#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১২

হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে জনসমাগম। কেউ বসে আছেন ডাক্তার দেখাবেন বলে, কেউ বা ডাক্তার দেখাতে মা, বোন বা স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। বড় বড় প্রাইভেট হাসপাতালগুলো ঝকঝকে তকতকে পরিষ্কার থাকে। কোথাও ময়লার টিকিটা ও থাকেনা।
পুষ্পকে নিয়ে প্রথমেই একজন গাইনোকলজিস্ট এর শরণাপন্ন হলো রাউফুন। পরিচিত ডাক্তারের স্ত্রী হওয়ার সুবাদে আচরণের দিকটায় আরও নম্রতা, মিষ্টিতা, কোমলতা পেলো পুষ্প।
খুঁটিনাটি প্রয়োজনীয় কিছু বিষয় সম্পর্কে অবগত হয়ে ডাক্তার হাফসা সানজিদা পরীক্ষানিরীক্ষায় গেলেন। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ আর তলপেটে অস্বাভাবিক ব্যথাটি স্বাভাবিক পিরিয়ডের ব্যথা নয়।
তিনি চেয়ার ঘুরিয়ে রাউফুনের মুখোমুখি হলেন। আপাতত পুষ্পকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। প্রয়োজনীয় কথাবার্তা গুলো রাউফুনের সঙ্গেই সেরে নিচ্ছেন ডাক্তার হাফসা সানজিদা। দুহাত মুঠোবন্দী করে কনুইয়ে ভর করে হাতদুটো টেবিলে রাখলেন। সরাসরি চূড়ান্ত কথায় পৌঁছাতেই বললেন,

-“ডঃ রাউফুন আপনার ওয়াইফের মিসক্যারেজ হয়েছে। অনেকসময় মিসক্যারেজ হওয়ার যথাযথ কারণগুলো আমরা নির্ণয় করতে পারিনা। আপনার স্ত্রীর ব্যাপারটিও তেমন। আপনি একজন ডঃ। তাই আমার কথাগুলো আপনার বোঝার কথা।
অনেকগুলো কারণেই মিসক্যারেজ হতে পারে। তার মধ্যে কিছু কারণ হিসেবে আমরা যেসকল কারণকে প্রাধান্য দিই সেগুলো হলো,
বাচ্চার জন্মগত ত্রুটি- যেমন গর্ভধারণের সময় ভ্রূণ যদি অনেক বেশি অথবা কম ক্রোমোজম পায়, তখন ভ্রূণ ঠিকমতো তৈরি হয়না। ফলে মিসক্যারেজ হয়ে যায়। আবার মায়ের শরীর থেকে বাচ্চার শরীরে রক্ত সরবরাহ হওয়ার মাধ্যমে কোনো ত্রুটি থাকলেও মিসক্যারেজ হয়। অনেকসময় জরায়ুর ত্রুটি, অস্বাভাবিক আকৃতির কারণে বাচ্চা বেড়ে উঠতে না পেরে মিসক্যারেজ হয়।

তাছাড়াও মায়ের অসুস্থতা-যেমন কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস, ব্লাড প্রেসার, বিভিন্ন ইনফেকশন থাকলে কিংবা মা যদি অতিরিক্ত পরিশ্রম ও অতিরিক্ত ভ্রমন করে থাকেন, তবে সে ক্ষেত্রে মিসক্যারেজ হতে পারে।

গর্ভকালীন সময়ে অনেক মায়েরই বিভিন্ন জিনিস খেতে ইচ্ছে করে। অনেকের মলম কিংবা সিগারেট ও খেতে ইচ্ছে করে। হাস্যকর হলেও সত্যি। এই ধরনের ব্যাপারগুলো থেকে অবশ্যই দূরে থাকা উচিত। সিগা’রেট, ম’দ্যপান, ক্যাফেইন গ্রহন, এন্টিবায়োটিক ঔষধ ব্যবহারে মিসক্যারেজ হতে পারে।
তাই বিবাহের পরবর্তী সময়ে পিরিয়ড মিস গেলে অবশ্যই সতর্কতা মেনে চলা উচিত। আপনাদের পরবর্তী সন্তান নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আপনারা যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ দেখে কালই নিয়ে আসতেন, তাহলে আমাদের চেষ্টা করার কিছু থাকতো।”

রাউফুন মনযোগ দিয়ে ডঃ এর কথা শ্রবণ করলো। ভেতর থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে সন্তানটির বাবা। না চাইতেও একটা খারাপ লাগা তাকে ঘিরে ধরেছে। যদিও ডাক্তারদের সবরকম পরিস্থিতিতে শক্ত হওয়া মানায়। তবুও ডাক্তারি পেশার বাইরে সম্পর্কগুলো কি বাঁধা মানে? সুপ্ত অনুভূতি গুলো কি গোপন করা যায়?
রাউফুন সবকিছু বুঝে নিয়ে পুষ্পকে রাখা কেবিনের পর্দা ঠে’লে ভেতরে প্রবেশ করলো। আজ আর রোগী দেখবেনা।
সুদীর্ঘ আখিজোড়া নিদ্রায় আচ্ছন্ন, হাতে ক্যানুলা ফিট করা। রক্তক্ষরণের ফলে গায়ের চামড়া শুভ্র হয়ে উঠলো। মলিন চোয়ালে মায়া মায়া ভাব। কাউকে তীব্রভাবে ভালোবাসলে তার সকল কিছুতেই মায়া খুঁজে পাওয়া যায়, হুটহাট তার যেকোনো রূপে প্রেমে পড়া যায়। এই মুহূর্তে রাউফুনের মনে তীব্র বাসনা জাগলো। ইচ্ছে করছে এই রোগা, জীর্ণ শরীরের অধিকারিণীকে তীব্র উৎকন্ঠায় বুকের সাথে মিশিয়ে নিতে। শুকনো মুখশ্রী উষ্ণ চুম্বনে ছুঁয়ে দিতে। বিনিময়ে তার অধর সুধার ছোঁয়া ললাটে স্থান করে নিতে।
রাউফুন মাকে ফোন করে ছোট করেই পুষ্পর মিসক্যারেজের ব্যাপারটা জানিয়ে দিলো। কিন্তু তিনি যে হাহুতাশ করে হসপিটালে পৌঁছে যাবেন, সেটা কে জানতো?

রোকসানা ছেলেকে ফোন করে কেবিন নাম্বার জেনে সোজা চলে এসেছেন। তিনি আরও একটি কাজ করলেন, পুষ্পর বাবার বাড়িতে খবর পাঠিয়ে দিলেন। তাদের তো মেয়ে। মেয়ের ভালোমন্দ খবর জানার অধিকার তাদেরও আছে। রাউফুন চাইছিলোনা সবাইকে টেনশন দিতে। ব্যাপারটা এখন জানানোতে সবাই যতটা প্যানিক করবে, হাসপাতালে এসে হৈচৈ করবে? পরে শুনলে ততটা হৈচৈ হতোনা। ঠান্ডামাথায় সব সামলে ওঠা যেতো। রাউফুনের মায়ের সাথে সাথে পুষ্পর বাড়ি থেকেও চাচা-চাচি সহ পুষ্পর মা ও এসেছেন। তার দাদুকে কেউ নিয়ে আসেনি। তিনি বসে বসে কান্নাকাটি করছেন আর নাতনির জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া চাইছেন। এরমাঝে খতম পড়ার নিয়ত করে ফেলেছেন।
আমরা বৃদ্ধ মানুষগুলোকে যতই অবহেলা করিনা কেনো, বিনিময়ে তারা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে যায়। সবসময় তাদের দোয়া আমাদের উপর লেগে থাকে। রেহানা খালাকে দাদুর কাছেই রেখে আসা হয়েছে। উনিও চেয়েছিলেন আসার জন্য। কিন্তু নিয়ে আসা হয়নি।

সবাই পুষ্পকে দেখে শান্তনা বানী শুনিয়ে যাওয়ার শেষ সময়ে পুষ্পর মা পাশে বসলেন। দুহাতের মুঠোয় শক্ত করে তার হাত চেপে নিয়ে কন্ঠস্বর খাটো করে কোমল গলায় বললেন,
-“আমি তোমার মা হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু পারিনি। তুমি হয়তো নিজের মায়ের জায়গা আমায় দিতে পারোনি। কিন্তু আমি মন থেকেই তোমায় সন্তানের জায়গায় আসন দিয়েছি। শুধু তোমার মা হতে পারবো বলে তোমার বাবার শর্তে আমি রাজি হয়ে যাই। নিজে কখনো গর্ভে সন্তান ধারণ করার কথা ভাবিনি। আমি জানি আমার একটি মেয়ে আছে। আমি তার মা নই, কিন্তু সে আমার মেয়ে। আমি আল্লাহর কাছে তোমার সর্বোচ্চ সুখ কামনা করি। তুমি দুচোখ মেলে সুখকে বরণ করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমায় উত্তম প্রতিদান দেবেন।”

পুষ্পর মা সন্তর্পণে ভেজা চোখজোড়া লুকিয়ে নিলেন। পৃথিবীতে হাজারো সুখী মানুষ অন্তরে দুঃখকে পুঁজি করে রাখে। তারমধ্যে পুষ্পর মা একজন। তিনি কোনো দো’ষ না করেও মাতৃত্বের স্বাদ নেওয়া থেকে বঞ্চিত। নামেমাত্র একটা সাংসারিক বেড়াজালে আবদ্ধ থাকলেও তিনি নিজেকে সুখী দাবী করতে পারেননা। নিজের স্বামীর কাছে কখনো মন খুলে ইচ্ছের কথা জানানোর সাহস পাননা। তিনি প্রথম স্ত্রী হারিয়ে নির্দয়, কঠিন মানবে পরিণত হয়েছেন। শুধু নিজের দিকটাই দেখলেন, কিন্তু পুষ্পর মায়ের দিকটা দেখলেননা, নিজের মেয়ের দিকটা দেখলেননা।

পুষ্পর আজ নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে। ঢোক গলাধঃকরণ করে নিচুশব্দে শুধালো,
-“আমি সারাজীবন নিজের কাছে অপরাধী থাকবো। তোমার জীবনটা ভিন্ন হতে পারতো। তুমি একটি সুখী জীবন পেতে পারতে। আমার জন্যই তোমাকে এই সংসারে নিয়ে আসা, অথচ আমার কাছ থেকেই তুমি সামন্যতম গুরুত্ব পাওনি। বিশ্বাস করো তোমার প্রতি আমার কেনো অভিযোগ নেই। শুধু আমার মায়ের জায়গায় আমি তোমাকে বসাতে পারিনি। আমাদের সম্পর্কটি আরও সুন্দর হতে পারতো। যদি বাবা আমাদের দুজনকেই কাছে টানতো।”

পুষ্পর মা তার চুলের ভাঁজে হাত গলিয়ে বললেন,
-“এখনও তো সময় আছে। আমি তোমার মা আছি।”

পুষ্প চোখ বুঁজলো। নেত্রজোড়ার ধার ঘেষে নোনাজল গড়িয়ে পড়লো।

সবাই বেরিয়ে গেলো। পুষ্পর মাথার কাছে টুল নিয়ে বসলো রাউফুন। ডানহাতে পুষ্পর জীর্ণ হাতখানা ধরে অপরহাত চুলের ভাঁজে রাখলো।
পুষ্প নেত্রপল্লব খুললো। রাউফুনের মুখের দিকে কিছুসময় তাকিয়ে শব্দহীন ভাবে শরীর কাঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাউফুন শক্ত থেকে পুষ্পকে সামলে চললো। তার কন্ঠস্বর কখনো রূঢ় নয়। সর্বদাই সে কোমলতার সহিত কথা বলতে পছন্দ করে। কন্ঠস্বর খাদে নামিয়ে একটু খানি ভালোবাসা, একটুখানি আদর ঢেলে দিলো গলায়। কোমলতা,নম্রতা, ভালোবাসার মিশ্রণের শুধুলো,

-“আমার সুখসয্যা সঙ্গিনী, বৃদ্ধ বয়সের সাথী, আমার প্রিয় নারী, বিষাদ মুহূর্তে একটুখানি সুখের কারণ তুমি। জীবনে ভেঙে পড়া মানায়না। আমাদের জীবনটা শেষ হয়ে যায়নি, চাওয়া-পাওয়া গুলো পূরণ হওয়ার জন্য প্রচুর সময় রয়েছে।
জীবনটাকে উপভোগ করো। জীবন উপভোগ বলতে আমরা আনন্দ আর সুখকে বুঝি। জীবনের কিছু কিছু সময় আল্লাহ আমাদের পরীক্ষায় ফেলে জীবনকে উপভোগ করতে শেখায়। মূলত সুখ হলো দুঃখের বিপরীত একটা সুন্দর সংজ্ঞা। দুঃখ না থাকলে সুখ উপলব্ধি করা যায়না। জীবনের স্বাদ আস্বাদন করতে হলে সুখের সাথে দুঃখকেও বরণ করে নিতে হয়। জীবন তখনই উপভোগ করা যায়, যখন সুখের সাথে সাথে দুঃখের ও স্বাদ নেওয়া যায়।
আমি চাইনা তুমি কঠিন হয়ে যাও। আমি চাই তুমি নিজের মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রেখে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে শেখো।”

পুষ্প রাউফুনের হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁইয়ে ধরা গলায় বলল,
-“এতবার কেনো আল্লাহ আমায় পরীক্ষায় ফেলেন? জানেন? আমার মা বলে যাকে জানেন, তিনি আমার বাবার দ্বিতীয় স্ত্রী। আমার মা আমার ছোটবেলায় মা’রা যান। বাবাকে কাছে পাইনি, এই পর্যায়ে এসে মাতৃত্বের স্বাদ পাওয়ার আগেই হারিয়ে বসলাম। কিছুই কি আমার নেই?”

রাউফুন যতনে পুষ্পর হাত বুকের সাথে মিশিয়ে পুষ্পর ললাটে গভীর চুমু খেয়ে বলল,
-“আছি, তোমার আমি আছি। এই মানুষটা একান্ত তোমার, কেবল তোমার ব্যক্তিগত মানুষ।”

পুষ্প ভীষণ আদরে গুটিয়ে গেলো, নিজেকে মিইয়ে নিয়ে একটুখানি সান্নিধ্য পাওয়ার আশায় রাউফুনের দিকে ঝুঁকে গেলো।
রাউফুন মৃদু হেসে বলল,
-“এটা হসপিটাল। বাড়িতে গেলে নিজের প্রাপ্যটা বুঝে নিও।”

পুষ্প মুখ ভার করে বলল,
-“বাড়ি ফিরবো কখন?”

এ পর্যায়ে রাউফুন শব্দ করেই হাসলো।
#চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here