#সন্ধ্যাতারা
#ফারহানা_কবীর_মানাল
শেষ পার্ট
সকালে চোখ খুলে দেখলাম আমি আলভির বাহুর মাঝে আবদ্ধ হয়ে আছি। নিজেকে সত্যি ভাগ্যবতী মনে হতে লাগলো। আলভিকে না জেনে অনেক ভুল বুঝেছি আমি। আলভিও যে আমাকে ভুল বোঝেনি এমনটা নয়। তবুও প্রিয় মানুষের কাছে দোষ স্বীকার করে নেওয়ার মাঝে কোনো লজ্জা নেই। আলভির বাহুর বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ফ্রেশ হয়ে অজু করে আসলাম। নামাজে দাঁড়াবো এমন সময় আলভি বলে উঠলো, ” আমাকে রেখে নামাজ পড়বে নাকি? দাঁড়াও আমিও অজু করে আসি। দুইজন মিলে জামায়াতে নামাজ পড়বো। ”
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানালাম। তারপর জায়নামাজে বসে ও-র জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। আলভি অজু করে আসার পর দু’জনে মিলে নামাজ শেষ করলাম। একদম আগের মতো করে, নামাজ শেষ করে দুইজনে মিলে বাগানে গেলাম। সকালের শান্ত পরিবেশটা আমার বরাবরই অনেক পছন্দের। আর আজকে তো আলভি সাথে আছে। দু’জনে মিলে খুব ভালো সময় কাটালাম। কিছু সময় পর আলভি ঘরে এসে কিসব কাজ করতে লাগলো। আর আমি রান্নাঘরে চলে গেলাম। অনেকদিন বাড়িতে ভালো-মন্দ রান্না করা হয় না। আজ সকাল সকাল একটু ভালো কিছু নাস্তা বানাবো ঠিক করলাম। ফ্রিজ থেকে গরুর গোশত বের করে ভিজিয়ে রাখলাম, তারপর ময়দা মেখে বেশ কতগুলো পরোটা বানিয়ে নিলাম। পরোটা বানানো হয়ে গেলে গোশতটা রান্না করে ফেললাম। এটা দিয়ে সকলের খাওয়া হয়ে যাবে। শাশুড়ি মা সকালে ভর্তা ভাত খেতে খুব পছন্দ করে, তাই তার জন্য ডিম ভর্তা আর বেগুন ভর্তা করলাম, সে-ই সাথে গরম ভাত। রান্না শেষ করতে প্রায় নয়টা বেজে গেলো।
খাবারে টেবিলে সবকিছু সাজিয়ে সবাইকে ডেকে নিয়ে এলাম। নীলয় আর নীলিমাও আজ বেশ খুশি আছে। তবে নীলয়ের কপালে চিন্তার ভাজ! বাইরে থেকে খুশি দেখালেও ভেতরে ভেতরে হয়তো অনেক চিন্তায় আছে। কিন্তু নিজের চিন্তা নিজের মাঝে সীমাবদ্ধ রেখে নীলয় সকলের সাথে ভালো ব্যবহার করছে। শাশুড়ি মা সবটা জানার পর হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। এ যেন তার সিরিয়ালের সাথে মিলে গেছে। খাওয়া শেষ করে নীলয় আলভিকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” ভাইয়া আপনার সাথে কিছু কথা আছে। একটু বাইরে আসবেন প্লিজ। ”
আলভি কিছু না বলে নীলয়কে নিয়ে বাগানে চলে গেলো। নীলয় আর আলভির পিছন পিছন আমি আর নীলিমাও গেলাম। আমাকে অবশ্য নীলিমাই ডেকে নিয়ে আসলো। সকলে এক জায়গায় হওয়ার পর নীলয় বললো, ” আলভি ভাই আমি নীলিমার কাছ থেকে সবকিছু শুনেছি। আপনাদের এই বিয়ের কি করবেন? আসলে আমি এ ব্যাপারে তেমন কিছু জানি না। তা-ই আপনাকে প্রশ্ন করলাম। ”
আলভি শান্ত গলায় বললো, ” আসলে নীলয় আমার সাথে নীলিমার বিয়েটাই হয়নি। তা ইসলামি মতে বলো বা দেশীয় আইনে বলো। আগের স্বামী স্ত্রী সাথে তালাক বা ডিভোর্স না হওয়া পর্যন্ত কারো সাথেই পুনরায় বিয়ে হয় না।”
নীলয় কিছু সময় চুপ করে থেকে বললো, ” তবুও যদি কিছু করা লাগে, আসলে আমি নীলিমাকে হারাতে চাই না। বা নীলিমার ভাগও কাউকে দিতে চাই না। ”
নীলয়ের কথা শুনে নীলিমা মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। সারা মুখ রক্তিম আভাতে ছেয়ে গেছে। হয়তো লজ্জা পেয়েছে। আলভিও আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দিলো। সে-ও যেন নীলয়ের বলা কথাগুলো আমাকে বলতে চায়। আমিও আলভির দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। তারপর লজ্জায় মাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আলভি নীলয়ের ধাড়ে হাত রেখে বললো, ” শোনো নীলয়,
অন্য পুরুষের বিবাহে থাকা স্ত্রীও অপর পুরুষের জন্য নিষিদ্ধ।
বিবাহিতা নারীরা নিশ্চিত ও কার্যকরী পন্থায় তালাকপ্রাপ্তা/বিধবা হয়ে ইদ্দত পালনের আগে দ্বিতীয় কোন পুরুষের ঘরণী হতে পারবেনা। এটাই আল্লাহ তায়ালার ফয়সালা।
কোরআনে কারীমে ইরশাদ হয়েছে, এবং সব সধবা নারীরাও বিবাহের ক্ষেত্রে তোমাদের জন্য নিষিদ্ধ। (সূরা নিসা, আয়াত-২৪)
কোন বিবাহিতা নারী যদি তার স্বামীর পক্ষ থেকে তালাকপ্রাপ্তা হন এবং তিন মাস (তিনটি পিরিয়ড) ইদ্দত পালন শেষ করেন শুধুমাত্র তাহলেই তিনি নতুন করে বিবাহের বৈধতা পাবেন।
এ ব্যাপারে আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের সুস্পষ্ট নির্দেশ, আর তালাকপ্রাপ্তা নারীরা নিজেদেরকে অপেক্ষায় রাখবে তিন হায়েজ পর্যন্ত। (সূরা বাকারা, আয়াত-২২৪)
বিবাহ যেহেতু আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক নির্দেশিত একটি ধর্মীয় রিচুয়াল। তাই তার নির্দেশের বিরুদ্ধে গিয়ে কিছু করলে সেই বিবাহ শুদ্ধ হিসেবে গন্য হবেনা।
এখন কারো যদি পূর্বের স্বামীর সঙ্গে শরীয়তসম্মতভাবে ছাড়াছাড়ি না হয়ে থাকে, তাহলে কোনভাবেই এ বিয়ে বৈধ নয়। তবে এর জন্য দুটি বিষয় নিশ্চিত করতে হবে।
প্রথম বিষয় হলো, প্রথম স্বামীর ছাড়াছাড়িটা ইসলামী শরীয়ত সম্মতভাবে হয়েছে কি-না। আর তালাকনামা পাঠানো এবং সেটি ইসলামী শরীয়ত সম্মতভাবে বিয়ে বিচ্ছেদ হওয়া পর্যন্ত পৌঁছেছে কি-না, এই বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে।
আররেকটি হলো, যদি শরীয়তসম্মতভাবে ছাড়াছাড়ি বা বিচ্ছেদ হয়ে থাকে, তবুও তিন মাস অথবা তিন পিরিয়ডের সময় পর্যন্ত ইদ্দত পালন করতে হবে। সেটি হয়েছে কি-না নিশ্চিত করতে হবে।
এই দুটি বিষয়ের কোন একটি বিষয় যদি অনুপস্থিত থাকে, তাহলে বিয়ে শুদ্ধ হবে না। বরং এটি একটি অবৈধ বিয়ে।
আবার দেখো
যে নারীকে বিয়ে দেওয়া হবে সে কুমারি হোক কিংবা তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা হোক সবার ক্ষেত্রেই বিয়ে দেওয়ার আগে মতামত নেওয়া বা অনুমিত গ্রহণ করা আবশ্যক। যিনি অভিভাবক হবেন তার জন্য অবশ্যই নারীর কাছ থেকে বিয়ের আগে অনুমতি বা মতামত গ্রহণ করা জরুরি। কোনো নারীর মতামতের তোয়াক্কা না করে ইচ্ছার বিরুদ্ধে পাত্রস্থ করা বা বিয়ে দেওয়া বৈধ নয়।
আবার যদি কোনো নারীর অনুমতি ও সম্মতি ছাড়াও তার বিয়ে দেওয়া হয় তবে সে নারী চাইলে তার বিয়ের আকদ বা চুক্তি বাতিল করতে পারবে। আবার বিয়ে বাতিলেরও অধিকার রাখে নারী।
হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, সায়্যিবাহ (আগে বিয়ে হয়েছে এমন তালাকপ্রাপ্তা বা বিধবা) বিবাহিতা নারীর মতামত বা সম্মতি গ্রহণ ছাড়া তার বিয়ে দেওয়া যাবে না এবং কুমারী নারীকে তার অনুমতি ব্যতিতও বিয়ে দেওয়া যাবে না।’
তারা (সাহাবায়ে কেরাম) বললেন, কুমারী নারীর অনুমতি আবার কিভাবে? রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘তার চুপ থাকাই অনুমতি।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস, ৫১৩৬)
এখানে এই বিয়েতে আমার বা নীলিমার কারোই মতামত ছিলো না। সে-ই জন্য এই বিয়েটা বৈধ নয়। ধরতে গেলে বিয়েই হয়নি। এছাড়া আমাদের দেশের আইনেও এ কথা বলা আছে।
মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রথম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল বলে গণ্য হবে। স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে ইচ্ছুক হলে তাঁকে আবশ্যিকভাবে আগে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করতে হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে প্রথম স্বামীকে তালাকের নোটিশ প্রদানপূর্বক ৯০ দিন পর তালাক কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে নির্দিষ্ট ইদ্দতপালন শেষে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করা যেতে পারে। এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকাবস্থায় স্ত্রী যদি স্বামীর জিম্মা থেকে পালিয়ে গিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেন সেক্ষেত্রে প্রথম স্বামী সেই স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দায়ের করতে পারেন। সেক্ষেত্রে অভিযুক্ত স্ত্রী বাংলাদেশের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ৭ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড পেতে পারেন। সঙ্গে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবেন। এ ব্যাপারে আমরা কোর্টে গিয়ে সমাধান করে নিবো।”
আলভি এক নাগাড়ে সব কথাগুলো বললো। নীলয় খুব মন দিয়ে আলভির কথা শুনছে। আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে আলভির দিকে তাকিয়ে আছি।আমার বরটা কতকিছু জানে। তবে কেউ কোনো বিষয় না জানলে তাকে নিয়ে হাসি-তামাশা বা উপহাস করা উচিত নয়। সবাইকে সবকিছু জানবে এমনটা নয়৷ আলভি কথা শেষ হলে নীলয় যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো।
(বিয়ের ব্যাপারে আমি যতটুকু জানি ততোটুক লিখেছি, ভুল হলে ধরিয়ে দিবেন। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ জ্ঞান নেই।)
আমিও খুব খুশি। নীলয় আলভির হাত ধরে আলভিকে ধন্যবাদ দিলো। আজকেই ওরা চলে যাবে, আমরা অনেক বলার পরও থাকতে রাজি হলো না। নীলয়ের পায়ের ব্যাথা অনেকটা কমে গেছে। কথা শেষ করার পর নীলয় নীলিমার হাত ধরে ঘরের দিকে যেতে লাগলো। আমি আর আলভি বাগানের ভিতর দাঁড়িয়ে আছি। ওরা দৃষ্টির আড়াল হতেই আলভি আমার দিকে এগিয়ে আসলো। আমি অবাক দৃষ্টিতে ও-র দিকে তাকিয়ে আছি। কি করতে চাইছে এই ছেলে। আলভি আমার কাছে এসে আমার দুইহাত ধরে বললো, ” আমার ভুল হয়ে গেছে, ওদিন তোমাকে বাড়ি ফিরে সবটা খুলে বলা উচিত ছিলো। তাহলে আর এতো কিছু হতো না।”
আমি ইশারায় আলভিকে চুপ করতে বললাম। আলভি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মুচকি হেসে বললাম, ” দোষটা আমাদের দুইজনেই, তাই কেউ কারো কাছে মাফ চাইবে না। আল্লাহ আমাদের মিলিয়ে দিয়েছে এটাই অনেক। ”
আলভি তানিয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। আমৃত্যু টিকে থাকুক পবিত্র সম্পর্কগুলো।
সমাপ্ত