#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১৭
___________

৪০.
মৃদুস্বরে ডাকা পাখিদের কলতান। ঠান্ডা সমীরণ ছুঁয়ে যাচ্ছে গা। মৃদু কম্পিত হচ্ছে আঞ্জুমানের দেহ। এলোমেলো চুলে বড্ড আদুরে দেখাচ্ছে মেয়েটাকে। একটু আদুরে আলিঙ্গনের স্পর্শে তাকে ভাসিয়ে দিতে চাচ্ছে আলীর অবাধ্য মন। খুব কাছে গিয়েও সরিয়ে নিলো মন-দেহের ক্ষণটা। ঘুম ছুটে গেছে সেই কোনক্ষণে। চোখ মেলে তাকিয়ে অপলক পলকে তাকিয়ে দেখছিল, তাকে জড়িয়ে ধরে রাখা আঞ্জুমানের মায়া ভরা মুখশ্রীকে। নিজ থেকে আলগোছে ছাড়িয়ে নিলো আঞ্জুমানকে। হালকা হাসল ভেবে, যে মেয়েটা জ্ঞান থাকা অবস্থাতে তাকে ভয়ের চোটে অজ্ঞান হওয়ার জোগাড়। সে-ই এখন ঘুমন্ত জ্ঞানহীন অবস্থায় জড়িয়ে ধরে কতোটা কাছে এসেছে। সেটা যদি দেখতে পেত, কী যে তাণ্ডব হতো! ফ্লোরে পা রাখতেই দেখতে পেল নিজের ফোনের টুকরো হওয়ার দশা। চিন্তায় কপালে ভাজ পড়ল। নিশ্চিত তাকে ফোনে না পেয়ে রিমা অস্থির হয়ে যাবে। আর তার অস্থিরতা আলীর জন্য মোটেও সুবিধাজনক নয়। দ্রুত ফ্রেশ হওয়ার তাগিদে অ্যাটাচ ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াল। বের হয়ে দেখে এখনো ঘুমে বিভোর আঞ্জুমান। সেভাবেই রেখে দরজা ভেজিয়ে গেল। নিচে নেমে এলো সকালের নাস্তার টেবিলে। সকাল সকাল এসে রাহিমা খালা নাস্তা তৈরি করে ফেলেছেন। আলীকে দেখেই ডাইনিংয়ে সেগুলো এনে রাখছেন। খাবার টেবিলে বসে খাওয়ার সময় আলী শুধু জিজ্ঞেস করল,

‘করিম কোথায়?’

জবাবে খালা বললেন,

‘বাইরে যাইবার দেখলাম।’

‘এলে বলবেন, আমি ডেকেছিলাম।’

ঘুম ভেঙে তব্দা খাওয়া মুখ নিয়ে বসে আছে আঞ্জুমান আলীর রুমে। হালকা চাপ প্রয়োগে রাতের কথা স্মরণে এলো তার। ভাবতেই চোখ ভরে আসার জোগাড়। সামনে না জানি কী থেকে কী হয়। নিজের অবস্থান দেখল ঠিকই আছে শরীরের কাপড়চোপড়, হালকা কুঁচকে যাওয়া ছাড়া। আজ ঠিক আছে, কাল বেঠিক হতে কতক্ষণ। তখন কী করবে সে? আলীর সাথে জোরে তো ভুলেও পারবে না। বাড়ি ছেড়ে যাবেই বা কোথায়? তবু্ও কি একবার দেখবে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে? নানাবাড়ি বা দাদাবাড়ি কেউ কি তাকে মেনে নেবে না কি কলঙ্কিনী, মুখপুড়ি বলে দূরছাই করে তাড়িয়ে দিবে? আর ভাবতে পারছে না। নানাবিধ ভাবনারা এসে মাথায় চেপে বসায়, মাথা ব্যথায় টনটন করছে। আবার রাতের তাণ্ডবের চাপের রেশও তো রয়েছে। এমন সময় আলী দরজা ঠেলে ভেতরে এসে আঞ্জুমানকে দু’হাতে মাথা চেপে ধরতে দেখল। এগিয়ে গিয়ে অস্থিরতা, উদ্বিগ্নতার স্বরে জিজ্ঞেস করল,

‘মাথা ব্যথা করছে?’

মাথায় কারো হাতের আদুরে স্পর্শে আঞ্জুমান নতমুখ ওপরে তুলে আলীর আকুল আবেদনের প্রশ্ন চক্ষু দেখতে পেল। ঝটকানি দিয়ে হাত সরিয়ে দিলো। ক্ষিপ্ত হয়ে ক্ষিপ্র গতিতে আক্রোশে আক্রমণাত্মকভাবে আলীর পরিধানকৃত নেভি ব্লু কালারের শার্টের কলার ধরে ঝাঁঝালো কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘ক্যান, হ্যাঁ ক্যান আপনে আমার জীবনডারে এমতে শেষ কইরা দিলেন? আমি কী করছিলাম আপনের? কয়ডা আম চুরি করনের লেগা আপনে আমার জীবনডারে এমতে নষ্ট কইরা দিলেন? কলঙ্কিত কইরা কলঙ্কিনী বানায় দিলেন? আইচ্ছা কন তো, আমি কি সত্যি কলঙ্কিনী?’

আলীর মুখে আজ কোনো জবাব নেই। আজ সে স্তব্ধ, বিমূঢ়, বিহ্বলতায় বাকরুদ্ধ। তার ভাবমূর্তিতে জ্ঞান-বোধ লোপ পেয়েছে, আঞ্জুমানের করা কড়া প্রশ্নে। আসলেই তো, সে তো জানে আঞ্জুমান কতোটাই পবিত্র, নিষ্কলুষচিত্তের অধিকারী। তার করা কাজের প্রভাবে আঞ্জুমানের মন প্রভাবিত হয়ে মানসিকভাবে ভেঙে আছে। শারিরীকভাবে না ভাঙলে মানসিক দিকে দিয়ে আগে থেকেই মূর্ছায়িত সে। আঞ্জুমানের পরিবারের করা অবেহলা তো ছিলই, এখন নতুন হিসেবে আলীর করা কর্মকাণ্ড যোগ দিলো। মেয়েটা এবার বাজেভাবেই মানসিক বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। সামনে যে কীভাবে সামাল দিবে তাকে? ভাবতেই মস্তিষ্কে তাড়নাবোধ হয়। এদিকক আলীর কাছে কোন সদুত্তর তো পেল না আঞ্জুমান, উলটে কিল-ঘুষি মারতে শুরু করল। আলীর গালে যখন আঞ্জুমানের মোলায়েল থাপ্পড় পড়ল তখন ধ্যানচ্যুত হয়ে বুঝল, মেয়েটা কী পরিমাণ ভায়োলেন্ট হয়েছে। আঞ্জুমানের পিঠে দু’হাতে চাপ প্রয়োগ করে আঁকড়ে ধরল বেশ শক্তি দিয়ে। কয়েকপল যেতেই বুঝল, আঞ্জুমান পাখির পালকের ন্যায় দেহখানি অসাড়তায় অবশ হয়ে ঢলে পড়েছে তার বলিষ্ঠ দেহের ভেতর। অতঃপর আলগোছে মেয়েটাকে বিছানায় শুইয়ে দিলো। আঞ্জুমানের মুখ ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। গায়ে তো ছিটেফোঁটাও শক্তি নেই, সে আসে আলীকে আঘাত করতে!

‘করলে তো পারিস মেয়ে। তবে ভালোবাসার আঘাত হতে হবে সেটা।’

বক্র হাসল ভেবে। নরম, চঞ্চলা মনের মেয়েরা ভালোবাসে খুব দ্রুত। অবশ্য ভাঙেও দ্রুতই। তবে যাকে ভালোবাসে উজাড় করে ভালোবাসে। ভালোবাসাটা হয় নিখাঁদ, ছাঁচে গড়া।

৪১.
‘ফোনটা?’

করিম মিয়া নিজের ফোন এগিয়ে দিলো আলীর কাছে। হাতে ফোন পেয়ে আলী হাঁফ ছাড়ল বোধহয়। সকালে ফোন করার কথা ভুলে গিয়েছে, আঞ্জুমানের কারণে। এখন না করলেই নয়। ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হলো।

‘ভুলে গেলে না কি?’

কাজের লোকদের কোয়ার্টার ছেড়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে বাগানের দোলনার কাছে গেল আলী। দোলনাটা আঞ্জুমানের জন্য আনতে বলেছিল করিম মিয়াকে। টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিল অবশ্য। যেদিন বাড়িতে ফিরল, সেদিন দোল খাওয়া আঞ্জুমানের হাসিমাখা মুখে কতোই না অপূর্বতা খেলা করছিল। দেখতেই মনের মধ্যে শান্তি নামক স্রোত বয়ে যায়। আলীকে দেখার পর থেকেই আঞ্জুমানের মুখে দেখা গিয়েছে ভয় আর আতংকার রেশ। ওপাশ থেকে রিমা ‘হ্যালো, হ্যালো’ বলেই যাচ্ছে। সম্বিত ফিরতেই সাথে সাথে বলল,

‘হ্যালো রিমা, শুনতে পারছ?’

রিমা তখন মল ছেড়ে বাইরে বেরিয়েছে।

‘ও বাব্বাহ! ভুলে গেছি আমি! ফোন কার বন্ধ?’

বাঁচা গেল রিমা তার অন্যমনস্কতা খেয়াল করেনি। ব্যস্ত না কি?

‘কোথায় তুমি?’

আলীর জানতে চাইল।

‘শপিং করতে এসেছিলাম।’

‘এসেছিলাম, তার মানে করা শেষ?’

‘আপাততের জন্য সেটাই। পরে বাকি থাকলে কিছু দেখা যাবে। অবশ্য তোমার জন্যও করেছি সাথে।’

বলেই লজ্জাশীল হাসি হাসল। যা আলীর হয়তো বোধগম্য হলো। সে আরো লজ্জা বাড়ানোর জন্য কিছু বলবে। এমন সময় রিমা ফের বলে উঠল,

‘আচ্ছা, শোন কাল তোমার ফোনের কী হয়েছিল?’

এবার আলীর খেয়ালে এলো আঞ্জুমানকে ঘরে একা রেখে এসেছে। চিন্তা হলো, মেয়েটা আবার জেগে উলটাপালটা কোনকিছু করছে না তো?

‘আর বলো না। ফোন ভেঙে গেছে। আরেকটা দেখি বাজার থেকে বাটন সেট কিনতে হবে আপাতত যোগাযোগ রাখার জন্য। তোমাদের ওখানে গেলে ভালোটা কিনব।’

ওপাশ থেকে রিমা বাঁধ সাধল।

‘কিনা লাগবে না। আমি নিয়ে নিয়েছি।’

বিস্ময়ে অবাক হওয়ার জোগাড় আলীর। তবে বিচক্ষণতার সহিত বুঝল রিমা তাকে কলে না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে, মোবাইল কিনেছে। মেয়েটা এমনই আলীর জন্য বেশ বেপরোয়া ভাব তার। চতুরতার হাসি খেলে গেল আলীর মুখ ছুঁয়ে।

‘ভাবা যায়, বরপাগল বউয়ের কারবার।’

লাজুক হেসে কপট রাগের ভান করে রিমা বলল,

‘ভাগ্যিস ফোনটা ভেঙেছে। নয়তো আমি-ই ভাঙতাম। আর নতুনটা হাতে ধরিয়ে দিতাম।’

‘সে তো আমি জানিই। বরপাগল বউটা যে তার বরের সাথে কথা না বলে থাকতেই পারে না।’

আলীর বলা দুষ্টুমির কথায় লাজুকলতার মতো নুইয়ে পড়ছে রিমা যার কারণে ফোন খট করে কেটে দিলো। এপাশে থাকা আলী সম্ভত সেটা বুঝল। হালকা হেসে বাগানের দোলনা থেকে ওঠে, নিজ বারান্দায় একবার চোখ বুলাল। দেখতে পেল, সদ্য ঘুম থেকে ওঠা ফোলা ফোলা চোখে রক্তিম আভা ছড়ানো মুখশ্রী, ঢেউ খেলানো এলোমেলো চুল নিয়ে দাঁড়িয়ে তার-ই পানে চেয়ে থাকা আঞ্জুমানকে। হঠাৎই তাকে এভাবে দেখে আলীর হৃৎস্পন্দনের গতি আকস্মিকভাবে তীব্র বেগে ছুটতে লাগল। মস্তক নিচু করে, বুকের দিকে তাকিয়ে বাঁপাশে হাত দিয়ে সেটা অনুভব করল। ফিরে আবার তাকালো ওপরে থাকা আঞ্জুমানের দিকে। অনুভূত হলো মনের কোণে, আঞ্জুমানের এমনতর তাকিয়ে থাকা আলীকে কেমন জানি ভয় মিশ্রিত অনুভূতি প্রদান করছে। অশুভ সংকেত যাকে বলে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here