‘ধূম্রজাল’
চতুর্বিংশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর
__________
মধ্য রাত। পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে, তবু আলো শোভা পাচ্ছে না ঘন মেঘের আচ্ছাদনে। মাঝে মাঝে মেঘের ভেলার আড়াল থেকে শুভ্রতা ভেসে আসছে। সেই শুভ্র আলোয় বাহারকে দেখছে সাদি। বাহারের ভেজা চুলে তার আঙুলের খেলা, ভরা অনুভূতির দৃষ্টি বাহারের মোহময় মুখ জুড়ে বিচরণ করছে। ভালো লাগছে তার আলো ছায়ার মাঝে প্রিয়তমার মায়াবী মুখখানি দেখতে। বাহার সাদির বুকে মুখ গুঁজে আছে, এক হাত দিয়ে সাদিকে জড়িয়ে রেখেছেন সে। বেলির সৌরভে মধুরতা ছেয়ে আছে আশেপাশে। দুজনেরই কন্ঠ রুদ্ধ হয়ে আছে।
নিস্তব্ধ পরিবেশের সমাপ্তি ঘটালো সাদি। বলে উঠলো সে, ‘কেন আসলেন এই শেষ সময়ে? আমার জীবনের সকাল হয়ে এলেন। এখন যেতে ইচ্ছে করছে না কোথাও।’
বাহারের মৃদু কণ্ঠের উত্তর, ‘যাবেন না। এখানে থেকে যান। একসাথে মরলেও সুখ।’
মুচকি হেসে সাদি বললো, ‘বাস্তবতার কাছে হার মানতেই হয়। যেতে হবে আমাকে সকাল।’
– সকাল?
– আমার সকাল, আমার জীবনের সকাল তুমি।
বাহারের মুচকি হেসে উঠলো। তাহাজ্জুদের সময় হয়েছে। বাহারের মনের বাসনা পূর্ণ হলো আজ। এতদিন শুধু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্বপ্নের গল্প পড়েছে সে। একসাথে তাহাজ্জুদ আদায়, নির্ঝঞ্ঝাট একটা সংসার এসবের গল্প পড়ে তার মনেও সুপ্ত ইচ্ছে বাসা বাঁধতে শুরু করে। তবে সে বাস্তবতায় বিশ্বাসী বলেই ওইসব কল্পগাঁথায় মন বাঁধেনি। আল্লাহ তার ইচ্ছে কবুল করেছেন।
তাহাজ্জুদের সালাত আদায় শেষে দুজন জিকিরে মগ্ন থাকলো। এসময়টায় বাহার ইস্তেগফার বেশি করে। তার জীবনের ভুলগুলোর ক্ষমা লাভ না করেই যদি তার মৃত্যু হয়, এই ভয়ে ইস্তেগফারের কথা স্মরণ হলেই সে ক্ষমা প্রার্থনা করে। এই সময়টায় দুজন কোনো কথা বলছে না। আল্লাহর সান্নিধ্যে এই সময়টা কাটানোর পর ফজরের আযান ভেসে এলো। সাদি মুনাজাত শেষে বাহারের দিকে তাকালো। বাহার তার দিকে তাকালে সে বললো, ‘প্রতিদিন এ সময়টা ভুলবেন না। আমি কাল থেকে আপনার তাহাজ্জুদের সঙ্গী হবো না, আপনার গল্পে আমার সাক্ষাৎ পাবেন না। কিন্তু সময়গুলো ভুলবেন না। কথা দিন?’
বাহার মুচকি হেসে বললো, ‘কথা দিলাম।’
ফজরের সালাত আদায় শেষে বাহার মুসাল্লা ভাঁজ করে বললো, ‘এখন ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে উঠতে হবে আপনাকে।’
সাদি বাহারের হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বললো, ‘ঘুমাতে ইচ্ছে করছে না, কিন্তু ঘুম ধরছে।’
বাহার বিছানায় বসে সাদির হাত ধরে বললো, ‘কোলে মাথা রাখুন। আমি গল্প বলি। তাহলে গল্প করতে করতে ঘুম চলে আসবে ইন শা আল্লাহ।’
সাদি বাহারের কোলে মাথা রাখলো। বাহার তার মাথা নেড়ে গল্প বলছে। সে কীভাবে পরিবর্তন হয়েছে, সাদির সাথে বিয়ে করে তার অনুভূতি কেমন। এসব গল্পে সাদির ছোট ছোট উত্তর এলো। এক পর্যায়ে তার পক্ষ থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। বাহার বুঝতে পারলো সাদি ঘুমিয়ে পড়েছে। সেও হেলান দিয়ে বসে মাথা কাঁত করে ঘুমিয়ে পড়লো।
__________
সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই বাহার আবিদার জন্য রুটি আর সাদির জন্য পরোটা তৈরি করছে। আবিদার ঘুম ভেঙে যাওয়ার পর তিনি রাতে রান্না করা গরুর মাংস গরম করলেন আর ডিম ভাজি করলেন। দুজন মিলে গল্প করতে করতে কাজ করলেন। আবিদা এরই মাঝে সালাত আদায় করার জন্য প্রয়োজনীয় সূরা আর দুআ শুনে নিলেন। যদিও তিনি মনে রাখতে পারবেন না বলেছেন। তাই বাহার সকালের নাস্তা খেয়ে আবিদাকে শেখাবে।
এরই মাঝে সাদির ডাক শোনা গেল, ‘সকাল, কোথায় আপনি? সকাল!’
আবিদা কিছুটা বিস্মিত হয়ে বাহারের দিকে তাকালে বাহার লজ্জা পেলো। আবিদা বুঝে নিলেন সব। তিনি কোনো প্রশ্ন করলেন না। আজ সকাল থেকেই আবিদার মন খারাপ দেখছে বাহার। সে কিছু বলছে না, সে বুঝেছে আবিদার মন খারাপের কারণ। এই প্রথম বাড়ি ছেড়ে এক রাত কাটালেন আবিদা রণজিৎকে ছাড়া। বিষন্ন মনে কাজ করছেন তিনি, মলিন মুখে হাসছেন। তবু বাড়ি ফেরার কথা বলছেন না একবারও। বাহার সাদির কাছে গেল। সাদি মুখ ধুয়ে বেরিয়েছে। বাহারকে দেখে সে বললো, ‘নাস্তা তৈরি হয়ে গিয়েছে?’
– জি।
– ঠিকাছে, আপনি টেবিলে দিয়ে দিন। আমি খেয়ে বেরিয়ে যাবো। কিছু কাজ আছে।
– আপনার সাথে কিছু কথা ছিল।
– বলুন?
বাহার বিছানায় বসে বললো, ‘মায়ের মন খারাপ।’
সাদি চুপ করে আছে। সেও এমন সময় পার করে এসেছে, সে জানে যে সময়টায় একাকীত্ব গ্রাস করে নিজেকে। শয়তান বারবার বোঝাতে চায় মানুষ ভুল করেছে ইসলাম গ্রহণ করে। ইসলামের জন্য মানুষটা বেঁচে থেকেও মৃত। সাদি সেসময় মসজিদের ইমামের সান্নিধ্যে থেকেছে, ইমামকে দেখলেই তার আল্লাহর কথা স্মরণ হয়ে যেত। একটা সময় ইমামকেও প্রয়োজন হয়নি তার। সে নিজেই মনস্থির করে ফেলেছিল যে হাজার কষ্ট হলেও সে ইসলাম ছাড়বে না। কিন্তু আবিদার জন্য এখন সময়টা কঠিন যাবে। যেহেতু তিনি একজন সংসারী মানুষ ছিলেন, এখন বৃদ্ধা বয়সে সংসার ছেড়ে একা চলাফেরা করা তার জন্য কষ্টকর বটে।
সাদি বাহারের হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো, ‘আমি আপনার উপর ভরসা করি। আপনি মায়ের সাথে থাকবেন সবসময়। মা যেন শয়তানের ফাঁদে না পড়েন, শয়তান চাইবে মাকে আবারো পথভ্রষ্ট করতে। আর আমি কাল একটা বিষয় ভেবেছি।’
– কি বিষয়?
– মায়ের বয়স প্রায় ষাটের কাছে। এ বছর মনে হয় সাতান্ন বছর বয়স হয়েছে। এমন বয়সের কোনো লোক পেলে মাকে আবার বিয়ে দিব।
– কিন্তু তিনি রাজি হবেন?
– এখনই রাজি করাতে হবে না। আপনি একদম দূরে রাখবেন না মাকে। মায়ের ডিভোর্সের কাজগুলো পরিচিত কাউকে দিয়ে করাতে পারলে ভালো হতো। এরপর তিনি যে ধর্মান্তরিত হয়েছেন, এটার ডকুমেন্ট লাগবে।
– এসব আমার পরিচিত উকিলের দ্বারা হয়ে যাবে ইন শা আল্লাহ। আর আপনি চিন্তা করবেন না। রণজিৎ ব্যানার্জি কোনো সমস্যা করতে পারবেন না। করলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হবে। আমি ব্যবস্থা করবো। শুধু মায়ের দ্বিতীয় বিয়ের ব্যাপারে আমি চিন্তিত। তিনি রাজি হবেন? আর রাজি হলেও, এমন পাত্র পাওয়া কি সম্ভব?
সাদি মুচকি হেসে বললো, ‘চেষ্টা আর দুআ। দুআ করলে অসম্ভব কিছু সম্ভব হয়ে যেতে পারে আল্লাহর ইচ্ছেতে। আর আমাদেরকেও চেষ্টা করতে হবে।’
_________
বিকেলবেলা বাহারকে নিয়ে সাদি ঘুরতে বের হলো। রিকশায় চড়ে দুজন মৃদু কণ্ঠে গল্প করছে। দুজনকে দেখে মনে হচ্ছে তারা যুগ যুগ ধরে একে অপরকে চেনে। রিকশায় বসে প্রণয়ের আলাপে মগ্ন দুজন। বাহার আওয়াজ বিহীন হাসছে, কেঁপে উঠছে বারবার। সাদিও মুচকি হাসছে। মনে হচ্ছে নতুন জীবন শুরু হলো পুরোপুরি নিষ্পাপ রূপে।
বাহারের ইচ্ছে অনুযায়ী ঝুম বৃষ্টির ঢল নেমেছে। রিকশা ছেড়ে দুজন সেই প্রান্তে হাঁটছে, যেখানে কৃষ্ণচূড়া আর রাঁধাচূড়ার গালিচা। বাহারের পাশে সাদি হাঁটছে, কল্পনা করছে প্রিয়তমার মুখশ্রী। জলধারায় অবগাহন করে মন ভালো করার চেষ্টায় দুজন একবারও নিজেদের বিচ্ছেদ বেদনার গল্প তুলে আনেনি। সাদির বুক ফেটে যাচ্ছে। বারবার তার মনে হচ্ছে বিয়ে করে সে সুখের কষ্ট পাচ্ছে। এই যে আজ কত শত মাইল দূরে চলে যাবে সে, মায়ের আদর ছেড়ে, সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীকে ছেড়ে, একদম যেতে ইচ্ছে করছে না তার। মা মুসলিম হলেন তার চলে যাওয়ার দুদিন আগে। বিয়েটাও হলো এমন সময়ে। সবকিছু অনুভব করার আগেই তার চলে যাওয়ার সময় হলো।
বৃষ্টি ভেজা কপোত কপোতীর ভিজে মন ভরে না। ভেতরে যে বিমর্ষ দুজনেই, অবিরাম রোদনে ভিজছে প্রতিনিয়ত। হঠাৎ করেই দুজনের কেউই কথা বলছে না। ভেজা শেষে রিকশা ঠিক করে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে তারা। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সাদিকে বের হতে হবে। রাত সাড়ে নয়টায় তার ফ্লাইট। তাই বেশ কিছুক্ষণ ঘুরে বেড়ানোর ইচ্ছে থাকলেও উপায় মেলেনি। বাসায় ফিরেও দুজন কোনো কথা বলেনি। বাহার নিকাব খোলার আগেই বাথরুমে ঢুকে পড়েছে। হয়তো তার রক্তিম নয়ন জোড়া আর আবির মাখা মুখখানি দেখাতে চায়নি সে।
সাদির বুকেও ঝড়ো হাওয়া। জামা বদলে মায়ের কাছে গেল সে। আবিদা এমনিতেই স্বামী সংসার ছেড়ে দিশেহারা বোধ করছেন, আল্লাহকে ডাকছেন, তিনি আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আর কোনো আমল জানেন না। বারবার কালিমা পড়ছেন যখনই সংসারের স্মৃতি মনে পড়ছে। রণজিৎ যেন কল করতে না পারে তাই ফোন বন্ধ করে রেখেছেন। বাহার একটা দুআ শিখিয়ে দিয়েছিল, ঈমান ঠিক রাখার দুআ যেটা আমাদের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পড়তেন। ছোট দুআ, কিন্তু তিনি মনে করতে পারছেন না। ভুল হওয়ার আশংকায় পড়ছেন না। সাদি এলে তিনি বললেন, ‘এই শোন না, বাহার আমাকে একটা…’
বলতে পারলেন না তিনি। সাদি জাপটে ধরেছে মাকে। কাঁধে মুখ গুঁজে কেঁপে উঠছে সে বারবার। আবিদা এক হাত ছেলের পিঠে রাখলেন। সাদির কান্নায় উচ্চশব্দ নেই, নেই করুণ সুর। কিন্তু হাহাকার অনুভব করছেন আবিদা, সাদির শ্বাস টেনে কান্না দমনের চেষ্টা আবিদার গাল ভিজিয়ে তুললো। তিনি আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। সাদি রুদ্ধ কণ্ঠে একবার বললো, ‘মা, আমাকে ভুলে গেলেও আল্লাহকে ভুলে যেও না।’
সাদিকে ছেড়ে তার মুখে তাকিয়ে আবিদা বললেন, ‘পাগল! আল্লাহকে চিনেছি, তিঁনি রক্ষা করলে তাঁকে ভুলবো না কখনোই। আর তোকেও না। তুই চলে যাচ্ছিস, গিয়েই আমাদের নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করবি। এখানে থাকবো নারে বাবু।’
সাদি চোখ মুছে বললো, ‘আমি এদিকে সকালকে বলেছি সব সামলে রাখতে। আমার ওর প্রতি অনেক আস্থা আছে। সকাল তোমার যাবতীয় সমস্যাগুলো মিটিয়ে দিবে ইন শা আল্লাহ। আর আমি কাতারে গিয়ে ব্যবস্থা নেব ইন শা আল্লাহ। একটু দেরি হলেও আমি তোমাদের নিয়ে যাবো কাতারে। ততদিন আল্লাহর রহমতে নিজেদের হিফাজত করে চলার চেষ্টা করো মা। রণজিৎ ব্যানার্জি ঝামেলা করতে পারেন। যদিও তার অবস্থা এখন নাজেহাল।’
– আমি তাকে ভয় করি না। আল্লাহ থাকতে আমার কিছুই হবে না। কিন্তু একটা বিষয় মাথায় ঢুকিয়ে রাখ। যা হবে সব সহজেই হবে, এটা ভেবে রাখিস না। এমন যদি হয় যে রণজিৎ এর রোষানলে পড়ে আমরা দুজন বিপদে পড়েছি, তাহলে তুই বিদেশে থেকে নিজের প্রেসার বাড়িয়ে ফেলিস না। আল্লাহকে ডাকবি। ধৈর্য ধরবি।
মুচকি হাসলো সাদি, ‘এত বড় বড় ঘটনা গেল, একবারও আল্লাহর প্রতি অভিমান করিনি। প্রতিনিয়ত আল্লাহর আশ্রয়ে আছি বলেই রক্ষা পেয়েছি। তাঁর অনুগ্রহ ছাড়া কখনোই দ্বীন আঁকড়ে ধৈর্য ধারণ করা সম্ভব হতো না। তুমি চিন্তা করো না মা। আমি তাওয়াক্কুল ধরে রাখবো ইন শা আল্লাহ।’
– তাওয়াক্কুল কি রে?
এরপর সাদি মায়ের সাথে ধর্মীয় আলোচনায় সময় কাটালো। রাসূলের জীবনী সম্পর্কে বললো সে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জন্মের পূর্বেই পিতা হারিয়েছেন, জন্মের পর ছয় বছর বয়সে মাকে হারিয়েছেন। আট বছর বয়সে তাঁর দাদা মৃত্যুবরণ করলেন। আবার প্রিয় চাচা মুশরিক অবস্থায় মারা গিয়েছিলেন। তিঁনি কত কষ্ট সহ্য করেছেন! তাঁর কষ্টের সাথে কোনো কিছুর তুলনা হয় না।
মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। সাদি ইমাম হয়ে সামনে দাঁড়ালো, পেছনে আবিদা আর বাহার। তিন জনের সালাত আদায় শেষে সাদি তৈরি হলো এয়ারপোর্ট যাওয়ার উদ্দেশ্যে। আবিদাকে নিয়ে বাহার এয়ারপোর্ট যেতে চাইছে। কিন্তু তিনি বাসায় থাকতে চাইলেন। সাদির জোরাজোরিতে যেতেই হচ্ছে তাকে। সাদি আজ বাহারের সাথে বোরখার দোকান থেকে কালো রঙের ঢিলেঢালা বোরখা কিনে এনে আবিদাকে পরিয়েছে।
বাহারের গাড়ির ড্রাইভার আছে। তিনজন গাড়ির পেছনে বসে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরলো। সন্ধ্যা শেষে রাত নামছে ধীরে ধীরে।
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)