‘ধূম্রজাল’
পঞ্চম পর্ব

তাবিনা মাহনূর

________

আজ সাদির সাথে বাহারের কথোপকথনের দ্বিতীয় দিন। বাহারের সাথে প্রথমদিন কথা বলার পর থেকে সাদিকে তিন বেলা বেশ ভালো পরিমাণের খাবার দেয়া হয়েছে। এর মূল কারণ সাদির কথা বলার শক্তি বাড়ানো এবং মস্তিষ্কের কাজের গতি দ্রুততর করা। কয়েকদিন সাদির পানি ও খাবারের সংকট ছিল বলে তার দেহের সকল অঙ্গের কার্যক্রম শিথিল হয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা বাড়াতে হবে, পুলিশের স্বার্থেই।

বাহার প্রথমদিনই ছক্কা মেরেছে, তাই তাকে আরো সুযোগ দেয়া হবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন শাওন ও শুভ্রত স্যার। যদি তিনদিনের মাঝেই সে সবরকম কথা বের করতে পারে তবে তার পদমর্যাদা বৃদ্ধি করা হবে, মামলা শেষে তাকে পুরস্কৃত করা হবে। আর যদি তিনদিনে সম্ভব না হয় তাহলে তাকে আরো বিভিন্ন সহায়তা দেয়া হবে। যেমন, লাই-ডিটেক্টর মেশিনের ব্যবহার, মেন্টালি স্ট্রেসলেস মেডিসিন কিংবা বিভিন্ন ধরণের যন্ত্র ব্যবহার যেগুলো মানসিক বিষয়গুলোর কাজ অগ্রসর করে, এমন সকল সহযোগিতা বাহারকে করা হবে। এই দেশে এসবের ব্যবহার সচরাচর প্রয়োজন হয় না। আর যন্ত্র আছেও খুব কম। বাহারকে তবু সাহায্য করা হবে কারণ ডক্টর শামসুজ্জামান তোহার সেই রিসার্চ পেপার গুলো খুবই প্রয়োজন।

একশো চার নং সেলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাহার। জেলারের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে সে একবার ডেকে উঠলো, ‘সাদি!’

ভেতর থেকে কোনো আওয়াজ এলো না। বাহার ভ্রু কুঁচকে ভাবলো, সাদি মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আবার ডেকে উঠলো, ‘সাদি হাসরাত!’

এবারও কোনো শব্দ এলো না। বাহার ধৈর্য হারাতে চায় না। সে চোখ বন্ধ করে নিজেকে বকে নিলো, অযথা নিজের বল হারানোর জন্য। এখনই রেগে গেলে সাদির সাথে কথা বলতে অসুবিধা হবে। তার ভাবনার মাঝেই জেলার এসে উপস্থিত। নির্দিষ্ট চাবি দ্বারা দরজা খুলে দিলেন তিনি, বাহার ভেতরে উঁকি মেরে দেখলো সাদির অবস্থান।

সাদি জেগে আছে। চুপ করে ছোট ঘরটার এক কোণে বসে আছে সে। গতদিন তাকে এই ঘর থেকে বের করে অন্য ঘরে বাহারের সাথে কথা বলিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আজ বাহার নিজে এসেছে সাদির অবস্থা দেখতে। কারণ সে অনুধাবন করতে পারবে, একজন মানুষকে এমন পরিস্থিতিতে রাখলে তার কাছ থেকে কতটুকু নির্ভুল জবাব পাওয়া যাবে। বাহার উপর নিচ মাথা দুলিয়ে জেলারকে বললো, ‘হুম, এই জায়গাটা তার জন্য ঠিক ছিল ততদিন, যতদিন সে কিছু স্বীকার করেনি। এখন একটু ভালো জায়গায় রাখুন। এ ব্যাপারে ওসি গালিব আর মেজর বিক্রমকে বলবেন। আর আমি শাওন স্যারের মাধ্যমে কথাটা জানিয়ে দিব।’

কথাগুলো বলে বাহার সাদির দিকে তাকিয়ে উচ্চস্বরে বললো, ‘বেরিয়ে আসুন। গতদিন যেখানে কথা হয়েছে, আপনাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হবে।’

বাহার অপেক্ষা না করে সেই ঘরে চলে গেল যেখানে তাদের কথোপকথন হয়েছিল। ছোট গোল টেবিলের এক পাশের চেয়ার টেনে বসে সে হাত দুটো টেবিলের উপর রাখলো। চোখ বন্ধ করে দৃঢ় শ্বাস নিয়ে সে একাই মুচকি হাসলো। যেন মুখটা গম্ভীর না থেকে স্বাভাবিক থাকে। যেন সে সাদির বড়ই আপনজন!

সাদিকে তার সামনের চেয়ারে বসানো হলো। সাদি এবারও দৃষ্টি নীচে রেখেছে। বাহার মৃদু হেসে বললো, ‘সাদি, আপনি উপরে তাকান। আমার কিছু কথা আছে।’

সাদির উত্তর, ‘আমার কিছু বলার নেই। আপনি কথা বললে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে, এমন কোনো নিয়ম নেই।’

– এমন নিয়ম অবশ্যই আছে। আপনি আমার দিকে না তাকালে আপনার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে জাগবে না আমার। মনে হবে আপনি আমাকে উপেক্ষা করছেন।

এই কথার বিনিময়ে হেসে ফেললো সাদি। এই হাসিটা উপহাসের, বাহারের অভিনয় ধরে ফেলার। তবে বাহার থমকে গিয়েছে। সেই হাসি! সেই টোল পড়া হাসি! যেটা দেখে বাহার ভেবেছিল, এই লোকটা মুসলিম কেন হলো না?

তবে আজ সাদিকে ওই দিনের তুলনায় অনেকখানি পরিবর্তিত মনে হচ্ছে। চিবুক জুড়ে ঘন দাড়ি, টোল দেখা গিয়েছে কারণ সাদির দাড়ি উঠেনি সেখানে। শুধু চিবুকের সম্পূর্ণ অংশে দাড়ি গজিয়েছে। তাতে সাদির রূপে গাম্ভীর্য ও সাহসিকতার ছাপ প্রকাশ পেয়েছে। বাহার কথার খেই হারিয়ে ফেলছে। সাদি না হাসলেও পারতো! মেজাজ গরম হয়ে যাচ্ছে গুলবাহারের। সে যথেষ্ট শান্ত থাকার চেষ্টা করে বললো, ‘আমি হাসির কিছু বলেছি বলে মনে হয় না সাদি।’

– আমি হয়তো পাগল বলেই হাসছি।
– কথায় আসুন। আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলুন।
– বলেছি তো, আমার কিছু বলার নেই।
– আপনার অনেক কিছু বলার আছে।

চুপ করে আছে সাদি। বাহার নরম সুরে বললো, ‘সাদি, আমি কিন্তু বলিনি আপনার মায়ের সাথে আপনার যোগাযোগ আছে।’

সাদি বলে উঠলো, ‘এছাড়া আপনি সবই বলে দিয়েছেন।’

গুলবাহার ঘাবড়ে যায়নি, ‘না। আমি সত্যিই কিছু বলিনি। এটুকু বলেছি যে আপনি একটা ভালো পরিবারের ছেলে ছিলেন। এবং আপনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারবেন।’

সাদি আবার হাসলো, ‘ওহ! এজন্যই তারা ভালো ভালো খাবার দিয়েছে আমাকে?’

বাহার ভেতরে ভেতরে অবাক হচ্ছে সাদির বুদ্ধিমত্তা দেখে। সাদিকে খাবার দেয়া হচ্ছে, এটা দেখেই সে বুঝে গিয়েছে বাহার নিশ্চয়ই সব বলে দিয়েছে এবং বলি দেয়ার আগে পাঠা যেমন মোটা-তাজা করা হয় সাদির সাথে সেটাই হচ্ছে। তবে বাহার নিজের মুখে বিস্ময় ভাব ফুটিয়ে তুললো না। মুচকি হেসে সে বললো, ‘দেখুন, আমি এখানে কেন আসি এটা আপনার জানা কথা। কেউ পারেনি আপনার মুখ থেকে স্বীকারোক্তি বের করতে। আমিও পারবো না জানি। আপনার মানসিকতা যাচাই করাই আমার উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু আপনি বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আপনি যখন থেকে বলেছেন আপনি নির্দোষ এবং আপনার কাছে প্রমাণও আছে, তখন থেকে আমি শুধুই চেয়েছি সত্যের প্রকাশ ঘটুক। আপনার মুক্তি মিলে যাক, আপনি একটা স্বাধীন জীবন পার করুন। আমি কখনোই অন্যায়ভাবে কাউকে অপদস্থ করা সমর্থন করি না।’

সাদি নিশ্চুপ নীচে তাকিয়ে। গম্ভীর মুখে না আছে হাসি, না আছে চিন্তার ছাপ। বাহার নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে সাদির মনে কথাগুলোর প্রভাব ফেলতে, সাদিকে ফাঁদে ফেলতে যেন সে মনে করে বাহার তাকে মুক্তি দিতে পারবে। বাহার আবার বলে উঠলো, ‘আমার এই কর্মজীবন মাত্র দুই বছরের। আলহামদুলিল্লাহ, এখন পর্যন্ত কোনো আসামিকে দেখিনি যারা নির্দোষ হয়েও অপরাধের শাস্তি পাচ্ছে। আপনিই প্রথম যিনি অপরাধী না হয়েও জেল খাটছেন, বিচার পাচ্ছেন না। সত্যি বলছি, আমি ন্যায় প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আপনি আমাকে সাহায্য করুন দয়া করে।’

সাদি এখনো কোনো কথা বললো না। বাহারও কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ধূসর রঙা চার দেয়ালের ঘর, ছাই পোড়া মেঝে। দরজার নিচের ফাঁকা অংশ দিয়ে হালকা আলোর উঁকিঝুঁকি। সেই আলোয় দুজন মানব মানবীর মুখশ্রী জুড়ে অভিব্যক্তির লুকোচুরি ধরা পড়েছে। দুজনেই অভিনয়ের খেলায় জিততে চাইছে, হার মানলেই সব শেষ। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সূক্ষ্ম আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। একজনের দৃষ্টি নীচে, আরেকজনের অপর পক্ষের উপর নিবন্ধ। লুকোচুরি অভিনয়ের খেলার মাঝে আরেক খেলা, ধৈর্য ধারণ। এই খেলায় জিতবে কে?

সাদিই জিতলো। অনেকক্ষন চুপ থাকার পর বাহার বলে উঠলো, ‘সাদি, আপনি যদি কিছুই না বলেন তাহলে আপনাকে এখান থেকে বের করবো কি করে?’

সাদি ধীর স্বরে কিছু বলছে। মোহর বুঝতে পারছে না। সে জিজ্ঞেস করলো, ‘কি বলছেন সাদি? জোরে বলুন।’

– আপনি নিজেকে খুব চালাক মনে করেন।

প্রচন্ড রাগ উঠে গেলেও মোহর চোখ বন্ধ করে তা নিয়ন্ত্রনে চেষ্টা করলো। রেগে গেলে কেউ কেউ বাঁকা হেসে ওঠে। মোহর তেমনি হেসে বললো, ‘একটু চালাক মনে করি। নাহলে এতদূর পৌঁছাতে পারতাম না। আপনি কাজের কথা বলুন সাদি। অন্তত এটুকু বলুন যে তোহা স্যারকে খু-ন কেন করা হতে পারে?’

সাদি আবার চুপ হয়ে গেল। বাহার বিরক্ত বোধ করছে। সে বলে উঠলো, ‘সাদি, আপনার মায়ের সাথে আপনার সম্পর্ক কেমন?’

– (নিশ্চুপ)
– তোহা স্যার আপনাকে খুব ভালোবাসতেন। মিসেস তোহা, মানে স্টেরি রোজারিও আপনার সুনাম করেছিলেন। তারমানে আপনার প্রতি তাদের সুধারণা ছিল বলেই তারা গোপন কক্ষের খবর আপনাকে দিয়েছিল। তোহা স্যারের অ্যাসিস্টেন্ট তাহমিদ ছাড়া আর কেউ কি জানে এই কক্ষের ব্যাপারে?
– (নিশ্চুপ)
– সাদি, ওয়ান লাস্ট কোয়েশ্চেন। আপনি কি মুনাফিক?

মুখ তুলে তাকালো সাদি। প্রশ্ন করলো সে, ‘কি বলতে চাইছেন?’

বাহার মনে মনে খুশি হচ্ছে সাদির দুর্বল জায়গায় আঘাত করে। তবে লোকটা উপরে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার মাথা নিচু করে ফেলেছে। বাহার বললো, ‘আপনি মুসলিম হয়েছেন মা শা আল্লাহ, কিন্তু আপনার আচরণ সন্দেহজনক। ধরে নিলাম আপনি দোষী নন, তাহলে কেন প্রমাণ উপস্থাপন করছেন না? আবার যদি আপনি দোষী হয়ে থাকেন তাহলে অন্তত এটা বলুন কেন আপনি খু-ন করেছেন তোহা স্যারকে? ইসলামের স্বার্থে যদি স্যারের কোনো কাজে বাধা দিতে তাকে খু-ন করে থাকেন, তাহলে একজন মু-জাহি-দ হিসেবে আপনার উচিত সব স্বীকার করে নেয়া। দুনিয়ার শাসকদের ভয় না করা।’

সাদি গম্ভীর কণ্ঠে বললো, ‘খু-ন না করেও খু-ন করেছি বলে মিথ্যুক হবো কেন?’

– মিথ্যুক হতে বলছি না সাদি। যদি নির্দোষ হয়ে থাকেন তাহলে যা জানেন তা বলে দিন। পেপারগুলো কোথায় সেটা বলুন। এটা না জানলে এটুকু অন্তত বলুন যে কে খু-ন করেছে বা করতে পারে। তাহলে বিশ্বাস করবো আপনি মুনাফিক নন। কারণ আপনি মুসলিম হলে নিজের ভালো কর্ম বাড়াতে নিজেকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বের করার চেষ্টা করতেন, যেহেতু আপনার দ্বীনে ফেরার বয়স বেশিদিন নয়। কিন্তু আপনি যা করছেন, তাতে মনে হচ্ছে আপনার মনে অন্য কোনো চিন্তা আছে যেটা দ্বারা আপনি প্রভাবশালী কেউ হতে পারবেন ভবিষ্যতে। আর তাই…’

বাহারকে থামিয়ে সাদি বলে উঠলো, ‘জেলে থেকে প্রভাব খাটাবো? রাবিশ!’

বাহার বুঝতে পেরেছে মুনাফিক কথাটা সাদির অন্তরে বেশ জোরালো আঘাত করেছে। সে মুচকি হেসে বললো, ‘অনেক মাফিয়া চক্র আছে যারা জেলে বসেই নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলে। আপনি তাদের একজন নাকি তা কীভাবে বুঝবো বলুন?’

সাদি একটু একটু করে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিল। কিন্তু সে উপরে তাকিয়ে এক পলক বাহারকে দেখে আবার নীচে তাকিয়ে বললো, ‘সাদি হাসরাতকে আপনি চেনেন না। তাই অনর্গল প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন। শুধু শুধু আমাকে ফিতনায় ফেলছেন।’

বাহারের ধৈর্যও সীমা অতিক্রম করবে এবার। সে শেষ চেষ্টা করলো, ‘আজ আপনি কিছুই বললেন না সাদি। আমি সত্যিই হতাশ হলাম মুমিনরা একজন সবল ব্যক্তিত্বের মানুষকে হারাতে বসেছে তার বোকামির জন্য।’

সাদি এ কথার অর্থ বুঝেছে। বুঝেই সে হেসে ফেললো। বাহার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, ‘আমি আবার আসবো। ততদিনে নিজেকে তৈরি করে রাখুন। আমার কথাগুলো একবার ভাববেন। যদি মুনাফিক না হয়ে থাকেন তবে ভেবে দেখবেন, সত্যের জয় হওয়া উচিত হবে কিনা।’

বাহার বের হওয়ার আগ মুহূর্তে সাদি বলে উঠলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ বলতে জানেন, আর বলতে হয় কোথায় সেটা জানেন না?’

পেছন ফিরে বাহার প্রশ্ন করলো, ‘মানে?’

– আপনার চাকরিটা হালাল হচ্ছে না। তাই আলহামদুলিল্লাহ, দু বছর চাকরি করছেন, এ কথাটা ঠিক মানায় না।
– হালাল হচ্ছে না কে বলেছে আপনাকে? আমি অসৎ নই!
– একজন পুরুষ সাইকিয়াট্রিস্ট পাঠাবেন, আপনার কাছে আমি কোনো কথাই বলবো না।

বাহার স্তম্ভিত চিত্তে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেরিয়ে এলো। খট খট আওয়াজ তুলে ত্রস্ত পায়ে হেঁটে সে গাড়ির কাছে পৌঁছালো। কত কষ্ট করে সে এখানে এসেছে, সাদির সাথে দেখা করার অনুমতি পেয়েছে, আর সাদি তাকে সবসময়ই অপমান করার চেষ্টায় থাকে! এখন ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানছে। বাহার মুমিনাহ না হতে পারে, কিন্তু সে মনেপ্রাণে একজন মুসলিম। সে বিশ্বাস করে মুসলিম নারী সবই পারবে! সমাজ ধর্মের নামে নারীদের অগ্রগতিতে বাধা দেয়।

গুলবাহার নিজে ড্রাইভিং করে গাড়ি চালিয়ে বাসার পথে রওনা হয়েছে। শহরের ট্রাফিক জ্যামের কারণে অপ্রত্যাশিত কিছু অবসর পাওয়া যায়। বাহার এই অবসরে ক্লান্ত শরীরটাকে সিটের উপর এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলো। সাদি খুব অদ্ভুত প্রকৃতির মানুষ। পুরো সময়টা সাদি তার নিয়ন্ত্রণে থেকেছে, শেষ সময়ে সাদিই তাকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলো। এটা কি সাদির সুপার পাওয়ার? গত দিনও সাদি এমন কিছু কথা গোপন রেখেছে যেন বাহারকে সে নিজের আয়ত্তে রেখে কাজ হাসিল করতে চাইছে। বাহারকে সে জমজমাট থ্রিলার উপন্যাস পড়তে দিয়ে মাঝ পথে কেড়ে নিয়েছে এই বলে, ‘বাকিটা নিজে সমাধান করো।’ অর্থাৎ সাদির তৈরি গোলকধাঁধার সমাধান বাহারকে করতে হবে।

হঠাৎ করে গুলবাহারের নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, নারীরা সত্যিই পুরুষদের তুলনায় একটু বোকা হয়ে থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে নারীদের সাফল্য পুরুষদের তুলনায় অধিক দেখা যেতে পারে। কিন্তু আনুপাতিক হিসাব করলে পুরুষদের বুদ্ধিমত্তার উত্তম পরিচয় পাওয়া যাবে। বাহারের মনে হলো, সাদি তাকে অবলা নারী ভেবে নিজের মতো নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। এবং তার পরিকল্পনা অনুযায়ী বাহার সেই ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে।

দুই চোখে আঙুল চেপে বাহার নিজের কিছু মুহূর্তের বোকামির জন্য নিজেকেই তিরস্কার করলো। ধর্মীয় আবেগ নিয়ে চললে কাজকর্মে কখনোই সৃজনশীল হতে পারবে না সে। চাকরির পূর্বে চারিদিক থেকে এই চাকরি করতে বাধা দেয়া হয়েছিল তাকে, শুনতে হয়েছে তার চারিত্রিক দোষত্রুটির কথা যা সে কাউকে বলতেও ঘৃণা বোধ করে। আবার চাকরির পর অফিসে স্যারদের চোখে তার অনন্য অবস্থান সবাইকে বিস্মিত করে না। কারণ তাদের নোংরা ধারণা আছে বাহার সম্পর্কে। বাহার যে দুই একটা বাজে প্রস্তাব পায়নি তা নয়। কিন্তু সে তেমন মেয়ে নয় যে উচ্চ মর্যাদায় স্থান পেতে নিজের সম্মান বিকিয়ে দিবে।

ভাবতে ভাবতেই বাড়ি পৌঁছে গেল বাহার। আজ অফিসে যাবে না সে। সাদির মানসিক অবস্থার একটা রিপোর্ট আর কথোপকথনের চার্ট তৈরি করতে হবে তাকে। এসবের জন্য তার নীরব ঝামেলামুক্ত পরিবেশের প্রয়োজন। নিজের বাড়ির তিন তলার ডান কোণের ঘরের সামনে বাগানবিলাসের অপরূপ শোভা, অদূরে তাদের বাগানে আসা পাখিদের মিষ্টি সুর, বারান্দায় কিছু ঘরোয়া প্রকৃতির গাছ আর রাত হলে কৃত্রিম আলোয় বারান্দায় একটা শীতল পরিবেশ তৈরি হয়। এসব বাহারের মনকে প্রশান্ত করে তোলে। তবে রাতের আহার সম্পন্ন হওয়ার পর যখন সবাই প্রত্যেকের ঘরে বিশ্রাম নেয়, তখন সালমা ফুপি সুর করে সূরা মূলক পড়েন। সেসময় বাহার বারান্দার মেঝেতে বসে মৃদু হাওয়ায় মিশে থাকা মাটির সোঁদা গন্ধে মন ভরে শ্বাস নেয়। আর সুমধুর কণ্ঠের ক্বুরআন তিলাওয়াত শুনে তার অজান্তেই অশ্রু ঝরে।

কিন্তু দুর্ভাগ্য বাহারের, বাড়িতে আরামদায়ক পরিবেশে কাজ করবে ভেবে আসলেও বাড়ি ভর্তি মানুষের আনাগোনা দেখে মেজাজ আবার বিগড়ে গেল তার। যদিও মুখে যথাসম্ভব হাসি ফুটিয়ে সে কোনো মতে নিজের ঘর পর্যন্ত গেল। এ ব্যাপারে হানজালা তাকে সাহায্য করলেন। আত্মীয়দের বললেন, মেয়েটা সকাল থেকে বাইরে অনেক কাজ করেছে। এখন একটু ফ্রেশ হয়ে আসুক।

গুলনাজ অবশ্য তার আপুকে ছাড়লো না। বাহারের পেছন পেছন গিয়ে সে মিটিমিটি হেসে বললো, ‘খবর আছে তোমার। রাজপুত্রগুলো সব তোমাকেই ধরে কেন? তবে সমস্যা নেই। শালী আধি ঘার ওয়ালি!’

বাহার এসবের কিছুই বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই নাজ বলে উঠলো, ‘এখন কিছু বলবো না। তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। নীচে গিয়ে সব জানতে পারবে।’

বাহার তেমন আগ্রহ দেখালো না। তার মন এমনিতেই ভালো নেই। আজকের রিপোর্ট জানলে শাওন স্যার যেমন উচ্ছাস দেখিয়েছিলেন, তেমনই নিভে যাবেন আবারো। এছাড়া সাদির মানসিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাহার একেবারেই মেনে নিতে পারছে না। তাই আপাতত তার মনকে অক্লান্ত রাখতে বিশ্রাম ও সুন্দর পরিবেশের প্রয়োজন। শুরুতেই প্রয়োজন হালকা শীতল পানির স্পর্শ। তাই সে গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে গেল।

আর এদিকে হানজালা মেয়ের একটা গতি করতে পেরে আনন্দে চায়ের পাতিলে লবন ঢেলে দিয়েছেন…

__________

(চলবে ইন শা আল্লাহ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here