি।
হঠাৎ মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকেন। আমার শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যায়। ভয়ে শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করি , মা কি হয়েছে?
মা কাঁদতে কাঁদতে বলেন, রাশেদের এক্সিডেন্ট হয়েছে, নাজিলা!
আমার পায়ের মাটি সরে যায়।
আমার অবশ শরীরটা আমার শাশুড়ী মা শক্ত করে ধরেন।
–নাজিলা শক্ত হও, মা। রায়হান রবিন সাথে আছে রাশেদের। এক্সিডেন্ট দুপুরে হয়েছে। ওরা আমাকে এখন জানালো। আমার ছেলেগুলো বেশি বুঝে। আমি চিন্তা করবো বলে কিছুই জানায় নি। এখন জানিয়ে বলছে ঘন্টা দু’য়েকে এসে পড়বে ওরা তিন জন।
আমার গলা কাঁপছে। কথা বের হচ্ছে না। শক্তি সঞ্চয় করে বলি, উনি কেমন আছে, মা?
—আছে, ভালো আছে। আল্লাহর রহমতে অল্পের উপর দিয়ে গেছে। হাতে নাকি ব্যাথা পেয়েছে। তুমি শক্ত থেকো মা।
আমার গলায় কান্না দলা পাকিয়ে আসে। আমি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলাই। আমাকে শক্ত থাকতে হবে। মা যদি শক্ত থাকতে পারে তবে আমি কেন ভেঙে পড়বো।
দুইযুগ পার করে যেন ওরা এলো। রাশেদের হাতে প্লাস্টার করা। আমি রাশেদের দিকে তাকাতে পারি না। আমার খালি কান্না পাচ্ছে।
রাতে সবাই সবার রুমে ঘুমতে গেলে আমি রাশেদের পাশে গিয়ে বসি।
রাশেদ তার স্বভাবসুলভ হাসি দিয়ে বলে, তোমার চুড়ি আর টিপ ব্যাগের ভেতর রাখা। ফুল আনতে পারি নি। তার আগেই এক্সিডেন্ট বাঁধিয়ে বসেছি।
—আমার টিপ চুড়ি কিচ্ছু লাগবে না। আজ আপনার কিছু হয়ে গেলে… আমি কাঁদতে শুরু করি।
—আমি ভালো আছি, নাজিলা। তুমি কেঁদো না।
তোমাকে কিন্তু বেগুনি শাড়িতে বেশ মানিয়েছে, বলে রাশেদ মিটমিট হাসে।
আমি লজ্জা পেয়ে যাই।
–চুড়ি আর টিপ পরে নেও। তোমাকে পুরো সাজে দেখতে ইচ্ছে করছে।
রাশেদের গলার স্বরে মাদকতা ছিল। আমি নত মুখে চুড়িগুলো পরতে থাকি। কপালে টিপ বসিয়ে ওর দিকে তাকাই।
রাশেদের মুগ্ধ চাহনীতে আমার মনে শিহরণ জাগে।
আমার গালে হাত রেখে রাশেদ বলে, নাজিলা একটা কথা বলতে চাই।
-কি?
-তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আমার চোখে আনন্দ অশ্রু। রাশেদের বুকে মাথা রেখে বলি আমিও ভালোবাসি। অনেক বেশি!
রাশেদ আউ করে উঠে!
আমি ভয়ার্ত চোখে তাকালে হেসে বলে, তোমার ভাগ্যটাই খারাপ। একে তো কালো জামাই তার উপর এখন ভাঙ্গা জামাই।
রাশেদের বুকে হালকা চাপড় দিয়ে বলি, আমার ভাঙা জামাই ই ভালো।
আর আপনি কালো কে বলেছে! আপনি হচ্ছেন সুরমা কালো। আমার ভালোবাসার রং।
সমাপ্তি।।
ঝিনুক চৌধুরী।।