নিজেকে দেখতে আসা পাত্রপক্ষের সাথে পরিচিত মুখ দর্শন করে চমকে উঠলো পুষ্প। পাত্র একজন ই এন টি স্পেশালিস্ট। আর অবাক করার বিষয় হলো পুষ্প দু’দুবার চিকিৎসা নিতে এই ডাক্তারের কাছে গিয়েছে।
ডাঃ রাউফুন সপ্ত’র তাকে মনে আছে কি-না জানা নেই। কেননা সে গিয়েছিলো দু’বছর পূর্বে। আর একজন ডাঃ এর কাছে দিনে কয়েক’শ রোগী অ্যাপয়েনমেন্ট নিয়ে আসে। পুষ্পকে মনে থাকার কথাও না।
পাত্রী দেখার পর সবার পছন্দ হলে দুজনকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দেওয়া হলো। বর্তমানে রেস্টুরেন্টে একাকী পাত্র-পাত্রী দেখা হলেও রাউফুনের মা সাফ সাফ জানিয়ে দিলেন “সে তোরা আলাদা দেখা করলে করবি! কিন্তু আমার সাথে এখন একবার পাত্রী দেখে আসবি”।
সব ঠিকঠাকই ছিলো। মাঝে বিপত্তি ঘটালো রাউফুনের মা। পুষ্পের চাচাতো ভাইকে মুসলমানি করানো হয়েছে। ঘরে বসে থাকতে থাকতে বেচারা বিরক্ত। তাই লুঙ্গি ধরে বসার ঘরে হাঁটাহাঁটি করছে। পুষ্পের চাচি ধমক দিয়ে নাবিলকে বলল ঘরে বসে থাকতে। ব্যাপারটা চোখে পড়লো রাউফুনের মা রোকসানার চোখে। তিনি এবার রাউফুনের মুসলমানির সময়কার কথা জুড়ে দিলেন।
রাউফুন লজ্জা পেলো। মায়ের উপর মনে মনে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করলোনা। একান্ত কথা বলার জন্য দুজনে ছাদকেই বেছে নিলো। রাউফুন স্পষ্টভাষী। তাই সরাসরি প্রশ্ন করলো,
-“আমাকে আপনার পছন্দ হয়েছে?”
পুষ্প কানের পাশে কয়েক গাঁছি চুল গুঁজে নিলো। মনে মনে উত্তর ঠিক করতে গিয়েও শুকনো ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিলো। ডাঃ রাউফুনের প্রশ্নের কী দেওয়া যায়?
রাউফুন কিছুটা সময় নিয়েই বলল,
-“আপনার কি অস্বস্তি হচ্ছে? তবে থাক, আপনি নাহয় পরে কারো কাছে নিজের মত জানিয়ে দেবেন।”
এই পর্যায়ে এসে পুষ্প জবাব দিলো রিনরিনে কন্ঠে,
-“আপনার মধ্যে অপছন্দ হওয়ার মতো কিছুই খুঁজে পাইনি। তাছাড়া আপনাকে আমার জানা নেই। শুধু বাহ্যিক দিক দেখতে গেলে অপছন্দ করার মতো মানুষ নন আপনি।”
উত্তরে মুচকি হাসলো রাউফুন। মেয়েটার বুদ্ধি আছে বটে। যথাযথ উত্তর দিয়েছে, হোক না সময় নিয়ে।
রাউফুন সুমিষ্ট কন্ঠে জবাব দিলো,
-“আমার ও আপনাকে পছন্দ হয়েছে। সমস্যা নেই, জানাশোনা ধীরে ধীরে হয়ে যাবে।”
কিছুক্ষণ কথা বলে নিয়ে দুজনেই সিঁড়িঘরে পা রাখলো। পুষ্প পিছিয়ে গিয়ে রাউফুনকে জায়গা করে দিলো আগে যাওয়ার জন্য। রাউফুন আগে আগেই নামলো। পেছন থেকে চিৎকারের শব্দ শুনে এগিয়ে গেলো রাউফুন। বসার ঘরের অনেকেই চিৎকারের শব্দ পেয়ে দৌঁড়ে আসলো। পুষ্প অসাবধানতা বশত সিঁড়ি থেকে পড়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছে। তার ধারণা পা ভেঙে গুঁতোগুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। বিয়ের কথাবার্তা এখনো ঠিক হয়নি, তার আগেই পা ভেঙে গেলো? তারমানে বিয়েটা তার জন্য শুভ নয়। রাউফুন অনুতপ্ত স্বরে বলল,
-“আমার উচিত ছিলো আপনার পাশাপাশি হাঁটা।”
পুষ্পর পা ধরে চেইক করতে গেলেই পুষ্প একটু পিছিয়ে যায়। ততক্ষণে সবাই এসে উপস্থিত। পুষ্পর মা এসে মেয়েকে ধরলেন। হাঁটতে পারছেনা পুষ্প। তবে প্রচন্ড ব্যথায় কাঁদছেও না। তাকে স্বাভাবিক থাকতে দেখে রাউফুন ভাবলো তেমন গুরুতর কিছু হয়নি। তবুও সে লক্ষ্য করলো পুষ্পকে দুপাশ থেকে দুজন ধরে ঘরে নিয়ে গেলো। রাউফুনের মা কিছুক্ষণ আফসোস করলেন মেয়েটার জন্য।
ডিউটি থেকে ছুটি নিয়ে নিজের বিয়ের পাত্রী দেখতে গেলেও, সেখান থেকে ফিরেই আবার হসপিটালে দৌঁড় লাগিয়েছে রাউফুন। হসপিটালে পৌঁছে সে অবাক হলো। পুষ্পকে দেখে এগিয়ে গেলো। পুষ্পর চাচাতো ভাই উমায়ের বলল পুষ্পর নাকি পা মচকে গিয়েছে। পা মচকে গেলে সাধারণত মেয়েদের চেঁচামেচি করে সবার সেবাযত্ন নেওয়ার কথা থাকলেও পুষ্প মেয়েটা কাঁদলোনা? ইন্টারেসটিং লাগলো ব্যপারটা।
এদিকে পুষ্প যেন পণ করেছে সে এই বিয়ে করবেনা। একটা মেয়ে পা ভেঙে বসে আছে। অথচ তার পাশ দিয়ে হেঁটেও তাকে ধরতে পারলোনা? একজন ডাঃ হয়ে অন্যকে জখম করে আবার হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। এমন মানুষকে বিয়ে করলে দেখা যাবে দুদিন পরপর তাকে হাসপাতালে দৌঁড়াতে হচ্ছে।
পুষ্পর মচকানো পা ঠিক হওয়ার পরই বিয়ের কথাবার্তা চললো। পুষ্প কথার ছলে জানিয়ে দিলো সে এখন মোটেও বিয়ে করতে প্রস্তত নয়। সংসার সামলানোর মত মানসিকতা এখনো তার হয়ে ওঠেনি। ব্যাপারটা যেহেতু দুটো পরিবার নিয়ে জড়িয়ে, তাই কথাটি গিয়ে পৌঁছালো রাউফুনের মায়ের কানে। সেখান থেকে রাউফুন জানলো। সে পুষ্পর নাম্বার নিয়ে ফোন করলো। রোগী দেখার পর নিজের একটু বিশ্রাম নেওয়ার সময়টুকু পুষ্পর সাথে দেখা করার কাজে লাগালো। দুজনেই মুখোমুখি একটা রেস্টুরেন্টে বসে রইলো। রাউফুন নিজ থেকেই বলল,
-“আপনি সেদিন বলেছিলেন আমায় অপছন্দ হওয়ার মতো কিছুই নেই। আর এখন বলছেন বিয়ের জন্য প্রস্তত না। কথাটি আমাকে প্রথম দিন বললেই হতো। আমি কিন্তু অপমানিত বোধ করছি।”
পুষ্প বিরক্তি প্রকাশ করলো। থমথমে গলার স্বর বের হলো,
-“দেখতে যাওয়ার পরই আমার পায়ের এই দশা। বিয়ের পর নিশ্চয়ই আমাকে হসপিটালের বেডে সংসার করতে হবে। আমি নিজের এমন করুন পরিণতি মেনে নিতে পারবেনা।”
ভেতর থেকে শব্দ করেই শ্বাস ছাড়লো রাউফুন। কপালে তিন আঙ্গুল ঘষে বলল,
-“এই ছোট্ট কারণে আপনি বিয়ে না করে আমাকে অপমান করছেন?
তাছাড়া আপনার নাকি এমনিতেও দুদিন পরপর হসপিটালে আসার অভ্যেস আছে শুনলাম। আপনার নাকের যা অবস্থা, এতে করে দুদিন পরই আপনাকে আপনার হাসবেন্ড বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। তারচেয়ে বরং আমি জেনেশুনেই আপনাকে বিয়ে করছি। সমস্যা হলেই রোগীর চিকিৎসা করে ফেলতে পারবো সহজেই। এতে আপনারই কিন্তু লাভ, বাড়তি চিকিৎসা খরচ লাগবেনা।”
পুষ্প রাগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে চোখ পাকিয়ে তাকালো। নাকের পাটা ফুলিয়ে খানিকটা টেবিলের উপর ঝুঁকে বলল,
-“মজা করছেন আমার সাথে?”
রাউফুন মিটিমিটি হাসলো। দু’বছর আগে পরপর দুবার পুষ্প নাকের সমস্যা নিয়ে এসেছিলো তার কাছে। চিকিৎসার একপর্যায়ে রাউফুন জিজ্ঞেস করলো,
-“বিয়ে হয়েছে?”
পুষ্প না জানালেো।
রাউফুন তখন হেসে উঠে বলল,
-“তাড়াতাড়ি নাক ঠিক করুন। নয়তো বিয়ের পর হাজবেন্ড বলবে ‘হাঁচতে হাঁচতেই দিন পার হচ্ছে, কাজ করবে কে’?”
এখন সেই হাজবেন্ড হওয়ার সুযোগ বোধহয় আল্লাহ রাউফুনকেই করে দিচ্ছে।
কত হাজার হাজার রোগী আসে রাউফুনের কাছে। সবাইকে মনে থাকার কথা নয়। সেদিন পুষ্পর চাচাতোভাই উমায়েরই বলেছিলো,
-“পুষ্প তো আপনারই রোগী। দু’দুবার আপনার কাছে গিয়েছিলো চিকিৎসার জন্য।”
তখন মাথায় জোর দেওয়ায় কিছুটা মনে পড়েছিলো রাউফুনের। তাই তো, তার হবু বউ তারই রোগী।
পুষ্প সাফ সাফ জানিয়ে দিলো সে বিয়ে করবেনা রাউফুনকে। রাউফুন এতে যেনো আরও আগ্রহ পেলো। উপযুক্ত কারণ দেখালে হয়তো রাউফুন এমনি এমনি মেনে যেতো। কিন্তু লেইম একটা কারণ দেখিয়ে তাকে, তার পেশাকে অপমান করবে কেনো? রাউফুন রাতে পুষ্পর পরিবারকে জানালো তাদের বিয়ে হলেও এখন পুষ্পকে সংসার করতে হবেনা। পুষ্প সময় নিক। নিজেকে গুছিয়ে ওর যখন মনে হবে ও সংসার করার জন্য তৈরী তখনই আসবে শশুর বাড়ি।
এ নিয়ে আর কারো আপত্তি রইলোনা। পুষ্পর দাদা গদগদ হয়ে উঠলেন। নাতনির জন্য বুঝি সঠিক পাত্র পেলেন।” খাপে খাপ, মাইনকার বাপ”।
এবার আর পুষ্প তিড়িংতিড়িং করতে পারলোনা। কারো সাথে না পেরে অগত্যা বিয়ের জন্য প্রস্তত হলো। এসব কিছুর মাঝে তার একজন মানুষকে খুব মনে পড়লো। মানুষটি যদি তাকে একটু ভালোবাসতো তবে কি হতো? একটু ভালোবাসা কি বেশিকিছু? লম্বা এক দীর্ঘশ্বাসে বুক ভার হলো পুষ্পর।
ভাবনার মাঝেই রেহানা খালা এসে বারান্দায় হাজির হলেন। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে তিনি পেটের কথাটুকু উগলে দিতে না পারলে শান্তি পাবেননা। পুষ্প বলল,
-“খালা যা বলতে এসেছো, বলে ফেলো।”
রেহানা এদিক ওদিক তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল,
-“আম্মাজান হুনো। তুমি ঐ বাড়িতে বিয়া কইরোনা। তাদের গ্যাস ছাড়ার অভ্যেস আছে।”
পুষ্প অবাক হয়ে বলল,
-“গ্যাস ছাড়ার অভ্যেস আছে মানে কি?”
রেহানা খালা বললেন,
-“পাত্রের লগে যে ব্যাডা লোকটা আইছিলোনা? হেয় ভুস ভুস করে গ্যাস ছাড়ে।”
পুষ্প বলল,
-“আশ্চর্য! গ্যাস তো সবাই ছাড়ে। এতে অবাক হওয়ার কি আছে?”
রেহানা খালা মুখে কাপড় দিয়ে লজ্জার পাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন,
-“আমি মনে করছিলাম যারা অফিস-আদালতে কাম করে তারা গ্যাস ছাড়েনা।”
রেহানা খালার আজগুবি কথায় খুব হাসি পেলো পুষ্পর। উনি মাঝেমাঝেই আজগুবি চিন্তাধারা নিয়ে তার কাছে আসে। বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজের পাশাপাশি রেহানা খালা যেনো এই বাড়ির একজন সদস্য হয়ে উঠেছেন।
খুব বেশি আয়োজন না করে, পরিবারের কিছু মানুষের উপস্থিততে বিয়েটা হয়ে গেলো। বিয়ের পরপরই পুষ্প ঘরের দরজা বন্ধ করে দিলো। রাউফের সাথে কথা বললোনা। সবাই থাকতে বললেও রাউফ হসপিটালের তাড়া দেখিয়ে সেই রাতটুকু থাকলোনা। বলতে গেলে পুষ্পর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে থাকতে চাইলোনা।
দুদিন পরই পুষ্পের জ্বর হলে। খবর পেয়ে সব ছেঁড়ে ছুড়ে রাউফুন পুষ্পদের বাসায় এসে উঠলো। অস্থির হয়ে বলল,
-“একি পুষ্প তুমি জ্বর বাঁধিয়ে ফেললে? নাকের এলার্জিটা বাড়লে না হয় আমি চিকিৎসা করতাম, কিন্তু আমিতো শুধু জ্বরের চিকিৎসা করিনা।”
সবার সামনেই কথাগুলো বললো রাউফ। লজ্জায় পুষ্পের মাথা কা’টা যাচ্ছে। এই লোক বিয়ে হতে না হতেই তাদের বাড়ি উঠে বসে আছে। আবার আপনি থেকে সুড়সুড় করে তুমিতে নেমে গিয়েছে।
সবাই মুখ চেপে হাসলো। একে একে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই পুষ্প কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-“আপনাকে এখন কে আসতে বলেছে?”
রাউফুন বলল,
-“তুমি রাগ করেছো আমি এ দুদিন আসিনি বলে? আচ্ছা এখন থেকে রোজ আসবো। তোমাকে দেখে যাবো। দয়া করে রাগটা একটু কমাও।”
পুষ্পর কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে বলল “হায় আল্লাহ কোন পাগলের পাল্লায় পড়লাম। বোঝালাম কি আর এই লোক বলছে কি? এটা আসলেই ডাঃ নাকি মানসিক রোগী?
রাউফুন ঠিক করলো আজ রাতটুকু শশুর বাড়িতেই কা’টাবে।
#চলবে…….
#কলা_পাতায়_বাঁধিব_ঘর
#জিন্নাত_চৌধুরী_হাবিবা