‘ধূম্রজাল’
ঊনবিংশ পর্ব

তাবিনা মাহনূর

__________

– আস্তাগফিরুল্লাহ! নাউযুবিল্লাহ! কি কথা বলছিস মা? আমার মাথা ঘুরে যাচ্ছে…

সালমা ফুপিকে বাহার সিয়ামের মনোভাব বলতেই তিনি চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বাহার তাকে জড়িয়ে ধরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো, ‘ঘাবড়ে যেও না ফুপি। আমাদের বিয়ে সহীহ হয়নি, বলতে গেলে বিয়েই হয়নি। তাই তালাকের ঝামেলা নেই। আমি আজ আমার বান্ধবী রিজিয়াকে ফোন করবো। সিয়ামের সাথে সম্পর্ক রাখবো না।’

– এতো সহজে মেনে নিবে সিয়াম?
– মেনে নিতে বাধ্য সে। যদি আমার পরিবার সাহায্য করে তাহলে এটা সহজ হয়ে যাবে। আর যদি তারাও আমার বিরুদ্ধে থাকে তাহলে আমি অনেক দূরে চলে যাবো। যেখানে আমাকে কেউ খুঁজে পাবে না। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী আমি কোনো ভুল করছি না। সুতরাং আমার কোনো ভয় নেই ফুপি। তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো। এখন আমাকে একটা সমাধান দাও। এ বাসায় থাকলে সিয়াম আমাকে নিতে আসবে। আমি আজ কোথায় গিয়ে থাকবো?

সালমা দিশেহারা বোধ করছেন। জটিল এই পরিস্থিতিতে তিনি কোনো কূল খুঁজে পাচ্ছেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে তিনি বিছানায় হেলান দিয়ে বসে বললেন, ‘আমি কিছুই জানি না। আমার ভালো লাগছে না। আমার মেয়েটার সাথে এ কি হলো আল্লাহ!’

ফুপিকে জড়িয়ে ধরলো বাহার, ‘এমন করে বলো না। আল্লাহ নিশ্চয়ই সর্বোত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি আমার জন্য কল্যাণ রেখেছেন বলেই এটা হয়েছে। আমি ঐ বাড়িতে পর্দা করতে পারতাম না ফুপি। যতটা সহজ ভেবেছিলাম, আদৌ তা সহজ নয়। চাইলেই মডারেট পরিবারকে বদলে দেয় যায় না। পর্দার পরিবেশ পাওয়া যায় না।’

আল্লাহ যা রেখেছেন, তা নিশ্চয়ই কল্যাণের। এ কথা ভেবেই সালমা শান্ত হলেন। তিনি সোজা হয়ে বসে বললেন, ‘এক কাজ কর তুই। আমার খালাতো বোনের বাসায় গিয়ে থাক।’

– তোমার খালাতো বোন মানে বাবারও বোন। তাহলে বাবা তো জেনেই যাবে আমি কোথায় যাচ্ছি।
– ঠিকাছে, তাহলে আমার ছোট বেলার বান্ধবীর কাছে যা? সে আবার নরসিংদী থাকে। ওর বাড়িও খুব পাকা নয়। তুই থাকতে পারবি?
– অবশ্যই পারবো। আমার এখন একটা থাকার জায়গা হলেই হবে।
– যখন নরসিংদী সদরে থাকতাম তখন রাবেয়া আর আমি একসাথে স্কুলে যাতায়াত করতাম। রাবেয়ার পাঁচ সন্তান, অর্থের অভাবে কেউই খুব শিক্ষিত হতে পারেনি। কিন্তু সচ্ছল পরিবার। তুই গেলে তোকে খুব আদর করবে দেখিস। আর পর্দার ব্যবস্থা আছে ভালো। আল্লাহ আমাকে ওর উসিলায় হিদায়াহ দিয়েছিলেন। এতো অল্প টাকার মধ্যেও রাবেয়া আর ওর স্বামী হজ করে এসেছে।

বাহারের বুক থেকে অনেকখানি ভার নেমে এলো। আজই সে গুলশান আড়ং এ কাজটা সেরে এয়ারপোর্ট রেলস্টেশনে চলে যাবে। ‘এগারো সিন্ধুর গোধূলি’ ট্রেন ছয়টা চল্লিশে ছাড়বে কমলাপুর থেকে। নরসিংদী পৌঁছাতে দেরি হবে না। রাবেয়া আন্টির নাম্বার নিয়ে সে অনলাইনে টিকিট বুকিং দিয়ে রাখলো। এরই মাঝে হানজালা আর নাজ এলো সালাদ আর লেমন মিন্ট জুস হাতে।

– এসেই ফুপির কোলে চড়ে আছিস, মায়ের কথা মনে পড়েনি ওখানে?

মায়ের কাছে এক লাফে পৌঁছে বাহার জড়িয়ে ধরলো হানজালাকে। নাজও পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘অনেক মিস করেছি তোমাকে। তুমি আজকে থেকে যাও এখানে।’

বাহার আর হানজালা হেসে ফেললেন। সাখাওয়াত গিয়েছেন বাজারে। দুপুরের খাবার এখানেই খাবে বাহার, সিয়ামকে ফোন করে বিকেল চারটায় আসতে বলেছে সে। কারণ তার আগেই সে এই বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। যদি মা বাবার অভিব্যক্তি অনুকূলে হয় তবে সে ফিরে আসবে। আর যদি প্রতিকূল হয় তাহলে ডিভোর্স পেপার হাতে না আসা পর্যন্ত সে কাউকে নিজের খোঁজ দিবে না। সিয়াম যেমন বেপরোয়া ছেলে তাতে বাহারের পালিয়ে বেড়ানো ছাড়া উপায় নেই।

চার জন মিলে বেশ আড্ডা জমিয়ে তুলেছে। কথার এক ফাঁকে নীরবতা দেখা দিলে বাহার প্রসঙ্গ টেনে আনলো, ‘মা জানো? সিয়াম নাস্তি-ক।’

চমকে উঠলেন হানজালা, ‘কি বলছিস এসব!’

– হুম, কালকে রাতে ও আমাকে বলেছে ও ধর্ম বিশ্বাস করে না। কোনো ধর্মই না।

হানজালা চিন্তিত মুখে বললেন, ‘ওর মা বাবা হজ করে এসেছেন, আবার ওদের উমরা হজের ছবি দেখেছি আমি।’

– মা, ওরা এগুলো কালচার মনে করে। সিয়াম উমরা করেছে যেমন, তেমনই ভুটান বৌদ্ধ মন্দিরে গিয়েছে। পাকিস্তানের এক মাজারে একটা পুকুরে সবাই কয়েন ফেলে, সেও ফেলে এসেছে ভাগ্য পরিবর্তন হওয়ার নাম করে। যদিও এসবে সে বিশ্বাস করে না কিন্তু এগুলো তার কাছে নতুন কিছুর অভিজ্ঞতা বলে মনে হয়।
– তোকে নামাজ পড়তে দেয়?
– হ্যাঁ, এটা সে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা মনে করে।

হানজালা চিন্তা থেকে বেরিয়ে এলেন, ‘তাহলে সমস্যা কি? তুই নামাজি বানিয়ে নিস, তাহলেই হবে।’

সালমা আর বাহার দুজনেই হতবাক। হানজালা কি জানেন না এই বিয়ে যে হয়নি? বাহার বললো, ‘মা, আমাদের বিয়েটা কিন্তু শুদ্ধ হয়নি। ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী বিয়েটা হয়নি।’

হানজালা ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘যাহ! কবুল বলে বিয়ে হয়েছে তোদের। বিয়ে শুদ্ধ হবে না কেন?’

– মা, তুমি যদি সিয়ামের হাতে সিঁদুরের কৌটা দিয়ে বলো আমার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে বিয়ে করতে, তাহলে সে সেটাই করবে। কারণ তার ধারণা এই কবুলের নিয়ম বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠী পালন করে তাই সেও করছে। এতে তার কোনো সমস্যা নেই, কারণ এটা ট্রেডিশন!
– আস্তাগফিরুল্লাহ! সিঁদুর দিতে যাবে কেন?
– কারণ এটাও একটা ট্রেডিশন তার কাছে। বিদেশ গেলে সে হয়তো বলতো, ‘আই ডু, আই ডু!’ খ্রিস্টান রীতি অনুযায়ী। বৌদ্ধদের রীতি আমার জানা নেই, নাহলে সে সেটাও করতে পারতো। মোট কথা, তার মাঝে ধর্মীয় বিশ্বাসটাই নেই। তাহলে কীভাবে বিয়ে শুদ্ধ হয়?

হানজালা বললেন, ‘তাহলে কি আবার বিয়ে করবি তোরা? ওকে মুসলিম বানিয়ে আবার কবুল পড়ে বিয়ে করে নে।’

বাহার হতাশ হয়ে যাচ্ছে। ধৈর্য ধরে সে বললো, ‘মা, এতো সহজে সিয়ামকে বিশ্বাস করানো যাবে বলো? আমি গিয়ে যদি বলি তুমি ইসলামী বিশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন করো, তাহলে দুটোর মধ্যে যেকোনো একটা প্রতিক্রিয়া পেতে পারি। প্রথমত, সে হয়তো নিজেই আমাকে তালাক দিয়ে দিবে। কারণ তার স্বাধীনতায় আমি হস্তক্ষেপ করছি। দ্বিতীয়ত, সে তালাক দিতে না চাইলে মুসলিম হওয়ার অভিনয় করবে, অর্থাৎ মুনাফিক হবে। কারণ সে আমাকে ভালোবাসে বলেই জানি।’

হানজালা সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তুই কি বলতে চাইছিস?’

– আমি ভাবছি সিয়ামকে তালাক দিয়ে দিব।

হানজালা আঁতকে উঠলেন, ‘ইন্না লিল্লাহ! তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে? বিয়ের একদিন মাত্র হলো, আর তুই ডিভোর্সের কথা চিন্তা করছিস?’

এই আলাপে একমাত্র নাজই অবুঝের মতো বসে আছে। সালমা চুপ করে থাকলেও তিনি এর মাঝে ঢুকবেন না। কিন্তু তিনি যেই ভয়ে কথা বলতে চাইছিলেন না, সেই কাজটাই হলো। হানজালা বাহারকে কিছু বলতে না দিয়ে সালমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনিই কি ডিভোর্সের কথা বলেছেন বাহারকে?’

সালমা বিস্মিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছেন। বাহার দ্রুত বলে উঠলো, ‘মা, এভাবে বলছো কেন ফুপিকে? ফুপি আমাকে কিছুই বলেনি। আমি নিজে থেকেই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি।’

– কিন্তু তোর ধর্মীয় জ্ঞান কবে থেকে এলো? যেখানে আমিই জানতাম না তোদের বিয়ে শুদ্ধ হয়নি সেখানে তুই কীভাবে জানলি যদি তোর ফুপি না জানায়?
– এটা কমনসেন্স মা। একটা বৌদ্ধ ছেলেকে বিয়ে করে আনলে তোমরাই বলতে, দূর হ তুই এখান থেকে। আর নাস্তি-ক ছেলের সাথে কীভাবে জায়েজ হয় বলো?

হানজালা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমি কিছুই জানি না। তুই সিয়ামকে বদলানোর চেষ্টা করবি। ও তোকে অনেক ভালোবাসে, তোর জন্য ছেলেটা পরিবর্তন হতেও রাজি আছে।’

মৃদু আর্তনাদ করে বলে উঠলো বাহার, ‘কিন্তু মা, যতদিন না ও পরিবর্তন হবে ততদিন ও আমার জন্য হারাম হয়েই থাকবে। তখন আমি কীভাবে ওর থেকে দূরে থাকবো?’

হানজালা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। যেতে যেতে তিনি বললেন, ‘আমি আর একটা কথাও শুনবো না। সিয়াম এলে বলবো তোকে নিয়ে যেতে। বৌভাতেও এই বাসায় আসার দরকার নেই।’

হানজালা চলে গেলেন। বাহারের চোখ ভরে উঠছে। কাঁদলে তার দুর্বলতা প্রকাশ পেয়ে যাবে বলে সে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছলো। নাজ তাকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘তোমার যা ইচ্ছে করে তাই করো আপু। জোর করে সংসার হয় না।’

বাহার মুচকি হেসে নাজের গালে হাত রেখে বললো, ‘ভালো কথা বলেছিস। এখন একটু যা তো বোন, আমি ফুপির সাথে কথা বলবো। আমিই আসবো তোর ঘরে।’

__________

দুপুরের খাওয়া শেষে বিশ্রাম নিলো বাহার। আজ বেশ পরিশ্রম করতে হবে তাকে। গাড়িও থাকবে না, এখান থেকে তাকে আড়ং যেতে হবে। বি-প্যালেস গুলশানে হওয়ায় গুলশান আড়ং যেতে রাধিকার কোনো অজুহাত দিতে হবে না। তবে সাদির জন্য কষ্ট হয়ে যাবে। সে থাকে আজিমপুর এলাকায়।

দুপুর সাড়ে তিনটা বাজছে। বাহার একটা ব্যাগে প্রয়োজনীয় জামা কাপড়, জমানো টাকা আর কিছু গয়না নিয়ে নিলো। যেন বিপদে পড়লে গয়না বেচে খেতে পারে। আর কাঁধের ব্যাগে একটা বোরখা ঢুকিয়ে নিলো। এখান থেকে বের হয়েই সে বোরখা নিকাব পরবে। ফুপির বোরখাটা লম্বায় একটু ছোট হচ্ছে, কিন্তু আপাতত এটাই তার সম্বল। বাইরে গিয়ে কেনার মতো পরিস্থিতি নেই। রাবেয়া আন্টির বাসায় পৌঁছে অনলাইনে বোরখা কিনে নিলেই হবে। অথবা সদরে গিয়ে মার্কেট থেকে বোরখা কেনা যাবে। এখন এটাই তার জন্য অন্ধের যষ্ঠি।

হানজালা আর সাখাওয়াত দরজা ভিড়িয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলাপে মগ্ন আছেন। বাহার জানে এই আলোচনা কি নিয়ে চলছে। তার ডিভোর্সের সিদ্ধান্তের কথা হয়তো ইতিমধ্যে বাবার কানেও পৌঁছে গিয়েছে। বাবার অভিব্যক্তি জানা হলো না বাহারের। সময় নেই। জলদি বেরিয়ে পরতে হবে। তা নাহলে সিয়াম এসে গেলে সব শেষ!

ফুপির অশ্রু মাখা গালে হাত বুলিয়ে সে বিদায় নিলো। সালমা বাহারের কপালে চুমু খেয়ে বললেন, ‘সাবধানে যা মা। কোনো সমস্যা হলে ফোন দিবি। কখনো একা ট্রেন ভ্রমণ করিসনি। আজ যাচ্ছিস, খুব ভয় হচ্ছে আমার।’

বাহার আশ্বাস দিয়ে বলেছে, ‘ভয় পেও না। আল্লাহ আছেন, তিঁনিই আমাকে হিফাজত করবেন। তুমি দুআ করতে থাকো। আর আমি বিশ্বাস করি, ভরসা করি তোমাকে যে আমার ঠিকানা তুমি কাউকে বলবে না ফুপি।’

বাহার বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিলো। এখান থেকে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত গিয়ে আবার বাসে উঠবে সে। বাসে উঠে বমি এলেও তার কিছু করার নেই। এভাবেই আজকের দিনটা তাকে পার করতে হবে।

কষ্ট শেষে আড়ং পৌঁছে গেল বাহার। তার বোরখার কারণে তাকে অনেকেই কেমন বাঁকা চোখে দেখছে। বাহারের কেন যেন ভালো লাগছে। মন বলছে, এটাই তো চেয়েছিলাম!
আড়ং এ প্রবেশ করে বাহার জামা কাপড় দেখার ভান করে হাঁটতে থাকলো। রাধিকা ব্যানার্জিকে সে চেনে না। টিভি দেখা হয় না, নিউজপেপার পড়া হলেও কখনো তার ছবি দেখেনি বাহার। তাই রাধিকাকে না পেয়ে সাদিকে খুঁজতে শুরু করলো সে। রাধিকা নিশ্চয়ই এখনো আসেননি। নাহলে তিনিই ফোন করতেন।

জিনিসপত্র দেখতে দেখতে হঠাৎ বাহারের মনে হলো, যেই বাড়িতে সে যাচ্ছে সেখানে কোনো উপহার নেয়া উচিত। রাবেয়া আন্টির ছোট মেয়েটার একটা ছেলে হয়েছে এক সপ্তাহ হলো। সেই ছেলেটার জন্য তিনটা নিমা জাতীয় আরামের পোশাক কিনলো বাহার। রাবেয়া আন্টির জন্য থ্রি পিসের কাপড় আর দুই ভাবীর জন্য দুটো আয়না। আরো কিছু কেনার ইচ্ছে থাকলেও টাকার স্বল্পতা চলে আসবে বলে কেনা হলো না।

পছন্দের জিনিসগুলো নিয়ে সে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়ালো। তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা বেশ লম্বা, মাথায় বেসবল ক্যাপ। মুখে কালো মাস্ক আর পরনে জিন্সের জ্যাকেট। আড়ং এর ভেতরে খুব শীত নেই, তবু লোকটা নিজেকে এমনভাবে আবৃত করে রেখেছে যেন সে মানালিতে আছে। বাহার এই লোকটার জন্য সামনের কিছু দেখতে পাচ্ছে না। বিপত্তি বাঁধালেন পেছনের মহিলা। তিনি এসেই এমনভাবে ধাক্কা দিলেন যে বাহার হুড়মুড় করে লোকটার উপর পড়ে গেল। জ্যাকেট খামচে না ধরলে মান সম্মান চলে যেত।

মূলত মহিলার দোষ নেই। তার পিছে থাকা লোক, এরও পিছে আরেকজন লোক অনেকক্ষণ ধরে সামনে আগানোর কল্পিত চেষ্টায় বারবার ঠেলছেন। ভুঁড়িতে-পিঠে ঘর্ষণে এমন ধাক্কাধাক্কির উৎপাত। লাইনে দাঁড়ালে এরকম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হতেই হয়। কিন্তু সকালে থেকেই বাহারের মেজাজ গরম থাকায় এবার সে রেগে গেল। কর্কশ স্বরে ক্যাশ কাউন্টারে থাকা লোকটাকে সে বললো, ‘মেয়েদের আলাদা লাইন কেন নেই? এভাবে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা যায়?’

এতেই কিছু ছেলে যেন প্রশ্রয় পেয়ে বসলো, ‘কি হয়েছে আপু? কেউ অ্যাবিউজ করেনি তো? বলেন আপু, ভয় পাবেন না। প্রতিবাদ করবেন।’ আরেকজনের কথা, ‘মেয়েদের আলাদা লাইন রাখতে হবে কেন। এত সমান অধিকারের যুগ। ছেলেরা বিরক্ত করলে মেইন পয়েন্টে কষিয়ে লাথি দিবেন।’
বাহারের মুখ লাল হয়ে এসেছে। আরো বিপদ হলো যখন একটা ছেলে এগিয়ে এসে বললো, ‘আপনার পেছনে তো মহিলা দাঁড়িয়ে। সামনে পুরুষ। ইনি কিছু করলে বলুন আপু। আমরা হ্যান্ডেল করবো ব্যাপারটা।’

বাহার বলে উঠলো, ‘আরে না না, উনি কিছুই করেননি।’

ছেলেটা নাছোড়বান্দা, ‘না আপু, আপনি বলেন। ভয় পাবেন না।’

সামনে দাঁড়ানো লোকটা পেছন ফিরলো। বাহার ভ্রু কুঁচকে ছেলেটাকে বললো, ‘দরকার নেই। উনি কিছুই করেননি।’ এই বলে সামনে ফিরতেই থমকে গেল সে। সাদি হাসরাত ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন মনে মনে অনেক অভিশাপ দিচ্ছে লোকটা। বাহার বলে উঠলো, ‘উনি আমার চেনা মানুষ। আপনাদের কিছু করতে হবে না।’

সাদি এক পলক তাকিয়ে আবার সামনে ফিরে গেল। তার খুব অস্বস্তি হচ্ছে এই চিপা অবস্থায় দাঁড়িয়ে থাকতে। সামনেও দাঁড়ানো এক নারী। নারী না পুরুষ বোঝার উপায় নেই। কারণ সাদিকে দেখার পর থেকে মেয়েটা বারবার কিছু ছ্যাঁচড়া পুরুষদের মতো পেছনে ফিরে তাকাচ্ছে। মেয়েটার চুলগুলো বাবরি কাট দেয়া। সাদি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। বেরিয়ে চলে যেতে নিলে বাহার বললো, ‘শুনুন, আমার হাতে দিন জিনিসগুলো। আমি ক্যাশের ঝামেলা মিটিয়ে দিচ্ছি।’

সাদি বুঝতে পারছে না মেয়েটা কে। তাকে বিস্মিত করে বাহার বললো, ‘ভয় পাবেন না। আমি গুলবাহার।’

সাদি তবু তাকে কিছুই না দিয়ে চলে গেল। বাহার অবশ্য হতাশ হলো না। সাদিকে সে চেনে। সাদি অল্প কথায় মানুষ, মেয়ে দেখলে এলার্জি রোগীর মতো লুকিয়ে পরে। বাহার তাই তার আচরণে মন খারাপ করে না। বরং তার এখন আফসোস হচ্ছে, সিয়াম যদি এমন হতো!

ক্যাশের ঝামেলা মিটিয়ে বাহার দেখলো সাদি লাইনের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে। এবার তার সামনে পেছনে পুরুষ দাঁড়ানো। বাহার অবাক হলো না। সাদি তো এমনই। তবে বাহারের চিন্তা অন্যখানে। রাধিকা আন্টি এখনো ফোন করেননি। রণজিৎ এর কাছে ধরা পড়ে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। সাদি ভাববে তাকে বাহার প্যাঁচে ফেলেছে, আবেগের স্থানে আঘাত করে তাকে এখানে ডেকেছে কোনো উদ্দেশ্যে। বাহারের চিন্তা কমিয়ে ফোন বেজে উঠলো। আবারো অচেনা নম্বর। বাহার ফোন ধরলে ওপাশ থেকে রাধিকা বললেন, ‘হ্যালো!’

– জি আন্টি, আমি বাহার।
– আমি আড়ং পৌঁছে গিয়েছি। এটা আমার ড্রাইভারের নাম্বার। তুমি কিন্তু ফোন করো না একবারও।
– জি আন্টি। তবে আপনি কেমন জামা পরে আছেন সেটা বললে ভালো হতো। আপনাকে কখনো দেখিনি তো তাই দেখলে চিনতে পারবো না।
– আমি ধূসর রঙের শাড়ি পরে আছি। আর একটা লাল রঙের সাল জড়িয়ে আছি যেটায় নকশি কাঁথার মতো নকশা আছে। ওটা দেখলেই বোঝা যাবে। আর আমি মাঝারি আকারের মানুষ।
– ঠিকাছে আন্টি, আমি কালো বোরখা পরেছি। বোরখাটা একটু ছোট।

কথা শেষ করে বাহার দরজার কাছে গেল। আড়ং এর দুই দিকে দুটো দরজা। একটি পার্কিং লট থেকে সোজা আড়ং এ ঢোকার জন্য, অন্যটি রাস্তা থেকে আড়ং প্রাঙ্গনে ঢুকে যারা, তাদের জন্য। বাহার ধারণা করলো রাধিকা নিশ্চয়ই পার্কিং লট থেকে আসবেন। তার ধারণা সঠিক হলো না। এই দরজাটা আজ বন্ধ। এর বাইরে কিছু কাজ চলছে। পুরোনো ওয়ালম্যাট বদলে নতুন লাগানো হচ্ছে। রাধিকা তাই ঘুরে এসে প্রথম দরজা দিয়ে ঢুকলেন।

বাহার যখন দেখলো দ্বিতীয় দরজাটা বন্ধ, সে প্রথম দরজার দিকে নজর রেখে সেদিকে হাঁটতে শুরু করলো। দুটো দরজা বিপরীত প্রান্তে হওয়ায় বেশ লম্বা দূরত্ব।

বাহার হাঁটছে। রাধিকা ঢুকলেন আড়ং এ। সানগ্লাস খুলে তিনি স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটতে শুরু করলেন। বাহার দেখেই চিনে ফেলেছে। অভিজাত সাজে রাধিকা তাগা ব্র্যান্ডের জামা কাপড়ের দিকে যাচ্ছেন, বাহার গতি বাড়ালো। হঠাৎ দৌড়ে এসে কেউ রাধিকাকে জড়িয়ে ধরলো। রাধিকা পরেই যাচ্ছিলেন। তিনি চোখ বন্ধ করে ফেললেন, তার নাক ফুলে উঠছে। এক্ষুনি অশ্রু ঝড়বে। বাহার দেখলো সেই দৃশ্য। মা সন্তান একে অপরকে জড়িয়ে যেন দীর্ঘদিন পর শ্বাস নিতে পেরেছে। বাহার স্বস্তির শ্বাস ফেললো। এবার তার ফিরে যাওয়ার পালা।

_________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here