#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা
#পর্ব_০৭
ঘর ছেড়ে বের হলোনা পুষ্প। রাতের খাবারের জন্য সবাই ডাকাডাকি করলেও বের হলোনা। শেষে একবার অপ্রত্যাশিত আগন্তুক গমগমে স্বরে ডাকলেন,
-“পুষ্প মামনী খেতে আসো। রাতে না খেয়ে ঘুমানো ভালো না।”
পুষ্প প্রতিত্তোরে কিছুই বললোনা, আর না দরজা খুললো। থম ধরেই বসে রইলো। এত আদিখ্যেতা সহ্য হচ্ছেনা। যখন সান্নিধ্য চেয়েছিলো তখন তো কাছে আসেনি, এখন কেনো এতটা মায়া দেখাচ্ছে? শুধু টাকা খরচ করলেই বাবার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়না। একটা সন্তান সমস্ত সুযোগসুবিধা পাওয়ার পাশাপাশি বাবার কাছে আরও একটা জিনিস চায়, “ভালোবাসা”।
আর সেই ভালোবাসা নামক জিনিসটি পুষ্প পায়নি। বাদ বাকি পরিবারের সবার কাছ থেকে সে ভালোবাসা পেয়েছে। দাদি, চাচা-চাচি সবাই। পরিবারের একমাত্র মেয়ে হওয়ার সুবাদে চাচাদের কাছ থেকেও কম ভালোবাসা পায়নি। বড় চাচা তার আলাদা বাসায় থাকলেও আদর কমেনি।
ছোটবেলায় মাকে হারানোর পর থেকেই পুষ্প কাঁদেনা। খুব ব্যথা পেলে চোখমুখ কুঁচকে নেবে, কিন্তু চোখ দিয়ে দু’ফোটা অশ্রু ঝরেনা। কার জন্য কাঁদবে? পাষাণ মানুষটার জন্য?
পুষ্প ভেবে রেখেছে সে আবারও কাঁদবে। কোনো একদিন নিজের আপন মানুষের যন্ত্রণায় ছটফট করবে, হাউমাউ করে কাঁদবে। কিন্তু এই পাষণ্ড পিতার জন্য কাঁদবেনা।
পুষ্প যখন ছোট ছিলো, তখন তার বাবা পরনারীতে আসক্ত হয়। পুষ্পর মা একদিন ছাদ থেকে অসাবধানতা বশত পড়ে গিয়ে মৃ’ত্যু হয়। পুষ্পর মাঝেমাঝে সন্দেহ হয় তার মা কি সত্যিই পা পিছলে পড়েছিলো? নাকি স্ব-ইচ্ছায় নিজের জীবনটুকু জলাঞ্জলি দিলো। পুষ্পর খুব ব্যথা লাগে, যখন ভাবে মা তার কথাটা ভাবলোনা? তাকে ফে’লে কিভাবে যেতে পারলো?
বাবা অবশ্য শেষ মুহূর্তে এসে সুপথে এসেছেন। কিন্তু ততদিনে মা পৃথিবী ছাড়লো।
মাকে হারানোর পর পুষ্প বাবার সঙ্গ চাইতো, কিন্তু বাবা তাকে কাছে টে’নে নিতোনা। পুষ্প বাবার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে কাঁদতো। তখন দাদি বা চাচি এসে তাকে কোলে তুলে নিয়ে যেতো।
কিছুদিন পরই বাবা আবার বিয়ে করলেন। তবে তাকে নয়, যার রূপের মায়ায় পড়ে পুষ্পর মাকে অবহেলা করেছেন। বিয়ে করলেন ভিন্ন এক নারীকে। যিনি পুষ্পর দেখাশোনা করবেন, মায়ের ভালোবাসা দেবেন। এই নারীটি হলো সে, যাকে এখন সবাই পুষ্পর মা হিসেবে জানে।
তিনি প্রথম প্রথম পুষ্পকে কাছে টা’নতে চাইলেও পুষ্প ভয়ে এগোতো না। সম্পূর্ণ অচেনা এই নারীর কাছ ঘেষতোনা। এরপর থেকে তিনিও পুষ্পকে কাছেও টানেননা আবার অবহেলা ও করেননা। বলতে গেলে বাবা-মায়ের ভালোবাসা বিহীন গড়ে উঠেছে পুষ্প নামক মেয়েটি।
একদিন বাবাই ভালোবেসে তার নাম দিয়েছিলো পুষ্প। অথচ এতগুলো বছর অযত্নে পুষ্পটি কেমন নেতিয়ে গেছে সেটা বাবা খেয়াল করেনি। এই ফুলের সুভাস নেই, কোমলতা নেই, আছে একরাশ অভিমান।
বাবার ডাকে সাড়া না দিয়ে পুষ্প বসে রইলো। জাহাজের ক্যাপ্টেন বাবা। কি আশ্চর্য! তিনি পুষ্পর বিয়েতেও ছিলেননা। অথচ সবাইকে বলেছিলেন তিনি পুষ্পর বিয়েতে আসবেন, কিন্তু পরমুহূর্তে ফোন করে জানালেন তিনি কাজে আটকা পড়েছেন।
নাবিলের বাবা বললেন,
-“পুষ্প মা, খেতে আয়। একসাথে সবাই খাবো। আমার কিন্তু খুব ক্ষুধা পেয়েছে। তুই না খেলে কিন্তু কেউ খাবেনা।”
এই পর্যায়ে এসে মুখ খুললো পুষ্প। কঠিন গলায় বলল,
-“আমার খেতে ইচ্ছে করছেনা। তোমারা খেয়ে নাও। আর যার ক্ষুধা পাবেনা সে খাবেনা। আমাকে জোর করোনাতো। যখন ক্ষুধা লাগবে আমি খেয়ে নেবো।”
সবাই হতাশ হলো। মীর হোসেন বাড়ি আসলেই মেয়েটা সবার সাথে তেমন খেতে বসেনা। বাবার সাথে কথা বলতে চায়না। মীর হোসেন কখনো জোর দিয়ে কিছু বললে দু’এক শব্দে উত্তর দিয়ে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলে।
সবাই খেতে বসে পড়লো। পুষ্পর মা ওর জন্য আলাদা খাবার ফ্রিজে রেখে দিলেন। রাতে ক্ষুধা পেলে খেয়ে নিবে।
★★★
রাত দশটার পর ব্যস্ততা শেষে ফোন তীব্র শব্দে ঝংকার তুললো। ‘ডাক্তার’ শব্দটি ভেসে উঠতেই সমস্ত গ্লানি দূর হয়ে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফোটে উঠলো।
রাউফুন ভিডিয়ো কল দিয়েছে।
পুষ্প রিসিভ করেই একটুকরো হাসি উপহার দিলো। সালাম বিনিময়ের পর রাউফুন জিজ্ঞেস করলো,
-“কি করছো?”
পুষ্প বলল,
-“মিস করছি।”
রাউফুন শব্দ করে হেসে বলল,
-“বউ দেখি আমাকে চোখে হারাচ্ছে। কিন্তু এখন তো আসতে পারবোনা।”
পুষ্প মন খারাপ করে বলল,
-“থাক কষ্ট করে আসতে হবেনা।”
আজ পুষ্পর চেহারা কেমন শুকনো শুকনো লাগছে। রাউফুন বলল,
-“এমন দেখাচ্ছে কেনো? মন খারাপ হচ্ছে?”
পুষ্প মাথা দুলিয়ে না জানাতেই রাউফুন ফের বলল,
-“কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে তোমার মন খারাপ। খেয়েছো রাতে?”
মিথ্যে বললোনা পুষ্প। বলল,
-“নাহ্! খেতে ইচ্ছে করেনি।”
রাউফুন চোখ রাঙিয়ে বলল,
-“খাবার না খেয়ে একদম ঘুমাবেনা। খেয়ে ঔষধ নিয়ে নাকে স্প্রে করে তারপর ঘুমাবে।”
পুষ্প বাধ্য মেয়ের মতো বলল,
-“আচ্ছা।”
রাউফুন বলল,
-“এখানে খাবার নিয়ে এসো। খেতে খেতেই কথা বলো। পরে দেখা গেলো একা একা তোমার খেতে ইচ্ছে করছেনা।”
পুষ্প দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
-“আনছি।”
ফোন হাতে নিয়েই ফ্রিজ খুললো পুষ্প। খাবার গরম করে ঘরে ফিরে ভিডিয়ো কল সামনে রেখেই খাবার শেষ করলো। মাঝে এটা ওটা বলে রাউফুন হাসিয়েছে। অনেকরাত পর্যন্ত কথা বলে দুজনে ঘুমাতে গেলো।
রাউফুন বেশ কয়েকবার মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করলেও পুষ্প ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলো। নিজেদের পারিবারিক কলহ স্বামীকে জানানো সমীচীন মনে করলোনা সে। যা আছে, তা কেবল তাদের বাবা-মেয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকুক। রাউফুনকে সে নিজের হাসিখুশি রূপ দেখাতে চায়।
সকালে ঘুম ভাঙতেই আশ্চর্য হলো পুষ্প। সকাল সকাল রাউফুন এ বাড়িতে এসেছে। সোফায় বসে তার বাবার সাথে কথা বলছে। শশুর-জামাইয়ের এই প্রথম দেখা। পুষ্পর মা কফি বানিয়ে দিয়ে গেছেন। দুজনেই কফিতে চুমুক দিচ্ছে আর খোশগল্প করছে। পুষ্প এগিয়ে যেতেই মীর হোসেন বললেন,
-“ঘুম ভেঙে গেছে মামনী?”
রাউফুনের সামনে নিজের অভিমানটুকু প্রকাশ পেতে দিলোনা পুষ্প। মাথা নেড়ে জানালো তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
নাস্তা করে এক ফাঁকে রাউফুন পুষ্পর ঘরে গেলো। সে খেয়াল করেছে গতকাল রাতে, তার বউ কোনকিছু নিয়ে আপসেট ছিলো। তাই তাকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যই সকাল সকাল শশুর বাড়িতে পদধূলি দিতে এসেছে। এখান থেকে আবার হসপিটালে ছুটতে হবে।
বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলো পুষ্প। পেছন থেকেই দুটো বলিষ্ঠ হাত তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরলো। ঘাবড়ালোনা সে। এই মুহূর্তে এই ঘরে কে আসতে পারে তা পুষ্পর জানা কথা। রাউফুন ঘাড়ে থুতনি রেখে বলল,
-“মন খারাপ কেনো? কি হয়েছে বলোতো?”
পুষ্প সামনে ঘুরে দুহাতে রাউফুনের গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
-“কোথায় মন খারাপ? কিছু হয়নি। আমি ঠিক আছি।”
রাউফুন চোখ ঈষৎ বড় করে বলল,
-“কী সাংঘাতিক! কী সাংঘাতিক! তুমি দেখছি আমার বিরহে জ্বলেপুড়ে যাচ্ছো।”
আলতো হাসলো পুষ্প। এতে রাউফুন আরও নিশ্চিত হলো তার বউয়ের মন ভালো নেই। অন্য সময় হলে রাউফুনের এমন কথায় খিলখিল করে হেসে উঠতো সে। রাউফুন চিবুক ধরে পুষ্পর গালে শব্দ করে চুমু খেয়ে বলল,
-“এখন তো হসপিটালে যেতে হবে। কাজ শেষ করে রাতে লং ড্রাইভে যাবো।”
এতেও বিশেষ একটা খুশির আমেজ দেখা গেলোনা পুষ্পর মাঝে। এবার রাউফুন পুষ্পকে আরেকটু জড়িয়ে নিয়ে বলল,
-“আচ্ছা কি হয়েছে? তুমি না বললেতো আমি বুঝবোনা, তাইনা? বলো কীভাবে তোমার মন ভালো করতে পারি? কেনো মন খারাপ তোমার? আমি কি দোষ করলাম?”
পুষ্প এবার খানিকটা বিরক্ত হলো। সে নিজেদের পারিবারিক বিষয়ের সমস্যা নিয়ে রাউফুনের সাথে কথা বলতে চায়না। কিন্তু রাউফুন তখন থেকেই ওই একই টপিক জানার চেষ্টা করছে। তাই হালকা ঝাঁঝ মেশানো গলায় বলল,
-“উফফ! বললামতো আমার কিছু হয়নি? আমার কি ব্যক্তিগত কিছু থাকতে পারেনা? বিয়ে হলেই কি ব্যক্তিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে হবে?
আপনি কাজ শেষ করে ফোন দেবেন, আমি তেরী হয়ে থাকবো।”
রাউফুন দমে গেলো। ভেতরে কোথাও একটা সূক্ষ্ম ব্যথা অনুভব করলো। খোঁচাটা বুকেই লেগেছে। আসলে সেই বেহায়া। যার কারণে বারবার সে নিজেই এখানে ছুটে আসে।
স্বামী-স্ত্রী মাঝে যে সুন্দর একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে, সেটা এখনো তাদের মধ্যে হয়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র কবুল বলে শারীরিক চাহিদা মেটানোকেই সংসার জীবন বলেনা। সংসার হলো আস্ত এক ভালোবাসা, মায়া নামক বেড়াজাল। সে পুষ্পকে এখনো সেই বেড়াজালে আটকাতে পারেনি। হ্যাঁ প্রতিটি মানুষেরই একান্ত বলে কিছু একটা থাকে, তাই বলে স্বামী তার স্ত্রীকে মন খারাপের কথা জিজ্ঞেস করবেনা?
রাউফুন খুব হাস্যরসিক মানুষ, তবে পুষ্পর কথাটায় খুব গভীর ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে। সে চাইলেই ব্যাপারটা অন্যভাবে সামলে নিতে পারতো।
আপনি যখন কাউকে কোনো বিষয়ে জানাতে চাননা, তবে তার সামনে স্বাভাবিক থাকুন। তার সামনে কেনো নিজেকে আপসেট দেখিয়ে তার মনে কৌতুহলের বীজ বুনেন?
রাউফুন কিছুটা দূরে সরে গেলো। নরম গলায় বলল,
-“আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি আসছি। নিজের দিকে খেয়াল রেখো।”
রাউফুন চলে গেলে পুষ্প বুঝতে পারলো একজনের রাগ অন্যজনের উপর ঝাড়া উচিত হয়নি। মনে মনে রাগ, অভিমান পুষে রাখাও উচিত নয়। যাথা সম্ভব সামনাসামনি, স্পষ্টভাষী হয়ে তার সাথে কথা বলা উচিত। বাবাকে বলা উচিত আপনার লোকদেখানো ভালোবাসা আমার সহ্য হচ্ছেনা। রাউফুনকে কেনো জেদ দেখালো? বিষয়টি নিয়ে পুষ্প সারাদিন মন খারাপ করে থাকলেও রাতে রাউফুনের দেওয়া একটা শাড়ি পরে তৈরী হয়ে নিলো। কিন্তু রাউফুন আসলোনা। পুষ্প নিজ থেকে যতবার ডায়াল করেছে, ততবারই রিং হয়ে কে’টে গিয়েছে।
পুষ্প নিশ্চিত হলো রাউফুন তার কথায় কষ্ট পেয়ে আসেনি। এমন পাগলাটে প্রেমিককে কষ্ট দেওয়া তার উচিত হয়নি! একদমই উচিত হয়নি।
বহুবছর পর পুষ্পর চোখ ভিজে উঠলো। একফোঁটা, দু’ফোঁটা করে টপটপ বারি হলো, অশ্রুবারি।
#চলবে………