বাসা থেকে বের হতেও আজকাল ভ’য় লাগে। যেন যেন ভ’য় নয়! গুরুতর ভ’য়। একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা মানুষের জন্য সাহ’সের হবে তা না! আমার জন্য এই বস্তুটা একটা ভ’য়া’নক ব্যাপার। আমরা সরকারি কোয়ার্টারে থাকি। আমার বাবা একজন সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। সেই সুবাদে সরকারি কোয়ার্টারের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছি আমরা। অবশ্য টাকা পয়সা তো যাচ্ছেই! তবুও! সরকারি কোয়ার্টার একটা অন্যরকম কিছু।
আসল কথায় আসি! নতুন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এসেছেন। এতদিন জানতাম সে বুড়ো- টাকলা, বউ বাচ্চা সমেত মানুষ। তবে আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে এক সুদর্শন যুবা পুরুষ। যাকে দেখে প্রথম দেখাতেই ক্রাশ নামক বাঁশ আমাকে খেতে হয়েছে। যখন শুনলাম সে অবিবাহিত, তখন যেন হাতে আকশের চাঁদ পেলাম। রোজ সকালে কলেজে যাওয়ার আগে সেজেগুজে তার বাসভবনের সামনে দিয়ে হাঁটতাম। তবে তার হদিশ পেতাম না। এই ভাবেই দিন যাচ্ছিল। একদিন আমাদের কলেজের সিনিয়র ভাই(চতুর্থ বর্ষে পড়ে) আমার পথ আটকে ধরলেন। একদম মসজিদ সংলগ্ন রোডে। সেখান থেকে সোজা রাস্তাতে আবার ক্রাশের বাসভবন। তো আমাকে তিনি প্রোপোজ করলেন। আমার তখন মাথায় শুধু একটাই নাম কিলবিল করত, ‘নায়েব শাখাওয়াত’। অত্যন্ত জোর গলায় আমি সেই সিনিয়র ভাইকে রিজেক্ট করলাম এটা বলে যে,
-‘আপনি জানেন আপনি কাকে এমন প্রস্তাব দিচ্ছেন?’
-‘কাকে আবার! তোমাকেই তো।’
-‘আমি কে সেটা জানেন?’
-‘না জানার কী আছে। অবশ্যই জানি।’
-‘উহু। আপনি কিছুই জানেন না। জানলে এমন দুঃসাহস দেখাতেন না। আমার বিয়ে ঠিক করা আছে। কার সাথে সেটা জানেন?’
-‘কী বলছ! বিয়ে? কার সাথে!’
-‘এই তো! দেখলেন! আপনি কিচ্ছু জানেন না। এই উপজেলার নির্বাহী অফিসার আমার হবু বর। আমরা অতি শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছি।’
-‘মানে! কী বলছ এসব! বিশ্বাস করি না আমি।’
-‘বিশ্বাস করা আর না করা আপনার ব্যাপার। তবে আপনাকে সাবধান করা আমার মানবিক কাজ ছিল। আমার উনি জানলে কিন্তু খবর করে দিবে।’
ভাব সাব নিয়ে তো সেদিন চলে এলাম। পরদিন শুক্রবার ছিল বলে আর বাসা থেকে বের হইনি। সমস্যা হলো শনি বারে! শনি আসলেই আমার জন্য কা’ল ছিল। আমার সর্বনাশের শুরু তো তখন থেকেই। বান্ধবী প্রত্যাশার জন্মদিনও ছিল সেদিন। সবাই ঠিক করল কালো শাড়ি পরবে। আমার কাছে ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগল। কালো শাড়ি তাও আবার জন্মদিনে? খুব সুন্দর করে সেজে খোপায় বেলি ফুল লাগিয়ে কাধ ব্যাগ ঝুলিয়ে গুনগুনিয়ে গান গাইতে গাইতে বাহিরে বের হলাম। বাসা থেকে বের হয়ে সামনের বিল্ডিং পার করার সময় দোতালা থেকে সবুজ ভাইয়ের গলার আওয়াজ শুনলাম। সে ডাক দিয়েছিল আমার নাম ধরে। আমি উপরের দিকে তাকাতেই বলল,
-‘কী ব্যাপার পত্রলেখা! এমন শো’কা’বহ বেশে কোথায় যাচ্ছো? এখন তো শো’কের মাস না।’
এই লোকটাকে আমার বিরক্ত লাগে। খুব বিরক্ত লাগে। দেখলেই এমন টি’প্পনী কেটে কথা বলে। আমি মৃদু হেসে বললাম,
-‘আমার এই বিল্ডিং পার করতে সবসময় শো’ক শো’ক ভাব লাগে। তাই আজ শো’কের চিহ্ন হিসেবে এই শাড়ি পরিধান করলাম।’
-‘কেন! কেন! এই বিল্ডিং কী করেছে?’
-‘বিল্ডিং আর কী করবে! বিল্ডিং এর দোতালায় একটা কাক থাকে সবসময়। আসতে যেতে তার কা কা শুনি। দাদী বলে কাকের ডাক অ’শু’ভ। শো’ক বয়ে আনে। তাই আর কী! তা চলি ভাইয়া। আমার আবার আজাইরা সময় নেই গপ্প করার।’
সবুজ কাকের মুখটা তখন দেখার মত ছিল। এবার ক্রস করব আমার ক্রাশের বাসা। এই রাস্তা দিয়ে হাঁটলেও গায়ে প্রেম প্রেম হাওয়া লাগে। আমি সারা বাসায় চোখ বুলাতে বুলাতে হেঁটে যাচ্ছি। তখনিই আমার ডান পাশ থেকে একটা রুক্ষ গম্ভীর স্বর শোনা গেল। আমি ফিরে তাকালাম। ওমা! এ তো দেখি ক্রাশ মহাশয়। উনি কী এই মাত্র আমাকে ‘এই মেয়ে’ বলে ডাকলেন? ক্রাশ নারিকেল গাছের ছায়া তলে দাঁড়িয়ে আছে। আমি দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেলাম। উনি কী ডেকেছেন! কিছু বুঝতে না পেরে পরে আর পাত্তা দিলাম না। মানে মানে কে’টে পড়াই বুদ্ধিমতীর কাজ হবে এই ভেবে আমি দ্রুত গতিতে পা চালাতেই পেছন থেকে আবারও ডাক এলো,
-‘তোমাকে যে আমি ডেকেছি, শুনতে পাও নি?’
এবার আমার ভীষণ রকম হাত পা কাঁপতে থাকে। ভ’য় হয়। এই লোক আমাকে হঠাৎ কেন ডাকছে? আমি
মৃদু পায়ে হেঁটে তার সামনে গেলাম। সে বলল,
-‘পালানোর সময় তো ভালোই পা চলছিল। তা এখন এত ধীর কেন?’
আমি চুপ করেই রইলাম। আশেপাশে এখন কেউ নেই। সকাল আট টা বাজে। সবাই যার যার বাসায় আছে। তৈরি হচ্ছে নিজের কর্মসংস্থানে যাওয়ার জন্য। সবারই তাড়া। এদিকে কারো লক্ষ্য করার কথাও না।
-‘চুপ করে আছো কেন? এখন বড় বড় কথা কই গেলো? তুমি আশেপাশে কী খবর ছড়াচ্ছো? আমরা নাকি এঙ্গেইজড্? বিয়ে হবে সামনে? এ ব্যাপারে তো আমি কিছু জানিনা। কখন হলো এত কিছু?’
আমি আকাশ থেকে জমিনে পড়লাম। বদমাইশ শিহাব(সেই সিনিয়র ভাই) তবে কী এটা পাব্লিসিটি করে দিল? আর সেটা এত দ্রুত এই লোকের কানেও এসে গেল? আমি চোখ তুলে লোকটার দিকে আবারও তাকালাম। তার তী’ক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার দিকেই। আমি বললাম,
-‘ছিঃ ছিঃ এসব কী বলছেন! আমরা বিয়ে করব কেন? আপনি কত বড় মানুষ।’
-‘কত বড় মানুষ বলতে কী বোঝাতে চাইছ? আমি বুড়ো মানুষ। আর ছিঃ ছিঃ করছ! তোমার সা’হস দেখে অবাক না হয়ে পারছি না। কার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছ! জানো তো কিছু?’
-‘আপনাকে আমি বুড়ো বলিনি। আমি বলতে চাইছি আপনি হচ্ছেন একজন বড় মাপের মানুষ। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। আপনার সাথে আমার কেমনে কী!।’
-‘কেন? আমার সাথে কী কিছু হওয়া মানা নাকি?’
-‘আপনি ভুল বুঝবেন না। আমি আমার দো’ষ স্বীকার করছি। কলেজের সিনিয়র এর ঝামেলা থেকে বাঁচার জন্য কেবল বলে ফেলেছিলাম যে আমি আপনার না মানে আপনি আমার।’
-‘কীসের তুমি আমার, আমি তোমার!’
-‘স্যরি। এখানেও ভুল হলো। আপনি যা শুনেছেন সব ভুল। মাফ করবেন ভাইয়া।’
-‘কীসের ভাইয়া? কে তোমার ভাইয়া!’
-‘ওহ স্যরি স্যার। মাফ করবেন। আর এই ভুল হবে না।’
-‘কী ভুল!’
-‘মানে আপনাকে কোনো কিছুতে জড়াবো না।’
-‘জড়িয়ে তো ফেলেছ! এখন আর কী করার! বাসা কোনটা তোমার?’
-‘জি?’
-‘বাসা কোনটা? কোন বিল্ডিং এর কত নম্বর ফ্লোর?’
-‘বলছি তো ভুল হয়েছে আব্বুর কাছে বি’চার দিয়েন না। দেখা গেল আমার পড়ালেখা বন্ধ করে দিবে। বিয়ে দিয়ে দিবে।’
-‘বেশি কথা বলবে না একদম। বাসা কোনটা সেটা বলো।’
কাঁদো কাঁদো গলায় বাসার ঠিকানা দিলাম। তারপর তিনি বললেন,
-‘এই সকাল বেলা এমন সেজেগুজে কোথায় যাচ্ছো?’
-‘বান্ধবীর জন্মদিনে।’
-‘এত সকালে!’
-‘জি আমরা ঘুরতে যাব তো তাই।’
-‘কলেজ ফাঁকি দিয়ে এসব করো?’
-‘না না। আজকে বান্ধবীর জন্মদিন। বাসায় বলেছি।’
-‘কখন ফিরবে?’
এবার একটু বিরক্ত হলাম। এত প্রশ্ন কেন? আমি কী কোনো আ’সা’মি নাকি? যত্তসব।
-‘বিকেল হবে।’
-‘এত সময়!’
-‘একটু সময় তো হবেই।’
-‘ছেলে বন্ধু আছে।’
-‘জি।’
-‘কী! কয়জন?’
-‘চারজন।’
-‘মেয়ে?’
-‘চারজন।’
-‘সব প্রেমিক প্রেমিকা?’
-‘জি।’
-‘প্রেম ও করো?’
-‘ না না। আমি না।’
-‘কী তুমি না?’
-‘ মানে আমি প্রেমি করি না। আমি আর রিহান সিঙ্গেল আমাদের গ্রুপে।’
এই রোদে দাঁড়াতে আর ভালো লাগছিল না। সূর্যের তেজ বাড়ছে। সে তো ছায়াতে আরামে আছে। আমি যে ঘেমে যাচ্ছি! জানিনা সাজ ঠিক আছে কীনা!
-‘ আমি তাহলে যাই?’
-‘ধরে রেখেছি?’
-‘না না তা হবে কেন।’
-‘তবে যাচ্ছো না কেন?’
জান হাতে নিয়ে পালিয়ে আসতেই আবার ডাক এলো। আমি পেছন ফিরে বললাম,
-‘জি আর কিছু বলবেন?’
-‘তোমার নাম কী?’
-‘পত্রলেখা কবির।’
-‘বাবার নাম কী?’
-‘মির্জা ইমদাদ কবির।’
তার প্রশ্নের ধরন দেখে বললাম,
-‘আপনি কী আব্বুর কাছে বি’চা’র দিবেন!’
-‘এত কথা তোমাকে বলার তো প্রয়োজন বোধ করছিনা।’
কথাটা বলেই সে হন হন করে নিজের বাসার দিকে চলে গেল। আমার বেশ গায়ে লাগল অপমানটা! আমি তাকে কত কিছু বললাম অপ্রয়োজনে আর সে নাকি আমাকে কিছু বলার প্রয়োজন মনে করেনা? ইউএনও হয়েছে বলে মা’থা কিনে নিয়েছে? যাহ বিটকেল। তোর নাম ক্রাশের খাতা থেকে কা’ট’লাম। মনে মনে এই বলে সেদিন চলে এলাম। আত্মসম্মান আমার বরাবরই বেশি ছিল। তাই তো আমি ঐ সুদর্শন পুরুষকে সেদিনের পর থেকে ইগনোর করা শুরু করেছিলাম। সেটা ধীরে ধীরে যে আমার জন্য এতটা ভ’য়া’নক হয়ে উঠবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি।
#চলবে।
#পত্রলেখা_কোথায়_যাও? (প্রথম পর্ব)