#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_১০
ভড়কে গেলো রাউফুন। বিষ্ময়ভাব না কাটাতেই আচমকা আক্রমণে তাল সামলাতে পারলোনা।
পুষ্প কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌঁড়ে এসে রাউফুনকে জড়িয়ে ধরলো। ধাক্কা সামলাতে না পেরে রাউফুন খাটে পড়ে ভর্তা হয়ে গেলো। পুষ্প ছাড়লোনা। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“ডাক্তার প্লিজ আর রাগ করে থাকবেননা।”
রাউফুন জোরে শ্বাস নিয়ে বলল,
-“আগে ছাড়ো।”
পুষ্প ছাড়লোনা, বরং হাতের বাঁধন আরেকটু শক্ত করে বলল,
-“না ছাড়বোনা। আগে বলুন আপনি রাগ করে নেই।”
রাউফুন মজার ছলে বলল,
-“কি সাংঘাতিক! কি সাংঘাতিক পুষ্প। শশুর আব্বাকে কিভাবে বলি তার মেয়ে আমাকে ছাড়া বাঁচবেনা।”
পুষ্প মেকি রাগ দেখিয়ে বলল,
-“আপনাকে এত কথা তো বলতে বলিনি। আপনি আগে বলুন আমার উপর রাগ করে নেই।”
রাউফুন বলল,
-“আগে তো আমাকে ছাড়ো। ঘামে ভিজে আছে শরীর। আর বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে দুর্গন্ধ ছড়াবে। ফ্রেশ হতে দাও আগে।”
পুষ্প সরে বসলো। রাউফুন বড় বড় শ্বাস নেওয়ার ভঙ্গিতে উপরে দুহাত তুলে বলল,
-“আজ বড় বাঁচা বেঁচে গিয়েছি। আল্লাহ রক্ষা করেছেন। এক্ষুণি বুকে পাথর চাপা পড়ে মা’রা যেতাম।”
পুষ্পর তীক্ষ্ণ চাহনি নজরে পড়তেই রাউফুন ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো। খাটের উপর বসে পা দোলাতে দোলাতে রাউফুনের অপেক্ষা করলো পুষ্প। এই ঘরটা দেখার মতো আর কিছুই নেই। আজ বিকেল থেকেই ঘরটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা শেষ।
একেবারে গোসল নিয়েই বের হলো রাউফুন। চুলে তোয়ালে চালাতে চালাতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি ব্যাপার বলোতো? তুমি একেবারে শশুর বাড়ি। কাহিনি কী?”
পুষ্প ভাব নিয়ে বলল,
-“আমার শশুর বাড়ি আমি কখন আসবো, কখন আসবোনা সেটা জানার আপনি কে?”
রাউফুন কিছু বুঝে ফেলার ভঙ্গিতে ঈষৎ চোখ বড় করে বলল,
-“ওওওওহ্, আমি তো ভুলেই গিয়েছি। এটা আপনার শশুর বাড়ি। তবে কৃপা করে যদি এই অধমকে কাহিনীটি বুঝিয়ে বলতেন, তাহলে বড়ই উপকৃত হতাম।”
পুষ্প বলল,
-“আপনি উপকৃত হলে আমার কী লাভ?”
রাউফুন কিছু একটা ভেবে বলল,
-“এই ধরুন, আপনার উপর আর রাগ করে থাকলামনা।”
পুষ্প ফটাফট মুখ খুললো,
-“আজ আঙ্কেল, আন্টি, রিশা গিয়ে আমাকে নিয়ে এসেছে। পরে রিসিপশন অনুষ্ঠান করা যাবে। তবে আপনাকে জানানো বারণ ছিলো।”
রাউফুন কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-“নিশ্চয়ই এই বুদ্ধি আপনার আর আপনার ননদিনীর।”
পুষ্প ঠোঁট টিপে হাসি থামানোর চেষ্টা করে অন্যদিকে ফিরে গেলো।
রাউফুন মিটিমিটি হেসে পুষ্পর গালে চুমু দিয়ে বসলো। পুষ্প দুহাতে মুখ ঢেকে বলল,
-“খেতে আসুন। আন্টি বলে দিয়েছে আপনি আসলে খাবার দিতে।”
রাউফুন মাথা দুলিয়ে পুষ্পর পিছুপিছু ডাইনিং এ গেলো। খাবার সব বেড়ে রাখাই আছে। রাউফুন হাত ধুয়ে বসে পড়লো। পাশের চেয়ার টে’নে পুষ্পকে ইশারা করলো বসে পড়তে।
পুষ্প আমতা আমতা করে বলল,
-“আপনি খেয়ে নিন। আমি ও এই তো বসছি।”
রাউফুন বলল,
-“দুটো প্লেটের দরকার নেই। পাশে বসো, আমি খাইয়ে দিচ্ছি। এটা শুধু গতকাল রাতে একটু কষ্ট দেওয়ার জন্য পুষিয়ে দিচ্ছি।”
পুষ্প একটি খাবারের প্লেট ঢেকে রাখলো। একই প্লেটে ভোজন শেষে দুজন ঘরে গেলো। রাউফুন একটু রোমান্টিক মুডে আছে। তখনই ঘরে প্রবেশ করলো নাবিল। খাটের মাঝখানে বসে বলল,
-“আপু, আমি তুমি আর দুলাভাইয়ার মাঝখানে ঘুমাবো।”
রাউফুন হতবিহ্বল চাহনি নিক্ষেপ করে বলল,
-“এ আবার কোথা থেকে উদয় হলো?”
-“ও আমার সাথেই এসেছে।”
পুষ্পের কথা শেষ হতে না হতেই নাবিল বলল,
-“বালিশ দাও, রিশা আপুর সাথে ঘুমাবোনা। সে আমাকে লজ্জা কথা বলে।”
রাউফুন বলল,
-“তুমি না বড় হয়ে রিশাকে বিয়ে করবে? একটু লজ্জা কথা বললে কিছু হবেনা।”
নাবিল যাবেনা বলে জেদ ধরে রইলো। রাউফুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে বলল,
-“শালাবাবু আসার আর সময় পেলোনা। শেষমেষ আমার মুডের বারোটা বাজাতে তাকে এখনই আসতে হলো।”
রিশা রুমে ঢুকে বলল,
-“নাবিল জামাই আসো, আসো। এতো রাগ করলে তো হবেনা। চলো আপু আর দুলাভাইয়াকে ডিসটার্ব করা একদম উচিত নয়।”
নাবিল মুখ ঝামটা মে’রে পুষ্পর পেছনে লুকিয়ে বলল,
-“তোমার সাথে যাবোনা। তুমি আমাকে লজ্জা কথা বলো। আমি তোমাকে বিয়ে করবোনা।”
পুষ্প রিশাকে পাঠিয়ে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বলল,
-“আচ্ছা, ও ঘুমাক আমাদের কাছে।”
রিশা ভাইয়ের অসহায় চেহারায় নজর দিলো। রাউফুন ইশারায় বোঝালো “যা বোন, আমার কপালে এটাই লিখা ছিলো”।
রিশা চলে গেলো। মাঝখানে বালিশ দিয়ে নাবিল শুলো। দুপাশে রাউফুন আর পুষ্প। সকালে ঘুম ভাঙতেই পুষ্প নিজেকে আবিষ্কার করলো রাউফুনের পিঠে মাথা দেওয়া অবস্থায়। রাউফুন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে, নাবিলের মাথা বিপরীত দিকে, পা পুষ্পর উপর। সকাল সকাল নিজেদের এই অবস্থা দেখে পুষ্প ধরেই নিলো রাতে এমন ওলটপালট হওয়ার সম্পূর্ণ দোষ নাবিল আর রাউফুনের। কারণ সেতো রাতে ওলটপালট হয়ে ঘুমায়না।
★★★
রাতে খাবার টেবিলে সবাই একত্র হয়েছে। রাউফুনের দাদি মেজো ছেলের কাছে গ্রামে ছিলেন কিছুদিন। এখন বড় ছেলের কাছে ঢাকা এসেছেন, কিছুদিন পর আবার ছোট ছেলে, আবার মেয়ের কাছে এভাবেই সব ছেলেমেয়ের কাছে ঘুরে ফিরে থাকছেন। নাতবউ তার পছন্দ হয়েছে। তবে খাবার টেবিলে একবার বেশ হুম’কি দিলেন, বাচ্চাকাচ্ছা নিয়ে নিতে। নয়তো নাতিকে আরেকটা বিয়ে করিয়ে ফেলবেন।
রাউফুন চুপচাপ খাবার গিলছে। সে ভাবলেশহীন, যেনো কিছুই তার কানে পৌঁছায়নি। পুষ্প কটমট দৃষ্টিতে তাকালো রাউফুন আর দাদী-শাশুড়ির দিকে। মনে মনে দাঁত দিয়ে দুজনের হাড় মাংশ চিবিয়ে খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে।
খাবার শেষ করেই দাদি পুষ্পকে ডেকে বসলেন নিজের ঘরে। পুষ্প খাওয়া শেষ করেই দাদির ঘরে গেলো। তিনি পাশে ইশারা করে বললেন,
-” বসো।”
পুষ্প বিনা বাক্যব্যয়ে পাশে বসে পড়লো। দাদি নরম সুরে বলল,
-“শুনো বু তুমি আমার কথায় রাগ হইওনা। তোমরাতো বাচ্চার কথা কইলেই রাগ হও। সংসার তোমগো, বাচ্চা ও তোমগো, তবে জামাইরে আঁচলে বাইন্ধা রাখবা। দরকার হইলে কাঁঠালের আঠা দিয়ে আটকাইয়া রাখবা। কোনোমতেই যেনো আঁচল ছিঁইড়া যাইতে না পারে।”
রাউফুন হাত তালি দিতে দিতে ভেতরে প্রবেশ করে বলল,
-“বাহ্ দাদি! বাহ্! তুমিতো দিখছি সাংঘাতিক চিটারি করছো। চোরকে বলছো চুরি কর, গেরস্তকে বলছো সজাগ থাক। এদিকে আমার বিয়ে দিচ্ছো, আবার তাকে আঁচলে বাঁধা ও শিখিয়ে দিচ্ছো। আমার আর বিয়ে করা হলোনা।”
পুষ্প রোষানল দৃষ্টি মেলে বলল,
-“বিয়ে করা ছুটাচ্ছি।”
রাউফুন ভ’য় পাওয়ার ভান করে বলল,
-“দাদি তুমি আমার কি সর্বনাশটাই না করলে। আজ রাতে আমায় খাটের বাইরে ছুঁড়ে মারবে। শুধু একটা হাঁচিই আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।”
-“আমি সারাজীবন হেঁচে যাবো, তাতে কার কি সমস্যা? আমি কি বলেছি নাকি আমাকে বিয়ে করুন।”
রাউফুন আড়চোখে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসলো। দাদি দুজনের কান্ডকারখানা দেখে ঠোঁট টিপে হাসছেন। পুষ্প দপদপ পা ফেলে বেরিয়ে গেলো।
রাউফুন দাদির সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে নিজেও ঘরে ফিরলো।
এসেই দেখলো তার জনাবা খাটের শেষ প্রান্তে উল্টো হয়ে শুয়ে আছে। এ ধারে জীবনেও গা ঘেষতে আসবেনা। রাউফুন আস্তে আস্তে কাছে ভীড়লো, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরতেই ঝাঁঝালো সুর কানে বাজলো,
-“একদম কোনো কথা নেই আপনার সাথে। আমিতো হাঁচতে হাঁচতে দিনপার করি, যান একটা ভালোমেয়ে দেখে বিয়ে করুন।”
রাউফুন বলল,
-“সে কি? আমি বিয়ে করলে তুমি রাগ করবেনা?”
পুষ্প ফোঁস করে শ্বাস ফেলে রাউফুনের দিকে ঘুরলো। শক্ত চোয়ালে বলল,
-“কাল সকালে গিয়েই রাম’দার অর্ডার দেবো।”
রাউফুন শব্দ করে হেসে নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে বলল,
-“এখন থেকে পিঠে ট্যাগ লাগিয়ে ঘুরতে হবে, “আমার একটা জল্লা’দ বউ আছে, মেয়েরা আমার থেকে দূরে থাকুন।”
এ পর্যায়ে পুষ্প নিজেও হেসে দিলো।
★★★
শরৎ এর স্নিগ্ধ, কোমল প্রকৃতি। মেঘমুক্ত আকাশে শিমুল তুলোর মতো শুভ্র মেঘের ভেলা।দূর্বাঘাস ভিজে ওঠে শিশিরবিন্দুর ছোঁযায়। দূর থেকে শিউলি ফুলের সুভাস ভেসে আসে। ইদানীং পুষ্পর সময়গুলো বেশ আনন্দে কাটে। সারাদিন শাশুড়ী, ননদ, শশুর এদের সাথেই সময় কাটে, রাত হলেই রাউফুনের সাথে খুনসুটিতে মেতে থাকে। শুক্রবার দুজনে মিলে ঘোরাঘুরি করে, মাঝেমধ্যে রাতে লং ড্রাইভে বের হয়।
পুষ্প রান্নাঘরে ঢুকেই বলল,
-“মা তুমি কিন্তু আমাকে মে’রেধরে রান্না শেখাবে। আমি কিন্তু কিছুই শিখে আসিনি।”
পুষ্প প্রথম প্রথম আঙ্কেল-আন্টি বললেও এখন মা বাবা বলে ডাকে। রাউফুনের বাবা মা রাগ হন আঙ্কেল-আন্টি ডাকলে।
রাউফুনের মা রোকসানা বললেন,
-“পাশে দাঁড়িয়ে দেখতে থাক। দেখতে দেখতেই শিখে যাবি। রিশাকেও আমি রান্না শেখাতে পারিনি। ওকে ওর শাশুড়ীই শেখাক।”
বিকেলে সোফায় শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন রেসিপি দেখছিলো পুষ্প। রোকসানা জিজ্ঞেস করলো,
-“কি দেখছিস?”
পুষ্প বলল,
-“রেসিপি দেখছি। আজ বিকেলের নাস্তা আমি বানাবো। তুমি রেস্ট করো।”
সন্ধ্যায় রোকসানার ডাকে ঘুম ভাঙলো পুষ্পর। ঘুম থেকে উঠেই বলল,
-“বিকেল কি শেষ?”
রোকসানা মৃদু হেসে বলল,
-“ফ্রেশ হয়ে আয়। এখন সন্ধ্যা।”
পুষ্প লজ্জায় দাঁতে জিহবা কা’টলো। ওর বিকেলের নাস্তা বানানোর কথা ছিলো, অথচ রেসিপি দেখতে দেখতে সে নিজেই সোফাতে ঘুম রেসিপি হয়ে গিয়েছে।
#চলবে………