#চারুলতা_ভালোবেসেছিল
পর্ব৭

লতাকে থাপ্পড় মেরে আমি নিজেই নিজের কাছে ছোট হয়ে গেলাম। হ্যাঁ খুব নোংরা ইঙ্গিত করেছে লতা, কিন্তু এই তীব্র মোহ আর আবেগের সময় তো আমিও পার করেছি। মনের ভিতর কী ভাঙা গড়ার খেলা চলে এই আঠারো উনিশ বছর বয়সে, তা তো আমার অজানা নয়। আমার তো উচিত ছিল লতাকে বুঝিয়ে বলা, নিজের মাথা ঠান্ডা রাখা। কিন্তু আমিও আব্বার মতো মাথা গরম করে শাস্তি দিয়ে ফেললাম। শাসনের মানে তো শুধু গায়ে হাত নয়, একথা আমি নিজেই বলতাম,
আর আজ যখন সময় আসলো, আমিও তাই করলাম যা আব্বা করতেন।
এত বড় একটা মেয়েকে চড় মারাটা অনুচিত, এখন লতার মান অপমান বোধ তীব্র। এই দুনিয়ায় আপন বলতে আমাদের দুই বোনের আর কেউ নেই।
এ সময় হৃদয় ভাইকে নিয়ে আমাদের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব আমাদের আরও একা করে দেবে।

সন্ধ্যার পর থেকে লতা কে আর দেখেনি, নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে আছে। ভয় লাগছে উল্টো পাল্টা কিছু করে ফেলে কিনা। একবার মনে হচ্ছে গিয়ে ক্ষমা চাই থাপ্পড় মারার জন্য, আবার যখন লতার বলা নোংরা কথা গুলো মনে পড়ে, অন্তর টা জ্বলে ওঠে। লতা ঠোঁটকাটা মানলাম, তাই বলে যা মনে আসে তাই কী বলবে! ভাবি খেতে ডেকেছিলেন, কিন্তু লতা বলেছে ওর পেট খারাপ, কিছু খাবে না। আমিও খেতে গেলাম না। ভাবি আমাদের দুইবোনের মধ্যে যে কিছু একটা ঠিক নেই তা বুঝতে পারলেন মনে হলো। আমাকে বলেছেন আমাদের সাথে কথা আছে,৷ বাচ্চাদের ঘুম পারিয়ে এসে কথা বলবেন। ভাবির অপেক্ষায় আমি বারান্দায় বসে আছি।

আজ রাতে বাড়িতে বাইরের লোক কেউ নেই। যে কয়েকজন ছিলেন রাত দশটার মধ্যে খেয়েদেয়ে চলে গিয়েছেন। বাড়িটা একদম নিরব। ভাইয়া ভাবি চলে গেলে আমরা দুইবোন কিভাবে থাকব এই নিশ্চুপ নিস্তব্ধতায়! ভাবতেই কেমন ভয়ভয় লাগে। ভাবির রুম থেকে ঘুম পাড়ানি গান ভেসে আসছে, জমজ দুই ছোট বাচ্চা নিয়ে ভাবি আসলেই দৌঁড়ের উপর থাকে। ভাইয়াকে বাচ্চাদের রাখার ব্যাপারে কোন সাহায্য করতে দেখি না, কিন্তু ছেলেরা কান্না করলে ভাবিকে ধমক দিতে ভোলে না।

আমি বারান্দায় বসে আছি। আজ নিজের রুমে ঘুমাতে হবে, লতাকে ডাকব না ভাবলাম। ও দূরত্ব নিয়ে চললে, আমিও একা থাকতে জানি। এমন সব এলোমেলো ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছি। হঠাৎ প্রচন্ড রকম চমকে উঠলাম, কোমরে কে যেন হাত রাখলো! চমকে ফিরে তাকাতেই দেখি ভাইয়ার শ্যালক, সবুজ ভাই।

“বেয়াইন কি ভয় পেলেন?”

“নাহ ভয় পাইনি, তবে আপনি আমার নাম ধরে ডাকতে পারতেন, এভাবে পিছন থেকে গায়ে হাত দেওয়া অভদ্রতা। ”

” বাপরে! বেয়াইন দেখি রেগে গেলেন। আমি তো ভাবলাম খুশি হবেন। বয়স কম আপনার, তার উপর একা মানুষ। কারো সঙ্গ পাওয়া তো খারাপ না।”

“আপা, ঘুমাবি আয়।”

লতা কখন এসে দাঁড়ালো টেরও পাইনি, কিন্তু এত ভালো লাগছে লতাকে দেখে।

“আর আপনি শুনেন ভাই, আপার একা লাগা নিয়ে না ভেবে নিজের বৌয়ের কথা ভাবেন, আপনি এখানে আছেন, ওদিকে আপনার বৌ না জানি নিজের একা একা লাগা কার কাছে দূর করতেছে।”

সবুজ ভাই অপ্রস্তুত হলেও রেগে গেলেন, চড়া গলায় বললেন, “লতা আর চারু এত ভাব নেওয়ার কিছু নাই। দুপুরে তোমরা দুইবোন ছাদে ঐ পুলিশের জন্য কেমন কামড়াকামড়ি করতেছিলা দেখছি আমি। তাই ভাবলাম একজনরে আমি ঠান্ডা করি।”

বলেই নিজের অশ্লীল হাসিটা দিলেন। ঘৃণায় গা রিরি করে উঠলো আমার। আচ্ছা বিধবা নারী, বয়স্ক অবিবাহিত মেয়ে, প্রবাসীর স্ত্রী, এমন একা নারীদের দেখলে এক শ্রেণীর পুরুষদের কেন মনে হয় যে তারা যেকোন পুরুষের ডাকে সাড়া দেবে! একাকী নারী যেন সহজলভ্য। যে কেউ ইচ্ছে করলেই সুযোগ পাবে ভেবে নেয়।

“সবুজ ভাই কামড়াকামড়ি যখন দেখেছেন, তাহলে আমার থাপ্পড়ও দেখার কথা। আমার বোনকে যদি থাপড়াতে পারি, আপনি কে!!! শুধু ভাবির কথা ভেবে এখনো হাত তুলিনি।”

“দে আপা একটা, অপেক্ষা করছিস কেন? আমাকে তো সাথে সাথে মারতে পারছিস, আর এখন কাজের সময় এত চিন্তার কী আছে।”

সবুজ ভাই হয়তো আমাদের পাল্টা কিছু বলতেন, কিন্তু ভাইয়ার রুমের দরজা খোলার শব্দ হওয়ায়, চোখ রাঙিয়ে সরে গেলেন।

“চারু, লতা কার সাথে কথা বলছিলে?”

“আপনার ভাইয়ের সাথে, আপুর একাকিত্ব নিয়ে খুব চিন্তায় আছেন তিনি।”

আমি কিছু বলার আগেই লতা বলে উঠলো। আমি একটু বিব্রত হলাম, যতই হোক ভাবির আপন ভাই। কথাটা নিশ্চয়ই ভালো ভাবে নেবে না।

“লতা আমার ভাই বলো, আর তোমার ভাই, এমন পুরুষের অভাব নেই যারা বাইরের মহিলার একাকিত্ব নিয়ে এত চিন্তা করে যে ঘরের মানুষটাকে আর সময় দিতে পারে না। ”

ভাবির এত সহজ স্বীকারোক্তি আমরা দুইবোন আশা করিনি, ভেবেছিলাম ভাবি ওনার ভাইয়ের হয়ে প্রতিবাদ করবে। আমাদের কারও মুখে তাই সহসা কোন কথা আসে না। ভাবিই আবার কথা বললেন, “চারু তোমার আর হৃদয়ের কথা আমি কিছু কিছু তোমাদের হিল্লোল ভাইয়ের কাছে শুনেছি, তবে সে যতটুকু বলেছি তাতে নিশ্চয়ই তার নিজের মতো করে কাহিনী বর্ননা করেছে। আমি তোমার কাছে জানতে চাই আসলে কী ছিল, কতটা ছিল? ”

আমি আড়চোখে লতা কে দেখি, লতা ও উৎসুক হয়ে তাকিয়ে আছে।

“ভাবি বলার মতো কোন ঘটনা আসলে নেই। হ্যাঁ আমি মনে মনে সব সময় হৃদয় ভাইকে ভালোবেসেছি, কিন্তু মুখ ফুটে বলার কথা কোনদিন ভাবিনি। আসলে আমি কোনদিন চিন্তা ও করিনি যে ভাইয়াও আমাকে পছন্দ করে। বরং ভাবতাম এই কথা ভাইয়াকে বললে যদি ভাইয়া আমাকে নিয়ে তামাশা করে, বা আব্বার কাছে বলে দেয়। ”

আসলেই আমি কাউকে কোনদিন বলিনি এই গোপন ভালোলাগার কথা, জানতাম শুধু আমি আর আমার ডায়েরি। আবার কথার খেই ধরি, “এরপর একদিন হঠাৎ ফুপু এলেন ঝড়ের মতো, হাতে একটা চিঠি, সেই চিঠি নাকি আমাকে লেখেছেন ভাইয়া। কী লেখা ছিলো সেই চিঠিতে আমি জানি না। তবে ফুপু বলেছিলেন প্রেম পত্র। ”

“তার মানে হৃদয় তোমাকে কখনো সরাসরি কিছু বলেনি, কোন ইশারাও করেনি। কেননা একটা ছেলে যদি কোন মেয়েকে পছন্দ করে, তাহলে মুখে না বললেও তার আচরণে অনেক কিছু প্রকাশ পায়।
কোন ইশারাটা ভালোবাসার, আর কোনটা নোংরা এসব বোঝার তুমুল অনুভূতি মেয়েদের জন্মগত।
হ্যাঁ ভালোবাসার মানুষ চিনতে হয়তো ভুল হতে পারে, তবে প্রেমে পরার আগের অনুভূতি গুলো কিন্তু মিথ্যা না।”

ভাবি একটানে অনেকটা কথা বললেন। আমিও ভাবনায় পরলাম, আসলেই তো সেদিনের সেই চিঠির আগে কখনো এমন মনে হয়নি যে হৃদয় ভাই আমাকে পছন্দ করেন। তবে কি সে চিঠি ষোড়শী সুন্দরী লতার জন্য ছিল, আর ফুপু আমাকে ভেবে ভুল করেছিলেন!!

Rukshat Jahan

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here