#সাহেব_বাবুর_বউ- [০৬]
সাদা ননস্টিজ্ শাড়ি পরেছে নূরি। লম্বা হাতার ব্লাউজের সাথে সাদা শাড়ি তার উপর মাথায় খোলা চুল একদম শুভ্র পরির মতো লাগছে নূরিকে। আহনাফ স্থির দৃষ্টি রেখে তাকিয়ে আছে নূরির দিকে। নূরির চোখ প্রথমে আহনাফের চোখের দিকে স্থির থাকলেও এবার সে তার চোখটা নামিয়ে পাশে থাকা রানীমার দিকে তাকায়। রানীমা ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে মৃদি হাসে তারপর প্রস্থান করেন। নূরি আহনাফের দিকে এক পলক তাকিয়ে চলে যায়। আহনাফ নূরিকে আটকাতে চেয়েও পাড়লো না। আশেপাশে থাকা ফুলের দিকে তাকিয়ে বলল, ” আজ কাকে বেশী সুন্দর সিগ্ধ লাগছে এই ফুলগুলোকে নাকি নূরিকে। নূরির কোমল চেহারার কাছে এই ফুলের সৌন্দর্যও আজ হাড় মানবে। একবার যদি ছুয়ে দেখতে পাড়তাম নূরির নরম কোমল গালদুটি।” জিভ কাটে আহনাফ। ছিঃ এসব কি ভাবছি আমি।” এই রমনী যে তোর আহনাফ। তোর ভবিষ্যৎ সঙ্গিনী। তুই কি করে পারিস তার পবিত্রতা নষ্ট করতে।
পুরো অনুষ্ঠানে নূরি রানীমার পাশেই ছিলো আর নূরির সাথে ছিলো দিবা। আহনাফ দূর থেকে নূরিকে দেখলেও নূরির কাছে সে আসেনি এমনকি কথাও বলে নি। আহনাফকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে এসেছে ওর গ্যাং, খামখেয়ালী গ্যাং। মেঘনা আজ আহনাফকে যেন ছাড়ছেই না। সারাক্ষণ আহনাফের পিছনে পরে আছে। আহনাফ বিরক্ত হলেও কিছুই বলছে না। বরং নূরিকে দেখিয়ে দেখিয়ে মেঘনার সাথে বেশ হেসেহেসে কথা বলছে। অনুষ্ঠান শেষ হলেই সবাই যে যার মতো চলে যায়। আহনাফ নিজের রুমে গিয়ে তার ডাইরিটা বের করে বেলকোনিতে চলে যায়।
” আমি স্বপ্নেও ভাবিনি আজ তুমি আসবে নূরি। জানো নানু যখন বলেছে তুমি আসবে তখন থেকেই আমি যে খুশিতে আত্নহারা ছিলাম। শুধু অপেক্ষা করতাম কখন তুমি আসবে। শেষ পর্যন্ত তুমি এলে আর তোমাকে দেখে থমকে গেলো আমার পৃথীবি, শুভ্রপরি। হ্যাঁ আজ থেকে তুমি শুভ্রপরি, মায়াময়ী মায়াবতী আমার এলোকেশী। তোমাকে দেখেই মনে হয়েছিলো আজ তোমার সাথে একটা মৃসন নিটোল একটা সম্পর্ক তেরী করে নিবো কিন্তু তুমি আজও আমাকে পাত্তা দিলে না। উপেক্ষা করে চলে গেলে।
জানো আমি তিনটা মাস অন্ধকারের ডুবে ছিলাম। আমার আশেপাশে অপরিচিত জনতার ভীড়। শুধু মাত্র দুজনকে চিনেছিলাম আমি। তাদের মুখ দেখে মনে হতো আমি তাদের চিনি। তবে জানতাম না তারা আমার কি হয়।ডক্টর তাদের দুজনের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলো। একজন আমার ড্যাড অপরজন আমার বন্ধু। তারপর দুজন বয়স্ক লোক তারা আমাকে তাদের নাতী দাবি করে। কিন্তু তাদের কেউ মনে করতে পারিনি আমি। ড্যাড বলল তারা বাঙালি, স্বভাবগত কারনেই সেদিন হেসেছিলাম আমার নানা নানী বাঙালি বলে। তারপর আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় ড্যাডের বাসায়। সেখানে পরিচিত হই আরো কিছু মানুষের সাথে। ড্যাড বলতো তারা আমার পরিবার। সারাদিন ঘুরেফিরে কাটিয়ে রাতে পার্টিতে ড্রিংক করে বাড়ি ফিরতাম। তারপর একদিন নানাভাই বলল, আমাকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরবে। সেদিন কেন জানি আমার এতটা খুশি লাগছিল বুঝতে পারিনি। নানাভাই একবার বলাতে আমি রাজি হয়ে যাই আর চলে আসি বাংলাদেশে। এখানে এসেও কাউকে চিনতে পারলাম না আমি। তবে সবাই আমাকে চিনে। নানু বলেছিল সবাই আমার পূর্বজন্মের পরিচিত। মন আর মাথার সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শুনে শুনে সব পরিচিতদের সাথে আবার নতুন করে পরিচিত হই আমি। দুঃখের বিষয় আমার সবচেয়ে অপরিচিত মানুষটা আমি নিজেই।
জমিদার মহলে সবার সাথে হাসিখুশিতে আমার দিন চলে যেত। তারপর পেলাম কিছু বন্ধু। তারাও নাকি আমার পূর্বপরিচিত। সবার সাথে হেসে খেলে সারাদিন কেটে যায় আমার। হ্যাঁ সবটা শুধু টাইমপাস ছিলো। আপন কাউকে নিয়ে নিজস্ব জগৎ তৈরী করতে পারিনি। মা বাবা, পরিবারের সম্পর্ক কেমন হয় জানা নাই আমার।কি নিয়ে চলি? তারপর একদিন তোমাকে দেখলাম, আজকের এই দিনে তোমাকে দেখলাম আমি। লাল পেরের সাদা শাড়ি পড়েছিলে তুমি। প্রথমে হচকচিয়ে গিয়েছিলাম তোমাকে শাড়িতে দেখে। আমার কাছে এসে রানীমার খোঁজ করলে! আমি বললে তুমি চলে যেতে নিতে আমার পায়ে লেগে পরে যাচ্ছিলে তখন আমি তোমার হাতটা ধরি। তুমি চোখ তুলে তাকাও আমার দিকে আর আমি হাড়িয়ে যাই তোমার ওই দুচোখে। সেদিন তোমার চোখে আমি আমার পৃথিবীর সন্ধান পেলাম। আমার এই জন্মের মানসী তুমি। আমার চিন্তায়, অনুভূতি, হৃদয়ে তোমায় পেয়েছি। এই জন্মের পাওয়া স্মৃতিটুকু ঘিরে শুধু তুমিই রয়েছো। আর কেউ নাই। এই স্মৃতিহীন আহনাফের স্মৃতিটুকু জুরে তুমি। আমার রুমে দেয়ালো টানানো ফটোটার কথা যখন নানুকে জিগ্যেস করলাম তখন সে বলল তুমিও আমার পূর্বজন্মের পরিচিত। আচ্ছা পূর্বজন্ম আমার পিছু ছাড়ছে না কেন? পূর্বজন্ম হয়তো আমার অনেকে ছিলো কিন্তু এজন্মে তুমি ছাড়া আমার আর কেউ নেই। পূর্বজন্মে তোমার সাথে আমার কি সম্পর্ক ছিলো জানার দরকার নাই এইজন্মে তোমাকে নিয়ে বাচতে চাই। তাইতো নানুভাইকে বলে তোমার ক্লাসে গিয়ে ভর্তি হই। তোমাকে ডিস্টার্ব করি জ্বালাতন করি। তোমাকে দেখিয়ে মেঘনার সাথে প্রেমের অভিনয় করি যাতে তুমি আমাকে নিয়ে জেলাস ফিল করো অথচ দেখ তুমি আমার দিকে ফিরেও তাকাও না। বড্ড অসহ্য লাগে আমার। নিজের রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারি। তাইতো তোমাকে এত কষ্ট দেই অপমান করি। তোমাকে দেওয়া প্রতিটা কষ্ট আমি নিজে উপলব্ধি করি। ভালো নেই আমি। আমি ভালো নেই তোমাকে ছাড়া।দেখো সবাই জানে তুমি আমার শত্রু। তোমাকে সহ্য করতে পারি না আমি। নানু এজন্য তোমাকে আমার সামনে আসতে মানা করে দিয়েছে। আমার উগ্র মেজাজ, উঠশৃঙ্খল স্বভাবের জন্যে কেউ আমার উপর ভরসা রাখতে পারেনি। তুমি অবশ্য দায়িত্ব এড়াতে জানোনা। আমার রাখের ইন্দন যোগাওঁ। আরে আমি তোমার সাথে কোমড় বেধে ঝগড়া করি শুধু তোমার সাথে একটু কথা বলার জন্যে। সময় কটানোর জন্যে। সেটা তুমি বুঝো না। ঘৃনা করো আমায়।”
ডাইরিটা রেখে পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে তাতে থাকা ছবিতে চুমু খায়। মনে মনে বলে, ” আর নয় দূরে থাকা এবার তোমাকে আপন করে নিবো। তোমার প্রেমিক তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে আমি কখনো তোমাকে একা ছাড়বো না। আরে তোমাকে রেখে তো আমি মরতেও পারবো না নূরি।”
রানীমার ঘরে ডুকতেই দেখে রানীমা বিছানা ঘুচাচ্চে। আহনাফ গিয়ে রানীমার পাশে দাঁড়ায়। রানীমা পিছন ফিরে তাকায়। জিগ্যেস করে, ” কলেজে যাবে না তুমি?”
” যাব। শেষের ক্লাসটা করবো শুধু। আসলে আমরা সবাই মিলে কলেজে একটা প্রোগ্রাম করতে চাচ্ছি। তুমি কি আমাকে হেল্প করবে নানু?”
” কি করতে হবে আমাকে?”
“নূরিকে রাজি করাও যাতে ও আমাদের প্রোগ্রামে গান গায়।” রানীমা আহনাফের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, ” নূরি রাজি হবে না।”
“কেন?”
” কারন ও গলার সুর যে ছিলো সেই হাড়িয়ে গেছে। তাই এত লোকের ভীড়ে নূরি গান গাইতে পারবে না। ওর সে শক্তি নাই।”
” তুমি কি নূরীর প্রেমিকের কথা বলছো যে নূরিকে ছেড়ে চলে গেছে।”
” হ্যাঁ।”
“তুৃমি চেনো তাকে?”
” খুব বেশী করে চিনি।” মনে মনে বলেন রানীমা। আমি নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলাম এই নগড়পাড়ার কুমারকে। আমার সেই কুমার হাড়িয়ে গেছে এখন যে আমার সামনে আছে সে আমার কুমার নয় সে ইংরেজ সাহেব। ইংরেজদের মতো যার চালচলন কথার ধরন।”
আহনাফের কথায় রানীমার ভাবনার ছেদ ঘটে। আহনাফ বলে, “নূরি আজও সেই ছেলেটার জন্যে কষ্ট পায়?” আহনাফের কন্ঠশ্বর কাঁপছে। রানীমা বলেন,
” মেয়েটা বড্ড বেশী ভালোবাসে তাকে।” রানীমার কথা শুনে আহনাফের বুকটা শূন্য হয়ে গেল। অনুভব করলো বুকের ভিতরের যন্ত্রণা। তবে আজ তাকে সবটা জানতে হবে। কে সেই মহাপুরুষ যাকে নূরি এতটা ভালোবাসে। আহনাফ বলে, ” যে হাড়িয়ে গেছে তার জন্যে এত কেন কষ্ট পাচ্ছে। নূরির একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ আছে। আচ্ছা নানু আমরা কি পারিনা নূরির প্রেমিকে ওর কাছে ফিরিয়ে দিতে।” আহনাফের কথা শুনে রানীমা হাসেন। আহনাফের দিকে তাকিয়ে বলেন, ” অনেক তো চেষ্টা করেছি পারিনি। সে তো আর আমাদের মাঝে নেই।”
আহনাফের মনে হলো নূরির প্রেমিক মারা গেছে। তাই বলল, ” তাহলে নূরিকে অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দাও।”
” সেও চেষ্টাও করেছি কিন্তু মেয়েটা রাজি হয়নি।”
” একটা মৃত মানুষের জন্যে কেন এভাবে কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটা। নানু তুমি নূরির সাথে কথা বলো না। আমি ওকে চাই। প্লিজ নানু না করো না। তোমার নূরিকে আমার হাতে তুলে দাও না। বড্ড ভালোবাসি ওকে।” কথাগুলো বলার সময় আহনাফের চোখ ঝাপসা হয়ে আসছিলো। রানীমা আহনাফের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলেন। তারপর ওর মাথায় হাত রেখে বলেন, ” সে মৃত হলে নূরি অনেক আগেই অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতো। কিন্তু সে তো বেঁচে আছে তবে সে নিজেকে ভুলে গেছে আর সাথে নূরিকেও। আহনাফ অবাক দৃষ্টিতে তাকায় রানীমার দিকে। চোখে তার যতটা কৌতুহল ততটাই যন্ত্রণা। রানীমা আহনাফের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, ” নূরির প্রেমিক আমার সাহেব বেঁচে আছে তবে সে এখন আমাদের পুরনো সাহেব নেই সে তো এখন আহনাফ, আহনাফ চৌধুরী।” রানীমার কথাশুনে আহনাফ অবাক হয়ে যায়। চোখমুখে তার জানার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। রানীম শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে বলেন, ” হ্যাঁ নানুভাই নূরি তোমার, শুধু তোমার। তোমার ছোট বেলার খেলার সাথী তোমার বাগদত্তা নূরি, তোমার নূর। তোমরা একে অপরকে ভালোবাসো। আজ থেকে দেড় বছর আগে ইংল্যান্ডে তোমার এক্সিডেন্ট হয় আর সেখানেই স্মৃতি হাড়িয়ে যায়। ভুলে গিয়েছো তুমি নিজেকে, আমাদের সবাইকে। পূর্বজন্ম বলে কিছু হয়না নানুভাই। আমরা সবাই তোমার আপজন।” রানীমার কথা শুনে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে আহনাফ। যতটা খুশি সে হয়েছে তার থেকেও বেশী যান্ত্রনা এখন হচ্ছে। নূরি যে তাকেই ভালোবাসে।
চলবে,,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।