#সন্ধ্যাতারা
#ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -২
আমার জ্ঞান ফিরেছে দেখে ঝাঁঝালো গলায় বললেন, ” আমার ছেলেটাকে কি তাবিজ পড়া খাইয়েছিস তুই? ”
শাশুড়ি মা’য়ের কথায় অর্থ আমার বোধগম্য হলো না। আমার সাথে কি হয়েছে বুঝতে চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার অবাধ্য চোখজোড়া আলভিকে খুঁজে চললো। কি হবে আমার সাথে!
কিছুসময় পর আলভি একজন লোককে সাথে নিয়ে ঘরে ঢুকলো। লোকটাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে উনি ডাক্তার। আলভি লোকটাকে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ” এই যে! ”
ডাক্তার লোকটা আমার প্রেশার মাপতে লাগলো। ভাবতেও হাসি পায়, যে মানুষটা আমার আত্মাটাকে মেরে ফেলেছে সে-ই আমার শরীরের চিকিৎসা করার জন্য ডাক্তার ডেকে আনছে। কতটা হাস্যকর! ইতিমধ্যে আলভিকে নিয়ে সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছে। আলভির নতুন বউ মুখ গোমড়া করে বসে আছে। সত্যি তো যে রাতে স্বামীকে একান্ত নিজের কাছে পাওয়ার কথা সে রাতে স্বামী অন্য কাউকে নিয়ে ব্যস্ত আছে। তাও তার প্রাক্তন স্ত্রী-কে নিয়ে। এটা কোনো মেয়েই মেনে নিতে পারবে না। অবশ্য আলভির এসব গায়ে লাগছে বলে মনে হচ্ছে না। অস্থির দৃষ্টিতে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে।
–” আলভি সাহেব উনার প্রেশার বারবার উঠানামা করছে। হয়তো মানসিক চাপের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে বলে এমন হচ্ছে। অতিরিক্ত মানসিক চাপ সহ্য করতে না পেরে অজ্ঞান হয়ে গেছে। উনার দিকে একটু খেয়াল রাখবেন। আর কোনো প্রকার মানসিক চাপ দেওয়া যাবে না। আমি দুইটা ঔষধ লিখে দিচ্ছি রাতে খাইয়ে দিবেন। ”
ডাক্তার সাহেব কথাগুলো বলে আলভির সাথে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আলভি চলে যেতেই শাশুড়ি মাথা চাপড়ে বলে উঠলো, ” কি হয়েছে ছেলেটার আমার! এই মেয়েকে যদি এতো ভালোবাসে তাহলে কেন আর একটা মেয়েকে বিয়ে করে এনেছে? আমার ছেলেটা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি! ও আল্লাহ গো!”
আশেপাশে কয়েকজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিলো। তাদের একজন বলে উঠলো, ” তোমার ছেলেটা কি আপা? নতুন বউটাকে রেখে আগের বউকে নিয়ে পড়ে আছে। কি সব যে হচ্ছে! ‘
–” আমার বাড়িতে কি হচ্ছে আপনার না জানলেও চলবে। নিজের বাড়িতে গিয়ে কাজ করেন তো!”
কথাগুলো বলতে বলতে আলভি ঘরে ঢুকলো। আলভির কথায় শাশুড়ি মা আর নতুন বউ বাদে সকলে ঘর থেকল বের হয়ে গেলো। যাওয়ার আগে একজন বললো, ” এতো ঢং তো নাটক সিনেমায় ও থাকে না। ”
শাশুড়ি মা আলভিকে জিজ্ঞেস করলেন, ” এসব কি করছিস তুই?”
আলভি মায়ের কথার জবাব না দিয়ে আমাকে উদ্দ্যেশ্যে করে বললো, ” ডাক্তারের কথাগুলো জানি মনে থাকে।! ”
আমি ও-র কথায় কোনো জবাব দিলাম না। শুধু এক দৃষ্টিতে ও-র নতুন বউকে দেখতে লাগলাম। মেয়েটা এতো শান্ত হয়ে আছে কি করে! আলভি ডাক্তারকে এগিয়ে দিয়ে আসা পর্যন্ত আমি খাটে বসে রইলাম। শাশুড়ি মা আফসোস করছেন তার ছেলের কি হয়েছে, মেয়েটা চুপচাপ বসে আছে। বাকিরা নিজেদের কাজে ব্যস্ত। আলভি বাড়িতে ফিরে আসার পর শাশুড়ি মাকে বললো, ” মা তুমি নীলিমার থাকার জন্য গেস্ট রুমটা খুলে দেও। ”
শাশুড়িসহ সকলেই হা করে আলভির দিকে তাকিয়ে রইলো। সেই সাথে আমিও হতবাক হয়ে ও-র দিকে তাকিয়ে রইলাম।
শাশুড়ি মা ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললেন, ” এসব কি আলভি নতুন বউ গেস্ট রুমে কেন থাকবে? আর তোমার ঘরে কে থাকবে?”
আলভি শান্ত গলায় বললো, ” এতোদিন যে থাকতো আজও সে থাকবে। আমি অনেক বেশি ক্লান্ত মা প্লিজ তোমরা যাও। ”
শাশুড়ি মা গজগজ করতে করতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। মেয়েটাও পুতুলের মতো শাশুড়ি মা’য়ের সাথে চলে গেলো। কিসব যে হচ্ছে কিছু বুঝতে পারছি না আমি। নীলিমা যদি আলভির বিয়ে করা বউ হয় তাহলে এসব কি! মাথাটা প্রচন্ড ব্যাথা করছে। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। সকলে চলে যেতে আলভি দরজা বন্ধ করে এসে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আলভিকে আজ কেমন রহস্য লাগছে আমার কাছে।
–” নতুন বউ থাকতে আপনি আমার কাছে ঘুমাচ্ছেন কেন?”
আলভি শার্ট খুলতে খুলতে বললো, ” আগের বউ বাসরঘরে যাওয়ার অনুমতি দেয়নি তাই।”
আলভি এমন কথায় আমার খুব রাগ হচ্ছে। আমার সাথে এমন করে কি মজা পাচ্ছে কে জানে। এদিকে আমি শোকে পাথর হয়ে যাচ্ছি, অন্যদিকে সে হেঁয়ালি করছে।
–” মানে? কিসব বলছেন আপনি? একটু পরিষ্কার করে বলেন তো।”
আলভি আলমারি থেকে একটা গেঞ্জি বের করে পরে নিলো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ” একটা মানুষ জীবনে কতবার বিয়ে করে তানিয়া?”
–” যতো বার একটা মানুষের ইচ্ছে করে!”
আলভি আর কিছু না বলে শুয়ে পড়লো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না৷ হয়তো আমার সাথে কথা বলতে চায় না। বিছানা থেকে উঠতে যাবো এমন সময় আলভি আমার হাত টেনে ধরলো। এবার আর সহ্য হচ্ছে না। আলভির উদ্ভট ব্যবহার আমি আর নিতে পারছি না। আলভি কি বুঝতে পারছে না ও-র দ্বিতীয় বিয়ে আমাকে ঠিক কতটা কষ্ট দিচ্ছে! নাকি জেনে বুঝে আমার সাথে মজা করছে। হয়তো আমাকে কষ্ট পেতে দেখে ও-র আনন্দ হচ্ছে।
আমি আলভির হাত ছাড়াতে চেষ্টা করতে লাগলাম। কিন্তু পারলাম না। ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম, ” কি হয়েছে হাত ধরেছেন কেন?”
–” কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
–” আমি যেখানেই যাই না কেন তাতে আপনার কি একটু বলেন তো।”
–” অন্যকারো?”
–” অন্যকারো মানে?”
–” কিছু না। এখন কোথাও যাওয়া যাবে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ো। ডাক্তার বলেছে তোমার বিশ্রামের প্রয়োজন। ”
আমি ও-র কথায় তেমন হেলদোল দেখালাম না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলাম। আলভি খাট থেকে উঠে এসে আমাকে কোলে তুলে নিলো তারপর বিছানায় নিয়ে শুইয়ে দিলো।
–” কোথাও যাওয়া যাবে না বলছি তো। ”
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না৷ আলভিকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে দিলাম। সত্যি এসব আমার সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। আলভি এই ব্যবহার আমাকে অনেক বেশি কষ্ট দিচ্ছে। আমাকে নিয়ে যদি ও এতটাই ভাবে তাহলে কি করে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারলো?
আলভি অবশ্য আমাকে কিছু বললো না। একহাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকলো আর অন্য হাত দিয়ে কপালে, চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে গেছি ঠিক মনে করতে পারলাম না সকালে ঘুম থেকে উঠে সারা শরীরে অনেক ব্যাথা অনুভব করলাম। মাথাটাও বড্ড জ্বালা করছে। আলভিকে আসেপাশে কোথাও দেখতে পেলাম না। কোথায় গেছে কে জানে!
নিজের কপালে হাত দিতেই বুঝতে পারলাম আমার সারা শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। এই জন্য সারা শরীরে এতো ব্যাথা। কাল বিকালে অতো সময় গোসল করার জন্যই হয়তো জ্বর এসেছে।
কোনো রকমে ফ্রেশ হয়ে ঘর থেকে বের হলাম। আমাকে দেখে শাশুড়ী মা বলে উঠলো, ” এই কালনাগিনী মেয়েটা আমার ছেলেটার মাথাটা মুড়িয়ে খেয়েছে। ছেলেটাকে একটু সুখে দেখতে পারে না৷ কি তাবিজ করছে কে জানে। এতো সুন্দর একটা নতুন বউ থাকতে শেষে কিনা সারারাত এর সাথে কাটালো। আল্লাহ গো! এ আমার কি হলো গো!”
নীলিমা পাশেই একটা চেয়ারে বসে ছিলো। শাশুড়ি মা’য়ের কথা শুনে বলে উঠলো, ” আপনি মনে হয় অনেক সিরিয়াল দেখেন তাই না? আপনার ব্যবহার একদম সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো লাগছে৷ ”
নীলিমার কথা শুনে শাশুড়ি মা নিজের কপাল চাপড়ে বললেন, ” আমার ছেলে এ কাকে বিয়ে করে এনেছে! আল্লাহ গো! যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। আলভি বাবা তোর কপালটা অনেক খারাপ রে! এইসব মেয়ে তোর কপালে জুটলো। আমার ভাইয়ের মেয়েটা কত ভালো ছিলো। শুধু তোর বাপের জন্য অতো মেয়েটাকে ছেলের বউ করতে পারলাম না। লোকটা নিজের ছেলের ভালোও বুঝতে পারলো না।”
শাশুড়ি মা এবার সত্যি সিরিয়ালের শাশুড়িদের মতো ভাব করছে। নীলিমা অবশ্য শাশুড়ি মাকে কিছু বললো না৷ ভাবলেশহীন ভাবে বসে রইলো। আমিও সেখানে সময় নষ্ট না করে সারা বাড়িতে আলভিকে খুঁজতে লাগলাম। এ বাড়িতে আলভির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা হলো ও-র ফুলের বাগান৷ নিজের হাতে নানান রকমের গাছ লাগায়। পরিচর্যা করে। ফুলের বাগানের পাশে একটা দোলনাও লাগিয়েছে ও। তার নাকি এমন বাগান খুব ভালো লাগে। কত রাত আলভির সাথে দোলনায় বসে গল্প করেছি ঠিক নেই। কখনো কখনো গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে যেতাম দু’জন সকালে নিজেদের দোলনায় দেখে খুব হাসতাম। পুরোনো স্মৃতি মনে পড়তেই চোখে পাতা ভিজে গেলো। আগে কি সুন্দর ছিলো সবকিছু আর এখন সবকিছু যেন ধোঁয়াসা। কিসব হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। বাগানে গিয়ে দেখলাম আলভি সেখানে নেই। আশাহত হয়ে বাগান থেকে ফিরে আসার সময় দেখলাম আলভি সদর দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকছে। এতো সকালে কোথায় গিয়েছিল? আলভিকে অনুসরণ করে ঘরের ভেতর গেলাম।
ঘরের দরজা থেকে আলভি নীলিমার নাম ধরে ডাকতে লাগলো। নীলিমা আলভির গলা পেয়ে রুম থেকে ছুটে বেরিয়ে এলো। তারপর আবার দুইজন মিলে রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
কাল হয়তো আলভি আর নীলিমা মিলে আমার সাথে মজা করছে। নাহ্ অনেক হয়েছে আজ আমি এ বাড়ি থেকে চলে যাবো। আলভির এ নাটক আমি আর নিতে পারছি না। চোখ মুছে ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম।
চলবে