#সাহেব_বাবুর_বউ- [০৪]
“নববর্ষের দিন ওকে একটা গান গাইতে বলেছিলাম আর ও মুখের উপর না বলে দিলো। বলল যে গান গাইতে জানি না। কি কান্ড-ই না করেছিলো গান গাইবে না বলে। আমিও কম যাই না দিয়েছিলাম পরেরদিন মাথায় চুইনগাম লাগিয়ে। আর এখন সে আমার বাড়িতে এসে গান গায়। মৃদু হাসে আহনাফ। দিপা আর দিবা চলে যেতেই ইনভেলাপ থেকে ফটোটা বের করে আহনাফ। ফটোর উপর হাত বুলিয়ে নিজের ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয়। তারপর সেটাকে বুকের উপর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।
বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে নূরি। ঘুম কিছুতেই ধরা দিচ্ছে না দুচোকের পাতায়। সাহেবের কথা খুব মনে পড়ছে তার। সাহেব ছোট থেকে বাবা মায়ের আদর খুব একটা পায়নি। সাহেবের মা মারা যাওয়ার পর ওর বাবা নিজ দেশে ফিরে যায় তারপর আর এখানে আসে নি। স্যামুয়েল আহনাফকেও তার সাথে করে ইংল্যান্ড নিয়ে যেতে চায় কিন্তু বড় সাহেব তার আগেই ঘোষনা দেয় উনি উনার সমস্ত সম্পত্তির উত্তরাধিকার করবেন আহনাফকে। আগত্যা স্যামুয়েল একাই চলে যায় নিজ দেশে। তবে ছেলের সাথে এমনি এই জমিদার বাড়ির সকলের সাথে তার যোগাযোগ ব্যাবস্থা ভালো ছিলো। নূরিকে নিয়েই ছিলো সাহেবের যত চাওয়া পাওয়া আর সব পাগলামি। নূরি একবার সাহেবকে জিগ্যেস করেছিলো, “তোমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিস কি?” সাহেব উত্তর দেয়”তুই। নূরি বলে সে ও আমি জানি। আমি ছাড়া আর কোন জিনিসটা তোমার প্রিয়? সাহেব হেসে উত্তর দেয়, তোর হাতটা আঁকড়ে ধরে সারাজীবন তোর পাশে থাকা, তোর সাথে সংসার করা। নূরি অধোর চেপে হাসে। চক্ষুদ্বয় কিছুটা সংকোচিত করে সাহেবের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ” আমার খুব ভয় হয় সাহেব। আমরা পারবো তো সারাজীবন একসাথে থাকতে। তুমি যদি চলে যাও তোমার নিজ দেশে। দেখো সাহেব এক সময় তোমার পূর্ব পুরুষরাও কিন্তু এদেশে এসেছিলো। এদেশে তারা তাদের রাজত্ব বিস্তার করে। প্রায় দু-শো বছরের রাজত্ব শেষে তারা কিন্তু আবার ফিরে যায় নিজ দেশে। ভেবেছিলো বাঙালিরা দুর্বল। আরে আমরা বাঙলি দেশের জন্যে নিজের প্রান দিতে দুবার ভাবি না।”
সাহেব বিস্ময় চোখে নূরির দিকে তাকায়। এই মেয়েটা সুযোগ পেলেই ওকে কথা শুনাতে থাকে। সাহেব বলে, তাহলে চলো এবার আমরাও যুদ্ধ শুরু করি, পানিপথের চতুর্থ যুদ্ধ।?”
“সে করাই যায়। তোমার পূর্ব পুরুষরা আমার পূর্ব পুরুষদের কত না কষ্ট দিয়েছে।” নূরির কথা শুনে সাহেব টেনে নূরিকে তার কোলে বসিয়ে বলে, “আমার পূর্ব পুরুষরা তোমার পূর্ব পুরুষদের যতটা কষ্ট দিয়ে তার থেকে দ্বিগুণ ভালোবাসা তোমায় দিবো আমি নূর। আমার ভালোবাসা দিয়ে তোমাকে পাগল করে দিবো। তখনো কি তোমার রাগ থাকবে বলো।” ঠোঁট চেপে হাসছে সাহেব। নূরি সাহেবের হাতে চিমটি কাটে।
চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে বালিশ ভিজে যাচ্ছে নূরির। তবুও যেন চোখের জলেরা বাধ মানছে না। দু-হাতে মুখ চেপে ধরে কেঁদো উঠে নূরি। পাশের রুমে থাকা রবিন আর নিতু মেয়ের চাপা আর্তনাদ আর সহ্য করতে পারে না। তারা সিদ্ধান্ত নেয় নূরিকে নিয়ে অন্য কোথাও চলে যাবে।
দিঘীর পাড়ে বসে আছে আহনাফ। সুন্দর, মনোরম এবং ঐতিহ্য পরিমণ্ডিত উপেন্দ্র সরোবর বা ১২ ঘাটলা দিঘী।
জানাযায়, আজ থেকে ৮৬ বছর আগে রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরীর বাবা উপেন্দ্র মোহন চৌধুরীর নামানুসারে ১১.২৬ একর জায়গার উপর এই দিঘীটি খনন করেন। তৎকালিন রায় বাহাদুর সতীশ চৌধুরী উপেন্দ্র সরোবরটির চার পাশ সুপ্রস্থ ১২ টি পাঁকা ঘাট স্থাপন করেন । দিঘীটিতে স্বচ্ছ পানি নিশ্চিত করার জন্য ৬ টি গভীর কুপ খনন করেন। সেই সময়ে বিহার থেকে খনন বিশেষজ্ঞ এনে ৬০০ শ্রমিক দিয়ে ৩ বছর সময় ধরে খনন করে অর্থাৎ ১৩৩৮ সন থেকে ১৩৪১ সন পর্যন্ত এই দিঘী খনন কাজ চলে। এই দিঘি খননের পূর্বে জায়গাটি নেবড়া ডাঙ্গা বিল নামে পরিচিত। ৩ দশক পুর্বেও দিঘীর চালায় খেজুর গাছে ভরপুর ছিল। বর্তমানে আগাছায় ভরপুর এ দিঘীটিতে খেজুর গাছের দেখা পাওয়া দুস্কর। এখনও হরেক রকমের পাখির কুজনে মুখরিত থাকে এই সরোবরটি। দিঘীর স্বচ্ছ জল রুক্ষ-কঠিন মনকেও বিমোহিত করবে। প্রাকৃতিক সু- শীতল বাতাস মনকে উদাসী করে তোলে। এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে এসেও কেমন অস্থির লাগছে আহনাফের। নিজেকে বড্ড ফিকে মনে হচ্ছে। পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে সেটায় থাকা একটা ছবির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সেটাতে ঠোঁট ছোয়ালো আহনাফ। তারপর তাড়াতাড়ি সেটা আবার পকেটে পুরে নিলো। কেউ দেখলে কেলেঙ্কার হয়ে যাবে। আহনাফ চলে যাবে এমন সময় চোখ পড়ে দীঘীর দক্ষিণ পাশে একটা শিড়িতে বসে আসে এক এলোকেশী। পীঠময় ছড়িয়ে পরেছে তার কৃষ্ণভ্রমরের মতো রাশি রাশি চুল। কপালে দাপাদাপি করছে অবাধ্য কিছু চুল। মুখে বিন্দু বিন্দু স্মেদ। ফর্সা কমনীয় মুখটা আরক্তিম। কজল কালো চোখদুটি লাল বর্ণ ধারন করেছে। এমন মোহনীয় লাগছে নূরিকে যে কোন পুরুষের মনে কম্পন উঠিয়ে দিবে। প্রনয়ী পুরুষ তার সাথে মিলিত হয়ে নিজেকে ধন্য মনে করবে। চোখের পলক পরে না আহনাফের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। অতি সংগোপনে উঠল দাঁড়ায় সে আর ধীর পীয়ে এগোতে থাকে এলোকেশীর দিকে। এলোকেশীর কাছে আসতেই প্রশ্ন করে আহনাফ, ” বয়ফ্রেন্ডের অপেক্ষা করছো?” উত্তর দেয়না মেয়েটা। আহনাফ আবারো বলে, ” নূরি আমি কিছু জিগ্যেস করছি?” এবার সে কোন জবাব পায় না নূরির,পক্ষ থেকে। নূরি অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকে। আহনাফের মাথায় যেন সাপ সোবল মারছে। দুমড়েমুচরে যাচ্ছে বুকের ভেতরটা। রাগ জেদ দুঃখ হতাশা ভয় সব অনুভূতি এক সাথে হচ্ছে। এত অবঞ্জা সহ্য হয় না তার। আহনাফ গিয়ে নূরির পাশে বসে। নূরির মনে হয় কেউ তার গলা চেপে ধরেছে। কান্নাগুলো গলায় এসে কুণ্ডলী পাকিয়ে যাচ্চে। এখন যদি এই স্মৃতিভ্রষ্ট আহনাফ না এসে সেই পুরনো সাহেব আসতো তাহলে হয়তো এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে তাদের মুহূর্তগুলো আরো সুন্দর হতো। উঠে চলে যায় নূরি। না সে আর সহ্য করতে পারে না। এখানে বেশীক্ষণ থাকলে সে কিছুতেই নিজের অনুভুরির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারবে না।
মহলে ফিরেই দেখতে পায় রানীমা নূরির বাবা মায়ের সাথে কথা বলছে। তাদের সকলের চোখে পানি যেটা আহনাফের চোখ এড়ালো না। আহনাফ ওদের পাশ দিয়ে চলে যাওয়ার সময় সবাই ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। পাত্তা দেয়নি আহনাফ। উপরে নিজের ঘরে চলে যায়। রাখে ক্ষোবে মাথাটা ফেটে যাচ্ছে। নূরি কেন তাকে এত অবঞ্জা করে। এই উপেক্ষা সে আহনাফ সহ্য করতে পারছে না। মাথায় চলছে প্রতিশোধের নেশা। সাথে আছে হাড়িয়ে ফেলার ভয়। মনে মনে বলে উঠে, ” তোমাকে কাছে পাওয়ার আগেই হাড়িয়ে ফেলছি না তো আমি।” থো মেরে বিছানায় কিছুক্ষণ বসে থাকে আহনাফ। তারপর কাবার্ড থেকে একটা ডাইরি বের করে তাতে লিখতে বসে, ” আজও আমাকে উপেক্ষা করে তুমি চলে গেলে নূরি। তুমি জানো তোমার এই উপেক্ষা আমার হৃদয়টাকে ঠিক কতটা ক্ষত বিক্ষত করে তুলে। জানো না , জানবে কি করে। জানতে হলে তোমাকে আমার সাথে মিশতে হবে। আমার সাথে সময় কাটাতে হবে কিন্তু সেটা তুমি করবে না। আমি যতবার ভাবি আজ তোমার সাথে ভালো করে কথা বলবো ততবারই তুমি আমাকে উপেক্ষা করো। যেটা আমি এক্কেবারে সহ্য করতে পারি না। তাইতো তোমাকে এতটা কষ্ট দেই যাতে তুমি প্রতিবাদ করো। আমার উপর চেচাও আমাকে শাসন করো, বকো কিন্তু সেটা তুৃমি করো না। আমাকে ঘৃনা করো তুমি। তোমাকে ভালোবাসি আমি তাইতো সহ্য করতে পারি না তোমার উপেক্ষা। তুমি জানো নূরি, আমার স্বপ্ন কি? আমার স্বপ্ন “নীল শাড়ি তে খোলা চুলে আমার হাত ধরে হাটবে তুমি, অনেক বাতাসে যখন তোমার চুল তোমার মুখে এসে পরবে, তখন পরম মমতায় মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিব আমি। ছুঁয়ে দিব তোমার সুন্দর নিষ্পাপ মুখ টা। লজ্জায় তোমার সুন্দর মুখ টা লাল হয়ে যাবে। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকব আমি, আর তুমি আমাকে উপহার দিবে, তোমার অদ্ভুত সুন্দর নিষ্পাপ হাসি টা। যে হাসিতে ঝড়বে মুক্তো আর ফুটবে ফুল, কৃষ্ণচূড়া ফুল !! হারিয়ে যাব আমি সেই হাসি তে…
আর তোমার পায়ে নুপুর পড়িয়ে দিব আমি। তুমি হাঁটবে আমি কান পেতে শুনবো তোমার নূপুরের ধ্বনি!! তোমার সুন্দর পা গুলোতে সুন্দর নুপুর বাজবে, আনমনে তাকিয়ে থাকবো আমি। হঠাৎ করেই তুমি জড়িয়ে ধরবে আমায়। তোমার শরীরের মিষ্টি গন্ধ আমার নাকে আসবে। আদরে আদরে শিহরিত হবে তুমি।
আহনাফের ডাইরি লেখে। নিজের ভালো মন্দ দুঃখ কষ্ট সব কিছু ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করে রাখে। কয়েক পেজ উল্টিয়ে একটা শব্দে তার চোখ আটকে গেলে যেখানে লেখা, “মায়াময়ী।” ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর নূরিকে প্রথম যেদিন দেখেছিল সেদিন লিখেছিলো নিজের মনের ভিতরে থাকা কিছু নাম না জানা অনুভূতি।
চলবে,,,,,
#মাহফুজা_আফরিন_শিখা।