‘ধূম্রজাল’
ত্রয়োবিংশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর
__________
– আমি পাগল হয়ে যাইনি মা। তোমরা পাগল হয়ে গিয়েছো। তাই আমাকে এমন একটা পরিবারে পাঠাতে চাইছো যেখান থেকে আমি পালিয়ে এসেছি। যেখানে সবাই অভিনয় করে। আমি নিন্দা করে গুনাহের ভার বাড়াতে চাই না। তুমি রাজি থাকো আর না থাকো, আমি নিরুপায় হয়ে সাদিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তোমরা আমার অভিবাবক বলেই জানাতে বাধ্য হলাম। আর বাবা একটু পরেই আসবেন। বাবার উপস্থিতিতে আমি উনাকে বিয়ে করবো।
হানজালা প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, ‘তোর বাবা কীভাবে রাজি হচ্ছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না! আর ওই মহিলা কি বলেছে তোকে যে তার ছেলেকে বিয়ে করার জন্য এতো পাগল হয়ে গিয়েছিস তুই? কি রে বাহার? লজ্জা করে না নিজের বিয়ে নিজে ঠিক করতে?’
বাহার বললো, ‘বিয়ের আগে প্রেম করে বিয়ের কথা বলতে যদি মানুষের লজ্জা না লাগে, আমি হালাল কাজ করতে চাইলে লজ্জা পাবো কেন মা? আর বাবার কথা বলছো? বাবাকে বলেছি উনি কাল বিদেশ চলে যাবেন। এটা শুনেই হঠাৎ রাজি হয়ে গেলেন বাবা। কেন রাজি হয়েছেন বুঝতে বাকি নেই আমার। কিন্তু শোনো মা, আমি বিয়ের পর আর কোনো অন্যায় মেনে নিব না। তোমরা আমাকে দিয়ে অন্যায় কাজ করাতে চাইলে আমি আঘাত সহ্য করবো কিন্তু সেই কাজে হাত দেব না। সারাজীবন ভুল বিষয় চাপিয়ে দিয়েছো। সিয়ামকে তালাক দিয়েছি আমার নিজের জোর থেকে। বিষয়টা ধর্মীয় ছিল বলে এমন সংবেদনশীল ব্যাপারে তোমরা কিছু বলার সাহস পাওনি। এবার আর নয়! আমি তোমাকে ভালোবাসি মা। এজন্যই তোমাকে শ্রদ্ধা করে বলছি, আমাদের জীবনের জন্য দুআ করে দিও। মায়ের দুআ অনেক বড় উপহার।’
এই বলে গুলবাহার কথা শেষ করলো। হানজালাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই সে ফোন রেখে দিলো। আবিদা যখন তার সাথে দেখা করেন, তখন থেকেই তিনি বাহারের সাথে আপনজনের মতো আচরণ করছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি বাহারকে সাদির সাথে বিয়ের বিষয়ে প্রস্তাব দিলে বাহার সাদির মতোই বিস্মিত হয়েছিল। প্রথমে সে পরিবারের কথা তুলে বিয়েতে অসম্মতি জানায়। কিন্তু আবিদা অনুরোধ করে বলেন বিষয়টা ভাবতে। তিনি চান আজই ছেলের সাথে বাহারের দেখা করিয়ে দিতে। বিয়ে হয়ে গেলে তিনি বাহারের সাথে থাকতে পারবেন। বাহার মৌন সম্মতি দেয় সিয়ামের বিষয়টা ভেবে। এই বিয়ে না করে তার সমস্যা থেকে উত্তরণের দ্রুত সমাধান নেই।
তারপর যখন সে জানলো সাদি দেশ ছেড়ে চলে যাবে তখন তাকে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতেই হলো। বিয়েটা করলে বাবা মা জোর করতে পারবে না তাকে ডিভোর্স দিতে। আর সে থাকবে আবিদার সাথে আলাদা বাসায়। দরকার হলে একটা বাচ্চা মেয়েকে সন্তানের মতো লালন করবে। তারপর সাদি ব্যবস্থা করলে দেশ ছেড়ে চলে যাবে সে আর আবিদা।
ভাবতে ভাবতেই আবিদা আর সাদি নেমে এলো। অদ্ভুত এক অনুভূতিতে মিশে গেল বাহার। এই অনুভূতি ভালো লাগার নয়, বরং তার খুব বিরক্ত লাগছে সবকিছু। মনে হচ্ছে দ্রুত সবকিছু মিটে গেলে ভালো হয়। আবার মনে হচ্ছে, সে কোনো ভুল করছে না তো?
সাদি আর আবিদা গাড়ির পেছনে বসলেন। বাহার ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। গাড়ি স্টার্ট দিতেই আবিদা বললেন, ‘তোমার বাবার সাথে কথা হয়েছে?’
– জি আন্টি।
– কি বললেন উনি?
– কাজী অফিসে আসতে বলেছি। বাবা রওনা হয়েছেন।
– আলহামদুলিল্লাহ। সব এতো সহজে ঘটে যাবে ভাবতেই পারিনি।
সাদি চুপ করে আছে। আবিদা বললেন, ‘এখন তোমরা দুজন কথা বলে নাও। যদি কোনো সমস্যা থাকে তাহলে বিষয়টা এখানেই শেষ করবো।’
সাদি কিছু বললো না। বাহার বিব্রত ভঙ্গিতে বললো, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
সাদির ভরাট কণ্ঠের উত্তর, ‘ওয়া আলাইকুমুস সালাম।’
– আপনি তো আমাকে দেখেছেন এর আগে।
– জি।
– দেখার প্রয়োজন নেই তাহলে।
– হুম।
বাহার আর কিছু বললো না। আসলে, সাদি এতো ছোট ছোট উত্তর দিচ্ছে দেখে তার কিছু বলার ইচ্ছে জাগলো না। সাদিই বলে উঠলো এবার, ‘আপনার আপত্তি নেই তো বিয়েতে?’
– জি না। আপনার?
– বিয়ের পর অনেক কিছু ছাড়তে হবে আপনাকে।
– যেমন?
– একান্ত প্রয়োজন ছাড়া গাড়ি চালাবেন না। আর পর্দার ব্যাপারে সর্বোচ্চ কঠোর হবেন যেন আমি আমার আমানত যেভাবে রেখে যাচ্ছি, ফিরে এসে তেমনই দেখি।
বাহার মুচকি হাসলো, শব্দহীন হাসি। সে বললো, ‘ইন শা আল্লাহ।’
– আমি আপনাকে বিশ্বাস করতে চাই।
– আল্লাহর সাহায্যে আপনার বিশ্বাস কখনো ভাঙবো না।
সাদি আর কিছু বললো না। আপাতত তাদের এটুকুই কথা হলো। যাওয়ার পথে বাজার দেখা দিলে সাদি বললো, ‘সাইডে গাড়ি রাখা যাবে? আমি খেজুর নিব।’
কিছুক্ষণ পর সাদি ফিরে এলো কতগুলো খেজুর আর খুরমা নিয়ে। সাথে আছে পানির বোতল। সেগুলো নিয়ে গাড়িতে উঠে সে মায়ের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো, ‘আমার ইচ্ছে ছিল আবার বিয়ে হলে এগুলো মানুষকে খেতে দিব। শুভ কাজে খেজুর খাওয়াবো।’
আবিদা চট করে বললেন, ‘আস্তে বলছিস কেন? লজ্জা পাচ্ছিস? জোরে বললে সমস্যা কি?’
সাদির মুখ লাল হয়ে এলো। সে চাইছে তার হবু স্ত্রীর সামনে মুখ গম্ভীর রাখতে। অথচ প্রায়ই তার মা তাকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিচ্ছে। বাহার অবশ্য কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। এখনো তাদের বিয়ে হয়নি। তাই সে উচ্চস্বরে হাসি আর কথা বলার ব্যাপারে সচেতন থাকতে চাইছে।
কাজী অফিসে পৌঁছে সাদি তার বন্ধুদের ফোন করলো। সাক্ষী হিসেবে বন্ধুরা এলো। সাখাওয়াত এসে পড়েছেন। বাহারের এ সময়টায় ফুপিকে খুব মনে পড়ছে। সে সালমা ফুপির নাম্বারে কল করলে তিনি ধরলেন দ্রুতই।
– আসসালামু আলাইকুম ফুপি।
– ওয়া আলাইকুমুস সালাম। কেমন আছিস মা?
বাহার কেঁদে ফেলেছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে সে বলছে, ‘ফুপি, এখন আমার বিয়ে হবে।’
– কি বলছিস? জোর করে বিয়ে দিচ্ছে তোকে?
– না ফুপি। আমি বিয়ে করছি নিজ ইচ্ছায়। তোমার দুআ নিতে কল করেছি। অনেক দুআ করে দিও ফুপি। তুমি আমার সবথেকে প্রিয় মানুষদের একজন।
সালমাও কাঁদতে কাঁদতে দুআ করে দিলেন। এমন একটা দিনে তিনি নেই, তিনিও কষ্ট পাচ্ছেন খুব। তবু তার অনুপস্থিতিতে যদি ভালো কিছু হয়ে যায়, তবে হোক। তার সাথে কথোপকথন শেষে বাহার কাজির সামনে বসলো। সাদি দাঁড়িয়ে আছে। সবচেয়ে কম খরচে ফাতেমী মোহরে সাদির সাথে বাহারের বিয়ে সম্পন্ন হলো। আবিদা নিজের হাতের বালা আর কানের দুল খুলে বাহারের হাতে দিয়ে বললেন, ‘বাসায় গিয়ে এগুলো পরবে ইন শা আল্লাহ।’
বাবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় বাহার একটুও কাঁদলো না। সাখাওয়াতও কাঁদলেন না। দুজনেই জানে, একদিন বাদে তাদের আবার দেখা হবে। সাখাওয়াত অবশ্য মনে মনে অন্য পরিকল্পনা করছেন। তাই তিনি মেয়ের বিদায়বেলায় অশ্রু ঝড়ালেন না। বাহারও বাবার মনোভাব খুব ভালো করেই বুঝেছে। তাই সে কাঁদছে না, কান্না আসছে না তার। অদ্ভুত এই বিদায়বেলা শেষে বাহার গাড়ি চালিয়ে আবিদাকে নিয়ে সাদির বাসায় গেল। সাদির কাজ থাকায় সে তাদের সাথে গেল না।
বাসায় ফিরে মাগরিবের সালাত আদায় করে রান্নার কাজে লেগে গেল বাহার। সাদির নাম্বার সে নিয়ে নিয়েছে ফোনে। একবার কল করে জেনে নিয়েছে বাসায় তরকারি কি আছে, সে রান্নার অনুমতি পাবে কিনা। সাদি স্বাভাবিকভাবেই উত্তর জানিয়েছে। অনুমতি পেয়ে বাহার রান্না করতে শুরু করলো। আবিদা বললেন ভালো দিনে ভালো খাবার রাঁধতে। তিনিও সাহায্য করলেন। গরুর মাংস ফ্রিজে অল্প ছিল, ওটা রেঁধেছে বাহার। এছাড়াও সে কতগুলো লুচি বানিয়েছে। আবিদা রাঁধলেন সবজির কারি। এগুলো দিয়েই আজ রাতের খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
সাদি ফিরে এলো তার কাজ সেরে। এসেই দুজনকে রান্নায় ব্যস্ত থাকতে দেখে সে নিজের ঘরে গেল। ঘর গোছানো ছিল, তবু সে নতুন চাদর পেরে দিলো। ঘরের ধুলোবালি ঝেড়ে ঘর ঝাড়ু দিলো। সাদি বেশ পরিষ্কার মানুষ। এসব কাজ দেখে বাহার বুঝে গিয়েছে সাদি কেমন পুরুষ। কথা কম, কাজ বেশি তার।
বিয়ের পর থেকে রাতের খাবার খাওয়া পর্যন্ত, পুরোটা সময় সাদির সাথে বাহারের কথোপকথন ছিল সৌজন্যমূলক। যেন দুজনের সম্পর্ক অনেক দূরের, কথা বললে ব্যক্তিত্ব ক্ষুন্ন হবে। সাদি যা বলছে বাহার তার উত্তর দিচ্ছে স্বল্প করে। আবার বাহারের প্রশ্নরও সাদি জবাব দিচ্ছে ছোট ছোট। আবিদা বুঝলেন দুজনের সময় প্রয়োজন। কিন্তু সেই সময়টা তারা পাবে কিনা ভাবলেন তিনি। কাল রাতেই সাদি চলে যাবে। অল্প এই সময়টুকু বাহারের মানিয়ে নেয়ার জন্য কি যথেষ্ট হবে?
__________
হানজালা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন। সাখাওয়াত ভ্রু কুঁচকে চিঁড়ে ভাজা খাচ্ছেন। তার স্ত্রী হিন্দি সিরিয়াল না দেখলেও ওইসব সঙ এর মতো ঢঙ করা শিখেছেন কার কাছ থেকে তিনি বুঝতে পারছেন না। হানজালা কাঁদছেন, বারবার বলছেন, ‘তুমি কীভাবে বিয়ে দিয়ে আমার মেয়েকে অজানা পরিবেশে রেখে আসতে পারলে? কীভাবে পারলে বলো?’
আবারো একই প্রশ্ন করলে সাখাওয়াত খাওয়া ছেড়ে বললেন, ‘তুমি জানো না সাদি ছেলেটা কাল বিদেশ চলে যাবে?’
– হ্যাঁ জানি। কিন্তু এর সাথে মেয়েকে বিয়ে দেয়ার কি সম্পর্ক?
সাখাওয়াত বুঝিয়ে বললেন, ‘শোনো হানজালা, আমি তোমার চেয়ে বেশি জানি। তাই না বুঝে ক্যাটক্যাট করো না। আমার মেয়ে কত জেদি তুমি এটা জানো। সে যেকোনো উপায়ে বিয়েটা করতো। সে সিয়ামকে বিয়ে করবে না বলেই এতো দ্রুত নিজেই নিজের বিয়ে ঠিক করে বিয়েটা করেও ফেললো। আমার মেয়ে পেয়েছে তার দাদির মতো জেদ। মায়ের কথা মনে নেই? হাসপাতালে এক সপ্তাহ থাকতে হবে শুনে তিনি কাউকে না বলে একাই বেরিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতাল ছেড়ে। কত ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল আমাদের। আমার মেয়েও এমন হানজালা। সে একবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিল, তাকে এবারও শান্ত না করলে সে কি করে বসতো আল্লাহই জানেন!’
সাখাওয়াত একটু থামলেন। গলার স্বর স্বাভাবিক করে বললেন, ‘মেয়েটাকে আপাতত নিজের আয়ত্তে আনতেই এগুলো করতে হলো আমাকে। সাদি নাকি দেশ থেকে একবারে চলে যাচ্ছে, ফিরে আসবে না আর। এ কারণেই মেয়ের এই বিয়ে আমি মেনে নিয়েছি। কারণ সাদি চলে গেলে বাহার আমাদের কাছে থাকবে। আমরা দুজন ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সাদির থেকে ডিভোর্স নেয়ার ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো। তখন মেয়েটা একাকী থাকতে থাকতে আমাদের কথা মেনে নিতে বাধ্য হবে। তোমাকে অভিনয় শেখানোর প্রয়োজন নেই, তুমি এমনিতেই অভিনয়ে সেরা। তাই বাহার কাল ফিরে আসুক, আমরা দুজন প্রথমেই তার উপর কিছু চাপিয়ে দেব না। ধীরে ধীরে তাকে বোঝাতে হবে এভাবে জীবন চলে না।’
হানজালা কান্না থামিয়ে চুপ করে বসে আছেন। কিছুক্ষণ পর তিনি আবারও কেঁদে বললেন, ‘তারপরও কেন এটা মেনে নিলে? জেদ দেখাতে চাইলে দেখাবে, তবু তুমি নিয়ে আসলে না কেন আমার মেয়েকে? কয়দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যেত।’
সাখাওয়াত এবার উঠে দাঁড়ালেন। এসব আর ভালো লাগছে না তার। তিনি ঘর ছেড়ে বের হলেন এই বলে, ‘তোমার কান্না দেখে আমার আরো রাগ উঠে যাচ্ছে। সিয়ামের সাথে বিয়েটা না ওঠালে এমন হতো না। এখন আবার আমাকেই দোষ দিয়ে নিজে সাধু সাজছে…’
__________
বারান্দায় দোলনা রাখার ব্যবস্থা নেই। দোলনা রাখলে তোশক পেরে সাজানোর উপায় নেই, আবার হাঁটার জায়গাও কমে যায়। তাই সাদি দোলনা বিক্রি করে দিয়েছে। এই ছোট বাসাটা সে নিজের জন্য নিয়েছিল। এক রুমের বাসা নেয়ার ইচ্ছে থাকলেও সাদির সৌখিন মন তাকে সাধারণের মাঝে অনন্য ধারার এই বাসা নিতে আকৃষ্ট করেছে। তাই যতটা সম্ভব সুন্দর করে সাজিয়েছে সে। এখন সে বারান্দার এক কোণে বিছিয়ে রাখা তোশকের উপর বসে আছে। তোশকটা সাদা চাদরে জড়ানো। একটা লাল ও একটা নীল বালিশের উপর ভর দিয়ে সে আধ শোয়া হয়ে বসে আছে। এমন সময় সে টের পেল তার ঘরে কেউ ঢুকেছে। মনে পড়লো তার, সে এখন আর একা নেই।
বাহার উদাসীন মনে বিছানায় বসে আছে। যে ঘরে আসার ইচ্ছে ছিল না তার। আবিদা বললেন যতটুকু সময় সাদিকে পাওয়া যায় সবটা যেন সে উপভোগ করে। এই বলে তিনি ঘরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিলেন, আর এলেন না। বাহার কিছুক্ষণ বসার ঘরে বসে থেকে সাদির ঘরে এলো। ভেবেছিল সাদিই ডাকবে তাকে। কিন্তু সাদি না ডাকায় তার অস্বস্তি আরো বেড়ে গিয়েছে। এখন যদি সাদি বারান্দা থেকে ঘরে না আসে তাহলে সে ঘুমিয়ে পড়বে। এমনিতেও আজ যা ঘটেছে তা তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
– খামটা নিন।
সাদির কণ্ঠে কেঁপে উঠলো বাহার। চমকে পেছন ফিরে সে দেখলো সাদির হাতে মোটা একটা খাম। বাহার উঠে দাঁড়ালে সে বললো, ‘এখানে আপনার দেনমোহরের টাকা সব আছে।’
অবাক হলো বাহার। এতগুলো টাকা সাদি কোথায় পেলো। প্রশ্নবিদ্ধ মুখে সাদির দিকে তাকালে উত্তর পেলো সে, ‘জমানো অনেক টাকা আছে আমার। কাতার গিয়ে কয়েকমাস চলার মতো টাকা রেখেছিলাম।’
বাহার টাকার খাম হাতে নিয়ে সাদির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো, ‘আমি দেনমোহরের সমস্ত হিসাব এখানেই শেষ করছি। আমি দেনমোহরের টাকা মাফ করে দিলাম। এটা আপনি রাখুন।’
সাদি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। একবার খামের দিকে তাকিয়ে আবারো বাহারের দিকে তাকিয়ে সে বললো, ‘আমি কোনো ঝামেলা চাই না। পড়ে বলবেন মাফ করেননি, এটা আপনিই রাখুন।’ এই বলে সাদি বারান্দায় ফিরে গেল। বাহারের খুব অসহায় মনে হচ্ছে নিজেকে। সাদি তাকে এড়িয়ে চলছে। বাহার বুঝতে পেরেছে তার মতোই সাদিও বিষয়টা স্বাভাবিকভাবে মানতে পারছে না। মানিয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছে।
সাদি আবার ফিরে এসে একটা প্যাকেট দিয়ে বললো, ‘এখানে শাড়ি আছে। মা বললেন আপনার জন্য একটা লাল শাড়ি কিনে আনতে, আর বাড়তি দুটো শাড়ি কিনতে। লাল পছন্দ হয়নি, আকাশরঙা শাড়ি কিনেছি একটা। ওটা পরবেন?’
মুহূর্তেই মন ভালো হয়ে গেল বাহারের। প্যাকেট হাতে নিতেই সাদি ঘরের বাইরে চলে গেল। বাহার স্যালোয়ার কামিজ বদলে আকাশি রঙের শাড়িটা পরে নিলো। শাড়ির ভেতরে হ্যান্ড পেইন্ট করা, সাদা মেঘ আর বৃষ্টির ফোঁটা। একটা লাল রঙের ছাতা আর উপন্যাসের খোলা বইও আঁকা আছে। কাছেই হ্যান্ড পেইন্টিং এর কাজের পোশাক বিক্রি করে এমন শো রুম থেকে শাড়িটা কিনে এনেছে সাদি। সাথে রাখা সাদা রঙের ঘটি হাতার পুরোনো নকশার ব্লাউজটা পরে বাহারকে পুরোনো যুগের নারীদের মতো দেখাচ্ছে। তবে বাহার অবাক হয়েছে আরো একটা জিনিস দেখে। বেলি ফুলের গাজরাটা সে তার খোঁপায় জড়িয়ে নিলো। নিশ্চয়ই সাদি তাকে এভাবেই কল্পনা করেছে। চোখে টানা কাজল দিয়েছে সে, আর কিছুই নেই। না লিপস্টিক, না অন্যান্য প্রসাধনী।
ঘরের বাইরে বাহার উঁকি দিয়ে সাদিকে ডাকলো, ‘কোথায় আপনি?’
সাদি ধীর পায়ে নিজের ঘরে গেল। বাহারকে না দেখেই সে বললো, ‘বারান্দায় আসুন।’
বারান্দার এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সাদি। অন্য কোণে বাহার দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার নিচের অংশে দেয়াল, উপরে ফাঁকা। সাদি দেয়ালের উপরের অংশে দুই হাত রেখে নিচে তাকিয়ে বললো, ‘কেন বিয়ে করলেন?’
বাহার ছোট এক শ্বাস ফেলে বললো, ‘আপনি কেন করলেন?’
– আমার মায়ের কথা চিন্তা করে। মা একা থাকবেন, এটা ভেবে চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ সমাধান দেখিয়ে দিয়েছেন।
বাহার নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইলো। সাদি আবার প্রশ্ন করলো, ‘বিয়েটা কেন করেছেন?’
– নিজের জন্য।
– মানে?
– নিজেকে ভালো রাখার জন্য।
মুচকি হাসলো সাদি, ‘আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল গুলোর একটি কি?’
– আল্লাহ আমাকে মুসলিম পরিবারে জন্ম হওয়ার তৌফিক দান করেছেন। অথচ আমি পথভ্রষ্ট ছিলাম। আশেপাশে এতো নিদর্শন দেখেও তাঁর মহত্ব অনুভব করতে পারিনি। এটাই সবচেয়ে বড় ভুল। আল্লাহ আমাকে এই ভুল থেকে শুধরে যাওয়ার পথ দেখিয়েছেন। যেন এই পথে আজীবন অটুট থাকি।
– আমিন।
কিছুক্ষণ পর সাদি বললো, ‘এছাড়াও আরো একটা বড় ভুল আপনার জীবনে চলে এসেছে।’
– কোনটা?
– আমাকে বিয়ে করা।
– আপনাকে বিয়ে করা যদি আমার বড় ভুল হয়ে থাকে, তবে এই ভুলকে আমি ভালোবাসি।
এর বিনিময়ে সাদির কিছুই বলার নেই। কথা বলতে তার ভালো লাগছে। ধীরে ধীরে বাহারকেও তার ভালো লাগছে। সে বলে উঠলো, ‘সোনার দুল আর বালা খুলে ফেলুন। এই সাজে এ দুটো মানাচ্ছে না।’
বাহার সেগুলো খুলে রেখে বললো, ‘স্বর্ণ সবাইকে মানায় না।’
– হুম, জীবন্ত স্বর্ণের কাছে জড় স্বর্ণ মূল্যহীন।
হেসে উঠলো বাহার, ‘আপনি কবিতা জানেন?’
– জানি। কিন্তু আজ বলতে ইচ্ছে করছে না।
বাহার আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ নিস্তব্দ কাটলো সময়। তারপর সাদি চাদর মোড়ানো তোশকের উপর বসে বললো, ‘এখনে বসুন।’
বাহার সাদির পাশে বসলো। কিন্তু দুজনেই কোনো কথা বললো না। সাদি চোখ বন্ধ করে বললো, ‘বিয়ে করেছেন ঠিক আছে। ভালোবাসবেন না। নাহলে কষ্ট পাবেন শুধু।’
বাহার বলে উঠলো, ‘এই পৃথিবী, এই জীবন শুধুই মায়াবাসার কারণ। ভালোবাসা তো পরকালীন সুখ। আমি সবাইকে মায়াবাসি।’
চোখ খুললো সাদি। বলে উঠলো সে, ‘ইহকালীন একটা বিষয় আছে যা পরকালীন সুখের অন্যতম অংশ। সেটা হলো স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক।’
মুচকি হেসে বাহার বললো, ‘যাক, বুঝেছেন তাহলে।’
বাহারের সব উত্তরে সাদি মুচকি হেসে উঠছে কিন্তু আড়াল করছে দ্রুতই। এবার আড়াল করতে পারলো না সে। সফেদ দাঁতের পাটি বের করে সে তার মায়ায় ভোলানো হাসি হেসে ফেললো। বাহার তার গালের গর্ত দেখে বললো, ‘আজকে এটা দেখতে কোনো বাধা নেই।’
গম্ভীর হয়ে গেল সাদি। বাহার আর কিছু বললো না। রাত বাড়ছে। বৃষ্টির আবির্ভাব প্রকাশ করছে গমগমে গর্জন। শীতল বাতাসে বাহারের এলোমেলো খোঁপা সামলে রাখতে পারছে না সে। সাদি একবারও তার দিকে তাকিয়ে কোনো মাদকতা প্রকাশ করেনি। বাহার মেনে নিয়েছে বিষয়টা। কিন্তু সাদির কথায় সে অবাক হলো। মানুষটা তাকে খেয়াল করছে, বুঝতে দিচ্ছে না।
– খোঁপা খুলে ফেলুন। বারবার হাত দিয়ে ঠিক করার প্রয়োজন নেই।
বাহার খোঁপায় বাধা কাঁটা খুলে চুল মেলে দিলো। বেলির মালা কোলের উপর রেখে দেয়ালে হেলান দিলো সে। হঠাৎ সাদি তার কোল থেকে বেলি ফুলের গাজরা নিয়ে তার হাত ধরে বললো, ‘এটা এখন হাতে পড়লে ভালো লাগবে।’ সে নিজেই বাহারের হাতে পরিয়ে দিলো। বাহার মুচকি হেসে উঠলো। সাদি স্বাভাবিক আচরণ করছে, এখন তাকে দেখে মনেই হচ্ছে না সে বাহারকে মেনে নিতে পারছিল না।
নির্বাক প্রকৃতিতে দুজন মানব মানবীর নিঃশ্বাসের আওয়াজ আর বাতাসের চঞ্চল ধ্বনি মিশে যাচ্ছে গহীন থেকে গহীনে। উপলব্ধি করছে তারা, মানবপ্রেম বলেও অসম্ভব সুন্দর বিষয়ের অস্তিত্ব রয়েছে। মন বেঁধে নেয়া মানবী নির্দ্বিধায় এক মুহূর্তে প্রিয় হয়ে ওঠা মানুষের কাঁধে মাথা রেখে আঙুলে আঙুল ডুবিয়ে বসে আছে। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের বলিষ্ঠ তরুণের কপোল ঠেকেছে মানবীর চুলে। যেই মানবী তার খুব চেনা নয়, কিন্তু খুব কাছের।
বাহার নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে এক জোড়া চোখের দিকে। সাদি তার এক হাত বাহারের চোখের উপর দিয়ে চোখের পাতা বন্ধ করে দিলো। বন্ধ আঁখি জোড়া অনুভব করছে নিঃশ্বাস। সাদির পাঞ্জাবির বোতামে বাহারের চুল আটকে গিয়েছে।
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)