#মেঘের_পালক
পর্ব-১১
“এটা কী নিলি? এই শার্ট তুই পরিস?” বিরক্ত হয়ে বললেন প্লাবনের মা।
“ওহ তাই তো! ভুল করে নিয়েছি।”
“তোর কী হয়েছে বলবি?”
“কিছুই না মা!”
প্লাবনের মা চিন্তায় পড়ে যান৷ এই ছেলে এক বছর ধরেই পাগল হয়ে আছে বিয়ের জন্য। অসংখ্য মেয়ে দেখেও পছন্দ হয়নি। তিনি জানেন এর পছন্দ আটকে আছে অন্য কোথাও। কিন্তু সেই মেয়ের কথা হাজার চেষ্টা করেও পেট থেকে বের করা যায়নি৷ কী আর করার! তার ওপর সেদিন বিয়েবাড়ি থেকে ফেরার পর থেকেই আরও আনমনা হয়ে গেছে। কী সমস্যা কে জানে!
আজ তারা রওনা দিচ্ছে ট্যুরের জন্য। পাহাড় দেখতে যাওয়া হবে। প্লাবনের মা ও তার কিছু বান্ধবী একত্রে ট্যুর প্ল্যান করেছে। শুধু নিজেরা যাবে না, ছেলেমেয়েও নিয়ে যাবে। একেবারে ফ্যামিলি ট্যুর। বড় একটা বাংলো পাওয়া গেছে৷ সেখানেই থাকবে৷ দিনে ঘুরবে, তাতে আগুন জ্বালিয়ে আড্ডা দেবে, কত পরিকল্পনা! প্লাবনের খুব একটা ইচ্ছে ছিল না এই মহিলাদের ভিড়ে। মা তাকে একপ্রকার জোর করে নিয়ে যাচ্ছে। তার প্লাবনকে নিয়ে অন্যরকম পরিকল্পনা আছে কি না!
★
মালপত্র টেনে বাস পর্যন্ত যেতে যেতে হাঁপিয়ে উঠল অরিন। মা বোধহয় বাড়ির সব নিয়ে এসেছে ব্যাগে। চারদিনের ট্যুরে এতকিছু নিয়ে কী করবে? আজব!
সে হাত থেকে ভারী কাপড়ের ব্যাগটা রেখে কোমরে হাত দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। তার মায়ের বান্ধবীদের সে ঠিকঠাকমতো চেনে না। অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী করবে? সালাম দেবে? কাকে দেবে? একেকজন একেক দিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অতঃপর যার সাথেই চোখাচোখি হলো, হাসি বিনিময় করে এ যাত্রায় সৌজন্য রক্ষা করল।
বাস যেখানে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে একটা ছোট্ট চা পানের দোকান। এখন ভোর। অল্প কিছু খদ্দের দোকানে। সকালের মৃদু বাতাসে ভেসে যাচ্ছে চায়ের কেটলি থেকে ওঠা ধোঁয়া। এক বুড়ো নামাজ পড়ে এসে বোধহয় চা খেতে বসেছে৷ একজন ভোরবেলাতেই পান মুখে দিয়ে বসেছে। পিক ফেলছে ফুটপাতের সিমেন্টের কিনারা থেকে গজিয়ে ওঠা বটগাছের পাতার ওপর। দৃশ্যটা মন দিয়ে দেখল অরিন। একটা আর্টিস্টিক ব্যাপার আছে৷
“হাই অরিন!”
চেনা গলায় চমকে উঠে তাকাল অরিন৷ এ কি দেখছে সে! এই ছেলে এখানে আসবে কেমন করে?
“আপনি এখানে?”
“চলে এলাম।”
অরিন রেগে গিয়ে বলল, “আমার পিছু নিচ্ছেন?”
“মোটেও না। আমি কেন তোমার পিছু নেব?”
“তাহলে?”
“ট্যুরে যাব তাই এসেছি।”
অরিনের মেজাজ বিগড়ে গেল। যদিও মনের একপাশ বলছে, সকালটা আরও সুন্দর করে দিল এই সুন্দর মানুষটা৷ আর অন্যপাশ বলছে, অসহ্য ছেলেটার সাথে তার কপাল বুঝি আঠা দিয়ে জোড়া দেয়া। কিছুতেই পিছ ছাড়বে না!
অরিন আর কিছু বলল না। মুখ ইচ্ছে করে গোমড়া করে রাখল। বাসে ওঠার সময় হলে উঠে বসল। আরও অনেকে এসেছে। মায়েদের বয়স অনুযায়ী ছেলেমেয়েরাও বড় বড়। অরিন একটা বান্ধবী জুটিয়ে ফেলল। নাম হুমায়রা। প্লাবনের সাথে যে ছেলে দুটোর কথা হলো তারা জমজ। নাম নয়ন, নবীন৷ আরও একটা মেয়ে এসেছে, নাম ইনায়া। এই সকালবেলাতেও যা সাজগোজ করে এসেছে তাতে অনেকেরই মুখ হা হয়ে গেছে৷ ইনায়া গিয়ে বসল স্বাধীনের পাশে। স্বাধীন ছেলেমেয়েদের মধ্যে সবার বড়। বেশ ভালো চাকরি করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পরিবেশ জমে উঠল। হাসি, গানে শুরু হলো যাত্রা।
অর্ধেক রাস্তায় যাত্রাবিরতির সময় অরিন বাস থেকে নামল হাত পা একটু সচল করে নেবার জন্য। জার্নিটা তার ভালোই কেটেছে, তবে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল প্লাবনের দিকে, এই যা সমস্যা। আর প্লাবন তো বোধহয় তার দিকেই আঠার মতো তাকিয়ে ছিল পুরোটা সময়। অবশ্য আরেকটা ইচ্ছে আছে অরিনের বাস থেকে নামার। সে একটু দূরে চলে যাবে এটা দেখতে যে প্লাবন আসে কি না। কেন যেন একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছে।
প্লাবন এলো না৷ এলো প্লাবনের মা। ওকে দূরে যেতে দেখে ডেকে বলল, “অ্যাই অরিন, এদিকে এসো তো মা।”
মহিলা এত মিষ্টি যে এই ডাক উপেক্ষা করা যায় না। অরিন গেল। তার দুই হাতে দুটো আইসক্রিম। একটা চকোলেট, একটা ভ্যানিলা। বললেন, “দেখো না, ছেলেটা কোথায় চলে গেল! ওর জন্য চকোলেট আইসক্রিম কিনলাম, এখন হাওয়া! তুমি খাও এটা প্লিজ। নইলে শুধু শুধু নষ্ট হবে।”
অরিন একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলেও আইসক্রিমটা নিল। প্লাবনরে মা গল্প জুড়ে দিলেন। রাজ্যের গল্প! সবটা সংসার আর প্লাবনকে নিয়ে। অরিনের পছন্দ হয়ে গেল তাকে। বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। আর খুবই খোলা মনের। সে এটাও ভেবে ফেলল, এই মহিলা তার শ্বাশুড়ি হলে খারাপ হতো না!
একটু পরেই উপস্থিত প্লাবন। এগিয়ে এসে ভুরু কুঁচকে বলল, “মা আমার আইস…”
“ওকে দিয়ে দিয়েছি। আইসক্রিম তোর জন্য বসে থাকবে নাকি? গলে পানি হয়ে যেত এতক্ষণে। ছিলি কোথায় তুই? একটা বারও…” বলতে বলতে চেঁচামেচি শুনে থেমে গেলেন৷ তাদের দলের এক মহিলা খুব চিৎকার করছেন এক পাগল তাকে ভেঙচি কেটে বুড়ি বলেছে বলে। সবাই সেদিকে চলে গেল।
এদিকে অরিনের প্রায় শেষ হয়ে আসা আইসক্রিমটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল প্লাবন। বলল, “আমার জন্য ছিল এটা।”
বাকি আইসক্রিমটুকু খেয়ে শেষ করে কাঠিটা দূর থেকে ডাস্টবিনের দিকে নিশানা করে ভেতরে ফেলতে পেরে বেশ তৃপ্ত হয়ে কোথায় চলে গেল! অরিন বেশ কিছুক্ষণ ঠিকমতো বুঝল না ঘটনা কী ঘটল!
বাস চলতে শুরু করল আবার৷ এবার সবাই একটু ঝিমিয়ে পড়েছে। একেবারে গন্তব্যে পৌঁছে দুপুরের খাবার খাবে বলে একটু যেন অস্থিরও হয়ে আছে সবাই, যদিও টুকটাক কিছু খাওয়া হয়েছে।
রুনা নামের খুব ফর্সা এক মহিলা দারুণ গান জানেন। তিনি শুধু গান গেয়ে যাচ্ছেন একটার পর একটা। এখন চলছে, “সে এক রূপকথারই দেশ..ফাগুন যেথা হয় না কভু শেষ…”
পৌঁছুতে প্রায় বিকেল হয়ে এলো। রোদ পড়ে আসছে। সূর্যের হলুদে কমলার ছটা লেগে গেছে। তারা যখন বাংলোতে ঢুকল তখন সবারই ক্লান্তিতে চোখ বুজে আসার অবস্থা। সবাই সার বেঁধে ঢুকছে, এমন সময় স্বাধীন অরিনের পাশে চলে এলো। তাদের বাসে পরিচয় হয়েছে শুধু। স্বাধীন বলল, “একদম মহিলা নিয়ে আমি ট্যুরে আসব কোনোদিন ভাবি নাই। এত অদ্ভূত ট্যুর কেউ দেয়?”
অরিনের কথাটা ঠিক ভালো লাগল না। সে বলল, “আপনি ওনাদের নিয়ে আসেননি, বরং সাথে এসেছেন।”
কথাটা শুনে স্বাধীন অরিনের দিকে চোখ তুলে ভালো করে তাকাল। ঠোঁটে মৃদু হাসি। কেন যেন অরিনেরও হাসি পেল। সে হাসিটা ফেরত দিল। তারপর ঢুকে গেল বাংলোর ভেতর। বিশাল বাংলো। একতলার দুটো ভাগ। যার যার প্রয়োজনমতো একটা বা দুটো ঘর নিয়ে নিল। বেয়ারা জানাল খাবার তৈরি আছে, ফ্রেশ হয়ে এসে খেয়ে নিতে পারে।
অরিন ঘরে ঢুকে ধপাস করে শুয়ে পড়ে চোখ বুজে ফেলল। তার মা তার তুলনায় ভালো অবস্থায় আছে। তিনি বসে বললেন, “অ্যাই, শুবি না। ওঠ! গোসলে যা। তারপর আবার আমি যাব। খেতে হবে। ক্ষুধা লাগে নাই তোর?”
অরিন শুয়েই রইল। নড়তে ইচ্ছে করছে না।
প্লাবন ঘরে ঢোকেনি। সে নয়ন আর নবীনের সাথে রুম শেয়ার করবে। ওরা ঢুকে জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। প্লাবনের কিছু ইচ্ছে করছে না। অরিন তখন স্বাধীনের সাথে এত কী কথা বলছিল? কত সুন্দর হাসল! তার সাথে তো কোনোদিন এভাবে হেসে কথা বলল না! গা জ্বলে যাচ্ছে কেন যেন।
ইনায়াকে দেখা গেল লনে হাঁটছে। সবুজ লনের একধারে ছোট্ট গোলাকার ছাউনি দেয়া বসার জায়গা। সেখানে গিয়ে বসল ইনায়া। সেলফি তুলছে। প্লাবনও নেমে গেল। এগিয়ে গেল ইনায়ার কাছে।
ইনায়া তাকে দেখে বলল, “আপনি প্লিজ আমার কিছু ছবি তুলে দিতে পারবেন?”
“অবশ্যই।”
ইনায়া কয়েক রকমের পোজে ছবি তুলল। হাসিমুখে, গোমড়ামুখে, আকাশের দিকে তাকিয়ে, কোমরে হাত দিয়ে, ইত্যাদি।
অরিন গোসল শেষে রুম থেকে বের হয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দৃশ্যটা দেখতে পেল৷ প্লাবন হাসিমুখে ইনায়ার নানা রকমের ছবি তুলে দিচ্ছে বাধ্য ফটোগ্রাফারের মতো পেছন পেছন ঘুরছে। আস্ত নির্লজ্জ ছেলে তো! মেজাজ গরম হয়ে গেল অরিনের।
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু