#ধারাবাহিকগল্প_পর্ব_২
#চারুলতা_ভালোবেসেছিল
আব্বা যখন মারা যান ঘড়িতে তখন ভোর ৬ টা বেজে ২৩ মিনিট। আমি ফজরের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ জোরে একটা শব্দ কানে আসে,দৌড়ে গিয়ে দেখি আব্বা খাবার ঘরের মেঝেতে পড়ে আছেন। মুখটা কেমন বেঁকে গিয়েছে। স্ট্রোক করেছিলেন আব্বা, এম্বুলেন্স আসতে আসতে সব শেষ।
ভাইয়া রওনা দিয়েছেন সাত টার পর, পাঁচ ঘন্টা অন্ততঃ লাগবে। এখন বাজে এগারোটা, বারোটার আগে ভাইয়ার পৌঁছানোর কথা না। সাথে ভাবি আর বাচ্চারা আসবে কিনা জানি না। কিছু খাবারের ব্যবস্থা করা উচিত, বাচ্চারা এলে যদি খেতে চায়, ছোট মানুষ তো জন্ম মৃত্যর এত কঠিন হিসেব বুঝবে না।
কী আনাবো তাই ভাবছি, মরা বাড়িতে চুলা জ্বালাতে হয় না, রাঁধতে হয় না, মফস্বলে এমনটাই প্রচলিত।
আমাদের অবশ্য তেমন কোন আত্মীয় স্বজন নেই যে প্রতিবেলায় বেলায় খাবার পাঠাবে, তাই দীর্ঘসময় চুলা না জ্বালিয়ে থাকা সম্ভব না, তবে মৃত্যুর কয়েকঘন্টার মধ্যে না জ্বালানোই শোভনীয়। আমার আর লতার নানা বাড়ির দিকে তেমন কেউ নেই। আম্মা যেহেতু মামা মামীর কাছে বড় হয়েছেন তাই ওনার সৎ ভাই বোন কারো সাথে যোগাযোগ নেই। মামাতো ভাই বোনেরাও কেউ তেমন খোঁজ খবর করে না।
একই অবস্থা দাদা বাড়ির দিকে ও, এক ফুপু ছিলেন, গত বছর মারা যান, ফুপাতো ভাই বোনেরা কেউ দেশের বাড়ি থাকে না। ভাইয়ার দু’জন মামা আর খালা দেশের বাড়িতে থাকেন, ওনারা কী আসবেন, আসতেও পারেন, আজ ভাইয়া তার দল ভারী রাখতে চাইবে, দুটি অবলা মেয়েদের কোনঠাসা করতে এর বিকল্প নেই।
তাহলে হয়তো ভাবিও আসবেন, স্বামীর সাথে শক্তি হয়ে। ভাবির সাথে আসলে আমাদের দেখা বা কথা এত কম হয়েছে যে তার সম্পর্কে ধারণা খুব কম। ভাবি ভাইয়ার অফিসেই চাকরি করতেন, একসাথে কাজ করতে গিয়ে ভালোলাগা আর বিয়ে। ওনাদের বিয়েটা একদম ঘরোয়া ভাবে হয়েছিল।
ভাইয়া চাকরিতে ঢোকার পর দেশের বাড়ি খুব কম আসতেন। আমাদের দুইবোনের সাথে তার সবসময় একটা দূরত্ব ছিলো। ভাবিকে পছন্দ হওয়ার পর বাড়িতে জানিয়েছিলেন, আব্বা আম্মাকে সাথে নিয়ে ঢাকায় যায়, সেখানে ভাবির মায়ের বাড়িতে আকদ হয়। আমাদের দুইবোন কে নেওয়া হয়নি। শুনেছিলাম ভাবির বাবা মা এ বিয়েতে খুশি ছিলেন না, তাই কোন আয়োজন করার আগ্রহ ওনাদেরও ছিল না। নিতান্ত মেয়ের ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে মেনে নিয়েছিলেন।
এরপর কয়েকটি ঈদে বাড়ি এসেছিলেন ভাবি, কিন্তু ভাইয়ার সাথে সহজ সম্পর্ক না থাকায় ভাবির সাথেও আমরা মিশতে পারিনি। আমার বিয়ের সময় ভাবির সাথে আব্বার কথা কাটাকাটি হয়, সে সময় আমার বিয়ের বিরোধিতা যদি কেউ করে থাকেন, তাহলে সেটা ভাবি। আমার চেয়ে বয়সে প্রায় তেরো বছরের বড়,স্বল্প শিক্ষিত ছেলের সাথে শুধু আর্থিক অবস্থা ভালো বলে বিয়ে ঠিক করাটা ভাবি মেনে নিতে পারেননি।
যদিও কোন লাভ হয়নি, তাও ভাবি চেষ্টা করেছিলেন আব্বা কে বোঝাতে। এই জন্য একটা ধন্যবাদ দেওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু পারিনি। আব্বার সাথে তর্ক করায় ভাইয়া খুব বিরক্ত হয়, আমার বিয়ে পর্যন্ত আর তারা থাকেনি, হলুদের আগের দিন ঢাকা ফিরে যায়। আমিও চলে যাই নতুন সংসারে।
ভাইয়ার জমজ ছেলে হয়েছে , দুইবছর চলছে বাচ্চাদের । এই বয়সী বাচ্চারা নিশ্চয়ই চিকেন ফ্রাই, কেক এমন খাবার পছন্দ করে। আব্বার দোকানের ছেলেটাকে পাঠিয়েছি, এলাকার সবচেয়ে ভালো বেকারি থেকে ভালো কেক আর বিস্কুট আনতে, চিকেন ফ্রাই পাওয়া যাবে না। আর কয়েকটা নুডলসের প্যাকেট আনতে বলেছি।
আনার বড় জা য়ের মেয়ে দেখতাম খুব নুডলস পছন্দ করতো। নিশ্চয়ই অন্য বাচ্চাদের ও পছন্দ।
ভাইয়া পড়ালেখায় ভালো ছিলেন, আব্বা যখন আম্মাকে বিয়ে করে আনেন, তখন ভাইয়া ক্যাডেট স্কুলে। এরপর ছুটি ছাটায় বাড়ি আসলেও আম্মা থেকে দূরে ই থাকতেন, হয়তো নিজের মায়ের জায়গায় অন্য মহিলাকে মেনে নিতে পারেননি তিনি।
তবে প্রকাশ্যে কখনো ঝগড়া করতে দেখিনি।
ভাইয়া বাড়তি আসতেন, দুই চার দিন নিজের মতো থেকে বাকি সময় টা মামা বা খালার বাসায় কাটাতেন।
আব্বা বা আম্মা কেউ ওনাকে ঘাটাঘাটি করতো না।
আজ ভাইয়া এ বাড়ির একমাত্র পুরুষ কর্তা হয়ে ফিরে আসছেন।
“আপা ভাইয়া কি মারুফ ভাই আর সোহেল ভাইয়ের মতো সম্পত্তি নিয়ে মারামারি করবে? কি মনে হয় তোর? ”
লতা কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
বসার ঘরে অনেক মানুষ, পাড়া প্রতিবেশী, আব্বার পরিচিত লোকজন।
মৃত ব্যক্তির উপর রাগ ধরে রাখতে হয় না, তাই সম্পর্ক ভালো হোক বা খারাপ, পরিচিত অনেকেই এসেছেন শেষ বিদায় দিতে।
মারুফ ভাই আর সোহেল ভাই, হারুন চাচার ছেলে। হারুন চাচার বাড়ি পিছনের গলিতে। চাচার মৃত্যুর পর সম্পত্তি ভাগাভাগি নিয়ে রীতিমতো মারামারি লেগে গিয়েছিল ভাই বোন দের মধ্যে। মারুফ ভাই তো বাঁশ দিয়ে বাড়ি মেরে বোন জামাইয়ের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলেন। পুলিশ এসে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে।
“জানিনা লতা। ভাইয়া তো শিক্ষিত মানুষ, এত নিচে নামবে না। তবে আমাদের ও শক্ত থাকতে হবে। মাথার উপর ছাদের নিশ্চয়তা পেতে হলে ভয় পাওয়া যাবে না।”
” আপা এত মানুষ নিচে, ওনাদের নাস্তার ব্যবস্থা কি করবো। আব্বা তো আমাদের হাতে কোন বাড়তি টাকা দিতো না।
আলমারি কি খুলে দেখবো টাকা আছে কিনা? ”
” কত লাগতে পারে লতা? আমার কাছে জমানো হাজার পাঁচেক আছে, কি আনাবো, চা পরোটা?”
” আপা তোর টাকাটা খরচ করিস না আর। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা, থাক হাতে। এমনিও দেখলাম ঢলু কে এক হাজার টাকা দিলি ভাইয়ার বাচ্চাদের জন্য এটা সেটা আনাতে। ”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিচে তাকিয়ে দেখি একটা মাইক্রোবাস এসে থেমেছে গেটে, ভাইয়া নামছেন সামনের দরজা খুলে।
” নিচে চল লতা, ভাইয়া ভাবি এসেছেন।”
Rukshat Jahan