গল্প- মধ‍্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব‍্য
পর্ব- ৭

শরতের আকাশে পেজা তুলোর মতো মেঘেরা উড়ে বেড়াচ্ছে। ছুটিরদিন বলে জয়ীতা নম্রতাকে সাথে করে বিকালে ঘুরতে বেরিয়েছে। ওদের মতো আরও অনেকে কাশফুলের শুভ্রতা উপভোগ করতে এসেছে। অনেকদিন পর আজ জয়ীতা খোলা আকাশ আর সবুজ আর সাদা প্রকৃতির মাঝে এসেছে। ভাল লাগছে তার খোলা আকাশের নিচে বসে থাকতে। কবে এসেছিল শেষবার মনে করার চেষ্টা করলো জয়ীতা। মনে পড়লোনা। মনে হোল আর একজীবনে বোধহয়। তার জীবনটা বড়ই অদ্ভুত।ভার্সিটিতে পড়ার সময় কার সাথে কোন সম্পর্ক হয়নি। ছাত্রী জীবনেই বিয়ে হয়েগেল। বিয়ের দুইমাসও গেলনা মানুষটা ফিরেগেল প্রবাসে। তিনমাস পর সবশেষ হয়ে গেল। বিবাহিত জীবন,স্বামীর ভালবাসা কোনকিছুই ঠিকমত বুঝে ওঠার আগেই । বিবাহিত জীবন নামক গ্রন্থের প্রচ্ছদ আর শেষপৃষ্ঠার মাঝখানটা বলতে ফাঁকাই রয়ে গেল। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো বুকে ভেতর থেকে।আজকাল প্রায় মনে হতে থাকে তার যে শিহাব আসলে মারাই গেছে।আর কখনো আসবেনা।মানুষটা সত‍্যিই নেই কিউ যদি তার একটা প্রমাণ এনে দিত। এক সময় নম্রতাকে ডেকে বলে চল বাড়ি ফিরি। কাল স্কুল খোলা। একটা রিক্সা ডাকে সে। কি ভেবে অনেকগুলো কাশফুল ছিড়ে নিয়ে রিক্সায় ওঠে জয়ীতা।
সকালে স্কুলের টিচার্স রুমে ফাইল কেবিনেটের উপর একটা প্লাস্টিকের মগে কালকের ছিড়ে আনা কাশফুলগুলো পানির মধ্যে রাখছিল জয়ীতা। হঠাৎ তার মনে হোল কেউ তাকে পেছন থেকে দেখছে। সে ঘুরে তাকিয়ে দেখে কেউ নেই। রুস্টার চেক করে রুম থেকে বেরনোর সময় দরজার বাইরে খুব মৃদু একটা সুগন্ধ পেল। আগেও পেয়েছে কিন্তু কোথায় মনে করতে পারলোনা জয়ীতা। রিনি ম‍্যাডাম ভাইস প্রিন্সিপালের রুম থেকে বেরিয়ে এদিকেই আসছিল। দুজনে কথা বলতে বলতে যার যার ক্লাস রুমের দিকে হাটতে লাগল। কিন্তু দরজার সামনে পাওয়া মৃদু গন্ধটা তার সাথে রয়ে গেল। ছুটির আগে সায়লার সাথে দেখা হয়ে গেল। জয়ীতা তার পরিবারের সবাই কেমন আছে,তার বেবী কেমন আছে জিজ্ঞেস করলো। ছেলের কথা বলতে গিয়ে সায়লা মাতৃত্বের গর্বের ছটা তার চোখে মুখে খেলে যেতে লাগল। জয়ীতার বুকের ভেতরের কোনখানটায় যেন খচ করে উঠল। স্কুল থেকে বের হয়ে একটা রিক্সা ডাকবে এমন সময় পিছনথেকে তাকে ডাকলেন জামান সাহেব।
– বাড়ি ফিরছেন।চলুন নামিয়ে দেই। গাড়ি আছে আমার সাথে!
– ধন্যবাদ আমি রিক্সাতেই চলে যাব। বলে রিক্সায উঠে পড়ল জয়ীতা। মুখে তার মৃদু হাসি খেলে গেল।বাড়ি ফিরে হাতমুখ ধুয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আচড়াচ্ছিল সে। নম্রতা চা দিয়েছে বুয়া বলে দরজার সামনে দাঁড়াল এসে।-আপু তোকে অনেক ফ্রেশ লাগছে! বলে উঠল সে। ব্রাশটা ড্রেসিংটেবিলে রেখে জয়ীতা নম্রতাকে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস -করলো আব্বা এসেছে?
-হুম। এক্ষুনি মাত্র এলো। রুমে গেছে।নম্রতা উত্তর দিল। দুইবোন রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে গিয়ে চেয়ার টেনে বসল। জরিনা ওরফে জরি গরম গরম ডালপুরি ভেজে এনে টেবিলে রাখল। ডালপুরি দেখেই একটা নিয়ে মুখে পুরে দিল নম্রতা। ছোট মেয়ের কান্ড দেখে হেসে উঠলেন জহুরা বেগম। শরফুদ্দিন সাহেবও যোগদিলেন তাদের সাথে। জয়ীতা রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে জরিকে কালকের লাঞ্চে কি রান্না হবে বুঝিয়ে দিয়ে নিজেদের শোবার রুমে চলে গেল। জহুরা বেগম শুয়ে পড়েছেন রুমে গিয়ে। নম্রতা আর শরফুদ্দিন সাহেব লিভিং রুমে বসে টিভি দেখছেন। অন‍্য সময় জয়ীতাও তাদের সাথে সচরাচর যোগ দেয়। কিন্তু আজ তার খুব একা থাকতে ইচ্ছে করছে। জানালার সামনে রকিং বসে দোল খেতে খেতে তার টিচার্স রুমের দরজায় পাওয়া মৃদু সুবাসের কথা মনে হোল। সে এখন জানে কে তাকে কাশফুলগুগো সাজানোর সময় পিছন থেকে দেখছিল। একই সুবাস সে রিক্সায় ওঠার আগে জামান সাহেবকে পাশকাটানোর সময় পেয়েছে। সে জন্যেই চেনা লেগেছিল। জয়ীতার ঠোটে মৃদু হাসি খেলে গেল।
গল্প-মধ‍্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব‍্য
পর্ব-৮
জামান সাহেব জয়ীতাকে আসলেই বেশ পছন্দ করেন। মানুষটা অনেক বড় একটা দুঃসময় পাড়ি দিয়েছে। একটা সফটকর্নার জয়ীতার জন্য কোথায় যেন তার মধ্যে তৈরি হয়ে গেছে। একদিন হয়তো তাকে সরাসরি বলতে পারবেন কথাটা। তার কোন তাড়াহুড়ো নেই। জীবন কোন তাড়াহুড়ো করার জিনিস নয়।প্রতিটা পদক্ষেপই বুঝেশুনে নিতে হয়। জামান সাহেব জানেন যে জয়ীতা এখনো ক্ষিন আশা রাখে শিহাব হয়তো বেঁচে আছে। শিহাবের ব‍্যাপারটা তার জন‍্যেও পরিস্কার হওয়া দরকার শিহাব বেঁচে আছে না মারা গেছে। আর যাক হোক অন‍্যের স্ত্রীর প্রতি দুর্বল হওয়া কোন কাজের কথা নয়। জামান সাহেবের কিছু বন্ধুবান্ধব সৌদিতে আছে অনেকদিন যাবত। তাদেরকে শিহাবের ব‍্যাপারটা কনফার্ম হতে বলবেন তিনি। তার জন্য শিহাব কোথায় কাজ করতো তার ইনফর্মেশান দরকার তার। সকাল থেকে তাই তিনি জয়ীতার জন‍্য অপেক্ষা করছেন। পিওনকে ডেকে বলে রেখেছেন। জয়ীতা স্কুলে আসলে যেন তার সাথে দেখা করে তা তাকে জানাতে।
জয়ীতা টিচার্স রুমের লকারে তার ব‍্যাগ তুলে রাখছিল। এমন সময় পিয়ন মনুমিয়া সালাম দিয়ে জানাল। ভাইস প্রিন্সিপাল সার জয়ীতা ম‍্যাডামকে তার সাথে দেখা করতে বলেছেন। সে তার পর চলে গেল। জয়ীতা একটু অবাক হোল। জামান সাহেবের তার সাথে কি কথা থাকতে পারে তা তার মাথায় আসলনা। রুস্টার চেক করে দেখল সেকেন্ড পিরিয়ডে তার কোন ক্লাশ নেই।তখনই দেখা করবে বলে ঠিক করল। নোর্টস সবগুছিয়ে ক্লাশের যাওয়ার জন‍্য তৈরি হলো। সায়লা, রিমি সহ সব সার ম‍্যাডামরা যে যার ক্লাশের দিকে রওয়া দিল। সায়লা রুম থেকে বের হবার আগে তাকে বলে গেল। – ভাইয়া আপনাকে দেখা করতে বলেছে জরুরি কথা আছে। সেকেন্ড পিরিয়ড অফ আছে তখন সে জামান সাহেবের সাথে দেখা করবে বলে জানাল।- ঠিক আছে আমি বলে দেব। বলে সায়লাও বের হয়ে গেল। জয়ীতার মাথায় কিছুতেই ঢুকছেনা কি এমন জরুরী কথা তার সাথে থাকতে পারে জামান সাহেবের!
জয়ীতা বড়ো সেক্রেটারিয়েট টেবিলে জামান সাহেবের অপজিট দিকে চেয়ারে বসে আছে। এইমাত্র জামান সাহেব শিহাব কোন কম্পানিতে কি ধরনের কাজ করতো তার ইনফরমেশনগুলো তাকে দিতে বলেছে।সে কি করবে তাদিয়ে জয়ীতা জানতে চাওয়ায় জামান সাহেব তাকে বলেছে অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্যে অনন্তকাল অপেক্ষা করা কারুরই উচিত না।জীবন একটাই সেটাকে এভাবে অনিশ্চয়তার পানে ঠেলে দেয়া অনুচিত। কথাটা তাদের দুজনের বেলাতেই প্রয‍োজ‍্য। জয়ীতা তাকে ইনফমেশনগুলো জানিয়ে দেবে জানিয়ে জামান সাহেবের রুম থেকে বের হয়ে আসল।
জয়ীতা স্কুল থেকে ফিরে ফ্রেশ হবার পর আলমারি খুলে একটা কাঠের বক্স বের করে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকদিন পর বক্সটা বার করেছে। আগে রেগুলার বের করে দেখতো শিহাবের লেখা চিঠিগুলো।ইদানিং তেমনটা দেখা হয়না! একটা অশরীরি মানুষের প্রতি টানটা হয়তো সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়।বক্সটা আবার ভিতরে রেখেদিয়ে জানালার পাশে যেয়ে দাড়ায় সে।
গল্প- মধ‍্যবিত্তের সুখদুঃখের কাব‍্য
পর্ব -৯
জয়ীতা শিহাব সম্বন্ধে যা যা কাগজপত্র তার কাছে ছিল তার সবগুলোই একটা খামে ভরে হ‍্যান্ডব‍্যাগে রাখল। তার কাছে খুব একটা কাগজপত্র নেই। শিহাবের পাঠানো সবকিছু শশুরের কাছে থাকতো। ফোনটোনে বেশির ভাগ সময় শশুর সাহেবই কথা বলতেন। শিহাব তাকে একটা মোবাইল কিনে দিতে বলেছিল। কিন্তু শশুর তার কিদরকার মোবাইলের বলে খারিজ করে দিয়েছিল। মাত্র বিয়ে হয়েছে লজ্জায় সেও জোরালো ভাবে চায়নি। তারপর তো মোবাইলের দরকারই শেষ হয়েগেল। আবার পড়াশোনা শুরুকরার পর শরফুদ্দিন সাহেব ফাইনাল ইয়ারে জোর করে কিনে দিয়েছিলেন। সেও মানা করেনি।অসুস্থ মায়ের খবরাখবর নেবার জন‍্যেও ফোনটা দরকার ছিল।জহুরা বেগম সেসময়ে খুবই অসুস্থ‍ ছিলেন। যদিও সেসময় বেশখানিকটা অর্থনৈতিকভাবে চাপের মুখে ছিলেন শরফুদ্দিন সাহেব। এইকটা কাগজে কিছু লাভ হবে কিনা সে জানেনা কিন্তু সেও এখন জানতে চায় সত‍্যটা।
আজকে লাঞ্চ আওয়ারে জয়ীতা কাগজপত্র সহ খামটা জামান সাহেব দিয়ে এসেছে। বাসায় সে এব‍্যাপারে কিছু বলেনি।এতোদিন পর কি একজন মানুষ সম্পর্কে জানা যাবে কে জানে। আজ প্রচন্ড রাগ হচ্ছে শিহাবের বাবার উপর। লাশ আনাতে খরচ হবার ভয়ে লাশ আনলেনইনা। পরে শুনেছে শশুর সাহেব মোটা অঙ্কের টাকাও পেয়েছেন। ছেলের মৃত্যুতে ক্ষতিপূরণ।
জামান সাহেবকে শিহাবের কাগজপত্রগুলো দিয়েছে দুমাস হয়ে গেছে তারপর তার সাথে তেমন কোন কথা হয়নি এ। স্কুলে সামনে পরিক্ষা,তার প্রস্তুতির ব‍্যাস্ততা আর বাড়িতে নানা কাজকর্ম তারপর নম্রতারও পরিক্ষার জন‍্য তাকেও হেল্প করা এসব নিয়ে খুব ব‍্যাস্ত সময় কাটছে জয়ীতার। নম্রতা সামনে বছর এস এস সি দেবে। সে এমনিতেই লেখা পড়ায় ভাল । তারপরও তার পড়াশোনার ব‍্যাপারটা জয়ীতাই দেখাশোনা করে। শীত পড়তে শুরু করেছে অল্প অল্প। সামনে মাসে একটা ভাল দেখে শাল কেনার কথা ভেবে রেখেছে।
স্কুলের পরীক্ষা চলছে সবাই ব‍্যাস্ত তাই নিয়ে। হঠাৎ জয়ীতার মনে হোল জামান সাহেবকে স্কুলে দেখছেন না কয়দিন যাবত। অসুস্থ কিনা কে জানে। জিজ্ঞেস করলে ভাল দেখায়না তাই কাউকে জিজ্ঞেস করেনি সে।
একদিন লাঞ্চের সময় রিমি ম‍্যাডাম কথায় কথায় জানালেন ভাইস প্রিন্সিপাল স‍্যার কাজে বিদেশে গেছেন। সবাই জানে এইস্কুল ছাড়াও ওনার বিজনেস আছে। বিজনেসের কাজে প্রতি বছরই একবার করে তিনি বিদেশ যান। জয়ীতা সবার মতই শুনলো কোন আগ্রহ ছাড়াই। ক্লাস শেষে ব‍্যাগট‍্যাগ গুছিয়ে স্কুলের সামনে রিক্সার জন‍্য অপেক্ষা করার সময় ঠিক একই জায়গায় জামান সাহেবের কাছ থেকে পাওয়া সুবাসের কথা হঠাৎ মনে পড়ে গেল জয়ীতার।
-চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here