#সাহেব_বাবুর_বউ- [০৭]
রানীমাকে নিজের সাথে চেপে ধরে আহনাফ। বুক কাঁপছে থরথর করে। বহুক্ষণ পরে কথা বলল,
“নূরি আমাকে ভালোবাসে!”
“নিজের থেকেও বেশী। তোমাদের গল্প কোন ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নয়। এ এক অমর প্রেমের গল্প।”
“আমাকে আগে কেন বলোনি তোমরা?”
” বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু নূরির নিষেধ ছিলো। ডাক্তারের কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলত মেয়েটা। তাইতো তোমাকে দিনের পর দিন শক থেরাপি দিয়েছে। মেয়েটা চেয়েছিল তার সাহেব বাবুকে ফিরে পেতে আহনাফ কে নয়। তাইতো সে দিনরাত্রি চেষ্টা করে গেছে তোমার স্মৃতি ফেরানোর।”
রানীমাকে ছেড়ে দাঁড়ায় আহনাফ। দুহাতে মুখ চেপো ধরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। মাথাটা কেমন দুলাচ্চে। ভূমিকম্প হচ্চে মনে হয়। স্বাভাবিক হয়ে সময় নেয় তারপর বলে,
” আমাকে আরো আগে বলা উচিৎ ছিলো। দিনের পর দিন মেয়েটাকে কষ্ট দিয়েছি আমি। আমার স্মৃতি বড় নাকি প্রেম বড়? তোমরা চিন্তা করো না, আমার স্মৃতি ফিরুক আর নাই ফিরুক তাতে কিছু যায় আসে না। আমার নূরি,, না নূর ও এখন থেকে আমাকে ওর সাহেব বলেই জানবে। স্মৃতি ফিরবে ওর সাহেবের। এত বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে একটু আকটু ভুল ভ্রান্তি হতেই পারে।” আহনাফের কথা বুঝতে না পেরে রানীমা প্রশ্ন করলেন, “মানে?” আহনাফ বলে, ” দেখতে থাকো। তোমাদের এই পাগল নাতীর উপর একটু ভরসা রাখো। তবে আজকের কথা কাউকে জানবে না। আমার স্মৃতি ফিরলেও নয়।”
“ডাক্তারকে জানাবো?”
“একদম-ই না। উনিই তো যত নষ্টের গোড়া। এই কথাগুলো শুধু তুমি আর আমি জানবো। কথা দাও। তোমাদের পূর্ব পুরুষদের অনুশাসনের নামে প্রতিঞ্জা করো। এখন আমাকে একটু একা থাকতে দাও।”
পরেরদিন কলেজে যেতেই মেঘনা এসে আহনাফের হাত জড়িয়ে ধরে বলে, বাহিরে ঘুরতে যাবে। আহনাফের উত্তর শুনে চমকে উঠে মেঘনা। এটা শুধু মেঘনার মাঝেই সিমাবদ্ধ রইলো না। শান্ত শিষ্ট নম্র আহনাফকে দেখে ওর গ্যাং ও আচার্য হলো। আহনাফ চুপচাপ বসে আছে। মন আর মাথা জুরে এখন শুধু নূরের বসবাস। নূরি আজ কলেজে আসে নি। আহনাফ নূরির অপেক্ষা করছে। নূরির ওই কাজল কালো ডাগর ডাগর চোখ দুটো। সাহেবের ডাইরিতে নূরির কাজল কালো দীঘীর মতো চোখের বর্ণনা দেওয়া আছে। সাহেবের সম্পত্তিতে হাত পরেছে আহনাফের। রানীমার কাছেই ছিলো সাহেবের ডাইরি। কাল রানীমা ওটা আহনাফকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সারারাত ভরে ডাইরিটা পড়েছে আহনাফ।
কলেজে এসেছে নূরি, আরো অন্তর্মুখী আরো চুপচাপ। সামনে গ্যাংটাকে দেখে চুপচাপ এগিয়ে গেলো। আহনাফও আজ কোন বিদ্রুপ করে নি। দামি সানগ্লাসের ভিতর থেকে নূরিকে এক পলক দেখে নিলো। নূরি চুপচাপ সামনে এগিয়ে গেলো। মনে পড়ে যায় সাহেবের কথা। সব শেষ সাহেবের সাথে দেখা হয়েছিলো এয়ারপোর্টে। সাহেব সেদিন ইংল্যান্ড চলে যায়। যাওয়ার বারবার নূরিকে দেখছিলো সে। নূরি প্রশ্ন করে,
“এভাবে আমাকে দেখছো কেন সাহেব?”
” তোকে কোটরবন্ধি করে নিতে চাই। তোকে না দেখে এতদিন থাকবো কি করে বলতো নূর!” চোখে জল চলে আসে নূরির। তুমি আমাকে ভুলে গেছো সাহেব। তুমি আমাকে ভুলে যাও তাতে আমাকে কোন দুঃখ নাই শুধু নিজেকে ফিরে পাও তুমি। তোমার এই উটশৃঙ্খল ভ্যাগাবন্ডমার্কা জিবন যে আমার সহ্য হয় না। পিছন ফিরে আহনাফের দিকে তাকায় নূরি। নিজের মনকে সংযোত করে বেধে ফেলে নূরি। যতই প্রলোভন আসুক ভেসে যেতে দিবে না সে। আহনাফ নয় সাহেব একমাত্র তার পার্থিব পুরুষ। অন্য কারো দিকে নজর দিবে না সে।
রেজাল্ট সিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে নূরি মুনমুন হাসি আর ওদের আরো অনেক ক্লাসমেট। সেকেন্ড ইয়ারের রেজাল্ট আউট হয়েছো আজ। রেজাল্ট দেখে মৃদু হাসে নূরি। পাশ থেকে মৃুনমুন বলে, “আহনাফ সারাদিন বেপরোয়ার মতো ঘুরেফিরে ক্লাসে মনোযোগ নেই তাও আবার টপ করে কি-ভাবে আমার মাথায় আসে না।” মৃুনমুনের কথা শুনে হাসি বলে, “শুনেছি বড় সাহেবের দাদা এই কলেজ প্রতিষ্ঠা করছে, হতেই পারে আহনাফ কোন সুবিধা পায়। নাহলে ওর মতো একটা ছেলে টপ করা অসম্ভব।” ওদের দুজনের কথা শুনে নূরি স্মিথ হেসে বলে, ” যে ছেলেটা অক্সফোর্ডে টপ রেজাল্ট করে তার কাছে এসব পান্তাভাত।”
“মানে?” নূরি হাসে কিছু বলে না। মনে মনে বলে উঠে, আমি জানি সাহেব তুমিই টপ করবা। জানো রানীমা যেদিন বলল, তুমি আমাদের ক্লাসে ভর্তি হবে সেদিন ই বলেছিলাম, সারাদিন ঘুরেফিরে পরে দেখবে ক্লাসে টপ করেছে। আমার কথা রানীমা হেসেচিলো তবে তোমাকে হাড়িয়ে অনেক কষ্টা পাচ্ছে রানীমা বড় বাবু। সেদিন আর ক্লাস করা হলো না নূরির। কলেজ ছেড়ে চলে আসে দীঘীর পাড়ে। পানিতে পা ডুবিয়ে বসে সাহেবের দেওয়া আংটিটা নাড়াচাড়া করছিলো নূরি। পরনে মিষ্টি কালারের টাংগাইলের তাঁতের শাড়ি। পিঠজুড়ে হেলাফলা করে উঠছে কৃষ্ণভ্রমরের মতো রাশী রাশী চুলগুলো। নূরি জানেনা ওকে এই বেসে দেখে কারো নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। নূরির এই মলিন মুখটা দেতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে আহনাফের। মনে মনে বলে, এই ভাবে কষ্ট পেতে থাকলে তো মরে যাবে মেয়েটা।” সাথে সাথে জিভ কাটে আহনাফ এটা ও কি বলল। পরক্ষনে বলে, কিচ্ছু হবে না তোমার নূর। আমাকে টপকে তবেই মৃত্যু তোমার কাছে যেতে পারবে। আমি সব সময় ঢাল হয়ে তোমার পাশে থাকবো।
রানীমার সাথে করা করা প্ল্যান অনুযায়ী আহনাফ নূরির পাশে গিয়ে বসে। নূরি তখনো চুপচাপ একমনে ভেবে যাচ্ছে সাহেবের কথা। ওর পাশে কারো উপস্থিতি টেরই পায়নি সে। আহনাফ গলা খাক্কারি দিলে সম্মিত ফিরে নূরির। পাশে আহনাফকে দেখে অবাক হয় সে। প্রশ্ন করে, “তুমি এখানে?” নূরির প্রশ্নের কোন জবাব দেয় না আহনাফ। শান্ত দৃষ্টিতে নূরির মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, “এভানে নিজেকে কষ্ট দিলে কি তোমার সাহেব বাবু ফিরে আসবে। যে চলে গেছে সে তো ফিরবে না কখনো। এভাবে নিজেকে কষ্ট দিওনা নূরি। তোমার পুরোটা জিবন পরে আছে। তোমাকে বাচতে হবে। ভালোভাবে হাসিখুশিতে বাঁচতে হবে।”
“কার জন্যে বাচবো আমি। সাহেব যে আমার সবটা নিয়ে চলে গেছে। কেউ হতে পারবে না ওর মতোন। তুমি ভাবতেও পারবে না সাহেব কি ছিলো। ওমন আদর্শবান, অনুকরণীয় অনুশাসনের মতো কেউ হতে পারবে না। আমি কাউকে সাহেবের জায়গা দিতে পারবো না।” আহনাফ নূরির হাত ধরে তারপর বলে,
” ওমন আদর্শবান ছেলে তুমি পাবে না। ওমন ভালো ছেলেও পাবে না। তবে একটা খারাপ ছেলে পেলে পেতে পারো। যে তোমাকে সেই সুখ সেই ভালোবাসা দিবে। সাহেবের জায়গা চাইনা আমি। আমাকে শুধু তোমার মনে একটু ঠাই দিও।”
মাথা নিচু করে বসে আছে নূরি। চোখদুটো পানিতে টইটম্বুর। সাহেব সবকিছু সহ্য করতে পারে কিন্তু ওর ভালোবাসার অপমান সে সহ্য করবে না। একদিন ঠাট্টা করেছিল নূরি তখন রেগে সাহেব বলে, তুই যা খুশি তাই কর তবে আমার ভালোবাসা অপমান করবি তাহলে আমি অন্য মানুষ হয়ে যাবো। অজান্তেই চোখ থেকে জল গড়িয়ে পরলো। মনে মনে বলল, “আমাকে তুমি মাফ করো সাহেব। আমি পাড়লাম না তোমার ভালোবাসা গ্রহন করতে।” আহনাফের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয় নূরি। তারপর বলে, কি আবোলতাবোল বকছো তুমি। যাকে নিজের পাশে বসার যোগ্যতা মনে করো আজ তার জন্যে ভালোবাসা উতলিবে পরছে। কে খারাপ ছেলে কে মন্দ ছেলে। আমাকে নতুন করে কষ্ট দেওয়ার ফন্দি।”
“এমন করে কেন বলছো। মানছি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি কিন্তু তুমিও তো কম যাওনা।”
” আমাকে এখন যেতে হবে।” উঠে দাঁড়ায় নূরি। সামনে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে যায়। আবারো অবঞ্জা করছে নূরি, রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে আহনাফের। নূরির পিছু যেতে থাকে। দীঘীর পাড় থেকে একটা রাস্তায় এসে দাঁড়ায় নূরি। তিন মোরের রাস্তায়। সেখানে দাঁড়িয়ে অটোর জন্যে অপেক্ষা করছে নূরি। আহনাফ ও ওর পিছু আসছে আর মনে মনে ভাবছে”,
“অভিমানী মেয়ে গুলোর প্রেম ভালোবাসার প্যারা অনেক ।তারা তাদের ভালোবাসার মতই অভিমান করে বসে তাও তীব্রভাবে । আপনাকে সে কিছুই বলবে না । জানাবে না কেন, তার কষ্ট হচ্ছে । বুকের ভিতর এক আকাশ অভিমান নিয়ে আপনার সাথে স্বাভাবিক কথাবার্তা বলবে । কিন্তু সে যত স্বাভাবিক হবে ততই তার অভিমান ভিতরে ভিতরে পোষে রাখার ক্ষমতা বাড়তে থাকবে । দেখবেন যে মেয়েটি ছোট ছোট বিষয় নিয়ে আপনার সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দেয় সেই মেয়েটির হুট করে চুপ হয়ে যাওয়া মানেই আপনার সাথে অনেক দুরত্ব তৈরী করা শুরু করেছে । ভালোবাসার মানুষটার জন্য এমন টাইপ মেয়ে গুলো যেমন রোজ ভিখারীর মত দাঁড়াতে পারে প্রেমিকের দরজায়। তেমনি একবার মনে আঘাত লাগলে যখন মুখ ফিরিয়ে নিবে তখন কখনো আপনার দরজায় আর ফিরবে না । আমরন নিজের কাছে আপনাকে লুকিয়ে রেখে ভালোবেসে মরবে তবুও আপনার কাছে নিজেকে কখনো আর প্রকাশ করবে না।”
আহনাফকে পিছনে দেখে নূরি সামনের দিকে এগোতে থাকে। আনমনা হয়ে হাটছে রাস্তায়। ওর পিছনে আহনাফ ও আসছে। হঠাৎ আহনাফের খেয়াল হলো নূরির সামনে একটা ট্রাক দ্রুত গতিতে আসছে। নূরির সেদিকে খেয়াল নেই সে শুধু সামনের দিকে হেটে যাচ্ছে। আহনাফ কিছুক্ষণের জন্যে ঞ্জান শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর নূর বলে চিৎকার করে। ততক্ষণ ট্রাকটা নূরির সামনে চলে আসে আর নূরিকে ধাক্কা দেয়। নূরি ছিটকে পরে রাস্তার মাঝে। আর আহনাফ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে।
চলবে,,,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।