‘ধূম্রজাল’
দ্বাদশ পর্ব
তাবিনা মাহনূর
__________
Toha Research Center
[Enlighten the spirit with the light of science]
রিসার্চ সেন্টারে ঢোকার আগে চেকইন করতে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একের পর এক কর্মচারী প্রবেশ করেন। তাদের চেহারা স্ক্যানার দিয়ে পরীক্ষা করে এবং রোবটের মাধ্যমে সকলের সিগনেচার গ্রহণ করে তাদেরকে ভেতরে ঢুকতে দেয়া হয়। এই সময়টায় সাদি সেন্টারের উপরে অভিজাত মার্বেল পাথরের উপর খোদাই করা লেখাগুলো পড়ে। প্রতিবার পড়ে আর ইস্তেগফার করে বলে, ‘কোনোদিন যেন বিজ্ঞানের পূজা না করি আল্লাহ!’ এখনো একই কাজ করলো। তবে আজ আল্লাহর নামে প্রশংসা বাণীও ফিসফিসিয়ে বললো। কতদিন পর সে অফিসে এসেছে, এর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করা যাবে না।
অপেক্ষা করতে করতে তার সময় চলে এলো। প্রতিবারের মতো তাকে স্ক্যান করে ভেতরে যেতে বলা হলো। আর ভেতরে যেতেই সে দেখতে পেলো, সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বেশিরভাগ লোক তাকে দেখেও না দেখার ভান করে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। আর কিছু লোক এগিয়ে এসে কুশল বিনিময় করলো। একজন বললো, ‘আমি জানতাম তুমি নির্দোষ।আমাদের সাদিকে আমরা চিনি।’
এই মানুষগুলোর ভরসা বাক্য শুনে সাদির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি খেলা করলো। অন্তত কিছু মানুষ তাকে ভালোবাসছে, তার সম্পর্কে সুধারণা রাখছে। সাদি তাদের সাথে অল্প আলাপ সেরে নিজের কক্ষে গেল। তার কক্ষের স্লাইড ডোরটার নীচে ময়লা জমে আছে। তার ঠিক বিপরীতে আছে তোহা স্যারের কক্ষ বা কেবিন। তোহা স্যারের কেবিনের পাশের কেবিনটা স্টেরি রোজারিওর। আর সাদির পাশের কেবিনটা ডক্টর তোহার এসিস্টেন্ট তাহমিদের।
এদিকে শুধু স্টেরি আর তাহমিদের কেবিন ও এর আশেপাশের অংশ পরিষ্কার রাখা হয়েছে। তোহা স্যার ও সাদির কেবিন পরিষ্কার করার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। সাদির মন খারাপ হলো স্যারের ঘরটা দেখে। স্যার বেঁচে নেই, তাই বলে তার ঘর ও কাজের যন্ত্রগুলো অপরিষ্কার রেখে দেয়াটা তাকে পীড়া দিচ্ছে। সে হাঁক ছাড়লো, ‘মকবুল ভাই!’
মকবুল এলো না। এমনকি কেউই এলো না তার ডাক শুনে। তাহমিদ স্যার এসে পৌঁছালে অন্তত তাকে ডেকে ঘরটা পরিষ্কার করানোর ব্যবস্থা করা যেতো। কিন্তু তাহমিদও আসেননি। সাদি মুখে মাস্ক পরে ভেতরে প্রবেশ করলো। ভেতরের ধুলোবালি সে গতকালই মকবুল ভাইকে দিয়ে পরিষ্কার করিয়ে নিয়েছে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রগুলো আজ সে নিজ হাতে সাফ করবে। কারণ এগুলো সাধারণ কারো হাত দ্বারা পরিষ্কার করলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সাদি তার পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লেগে পড়লো। এপ্রোনটা দরজার পেছনে ঝুলিয়ে হাতা গুটিয়ে ড্রয়ার থেকে মোছার কাপড় বের করলো। মকবুলের অপেক্ষায় বসে থাকলে চলবে না।
তার পরিষ্কারের মাঝেই তাহমিদ এসে উপস্থিত। ইতিমধ্যে দুটো প্রয়োজনীয় যন্ত্র আল্ট্রাসাউন্ড মেশিনের মাধ্যমে পরিষ্কার করা হয়ে গিয়েছে। আরো কিছু যন্ত্র শুরু করার আগেই তাহমিদ এসে বললেন, ‘কেমন আছো সাদি?’
সাদি বেসিনে হাত ধুয়ে মাস্ক খুলে হাসিমুখে বললো, ‘আলহামদুলিল্লাহ! অনেক ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?’
তাহমিদ বুঝতে পারলেন না সাদির অনেক ভালো থাকার কারণ কি। তবে তিনি মনে মনে সাদির জন্য করুণা করলেন। কারণ বাইরে রণজিৎ আর স্টেরি অপেক্ষায় আছে। তাদের কথোপকথন শুনলে সাদির ‘অনেক ভালো’ নিমিষেই ‘অনেক খারাপ’ এ পরিণত হবে। তিনি চশমা ঠিক করে বললেন, ‘আমিও ভালো আছি। এখন স্টেরি ম্যামের কক্ষে চলো সাদি। উনি তোমার সাথে দেখা করবেন।’
সাদি যেন আগে থেকেই জানতো সব। সে হাত মুছে এপ্রোন গায়ে দিয়ে বললো, ‘চলুন।’
সাদি যখন ভেতরে ঢুকলো, তখন তার চেয়ে বেশি তাহমিদ অবাক হলেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন সাদির মুখ পানসে হয়ে যাবে। কিন্তু সাদি হাসিমুখে ভেতরে ঢুকে বলে উঠলো, ‘তাহমিদ স্যারের এইজন্যই দেরি হয়েছে আজ। বুঝতে পেরেছিলাম অবশ্য।’
এএসপি নাকিব আর সিআইডি সাগর সাধারণ পোশাকে এসেছেন যেন মানুষ তাদের আসল পরিচয় না জানতে পারে। এই সেন্টারে শুধু তাহমিদ আর সাদিই জানে এরা কারা। সাদি মোটেও অবাক হয়নি। সে মুচকি হেসে আবার বললো, ‘সব কথা দ্রুত সেরে ফেলি।’
রণজিৎ আর স্টেরি কোনো কথাই বললেন না। শুরু করলেন এএসপি নাকিব, ‘সাদি, যেহেতু তুমি আগেই অনুমান করেছিলে আমরা আসবো, তাই তুমি নিশ্চয়ই জানো আমরা কেন এসেছি?’
সাদি তার হাসিমুখটা গম্ভীর করে ফেললো। তার জ্বলজ্বলে চোখে অনুভূতির আলো ঝরছে। সামনে বসে থাকা বি-অ্যারোমা কোম্পানির মালিক রণজিৎ তার জন্মদাতা। অথচ পিতা হয়েও সন্তানের কাছে ফায়দা হাসিলের উদ্দেশ্যে এসেছেন, সন্তানকে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়ে। সাদি তার বাবার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে থেকে বললো, ‘জানি।’
স্টেরি বললেন, ‘স্যাডি, আই থিংক উই শ্যুড ফিনিশ দিস টপিক। তোমার কিছু বলার না থাকলে ফাইলগুলো দিয়ে দাও।’
সাদি রণজিৎ এর কন্ঠ শোনার অপেক্ষায়। রণজিৎ ঠিক সাদির মতোই পুত্রের চোখের দিকে তাকিয়ে। তাদের নীরব কথোপকথন তাহমিদের দৃষ্টিতে ধরা পড়েছে। তিনি বলে উঠলেন, ‘রণ স্যার, আপনি যা বলতে চেয়েছিলেন…’
তাহমিদকে থামিয়ে রণজিৎ প্রথমবার কথা বলতে শুরু করলেন, ‘আমার কথাগুলো স্টেরি বলে দিয়েছেন। আমরা পেপার্স হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।’
সাদি এবার বললো, ‘পেপার্স আমার কাছে আছে। তবে আমার একটা শর্ত আছে।’
নাকিব কর্কশ সুরে বলে উঠলো, ‘জামিন পেয়েও তোমার শর্ত পূরণ হয়নি? আবার কিসের শর্ত?’
নাকিবের দিকে তাকিয়ে সাদি বলে উঠলো, ‘রণজিৎ ব্যানার্জি আমার নামে পেপার্স সরানোর অভিযোগ তুলে মামলা করেছেন। সেই মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। এবং স্টেরি রোজারিও ডক্টর তোহা খু-নের দায়ে আমার নামে মামলা করেছেন। সেটাও তুলে নিতে হবে। অর্থাৎ আমাকে যেকোনো প্রকার ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখলে তবেই আমি ক্লোন পেপারগুলো দিব। আর সেই অনুযায়ী কাজও করবো।’
এএসপি নাকিব সাদির শার্টের কলার ধরে দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো, ‘খুব চালাকি শিখেছিস না? তোকে আবার জেলে ঢোকাবো।’
রণজিৎ উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘ওর সাথে আমাদের আর কোনো কথা নেই। নাকিব, তুমি পুলিশকে ডাকো। আমরা কোনো মামলা প্রত্যাহার করবো না।’
সাদি চুপ করে বসে আছে। স্টেরি ছটফট করছেন। তিনিও রাগান্বিত স্বরে বললেন, ‘তুমি কি আমাদের বোকা পেয়েছো স্যাডি? তোমার মতলব কি?’
– আমার মতলব এটাই যে আমি নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চাই। কাগজে লেখা অনুযায়ী আপনাদের জন্য আমি মেলান স্প্রে তৈরি করবে। এরপর যদি দেখি আমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাহলে আমার কি লাভ হলো?
– তোমাকে ফাঁসিয়ে দেয়া হবে কেন?
– হিমের কারণে। মানুষ জানে আমি খু-নি। মানুষ কি তোহা স্যারের খু-নিকে ছেড়ে দিবে? যদি কোনোভাবে প্রমাণ করা যায় যে আমি দোষী নই এবং কে আসল অপরাধী তা ধরা পড়ছে না তাহলেই আমি নিরাপদ। কারণ তোহা স্যারের মৃত্যুতে যেই অপরাধী জড়িত, তাকে দেশের জনগণ ছাড়বে না। আর হিমকে বাঁচাতে আমাকে ফাঁসানো কোনো কঠিন বিষয় নয়।
সাদির কথাগুলো ঠিক। এখন পুরো দেশবাসী জানে সাদিই আসল খু-নি। যদি মামলা তুলে না নেয়া হয় তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে ও দেশের জনগণের পক্ষ থেকে সে রোষানলে পড়ে যাবে। আর মামলা তুলে নিলে সে বিদেশে চলে যেতে পারবে। তখন মানুষের কটূক্তি কিংবা ন্যায় বিচারের দাবিতে তার কোনো সমস্যা হবে না। জেল হাজতে থাকা ব্যক্তিকে বিদেশ যাওয়ার অনুমতি দেয়া হয় না। সাদির পাসপোর্ট আর ভোটার আইডি কার্ড এখনো জব্দ করে রাখা। তাই মামলা তুলে নেয়া অত্যন্ত জরুরি।
সবকিছু শুনেও রণজিৎ নিজের কথায় অনড় থাকলেন, ‘আমি কোনোভাবেই মামলা তুলে নিব না। নাকিব, তুমি তোমার কাজ করো।’
সাগর বললেন, ‘এতো সাহস দেখে অবাক হচ্ছি। এবার জেলে গেলে যে বেঁচে ফিরতে পারবে না এটা জানো তুমি?’
সবাইকে থমকে দিয়ে স্টেরি বললেন, ‘ওর কথা মেনে নেয়া হোক।’
রণজিৎ ভ্রু কুঁচকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনি কোন যুক্তিতে এই কথা বলছেন মিসেস তোহা?’
– বাংলাদেশে আমাদের কাঙ্ক্ষিত ক্লোন বানানোর পর্যাপ্ত পরিবেশ আর মেজার্মেন্টস নেই। তাই স্যাডিকে এমনিতেও বিদেশে যেতে হবে। তাই মামলা প্রত্যাহার করতেই হবে। কিন্তু!
সবাই স্টারির দিকে তাকিয়ে আছে। সাদি অবশ্য মাথা নিচু করে বসে আছে। সে জানে স্টেরি কি বলবেন।
– কিন্তু স্যাডিকে অবশ্যই চুক্তি করতে হবে এই যে, আমাদের কাঙ্ক্ষিত ক্লোন বানানোর প্রস্তুতি বাংলাদেশ থেকেই শুরু করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত মামলা প্রত্যাহার না করা হয় ততদিন সে কাজ চালিয়ে যাবে। যেদিন প্রত্যাহার করা হবে সেদিন স্যাডি অবশ্যই পেপার্স ফিরিয়ে দিবে। তারপর তাকে আমরা বিদেশে পাঠানোর চেষ্টা করবো। আর যদি সে ফিরিয়ে না দেয় তাহলে তাকে সেদিনই মৃত্যু দেখতে হবে।
সকলের সামনে স্টেরি সাদিকে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে রাখলেন যেন সাদি বিষয়টাকে হেলাফেলা না করে। সাদির তাতে কোনো ভ্রূক্ষেপ নেই। সে উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি স্টেরিকে বুদ্ধিমতী ভেবেছি বলেই এই প্রস্তাব রেখেছি। এখন আপনারা এটা মেনে নিবেন কিনা তা নিজেরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিন।’
সাদি আর কোনো কথা না বলে স্টেরির ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের কেবিনে গিয়ে দু চোখ বন্ধ করে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো সে, ‘হে আল খবির! আমার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সর্বজান্তা একমাত্র ইলাহ! আপনি আমার জন্য যা কল্যাণ রেখেছেন তাই করুন। তা আমার জন্য কষ্টসাধ্য হলে তাওয়াক্কুল রাখার তৌফিক দিন। আমি শুধু আপনার নূরের দেখা পেতে চাই, রাসূলের সান্নিধ্যে থাকতে চাই।’
__________
গুলবাহার নিজেকে আয়নায় একবার দেখে নিলো। আজ তার অফিসে শেষ দিন। সে অফিসে যাবে, গিয়ে পদত্যাগ পত্র দিবে, তারপর সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসবে। তবে আজকের দিনটা আরো একটি কারণে বিশেষ। সে আজ ফুপির দেয়া পরীক্ষায় অংশ নিয়েছে। ফুপি যখন বলেছিলেন, তখন তার কাছে এটা কোনো বিষয়ই মনে হয়নি। অথচ এখন যাওয়ার আগ মুহূর্তে মনে হচ্ছে, বিদায় নেয়ার সময় সে কিভাবে নীচে তাকিয়ে থাকবে? এটা কেমন অভদ্রতা দেখাবে না!
এতকিছু ভেবে এখনই মাথায় জট পাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই, এই বলে নিজের মনকে শান্ত করে সে ফুপির ঘরে গেল। সালমা কেবলই ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছিলেন। দুজনে হুট করে দাঁড়িয়ে গেলে সালমা হেসে বললেন, ‘আমি তোর ঘরেই যাচ্ছিলাম। তোকে একটা কথা বলতে ভুলে গিয়েছি।’
– কি কথা ফুপি?
– তুই কিন্তু তোর বাবার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবি।
– ওহ! এটা আমি জানি ফুপি। বাবা, ভাই, স্বামী আর ছেলের দিকে তাকিয়ে কথা বলা যায়। মানে এরা কি যেন? মাহরাম! হ্যাঁ, এরা মাহরাম।
– শুধু ইনারাই না। চৌদ্দ জন মাহরাম আছে। তোর আপন মামা, আপন চাচা, আপন বোনের ছেলে বা ভাইয়ের ছেলে, দুধ মায়ের স্বামী, ছেলে..
– বাহ! আমি তো শুধু ওই চারজনকে ভাবতাম।
– তোকে আরো কিছু জানতে হবে। এখন সময় নেই। আজকের কাজটা সেরে ফিরে আয়, তারপর অনেক গল্প করবো আমরা।
সালমা বাহারের চিবুকে হাত দিয়ে আদর করে বললেন, ‘তুই যেন আল্লাহর প্রিয় বান্দা হতে পারিস। মিথ্যের দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়ে আয়।’
ফুপির সাথে ডাইনিং রুমে গেল বাহার। হানজালা রুটি আর গরুর মাংসের তরকারি রেখে বাহারকে বললেন, ‘চাকরি ছাড়ছিস, এখন থেকে আমার সাথে রান্নাঘরে কাজ করবি। গাধার মতো খাটবি। চাকরি নেই, সংসারে গৃহপালিত পশুর মতো চলবি, সম্মান পাবি না। এটা তোকে মেনে নিতে হবে।’
সালমা বুঝলেন হানজালা রেগে আছে। তিনি কিছু বললেন না, বললো না বাহারও। সালমা আস্তে করে বাহারের কানের কাছে গিয়ে বললেন, ‘এমন পুরুষ বিয়েই করবি না যে তোর কাজকে ছোট করে দেখে।’
বাহার মুচকি হেসে থেমে গেল। সিয়াম কেমন পুরুষ? সে কি বাহারের চাকরি চলে যাওয়াকে স্বাভাবিক ভাবে দেখবে? সিয়ামকে তার চাকরি ছাড়ার ব্যাপারটা জানাতে হবে।
সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাহার গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়ি স্টার্ট দিয়ে পার্কিং লট থেকে বেরিয়ে সে রাস্তায় যেতেই জ্যামে আটকা পড়লো। আজ বের হতে দেরি হওয়ায় সকালের ফাঁকা রাস্তাটা পেলো না সে। একটু দেরি হলেই জ্যামে কয়েকশ গাড়ির লম্বা লাইন পড়ে যায়। তবে বাহারের পরীক্ষা এখান থেকেই শুরু হলো।
গাড়ির লাইন রাস্তার ডান পাশে থাকে। বাহার বাম পাশে আছে। তাই পুলিশের আসতে দেরি হলো না। হুট করে একজন পুলিশ বাহারের জানালার কাঁচে আঙ্গুল দিয়ে ঠক ঠক আওয়াজ করে বললো, ‘আপনার লাইসেন্স দেখি।’
বাহার বুঝেছে পুলিশের মতলব কি। সে সবসময় লাইসেন্স নিয়েই গাড়ি চালায়। পুলিশকে দেয়ার পরই লোকটার মুখ পানসে হয়ে গেল। যে আশা করেছিলেন তিনি, তা পেলেন না। ভেবেছিলেন মেয়ে মানুষ লাইসেন্স ছাড়াই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। এবার কিছু কামাই হয়ে যাবে। কিন্তু বাহারের ক্ষেত্রে তিনি বিফল হলেন। আর ঝামেলা করলেন না, তবে গাড়ির আশেপাশে চোখ বুলিয়ে বললেন, ‘গাড়িতে কালো কাচ রাখা যাবে না। এটা আমজনতার জন্য নিষেধ।’
পুরোপুরি কালো কাচ রাখা নিষেধ এটা ঠিক কথা। কিন্তু হালকা কালো বা ছাই রঙা কাচ লাগানো নিষেধ নেই। বাহারের গাড়িতে তেমনই কাচ লাগানো আছে। তারপরও একটা খুঁত ধরতেই হবে পুলিশের। তবে আল্লাহর রহমতে লোকটা এই কথা বলেই চলে গেল। বাহারকে ঝামেলায় পড়তে হলো না। কিন্তু সে চিন্তায় পড়ে গেল। এতক্ষণ বাহার পুলিশের দিকেই তাকিয়ে ছিল। একবারও চোখ নামিয়ে কথা বলেনি। সে দেখেছে, মধ্য বয়স্ক পুলিশ লোকটার গোঁফ আছে। চোখ দুটো যেন গর্তের ভেতর আর তার নিচে কালো দাগ। লোকটাকে দেখে বাহারের মনে কোনো ঘৃণিত চিন্তা জাগেনি তবে সে আরো একটা বিষয় ভাবলো। এই যে লোকটা তার লাইসেন্স দেখেছে, সেখানে তার একটা বেপর্দা ছবি আছে। লোকটা লাইসেন্স সনাক্ত করতে তার দিকেও তাকিয়েছে। তাকে দেখতে বাধ্য হয়েছে। এখানে এই লোকটার দৃষ্টির হিফাজত না করার কোনো দোষ দিতে পারছে না সে। তাহলে নারীদের কি পর্দার কোনোই প্রয়োজন নেই?
প্রশ্নটা তাকে চিন্তায় মগ্ন রাখলো। আজই ফুপির কাছে সে নিজের অভিজ্ঞতা বলবে। ফোন বের করে সে নোটপ্যাডে প্রশ্ন লিখে রাখলো যেন ভুলে গেলেও পরে সে প্রশ্নটা করতে পারে।
ইতিমধ্যে গাড়ির জ্যাম ছেড়ে দিয়েছে। বাহার মৃদু গতিতে গাড়ি চালিয়ে অফিসের পথে চলছে। অফিস যাওয়ার পথে একটা রাস্তা আছে যেখানে সারি সারি কৃষ্ণচূড়ার গাছ রয়েছে। একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের পর একটি রাঁধাচূড়া গাছ। তারপর আরো একটি কৃষ্ণচূড়া। এভাবেই রাস্তাটা লাল-কমলায় মিশে আছে। এই রাস্তার পাশে অনেকেই গাড়ি থামিয়ে ছবি তোলে, হাঁটে। প্রিয় মানুষের হাতে হাত রেখে অনেকদূর হেঁটে যাওয়া যায় এমন রাস্তায়।
গুলবাহারের জন্ম সবাইকে বিস্মিত করেছিল। কারণ হানজালার গর্ভে তার বয়স ছিল সাড়ে সাত মাস। সেসময় গর্ভপাত হওয়া অস্বাভাবিক না হলেও সাধারণত নয় মাসের পূর্বে গর্ভপাত হয় না। কিন্তু তার যেন ধরণীর আলো দেখবার জন্য খুব তাড়া ছিল। মায়ের গর্ভে চঞ্চলতা দেখাতে গিয়ে সেদিন মাকে প্রায় পরপারে পাঠিয়ে দিচ্ছিলো সে। হানজালাকে গাড়িতে তুলে ভালো হাসপাতালে নেয়ার সময় হয়নি। পুষ্পের কল্পলোকে হারানো ছোট এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সেবালয়ে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। সেখানে থাকা একজন ধাত্রী সম্প্রদায়ের মহিলার দ্বারা বাহারের জন্ম হয় খুবই সাধারণভাবে। না কোনো আয়োজন, না আড়ম্বর হাসপাতালে তার আভিজাত্যের প্রকাশ ছিল। তার জন্মের পরপরই বাগানবিলাস ফুলের ফুলের ঝরে পড়ার দৃশ্য, পাখিদের গুনগুনিয়ে গান আর শীতল বাতাস বয়ে যাওয়া দেখে সাখাওয়াত নাম রেখেছিলেন কাননবতী। পরবর্তীতে হানজালা নামটা অপছন্দ করলে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়, গুলবাহার।
বাহারের ইচ্ছে আছে, কোনো এক ভোরে নুপুর রূপের আন্দোলনে বৃষ্টির রিমঝিম কলধ্বনিতে সে এই রাস্তায় হাঁটবে। মাটিতে থাকবে লাল কৃষ্ণচূড়ার গালিচা আর বাসন্তী কমলা রাঁধাচূড়ার আতিথেয়তা। সে হাঁটবে, হাসবে। হঠাৎ পেছন থেকে কেউ ডাকবে, ‘গুলবাহার! আমার জীবনের পুষ্প বাগান তুমি। তুমিই আমার রং!’
__________
(চলবে ইন শা আল্লাহ)