# ধারাবাহিক গল্প ( সমাপ্তি পর্ব)
# চারুলতা ভালোবেসেছিল

মফস্বল শহরে রাত বারোটা মানে বলতে গেলে গভীর রাত। গতরাতে ঘুমাতে পারিনি, আজ ও বোধহয় পারব না। লতাও জেগে আছে বুঝতে পারছি। আমরা আজও একসাথেই শুয়েছি। আমার কথা শেষ হওয়ার পর ভাবি লতার কাছে জানতে তার কথা চেয়েছিল। হৃদয় ভাইকে নিয়ে যে লতারও অন্য রকম অনুভূতি আছে, তা আমার পাশাপাশি ভাবিও টের পেয়েছেন।

নাহ, হৃদয় ভাই লতাকে ও ভালোবাসার কোন কথা বলেনি। দেড় বছর আগে ফুপুর মৃত্যুর সময় ভাইয়ার সাথে যখন দেখা হয়, তখনো নাকি লতার মনে এসব কিছু ছিল না। ভাইয়ার নাম্বার ছিল, মাঝেমাঝে কথা হতো এটুকুই।

আমিও তখন বিবাহিত ছিলাম, শ্বশুর বাড়িতে সংসার করছি। ফেসবুকে চ্যাট আর ফোনে অল্প স্বল্প কথা বলতে বলতে লতা নিজের অজান্তে দুর্বল হয়ে পরে।
টিন এজ বয়সটাই হয়তো এমন। তাছাড়া আমার বিয়ে হয়ে গিয়েছে, ফুপু মারা গিয়েছেন, হৃদয় ভাই ভালো চাকরি করছে এবং সিঙ্গেল আছেন। এসব দেখে লতা ভেবে নিয়েছিল যে এবার পারিবারিক ভাবে হয়তো কোন সমস্যা হবে না। আমি হয়তো মন খারাপ করব, কিন্তু যেহেতু নিজের সংসার আছে, লতাকে আটকাবো না। তবে আব্বা জীবিত থাকতে লতা কখনো সাহস পায়নি একথা বলার, তাছাড়া ততদিনে আমিও বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি ফিরে এসেছি। লতা ভয় পেয়ে গিয়েছিল। তাই হৃদয়ের জন্য মনের টান আর আকর্ষণ সবার কাছে লুকিয়ে রেখেছে।

মেয়েটা বড্ড বেশি অবুঝ, অবশ্য এ বয়সে আমিও এমন ছিলাম, হয়তো এখনো আছি। না হলে যে সহজ জিনিসটা ভাবি একমুহূর্তে ধরিয়ে দিলেন, সেটা চার বছরেও আমি বুঝতে পারিনি। কেমন বোকার মতো ছোটবেলার অবুঝ ভালোবাসা বুকে লালন করে গিয়েছি, নিজের ভাগ্য কে দোষ দিয়েছি। যে হয়তো আমার ছিল না, তাকে না পাওয়ার কষ্টে ক্ষতবিক্ষত হয়েছি।

মুবিন, হায় মুবিন! স্বামীর ভালোবাসা থেকে ওকে আমি বঞ্চিত করেছি।

তাই হয়তো অল্প বয়সে বিধবা হওয়াটা আমার নিয়তি ছিল, প্রকৃত ভালোবাসার মূল্য দিতে পারিনি বলে তা আমার হাতের মুঠো থেকে জলের মতো বেরিয়ে গেলো,
আমি ধরে রাখতে পারিনি।

“আপা, আমাকে মাফ করে দে প্লিজ, আমি তোকে খুব বাজে কথা বলেছি।”

হঠাৎ লতা এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো।
অবুঝ বোনটা আমার, ওর উপরে রাগ করে থাকতে পারি না। আল্লাহ আমার মতো মন্দভাগ্য ওর না করুক,
সত্যি যদি হৃদয়ের মনে লতার জন্য কোন অনুভূতি থাকে, আমি খুশি খুশি ওদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
এখনতো আমিই লতার অভিভাবক।

উঠোনে প্যান্ডেল টাঙানো হয়েছে, মসজিদে মিলাদ পড়ানো শেষ। চমচম, সিঙ্গারা, নিমকি দিয়ে প্যাকেট করে নামাজের পর মুসুল্লিদের দিয়েছেন ভাইয়া।
আত্মীয় স্বজনেরা দুপুরে বাড়িতে খাবে। বাবুর্চি রান্না করেছে। কুলখানির খাবার যেমন হয়, মুরগীর মাংস,গরুর মাংস, বুটের ডাল, চিকন চালের ভাত আর লাউ। হৃদয় ভাই আর আমার বড় দুই ফুপাতো বোন এসেছেন পরিবার নিয়ে। আব্বার কুলখানি উপলক্ষে আপারা ঢাকা থেকে আসলেন। রাতে আমাদের বাড়িতেই থাকবেন। ভাইয়ার শ্যালক সবুজ ভাই আর আমাদের দুইবোনের সাথে কোন কথা বলার চেষ্টা করেনি, দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে নাকি ঢাকা চলে যাবেন। সম্ভবত নীলু ভাবি কিছু বলেছেন তার ভাইকে।

ভাবি বলেছেন সুযোগ পেলে হৃদয় ভাইয়ের সাথে কথা বলবেন, ঢাকা ফেরার আগেই তিনি সঠিক বিষয়টা জানতে চান। ভাবির উপর সত্যি বলতে আমরা কৃতজ্ঞ।
আমাদের জন্য আর কেউ এতটা ভাবেনি, এমনকি ভাইয়া ও না। সম্পদের বন্টন শেষে ঢাকা ফিরে যেতে প্রস্তুত ভাইয়া, আমার আর লতার কথা মনে হয় না কিছু ভেবেছেন। কিন্তু ভাবি কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আমরা সবাই সব জানতে পারি, এত দিন বয়ে বেড়ানো ভুল বোঝাবুঝির অবসান অবশেষ ঘটে, তবে বড়ো দেরিতে।

দুপুরের খাবার শেষে সবাই বারান্দায় চেয়ার পেতে বসেছেন। আমার ফুপাতো বোন দীলু আপা কিছু বলতে চান। আপা হঠাৎ সবার সামনে আমার হাত চেপে ধরেন ।

“চারু, বোন আমার, তোর সাথে কত অন্যায় হলো, তখন আমরাও আম্মাকে না বুঝে তোর বিরুদ্ধে কথা লাগিয়েছি। কী করবো হৃদয় নিজে তোর নাম নিয়েছিলো। ”

আমার হাত পা ঘামছে, মনে হচ্ছে জ্ঞান হারাবো,
হঠাৎ আমাকে শক্ত করে ধরলো একটা হাত, লতা আমার বোন, আমাকে ধরে আছে কী শক্তি আর ভালোবাসা নিয়ে।

” চারু, আম্মা বেঁচে থাকতে হৃদয় কখনো আর কথা তোলেনি। আমরাও এতদিন তাই প্রকৃত সত্যটা জানতে পারিনি। জানিসই তো ঐ দিনের পর আম্মা ওকে ঢাকা পাঠিয়ে দেয়। আম্মার কত ইচ্ছে ছিলো নিজের পছন্দে ছেলের বৌ আনার , কিন্তু তার আগেই আল্লাহ আম্মাকে নিয়ে গেলেন।”

আপা কেঁদে ফেললেন বলতে বলতে।

“চারু, এতদিন পর হৃদয় আমাকে সত্যিটা বললো।
চিঠিটা তোর জন্য লেখেনি হৃদয়।”

লতার বাঁধন আস্তে আস্তে ঢিলে হয়ে গেলো, আমার বুকের পাথরটাও যেন নেমে গেলো।

আপা বললেন “চিঠিটা রাবেয়া খালার মেয়ে দোলার জন্য ছিলো, চারু।”

একটা বোমা পরলেও বোধহয় আমি এত অবাক হতাম না, কী বললেন আপা, দোলা! আমার জানের বান্ধবী দোলা! আমাদের প্রতিবেশী রাবেয়া খালার মেয়ে দোলা! তাহলে দোলাই ছিলো হৃদয়ের মনের রানী।

দোলার জন্যই যখন তখন বাড়ি আসতেন ভাইয়া,
হায় বোকা মেয়ে আমরা! আমি আর লতা। আমার আর ভাবির চোখাচোখি হলো। লতা কাঠ হয়ে বসে আছে। হৃদয় ভাই মুখে তালা ঝুলিয়েছেন, মাটির দিকে তাকিয়ে বসে আছেন। আমার এতদিনের অন্ধ আবেগটা এক নিমিষে যেনো ফুঁ দিয়ে উড়ে গেলো।

“জানিসই তো রাবেয়া খালার স্বামী, হামিদ চাচার সাথে আব্বার সম্পর্ক ভালো ছিল না, আম্মাও দেখতে পারতো না। তাই আম্মা যখন চিঠিটা কার জন্য লেখা জিজ্ঞেস করলেন, হৃদয় নাকি ভয়ে তোর নাম বলেছে। ”

এই লোক আসলে চিরকালই কাপুরষ ছিল, আজ ও তার হয়ে কথা বলতে আপাকে নিয়ে এসেছে।

“চারু, হৃদয় ভেবেছিলো আম্মা তোকে এত আদর করে, তোর জন্য লেখা বললে কিছু মনে করবে না।
কিন্তু যখন আম্মা এত রেগে গেলেন, হৃদয়ের আর সাহস হয়নি সত্যি বলার। ও ভেবেছিলো আম্মা ঠান্ডা হলে, পরে তোকে সত্যি টা জানাবে। কিন্তু আম্মা এত হইচই করলেন, যে আর কিছু জানানোর সুযোগ হয়নি।”

চার বছরেও হৃদয় ভাইয়ের সাহস হয়নি সত্যি বলার, ভালোই। আর আমার ফুপুর সাহস হয়নি, ভাইয়ের আদরের মেয়েটাকে ছেলের ভবিষ্যত বৌ হিসেবে মেনে নেওয়ার। কেননা মেয়েটা সুন্দরী ছিল না। হৃদয়ের বলা একটা মিথ্যে, চারটা বছর ধরে আমার জীবনটা এলোমেলো করে রেখেছে। আর আজ কী অবলীলায় ওরা বলছে সামান্য ভুল বোঝাবুঝি।

কাল পর্যন্ত হৃদয় ভাইকে আমাদের ক্রান্তিলগ্নে নায়ক হয়ে এসেছেন বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে হৃদয় ভাই সবসময়ই কাপুরুষ ছিলেন, আছেন, থাকবেন। কিছু বলার রুচি হলো না। যে সময় জীবন থেকে চলে গিয়েছে তাতো আর ফিরে পাবো না।

এখন আমি লতাকে সামলাবো।চারু আর লতা ভুল করে কোন কাপুরষ কে ভালোবেসেছিল ঠিক, তবে এই বার তাকে মন থেকে ভুলে যাবে। চারু, লতা নিজের জন্য বাঁচবে, নিজেদের ভালোবাসবে। সময়ের আবর্তনে যদি কেউ ভালোবেসে জীবন সঙ্গী হতে চায় তবে ভালো, না চাইলেও আফসোস নেই। একবারই ভুল করে ভালোবেসে নিজেদর হারিয়েছিলাম আমরা, তবে আর না।

দোলার সাথে হৃদয় ভাইয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে। ঢাকা গিয়েও নাকি দুজনের যোগাযোগ সবসময়ই ছিল। দোলার পড়াশোনা শেষ হয়েছে, ভাইও চাকরি করছে।
দুই পরিবারে আর বাঁধা দেওয়ার কেউ নেই।
এই দোলাও জানতো কত অবিচার হচ্ছে আমার সাথে, তারপরও নিজের স্বার্থের কথা ভেবে মুখ খোলেনি।
বিয়ে ঠিক হওয়ার পর এসেছিলো বাড়িতে, ঘরে আসা মেহমানের মতো আপ্যায়ন করেছি, বন্ধুত্বের বিসর্জনতো কবেই দিয়েছি।

যেহেতু ফুপুর পরিবারের কেউ এখন দেশের বাড়ি থাকেনা, তাই বিয়ের আয়োজন আমাদের বাড়িতেই হবে। আমরা দুবোন অবশ্য স্বাভাবিক ভাবেই সব আয়োজনে অংশ নিচ্ছি। এখন আমরা নীলু ভাবির সাথে আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করি অবসর সময়ে। ভাবি আমাদের খালি রুম গুলো মহিলা বোর্ডিং করে ভাড়া দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, তাহলে এই বড়ো বাড়িতে আমাদের একা ও লাগবে না, আবার নিরাপত্তা ও থাকবো, সাথে আয়ও হবে।

নিচের গুদামঘর টা খালি করে কোচিং সেন্টার খুলব খুলবো। আমি আর লতা এলাকার বাচ্চাদের প্রাইভেট পড়াব। পাশাপাশি আমি প্রাইমারি নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করব। আর লতা তার পড়াশোনা শেষ করবে।

ভাইয়া, ভাইয়ার মতোই আছেন, দুই দিনে পরিবর্তন হয়ে যাবেন আশাও করি না। তবুও শেষ পর্যন্ত সম্পদের বন্টন যে তিক্ততা ছাড়া, সুন্দর ভাবে হয়েছে আমরা তাতেই খুশি। এই সব কিছুর মধ্যে আমাদের প্রাপ্তি আরেকটা বোন নীলু ভাবি। তিন ভিন্ন বয়সী তিন নারী, একে ওপরের শক্তি আর সমব্যথী হয়ে গিয়েছে নিজেদের অজান্তে। ভাবিও এখন আর ভাইয়ার কাছ থেকে পাওয়া অবহেলা নিয়ে কষ্ট পাবেন না বলেছেন।

ভাবির ইচ্ছে আছে বাচ্চাদের নিয়ে এখানে চলে আসার, নিজের মতো করে কুটির শিল্প বা বুটিক নিয়ে কাজ করবেন ভাবছেন। সব সময় শুধু পুরুষের কাছেই আশ্রয় পেতে হবে ভালোবাসা আর ভালো থাকার জন্য, এমন তো না। নিজেও নিজেকে ভালোবাসা যায়, ভালো রাখা যায়।

তাই চারু লতা ভালোবেসেছিল, এটা আর ঠিক না,

চারু লতা ভালোবাসে এখন নিজেকে,
আর সেটা অনেক বড় পাওয়া।

Rukshat Jahan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here