#নিশুতি_তিথি
লেখা : মান্নাত মিম
পর্ব ১০
___________

২০.
তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো,
তার জীবনে ঝর,
তোমার কথার শব্দ দূষণ,
তোমার গলার স্বর,
আমার দরজায় খিল দিয়েছে,
আমার দারুণ জ্বর,
তুমি অন্যকারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর।

শ্যামাঙ্গী মেয়েটার গুণের অভাব নেই, সাথে নেই অফুরন্ত সম্পদেরও।

‘সুখ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকে রোজ,
তবুও কেন যেন নেই সেই সুখের খোঁজ।’

মন খারাপের আবেশে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রিমার মুখের ওপর বৃষ্টির ছিটেফোঁটা উপচে পড়ছে। পেছন থেকে পুরুষালী হাতের আদুরে স্পর্শেও মন খারাপের রেশ সরছে না তার মুখ থেকে।

‘গানটা কেবল তোমার গলায়ই ভালো শোনায়।’

জড়িয়ে ধরে কাঁধে থুঁতনি রেখে আলীর প্রশংসাও রিমার মুখে হাসির কারণ হতে পারল না। তখন তাকে ছেড়ে দিলো আলী। মনে ক্লেশের ভার সইতে না পেরে এবার ডুকরে কেঁদে উঠল রিমা। আলী তখন তাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিয়ে, দু’হাতের আঁজলায় তার মুখ তুলে দৃষ্টি সমান করে দু’জনার। সেই অশ্রুভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আলী বলল,

‘মন খারাপ করে কান্না করছ কেন? এখানে তো আমাদের হাত নেই। সৃষ্টিকর্তা চাইলে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করবে। বাই হুক অর বাই কুক।’

আলীর শেষোক্তিটি ছিল অস্পষ্ট, তবে নিজের জন্য। অবশ্য সেদিকে রিমা খেয়াল করল না। সে নিজের কান্নার মগ্নতায় আলীর পুরুষ্টু বুকে মুখ গুঁজে রোদনের ঝংকার তুলল। আলী শ্বশুর বাড়িতে দুপুরের লাঞ্চ সেরে ড্রয়িংরুমে বসেছিল। বাড়িতে বড়ো ভাবির অনুপস্থিতি বেশ ভালো করে লক্ষ করেছিল আলীর ধুরন্ধর, অগ্রণী নজর। সেই বিষয়ে রিমাকে জিজ্ঞেস করাতে, রিমা মুখে কুলুপ এঁটে ছিল। অতঃপর ছোটো ভাবির সাথে আবার ভাব-ভঙ্গি বেশ ভালো আলীর। সেক্ষেত্রে তাঁর কাছেই সুযোগে জেনে নিলো বড়ো ভাবির অনুপস্থিতির কথা। জানতে পারল কিছুদিনের জন্য বড়ো ভাবি নিজের বাবার বাড়িতে গিয়েছেন, তবে তাঁকে একেবারের জন্য বের করে দেওয়া হয়নি। বাড়ির পরিস্থিতি ঠান্ডার সাপেক্ষে এই পদক্ষেপ নেওয়া। এখন আলী সাময়িক সময়ের জন্য নিজের ভাবনাগুলোর আজ ছুটি দিয়ে আগলে নিলো রিমাকে নিজের বাহুডোরে।

২১.
আঞ্জুমানের অবস্থা দেখে লিমার বুকটা হু হু করে উঠল। বাপ-মা মরা মেয়েটার কী অবস্থা করেছে জালিমের বাচ্চাটায়! মনেই মনে আলীকে গালাগালির দিলেও মুখে টু শব্দটুকু করার সাহস নাই লিমার। অবশ্য তাদের মতো গরিব আর চালচুলোহীন উপরন্তু মেয়ে মানুষের জীবনে সুখ-ফড়িঙের আশা করা সমীচীন নয়। তারা সবসময়ই পুরুষ জাতির পদতলে পিষ্ট হওয়ার জন্যই বোধহয় সৃষ্ট। তা নাহলে কেন তাদের নরকের জীবনে এক ধুলো পরিমাণ সমীরণ বহে না?

‘এই মেয়ে তোমার নামটা জানি কী?’

‘ল…লিমা।’

আচমকাই নার্সের হাতের ধাক্কা ও প্রশ্নে থতমত খেয়ে তোতলে যায় শব্দসন্ধি লিমার ঠোঁটে।

‘আচ্ছা, যাও তো আমার জন্য একটু স্যুপ করে নিয়ে আসো।’

‘আমি তো সস..প বানাতে পারি না।’

লিমার গলারস্বরে ভীতিগ্রস্ত হওয়ার ইঙ্গিত সাথে শব্দ উচ্চারণে লেখাপড়া না জানার আভাস। তবে নার্সের হাসির ফোয়ারায় অবাকান্বিত হওয়ার যোগ লিমার। কারণ কী এভাবে হাসার? পরক্ষণেই উত্তর মিলল তার।

‘কী কী বললে? স্যুপের নামের নতুন প্রবর্তন দেখছি।’

ফের হাসির ফোয়ারা। আঞ্জুমানের রুমে দু’জনেরই অবস্থান তাদের। নার্সের উচ্চস্বরে হাসির তরঙ্গে আঞ্জুমানের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে। ফলাফল চোখ মেলে তাকায় আঞ্জুমান। ব্যথা শরীরে জোঁকের মতো। তবে মনে হয় সেটা রক্ত নয়, চামড়ার মধ্যবর্তী কোমল ও নরম অর্থাৎ মাংশে কামড়ে কামড়ে ধরছে। শব্দ হলো অস্পষ্ট, ব্যথাহত। সেই শব্দে থেমে গেল হাসির ঝংকারা। হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এলো নার্স ও লিমা।

‘ম্যাম, ম্যাম কী হয়েছে?’

দন্ত দ্বারা ঠোঁটের কোণ কামড়ে ব্যথা সংবরণের আঞ্জুমানের দৃঢ় চেষ্টা লিমার অবাকান্বিত যেন আরো বাড়িয়ে দিলো৷ যে মেয়ে অল্প কষ্টে কেঁদে কেঁদে তাকে এসে জানাতো, সে মেয়ে এখন শরীরে কষ্টের হাজারো বর্শা নিয়ে তড়পালেও সহ্য করার চেষ্টা চালাচ্ছে। এদিকে নার্স বিড়বিড়িয়ে বলল,

‘অসহ্য! এত তাড়াতাড়ি ওঠে গেল। ডোজে কি কাজ হচ্ছে না?’

পরক্ষণেই মনে পড়ল হাসির শব্দে হয়তো জেগে গেছে। নার্সের মন-মেজাজের অবস্থা হলো বিক্ষিপ্ত, ক্রোধিত। তৎক্ষনাৎ লিমাকে বলল,

‘তোমার জন্য এই অবস্থা হলো ম্যামের।’

‘আমি! আমি কীয়ারলাম আবার?’

মূক হওয়া প্রশ্ন লিমার। তবুও ওপাশ থেকে কোনো সদুত্তর এলো না, এলো তো শুধু বিরক্তি হওয়া তীক্ষ্ণ ফলার দৃষ্টি। চাপা ঢোক গিলে ভয়ে ভয়ে নার্সের সম্মুখ থেকে সরে দাঁড়ালো লিমা। রাতের শিফটের নার্সটা আসার পর থেকেই লিমার ওপর কেন যেন ক্রুদ্ধ। সেটা অবশ্য লিমার বুঝে আসে না। দিনের বেলার নার্সের সাথে তার দেখা হয়নি। এখন সে ভাবছে অন্য নার্সটা না জানি আবার কেমন হয়! আর আলী যে কবে আসবে? তার যে অনেক কথা আছে আলীর সাথে। একপলক দেখল আঞ্জুমানকে, নার্সটা ইনজেকশন দেওয়ার কারণে আঞ্জুমান ঘুমে তলিয়ে গেল।

২২.
‘ওখানের কী খবর?’

‘ভালো।’

‘সুস্থতা কতটুকু?’

‘ব্যথা সেরেছে, বাকি আছে অল্পকিছুটা।’

‘হাঁটা-চলা?’

‘করতে পারে, তবে বেশি দূর হাঁটতে গেলে আবার ধরে নিয়ে যাওয়া লাগে।’

উপুড় হয়ে আবরণশূন্য গায়ে শুয়ে থাকা আলীর পিঠে আচমকা এসে আক্রমণ করে বসে রিমা। যার ফলে কান থেকে ফসকে পড়ে যায় ফোন। খিলখিল শব্দযোগে ভারি হয়ে ওঠে রুমের চার দেয়াল। সেই শব্দ পর্যন্ত ফোনের অপরপাশে থাকা ব্যক্তি করিম মিয়ার কানে পৌঁছায়। দ্রুত হাতে ফোন তুলে কল কেটে দেয় আলী। ওপাশের দীর্ঘশ্বাস অবশ্য আলীর কর্ণগোচর হয় না। পিঠে ক্ষণ, ক্ষণ সময় নিয়ে দন্তের সুচালো খোঁচা অনুভূত হচ্ছে আলীর। ঘুরে গিয়ে কায়দা করে দু’হাতে রিমাকে নিজের নিচে ফালায়। রিমার হাসি থমকে যায়, নিজের ওপরে আলীর শরীরের ভারে। বেশ সময় নিয়ে দু’জন একদৃষ্টে দু’জনকে দেখে। মুখ নিচু করে রিমার কানের কাছে পৌঁছায় আলী। অঙ্গে জানাশোনা শিহরণ বয়ে যায়। কারণ আলী কাছে এলেই রিমার অনুভূতিরা এলোমেলো হয়ে রক্তকণিকায় দ্রুত বেগে ছুটতে থাকে।

‘কী ব্যাপার? মহারানীর এত হাসির কারণ কি জানতে পারি?’

পরক্ষণেই দমিয়ে রাখা হাসি বিচরণ করল রিমার মুখ জুরে। হাসির দমকে কথা গুছিয়ে বলতেই পারল না সে। ভ্রু কুঁচকে তখন আলী বলল,

‘হাসির সমাপ্তি হলে বলেন তখন। আপনার এই দাস অপেক্ষায় থাকবে।’

বহু কষ্টে হাসি চাপালো রিমা। অন্যদিক মুখ করে রাখা আলীর চিবুক ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বলল,

‘ছোটো ভাবি আমাকে লজ্জা দিয়েছে।’

মৃদুমন্দ চেয়ে বলল রিমা। বোঝাই যাচ্ছে কোনো বিষয়ে সে লজ্জায় মরমে মরে যাচ্ছে। এজন্যই চোখের দৃষ্টি পূর্ণ নয়।

‘তাই বুঝি? তা আমার ভালোবাসার রানির মুখশ্রীতে কীসের এত লাজ?’

এবার দু’হাতের পাতায় মুখ ঢেকে ফেলল রিমা। তার বাবা যে তাদের জন্য হানিমুন সুইটস বুক করেছে সুইজারল্যান্ডে, সেটা বলতেই তার এত লাজ-শরমের অবস্থা। মুখ ঢাকা অবস্থায় কেবল তার হালকা গোলাপিবর্ণের অধর উন্মুক্ত। সেই সুযোগে আলী নিজের অধর দিয়ে চাপ প্রয়োগ করল রিমার অধরে। কিয়ৎক্ষণ গড়াতেই ওষ্ঠের পৃথক হতেই রিমা বলল,

‘বাবা আমাদের জন্য হানিমুন সুইটস বুক করেছে সুইজারল্যান্ড।’

এখনো ঢেকে রাখা রিমার চক্ষুদ্বয়। তবে আলীর চোখের অবস্থা সাংঘাতিক। যেন সেই চোখে কোনো বিস্ফোরণ ঘটল মাত্রই। মাথায় তখন শুধু একটা নাম শব্দযোগে ঘুরছে।

‘আঞ্জুমান!’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here