# হায়েনা(৫ম পর্ব)
ধারাবাহিক গল্প
নাহিদ ফারজানা সোমা
ইস্কাটনে ” জোহরা ভিলা”র দোতলায় নীরব নিরানন্দ একটি ঘর। প্রতি তলায় বড় বসার ঘর, তিনটি শোবার ঘর, খাওয়ার ঘর, ফ্যামিলি লিভিং রুম, একটি গেস্ট রুম। জোহরা নিজে দোতলাটা রেখে তিন ছেলেমেয়ের মধ্যে লটারি করেছিলেন। সুমন নীচতলা পেয়ে খুব রাগ করেছিল। আনিলা তিনতলা,আরিশা চারতলা পেয়েছিল। আরিশার মন্তব্য ছিল, “আহা মা,চারতলায় তোমরা যেয়ে দোতলাটা আমাকে দিয়ে দাওনা?”
আনিলা লটারির কাগজগুলোও ধরেনি, তিনতলা পাওয়ার পরে কোন উচ্ছ্বাস -নিরুচ্ছ্বাস কিছুই দেখায়নি। বাবার করা এই বাড়িতে বাবার প্রথম সন্তানেরই কোন ভাগ নেই মায়ের ষড়যন্ত্রে,ভাইবোনরাও এই অন্যায়ের বিষয়ে নির্বিকার, আনিলার খুব ঘেন্না হচ্ছিল বাপ-মা-ভাই-বোনের উপরে,সেই সাথে নিজের উপরেও। সে ঠিক করে রেখেছিল, কখনোই সে বাপের বাড়ির ভাগ নিবেনা।
আজ জোহরার ফ্ল্যাটের গেস্ট রুমে তিনজন মানুষ। আরিশা ঘুমাচ্ছে, জোহরা আর অশ্রু বসে আছে মুখোমুখি। অশ্রুকে দেখে সামাদ সাহেব বড্ড অবাক হয়েছিলেন, মুখে খুশির রেখাও ফুটে উঠেছিল, কিন্তু জোহরাকে দেখতে পেয়ে মনের ভাবকে দ্রুত চাপা দিয়েছিলেন।
“কেমন আছেন আব্বা?”
“ভালো।”
সামাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে গেলেন,যখন জোহরা নরম গলায় বললেন, “অশ্রু, এই ঘরে আয়।”
জোহরার পিছনে আরিশা।তিনজন মিলে গেস্ট রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিয়েছিল।
“অশ্রু, এই বাচ্চাটা আগে নস্ট করতে হবে।”
“তিন মাসের বাচ্চা নষ্ট করবেন? বাচ্চা এখন কতগুলো কোষের দলা নয়,রীতিমতো একটা প্রাণ। তাছাড়া আরিশারও রিস্ক আছে।”
“রিস্ক থাকলে কি করার আছে? এই বাচ্চা রাখা যায়?
রাখলে একসময় সবাই বুঝবে মেয়েটা প্রেগন্যান্ট। তখন মানুষকে কি উত্তর দিব? ”
কথাটা যৌক্তিক। আবার একটা প্রাণ নষ্ট করার অনুমতি কি ভাবে দেওয়া যায়?
“অশ্রু। ”
“জ্বী।”
“কি করবো?”
“আমি বুঝতে পারছি না। আরিশাকে একবার জিজ্ঞেস করি।”
“ওকে কি জিজ্ঞেস করবি? নষ্ট মেয়ে। নইলে নিজের দুলাভাই এর সাথে_” জোহরা চোখে আঁচল চাপা দিলেন।
অশ্রুর গা আবার ঘিনঘিন করে উঠলো। ইচ্ছা হলো,আসিফ আর আরিশাকে খুন করে ফেলে।
এই দুই শয়তান তার আদরের আনিলাকে ঠকিয়েছে। অশ্রুর মনের পৃথিবীতে বাস করে কয়জনই বা? মৃত মা, মমতাময়ী স্ত্রী, পঙ্গু সন্তান, কলিজার টুকরো বোন আনিলা,আনিলার ছেলে। আরও কয়েকজন আছে তার ভালোবাসার মানুষ। খুব কপাল,সে এতো ভালো শ্বশুর বাড়ি পেয়েছে। অর্থ নেই, কিন্তু ভালোবাসা আর মমতার সমুদ্র একেকজন। যত্নে-আদরে-ভালোবাসা আর সম্মান দিয়ে অশ্রুর অনেক ক্ষত সারিয়ে তুলেছে তারা। তাছাড়াও কিছু বন্ধু আছে,কয়েকজন শিক্ষক আছেন যাদের ভূমিকা অশ্রুর জীবনে অনেক।
আনিলা আর ভাগ্নেকে এখনই নিয়ে আসতে ইচ্ছে হচ্ছে ওই প্রতারক, শয়তানটার কাছ থেকে। আনবে তো বটেই, বোন-ভাগ্নেকে নিজের বাসায় মাথায় তুলে রাখবে অশ্রু আর রেণু,কিন্তু এমন ভাবে সবকিছু করতে হবে যেন আনিলার মেন্টাল ট্রমা বেশি না হয়।
“অশ্রু, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি।বাচ্চা নষ্ট করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। ”
আরিশা এই সময়ে চোখ খুললো। স্পষ্ট গলায় বললো,”উঁহু,আমি বাচ্চা নষ্ট করবো না।”
এই হলো মা জাত! অশ্রুর মায়াই লাগলো আরিশার প্রতি।
জোহরা বেগম খেঁকিয়ে উঠলেন,”বাচ্চা নষ্ট করবি না?কি করবি তাহলে?ওই লোফারতো তোকে ঘাড় ধরে বের করে দিল। আবার ওর কাছে ফিরে যাবি?ওর মিসট্রেস হয়ে থাকবি? ”
“না। ওই বদটাকে অনেক পয়সাওয়ালা ভাবতাম।এখনতো দেখলাম,বাপের টাকা ছাড়া বলদটা রাস্তার ভিখারি। ওর আছেটা কি?”
“তাহলে কি করবি পেটের শত্রু নিয়ে? তাকে নস্ট না করে পূজা করবি নাকি?”
“বাচ্চার বাবাকে বাধ্য করবো আমাকে বিয়ে করতে।”
“মানে?”
“মানে আর কি?আমিতো আগে থেকেই জানি,বাচ্চার বাবা কে।তোমার বড় মেয়ের যেন সর্বনাশ না হয়,তাই সময়মতো তার বরকে ছেড়ে দিয়েছিলাম। এখন তাকে ধরবো। আমার নিজের কথাওতো আমাকে ভাবতে হবে,তাইনা?”
জোহরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন আরিশার উপর। ” মেরে ফেলবো তোকে। নিজের হাতে গলা টিপে মেরে ফেলবো শয়তানের বাচ্চা। আমার আনিলার সংসারে যদি নাক গলাস, আল্লাহর কসম,তোকে আমি নিজে শেষ করবো।”
অশ্রু বললো,,”আনিলা আর সায়নকে আমি ওই নোংরা লোকটার কাছে রাখবো না। আমার বাসায় নিয়ে যাবো, মাথায় তুলে রাখবো ওকে। আমার বোন আর ভাগ্নেকে আমি সাধ্যমতো ভালো রাখবো।”
“সেটা তুই করবি বাবা,আমি জানি। কিন্তু কি দরকার আনিলাকে এসব জানানোর?ওর মনটা ভেঙে দেওয়ার?অশ্রু, আনিলা তার ছেলে নিয়ে নিজের সংসারে মাথা উঁচু করে থাকবে,ওর স্বামী ওরই থাকবে।”
“এমন স্বামীর কাছে কেন থাকবে আমার বোন?একটা চরিত্রহীন?একটা ঠগবাজ? ও আমার বোনের যোগ্য নয়। কি দুর্ভাগ্য! এমন একটা ছেলের সাথে আমি আমার বোনের বিয়ে ঠিক করেছিলাম। আমি নিজেকে কোনদিন ক্ষমা করতে পারবো না।”
“সে যাই হোক অশ্রু, আনিলাকে কিচ্ছু জানতে দেওয়া যাবে না। কি কষ্ট পাবে আমার মেয়ে! কত অপমানিত হবে,চিন্তা করতো। আমি এই মেয়ের পেট আজকেই খালাস করাবো।এটাই ফাইনাল। আর এই নোংরা মেয়েটার মুখ থেকে যদি একটা কথা আমার জীবদ্দশায় বের হয়, ওকে আমি নিজের হাতে খুন করবো, দেখিস অশ্রু। ”
আরিশা মনমরা হয়ে আছে। ফেলে দেওয়া বাচ্চার জন্য
নয়, ভবিষ্যৎ নিয়ে সে উদ্বিগ্ন। তার কেলেংকারীর কথা কেউ জানবে না, তা সে জানে, কিন্তু এই যে তাল তাল নগদ টাকা, নিত্যনতুন দামী উপহার,চাইনিজ, হাই ফাই হোটেলে থাকা-এগুলোর কি গতি হবে? মা তার বাচ্চা খালাসের ব্যবস্থা করেছে অতি নিপুণ ভাবে,কাকপক্ষীও টের পায়নি।কলেজে যেয়ে টিচার -বন্ধু বান্ধবকে রাজ্যের মিথ্যা কথা বলে মা একেবারে নরম হালুয়া বানিয়ে ফেলেছে, সবাই আক্ষেপ করছে কেন তারা আরিশার মতো এতো ভালো মেয়েকে ভুল বুঝলো।
বিলাসিতার রসদ এখন কোথা থেকে জুটবে,সেই চিন্তায় আরিশা একেবারে কাতর হয়ে পড়লো। তাছাড়া পুরুষসঙ্গ তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন কি হবে?
জোহরা মেয়ের সাথে কথা বলেন না। আনিলার স্বামীর সাথে না জড়ালে তিনি অতি সহজেই আরিশাকে ক্ষমা করে দিতেন। এখন এই মেয়ের মুখের দিকে তাকালেও তার রাগ হয়। আর আসিফের কথা ভাবলেও গা গুলিয়ে ওঠে।
অশ্রু বলেছে আনিলাকে সব খুলে বলা হোক। তারপর আসিফকে ডিভোর্স দিয়ে আনিলা চলে আসুক তাদের কাছে ছেলেকে নিয়ে। একদিন নয়,দুদিন নয়, প্রায় বছর খানিক এই ছেলে আনিলাকে ঠকিয়ে তারই বোনের সাথে কুৎসিত সময় কাটিয়েছে, হীরের আংটি-মুক্তার সেট উপহার দিয়েছে, দামী মোবাইল গিফট করেছে, এমন ছেলের সাথে কেন আনিলার মতো একটা মেয়ে থাকবে? জোহরা বুঝেন,অশ্রুর কথা ঠিক, কিন্তু এসব শুনে আনিলা যদি আত্মহত্যা করে? আত্মহত্যা না করলেও নিদারুণ আঘাত পাবে,অপমানিত হবে,এতে তো কোন সন্দেহ নেই। তাছাড়া আনিলা ডিভোর্স দেওয়ার সাথে সাথে ওই বদমাশ আর এই রাক্ষসী বিয়ে করবে নিশ্চিত। চোখের সামনে এসব দেখলে আনিলা প্রতি মুহূর্তে কষ্টের আগুনে পুড়বে না? বরং কিছুই না জানলো,সেই ভালো।
জোহরার কথামতো অশ্রু তার অফিসে আসিফকে ডেকে পাঠালো।
“কি ব্যাপার দাদা?হঠাৎ অফিসে ডাক?”
“এই ভিডিও দেখো।”
আসিফ দেখলো। প্রথমে সামান্য চমকালেও পরে নির্বিকার।
“তোমার খারাপ লাগছে না?”
“না।”
অশ্রু হতবাক হয়ে যায়।
“ব্যাপারটা আমার একার ইচ্ছায় ঘটেনি, আমার থেকেও আপনার বোনের ইচ্ছা,তৎপরতা একশো গুণ বেশি ছিল। ”
“আনিলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা কি করে করলে?”
“দাদা,আপনার বাপ আপনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নি?আপনার সৎ মা করে নি?আরিশা মায়ের পেটের বোনের সাথে করেনি? চার্জ করলে সবাইকে করেন?শুধু আমাকে কেন?”
“কে কি করেছে তার কথা আপাতত বাদ দাও। তোমার নিজের কথা বলো। আনিলার মতো একটা মেয়েকে ঠকালে কি করে?”
“আনিলার মতো মানে? সে কোন্ স্পেশাল জিনিস? কোন দিক দিয়ে আহামরি কিছু? চেহারা?বিদ্যাবুদ্ধি?
কোনো পুরুষকে খুশি রাখার ক্ষমতা? সবদিক দিয়েই জিরো। ”
অশ্রু হতভম্ব হয়ে গেল। মানুষ এতো নির্লজ্জ, এতো বিবেকহীন হতে পারে? অবশ্য পারবে নাই বা কেন? তার বাবা,সৎ মা, আনিলার নানা-নানি, অভি, আসিফ সবাই এক গাছেরই ছাল। স্বার্থপর, লোভী। কেউ অর্থ লোভী,কেউ দেহলোভী। হায়েনা কি এদের থেকেও নিষ্ঠুর? মনে হয়, না। স্রষ্টা তো হায়েনাকে বিবেক বুদ্ধি দেন নি। মানুষকে দিয়েছেন।
“কি ভাবছেন?আনিলার মা’কে বলবেন,এই ভিডিও দেখিয়ে আমাকে কাবু করা যাবেনা। এখানে তার বেহায়া মেয়েকেই দেখা যাচ্ছে বেশি। সে যদি তার মেয়ের শরীর দেখিয়ে বিজনেস করতে চায়,করতে পারে।’
সময় বয়ে যায়। জোহরা হন্যে হয়ে আরিশার জন্য পাত্র দেখেন। এই মেয়ের পড়ালেখা হবেনা। তার নজর সাজগোজ, টাকা-পয়সা আর ছেলেদের উপর। আবার কেলেঙ্কারি করার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। আরিশা তাঁর চেয়েও চতুর,স্বার্থপর, বাঘের উপর টাগ আর কি!
আনিলা মা’কে বাধা দেয়। ” এতো অল্প বয়সে আরিশার বিয়ে কেন দিতে চাও মা? পড়ালেখা কমপ্লিট করুক।”
“তোমার বোনের লেখাপড়া আর না করলেও চলবে। এমনিতেই বহুৎ পড়ে ফেলেছে। এখন নমঃ নমঃ করে বিদায় দিতে পারলে বাঁচি।”
মা আরিশার বিয়ের জন্য এতো মরিয়া কেন হয়ে উঠলেন,আনিলা বুঝতে পারেনা। বাসায় কিছু একটা হয়েছে। সে কিছু দিন পরপর আসে, মা আর আরিশার মধ্যে সেই গলাগলি ভাব আর দেখেনা। এক সন্ধ্যায় মায়ের ফোন পেয়ে সে বাসায় যায়। জোহরা তাকে নিজের ঘরে নিয়ে দরজা আটকে দেন আর তাকে বিস্ময়ে পাথর করে দিয়ে জানান,একটু পরেই আরিশার বিয়ে।
এটা কি করে সম্ভব? ছোট বোনের বিয়ে, বড় বোন জানলো আধাঘন্টা আগে?
” শোন,তোমার বোন একটা বাজে ছেলের পাল্লায় পড়েছে। নেশা ভাং করা ছেলে। মেয়েমানুষের নেশাও আছে। সেই ছেলেকে তোমার বোন বিয়ে করবেই, ছেলে কাল এসে আমাকে শাসিয়ে গেছে, আমরা যদি ওর সাথে আরিশার বিয়ে না দেই, তাহলে সে আরিশার মুখ পুড়িয়ে দিবে এসিড মেরে। আমার ছোট বেলার এক বান্ধবী, তোরা চিনবিনা, কিছুদিন আগে আমার সাথে আরিশাকে মার্কেটে দেখেছিল, দেখেই তার মাথা খারাপ, সে তার বোনের ছেলের জন্য সম্বন্ধ নিয়ে এসেছে। আজ ছেলে আর তার মা এসে আরিশাকে দেখে একদম ফিদা, আমি আবার ঐ মাস্তানের কাহিনী বললাম,শুনে ছেলের মা আর রিস্ক নিতে চাইলো না। বললো,আজই বিয়ে দিয়ে বৌ নিয়ে যাবে। আরিশার কোন বিপদ থাকবে না। আমিও আপত্তি করলাম না।
ছেলে বিরাট ব্যবসায়ী, তিন পুরুষ ধরে এই ব্যবসা, ছেলে হোটেল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেছে অ্যামেরিকা থেকে, বাড়ির সবাই উচ্চ শিক্ষিত, ভালো মানুষ, এর থেকে ভালো প্রস্তাব আর এই মুহূর্তে হয়না।”
“আসিফ, আমার শ্বশুরকুলের লোক আসবে না?নিদেন পক্ষে শ্বশুর -শাশুড়ি? ”
“না রে মা, খুব চুপেচাপে বিয়েটা দিচ্ছি, তোর নানী,মামা-খালাদেরও বলিনি,আমরা আমরাই। পরে সবাইকে বুঝিয়ে বললে কারোর তো মাইন্ড করার কথা না। মেয়েটার জীবন আগে না সামাজিকতা আগে? ”
তা অবশ্য ঠিক। আনিলা বোনের কাছে যেতে চায়। জোহরা বাধা দেন।
“এখনই যাস না আনিলা, মেয়ের ওই মাস্তানের জন্য আহাজারির শেষ নেই, সবার সাথে খারাপ ব্যবহার করছে, তোর সাথেও করতে পারে,বানিয়ে হাজারটা কথা বলতে পারে।আমি যখন যাবো,তখন আমার সাথে তুই যাস,বিয়ে পড়ানোর সময়। একমাত্র আমাকেই সমঝে চলে।”
আসলেই আরিশা তার মা’কে এখন ভয়ংকর সমঝে চলছে। সেদিনের কথা ভাবলে এখনো তার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যায়। সবাই ঘুমিয়ে গেছে ভেবে রাতে সে আসিফের সাথে ফোনে খুব সন্তর্পণে কথা বলছিল, আসিফকে সে এখনও প্রচন্ড ভালোবাসে,আবার সে তার কাছে ফিরতে চায়, আনিলাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ডিভোর্স দিয়ে আসিফ আরিশাকে বিয়ে করুক,এসব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছিল। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় পিছনে ফিরে দেখলো জোহরা দাঁড়িয়ে আছেন। তারপরের ব্যাপারটা এ জীবনে ভোলার নয়। জোহরা মেয়ের চুলের মুঠি ধরে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন, হাতে আজদাহা এক বঁটি, হিসহিসিয়ে বললেন,”তোকে সত্যি আজ জবাই করে ফেলবো। আমার ফাঁসি হলে হবে।কিন্তু তোকে আমি আজ শেষ করে ফেলবো,কসম। ”
আরিশা ভয়ে থরথর করে কাঁপছিলো।মা’কে ভয়ংকর এক রাক্ষসীর মতো দেখাচ্ছিল। মা’র চোখগুলো ঠেলে বাইরে বের হয়ে আসছিল। অনেক হাতে-পায়ে ধরে,বিভিন্ন কিরা-কসম কেটে আরিশা সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিলো। তবে জোহরা আরিশাকে ইচ্ছে মতো এলোপাথাড়ি মেরেছিলেন। আসিফের সাথে যদি আর কখনো আরিশা এতোটুকু যোগাযোগ করে, মেয়েকে মেরে ফেলতে তাঁর বিন্দুমাত্র হাত কাঁপবেনা সেটা জানিয়ে দিয়েছিলেন স্পষ্ট করে, আর হ্যাঁ, যেখানে তিনি আরিশার বিয়ে ঠিক করবেন,বিনা বাক্যব্যয়ে তাকে সেই ছেলেকেই মেনে নিয়ে সংসার করতে হবে তাও পরিস্কার করে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
পাত্র তিনি ঘটকের মাধ্যমে ঠিক করেছেন। ব্যবসায়ী। চল্লিশ বছর বয়স। দেখতে অবশ্য খুবই হ্যান্ডসাম। বৌ আছে, একটা বাচ্চা আছে, বৌকে ভালো লাগেনা,দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়, বৌ কোনো ঝামেলা করতে পারবেনা, তার বাপ-মা নেই, অ্যাকসিডেন্টে মারা গেছেন, ভাইবোনরা কেউ বোন আর ভাগ্নির দায়িত্ব নিবে না,নিশ্চিত, তাদের আর্থিক অবস্থাও সুবিধার নয়, বৌটার বিদ্যাবুদ্ধি, সাহস কোনটাই নেই যে সে স্বামীর দ্বিতীয় বিয়েতে বাধা দিতে পারবে, লোকটার অনেক টাকাপয়সা, জোহরা রাজি হয়ে গেলেন।
অশ্রু হতভম্ব গলায় জোহরাকে বলেছিল “দোজবরের কাছে ওকে বিয়ে দিবেন?আরেকটা মেয়ের সংসার নস্ট করে?”
“আমরা নষ্ট না করলেও ওর সংসার নষ্ট হতো। এই ছেলে আরেকটা বিয়ে করেই ছাড়বে। তাহলে আরিশাই তার বৌ হোক। সে যা চায় তাইতো পেলো।সুন্দর বর,মেলা টাকা পয়সা।”
“আপনি আনিলার সংসার বাঁচানোর জন্য আরেকটা মেয়ের সংসার তছনছ করে দিবেন?”
“আরে বাবা,বলছি কি,ওই ছেলে তো অলরেডি বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজেই বেড়াচ্ছিলো।”
“লোকটা যদি প্রথম বৌকে এতো অপছন্দ করে,তাহলে ডিভোর্স দেয়নি কেন?”
“ওইতো এক মহাজ্বালা। ছেলের বাপ আবার বৌমা বলতে অজ্ঞান। বুড়ো না মরা পর্যন্ত ডিভোর্স দেওয়া
সম্ভব না। বুড়া-বুড়ি ওই বৌকে নিয়ে তাদের ধানমন্ডির বাড়িতে থাকবে,আর আরিশাকে নিয়ে জামাই গুলশানের ফ্ল্যাটে থাকবে। বাড়ি আরিশার নামেই হবে।আমি কথা বলে নিয়েছি।”
অশ্রু কথা বাড়ায় না।কিন্তু তার মনটা না দেখা সেই মেয়ে আর তার সন্তানের জন্য হুহু করে ওঠে। তারতো এই বিয়ে ভেঙে দেওয়ার শক্তি,সাহস কোনটাই নেই।
নতুন জামাই এর ব্যাপার স্যাপার শুধু সামাদ সাহেব,জোহরা বেগম, অশ্রু আর আরিশাই জানে। বাকি সবার জন্য জোহরা একই গল্প বানিয়েছেন।
ছেলে এলো তার বড় বোন, একমাত্র ভাই -ভাবী, আর চারজন বন্ধু নিয়ে। নেওয়াজের ভাই বোনেরা আবার আগের বৌকে দেখতে পারেনা। গরীব, গাঁইয়া কিসিমের। বিদ্যা নাই,বুদ্ধি নাই, রূপ নাই, বাপের বাড়ির মুরোদ নাই, এমন মেয়েকে পুঁছে কে? অনেক সময় বৌএর দুর্গতি দেখতে জা, ননদের ভালো লাগে বৈকি।
ঘরেই জোহরা অনেক আয়োজন করেছিলেন। মেয়ের জন্য গয়নাগাটি বহু আগের থেকেই তৈরি করে রেখেছিলেন। সেই সাথে শাড়ি আর সালোয়ার কামিজের বাহার। দেনমোহরের কথা উঠলে ছেলে নিজেই বললো,”আপনারা যা বলবেন,তাই।”
জোহরা বললেন,” বিশলাখ।”
নতুন জামাই হেসে ফেললো। বললো,”তিরিশ লাখ উইদাউট অরনামেন্টস। আজকেই আরিশাকে ক্যাশ দিয়ে দিব।”
আরিশার মুখ আলো হয়ে গেলো। জোহরার হাসি তাঁর দুই কান স্পর্শ করলো। সামাদ সাহেব “আলহামদুলিল্লাহ ” বললেন। সুমন অদ্ভুত ভঙ্গিতে বলে উঠলো, “ওয়াও! জিজুর পায়ে ঠেকাই মাথা।”
আনিলা ফিসফিস করে অশ্রুকে বললো,”মানুষ এতো টাকা কিভাবে বানায় রে দাদা?”
বিদায়ের সময় জোহরা আরিশাকে বুকে টেনে ফিসফিস করে বললেন,”শোন্, জামাইকে বেশি করে খুশি রাখবি। পুরুষ মানুষ কি পেলে গোলাম হয়ে যায়,জানিসতো? জয়েন্ট অ্যাকাউন্ট খুলে ফেলিস যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। আমি তোকে সময় মতো সব বলে বলে দিব। ”
চলবে।