#দুঃখগাথার_রাজকন্যা
#কলমে_লাবণ্য_ইয়াসমি
#পর্ব_৪
রাত্রি রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় পানি বসিয়ে ময়দা নিয়ে মাখতে শুরু করলো।। কি তৈরী করবে জানা হয়নি তবে আপাতত নিজে যা পারে ওটাই করবে। চায়ের পানি ফুটছে কিন্তু সমস্যা হচ্ছে রাত্রি রুটি তৈরী করতে পারেননা। পারেনা বলতে রুটির বৃত্তটা গোলাকার না হয়ে ত্রিকোণ হয়ে যায়। ছোট ছোট লেজ গজিয়ে চমৎকার দেখতে হয়। আম্মা এগুলোকে কখনও ত্রুটি বলে বিবেচনা করতেন না। উনি বলতেন সময়ের ব্যবধানে সব ঠিক হয়ে যাবে। রাত্রি মায়ের কথায় ভরসা পেয়ে রুটির প্রতি সুনজর দিতে পারেনি। কথায় বলে সময়ের কাজ সময় থাকতে করতে হয়। অসময়ে করতে গেলে লাঞ্ছনা,বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়। রাত্রি চায়ের পানি নামিয়ে রেখে রুটি তৈরী করতে মনোযোগ দিলো। বহুকষ্টে রুটি তৈরী হলো তবে বুদ্ধি একটা পেয়ে গেছে। পাশে রাখা থালা দিয়ে মাপ করে ছুরি দিয়ে কেটে নিয়েছে। এবার থেকে এভাবেই রুটি তৈরী করবে। রাত্রি নিজের বুদ্ধির প্রতি সন্তুষ্ট। রুটি আলুভাজি ডিম ভাজি রেডি করে চায়ে কাপ নিয়ে বাইরে গিয়ে দেখলো রবি দাঁড়িয়ে আছে। রাত্রি রবির হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়লো। তবে মুশকিল হলো নাস্তার টেবিলে। রবি বাজার করতে বাইরে গেছে। রাত্রিকেই এই ভদ্রলোকের ছেলেকে খাবার দিতে হবে। কথাটা ভেবে ও বেশ কয়েকবার ঢোক গিলে মনে সাহস নিয়ে এগিয়ে গেলো। সকাল ছয়টা কিন্তু বাড়ির লোকজনের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। সোনিয়া মির্জা শান্তিতে ঘুমিয়ে আছেন। বেশ কিছুদিন সকালের ঘুমটা হয়নি এখন আপাতত শান্তি। রাত্রি এদিক ওদিক দেখে খাবার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালো। আরাভ খুব মনোযোগ দিয়ে খাবার গুলো পর্যবেক্ষণ করছে। পাশে কারো পায়ের শব্দ পেয়ে ও মাথা তুলে সন্দেহভাজন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
> চমৎকার রুটি তবে কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছে। বুদ্ধি আছে।
> জ্বী সাহেব?
রাত্রি সরল মুখ করে প্রশ্ন করে চেয়ে আছে। যেন আরাভের কথার ও কিছুই বুঝতে পারেনি। ওকে এভাবে তাঁকিয়ে থাকতে দেখে আরাভ মুখ খুলল,
> প্রথমবার নাকি এর আগেও করেছো?
> সহজে হয় তাই আর চেষ্টা করা হয়নি। এভাবেই অভ্যাসে করেছি।
> হুম তবে খালামনি কি বলেছেন তোমাকে আমি সকালবেলায় এগুলো খাই কি না?
> আমি এগুলোই পারি তাই।
> আচ্ছা সমস্যা নাই শিখে নিও আশাকরি পারবে। আচ্ছা তোমার হাতটা দেখি।
রাত্রি তাড়াতাড়ি নিজের হাতখানা লুকিয়ে ফেললো শাড়ির আচলের নিচে। লোকটা আসলেই ভয়ঙ্কর। রুটি তৈরী করার আগে হাতখানা ভালো করে পরিস্কার করা হয়েছিল যার দরুণ ডান হাতের কালো রঙ চলে গিয়ে আসল রঙের প্রকাশ ঘটেছে। রাত্রিকে হাত লুকাতে দেখে আরাভ আবারও বলল,
< কৈ দেখাও। রাত্রি ভয়ে ভয়ে বাম হাতটা সামনে এগিয়ে দিলো কিন্তু ও সন্তুষ্ট হলোনা। ডান হাত দেখানোর নির্দেশ আসলো। রাত্রি নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে। এরকম বিপদের থেকে রক্ষা পেতে হলে তৃতীয় ব্যাক্তির উপস্থিতি প্রয়োজন। কিন্তু এ বাড়িতে এমন কেউ নাই সবাই ঘুমিয়ে বিভোর। রাত্রির ভাবনার অবসান ঘটলো কলিং বেলের শব্দ শুনে। রাত্রি এবার চনচল হয়ে উঠলো। কাঙ্ক্ষিত কেউ এসেছে মানে ও বেঁচে গেছে। কথাটা ভেবে ও তাড়াতাড়ি গিয়ে দরজা খুঁলে দিলো। দরজায় একজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। চেহারা থেকে বয়সের অনুমান করা বেশ কঠিন। তবে বিশ ত্রিশের মাঝামাঝি হতে পারে। লোকটা ভ্রু কুচকে বলল, > নতুন কাজের মেয়ে তাইনা?
> জ্বী ভাইজান।
> বাইরে লাগেজ আছে নিয়ে যাও। আর শুনো আমাকে ভাইজান ডাকবেনা। আঙ্কেল বলবে ঠিক আছে?
>জ্বী চাচাজান ডাকি?
রাত্রির কথায় লোকটা উত্তর করলো না। গটগট করে চলে ভেতরে চলে গেলো। রাত্রি বাইরে থেকে লাগেজ নিয়ে ভেতরে আসলো কিন্তু লোকটা ঠিক কোন রুমে ঢুকেছে জানে না। ও সিঁড়ির কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে উপরে উঠতে গেলো কিন্তু পেছন থেকে হুকুম আসলো,
> এতোদূর থেকে লাগেজ আনতে কষ্ট হয়নি তাহলে এইটুকুতেও হবার কথা না। তাই ওদিকে না যাওয়ায় ভালো।
রাত্রি দাঁড়িয়ে পড়লো সামনে যাওয়া ঠিক হবে না। এই বাড়িতে ঠিক কয়টা প্রাণির বসবাস এটাইতো জানে না। সবার উপরে ফোকাস করতে হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। পরিচয় পর্বটা সারতে হবে। কথাগুলো ভেবে ও লাগেজ রেখে নিজের রুমে চলে আসলো। আরাভ খাওয়া শেষ করে লাগেজ নিয়ে লোকটার ঘরের দরজায় গিয়ে উঁকি দিলো।লোকটার নাম আজহার মির্জা যিনি সুবাদে এই বাড়ির মালিকের ছোট ভাই। উনি প্রচণ্ড গম্ভীর আর একটু দাম্ভিক টাইপের। কাজের মানুষ দেখলে উনার হাতের বল কমে যায়। হুকুম করতে উস্তাদ। যাইহোক আরাভ উঁকি দিয়ে দেখলো লোকটা গুনগুন করে গান গাইছে আর নিজের চুলটা পরিপাটি করছে। পেছনে কারো পায়ের শব্দ শুনে উনি বলে উঠলে,
> ভেতরে আসো আর শুনো এক কাপ কফি তৈরী করে আনো। সকাল সকাল ঝামেলা শুধু।
> আঙ্কেল রাত্রি নিচে কাজ করছে। আমি এদিকে আসছিলাম তাই ভাবলাম নিয়ে আসি।
> ও থাকতে তুমি আসলে? শুনো কাজের মেয়েদের এতো আল্লাদ দেখাতে হয়না। ওদের জন্ম হয়েছে বড়লোকের সেবা যত্ন করার জন্য। যাইহোক মেয়েটা দেখতে কেমন কুচকুচে কালো। আমাদের বাড়ির সঙ্গে ঠিক যায় না।
> ওকে তো আর আপনার বাড়ির বউ হিসেবে আনছেন না। তাছাড়া বর্ণবাদে আমি বিশ্বাসী না। কর্ম দিয়ে মানুষ যাচাই করি বর্ণ নিয়ে না।
> এই হয়েছে তোমাদের নতুনদের একটা সমস্যা। শুধু আবেগ আর আবেগ। আমাকে দেখো, বয়স চল্লিশ হতে চলেছে দেখলে কেউ বুঝবে? আমার লুকটা এমনিই সুন্দর।
> আঙ্কেল সৌন্দর্য সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি আপনার না। এখানে গৌরবটা আপনার না বরং আমাদের যিনি সৃষ্টি করেছেন তাঁর। উনি চাইলে এর বিপরীত হতে পারতো। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করুন। আমি আসছি।
আরাভ হন্তদন্ত হয়ে চলে আসলো। এই লোকটাকে ওর ঠিক সুবিধার লাগে না। তাই ইচ্ছা করেই রাত্রিকে আসতে মানা করেছিল। খালামনি ওকে দায়িত্ব দিয়েছে এই বাড়িতে কাজের মেয়ে থাকেনা কেনো তার রহস্য খুঁজে বের করতে। রবি কিছুটা জানে তবে সে চাকরি যাওয়ার বা প্রাণের ভয়ে চুপচাপ আছে কিছুই বলছে না। তবে ও ঠিক ধরে ফেলবে। এই বাড়িতে নিয়মিত মোটামুটি এগারো জন লোকের বসবাস অস্থায়ীও আছে যারা বাইরে আছে। সোনিয়া মির্জার এক ছেলে আর এক মেয়ে। উনার ভাসুর দেবর তাদের স্ত্রী ছেলেমেয়ে মিলিয়ে। তবে সবাই এখানে থাকে না। বউগুলো বেশিরভাগ নিজেদের কর্মস্থলে থাকে। মির্জা সাহেব নিজের বাড়িতে ভাইদের থাকতে দেন কারণ ওদের অবস্থা ততটা উন্নত না। মির্জা সাহেব চান সবাই ভালো থাক।উনার সাহায্যে যদি কিছুটা হয় এই আশায়। আরাভ কথাগুলো ভেবে বাইরে চলে আসলো। এতক্ষণে বাড়ির বাকিরা উঠে গেছে। সোনিয়া মির্জা রান্নাঘরে রাত্রির সাহায্যে রান্না করছে। মেয়েটা খুব মনোযোগ দিয়ে কাজগুলো করছে। মনে হচ্ছে এগুলো শেখা ওর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আরাভ ওদিকে তাকিয়ে নিজের ঘরে চলে আসলো। অনেক ক্লান্ত লাগছে একুট বিশ্রাম নেবার দরকার ভেবে ও বিছানায় সাট হয়ে শুয়ে পড়লো। চোখগুলো জ্বলছে। ঘুমাবে ভেবে ও চোখ দুটো বন্ধ করতেই বুকের উপরে ভারি কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করলো। ও ঝট করে চোখ খুলে দেখলো মিরা ওর বুকের উপরে শুয়ে আছে। ও তাড়াতাড়ি উঠতে গেলো কিন্তু পারলো না। মেয়েটা ওকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো দেখে আরাভ ভ্রু কুচকে বিরক্তিকর ভাবে বলল,
> কি হচ্ছে মিরা? তুই বড় হয়েছিস আগের মতো ছোট নেই। আমাকে ছাড়।
> বড় হয়েছি যখন মানছো তাহলে বিয়ে করছোনা কেনো শুনি?
> কে বলেছে এগুলো? শোন আমি বিয়ে টিয়ে করতে পারবো না। উঠ আমার কিন্তু বিরক্ত লাগছে।
> শুনছি না ওসব কথা। এই শুনো না চলো বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
> তুই উঠবি নাকি আমি চিৎকার করবো। এরকম করলে আমি কিন্তু হোস্টেলে গিয়ে উঠবো।
আরাভের ঝাড়ি শুনেও মিরার কোনো হেলদোল হলো না। সে আগের মতো ওকে জড়িয়ে আছে। মাঝে মধ্যে ওর চুলের মধ্যে হাত বিলি কাটতে চাইছে। এমন সময় দরজায় নক পড়লো,
> আপনার কফি, খালাম্মা পাঠিয়েছেন।
হঠাৎ আওয়াজ পেয়ে মিরা তাড়াতাড়ি উঠে বসলো। রাত্রি কফি নিয়ে আরাভের সামনে ধরতেই ও উঠে কাপটা নিয়ে নিলো। রাত্রি এবার মিরার দিকে তাঁকিয়ে চলে আসতে চাইলো কিন্তু পেছনে থেকে আরাভ বলে উঠল
> দুইটা ধন্যবাদ।
রাত্রির খুব জানতে ইচ্ছা করলো দুইটা ধন্যবাদ দেবার মানে কি কিন্তু পরক্ষণেই কিছু ভেবে ওর ঠোঁটের কোনে হাসি ফুঁটে উঠলো। ও না দাঁড়িয়ে চলে আসলো। ও চলে যেতেই মিরা রেগে বলল,
> এই মেয়েটাকে আমার একটুও পছন্দ না। দেখেছো কেমন গায়ের রঙ?
> গায়ের রঙে কি যায় আসে। ওর চোখগুলো ভালো করে দেখলে যে কেউ প্রেমে পড়বে। আবশ্য তোমাকে বলে কি হবে। যাওতো এখন আমি কফি শেষ করে বাইরে যাবো।
আরাভের কথাগুলোতে মিরা জ্বলে উঠলো। ও হনহন করে বাইরে চলে আসলো। আরাভ মিরাকে ইচ্ছে করেই কথাগুলো বলেছে। এরকম দাম্ভিকতা ওর পছন্দ না। কথাগুলো ভেবে ও বাথরুমে চলে আসলো। ক্লাস আছে গত দুই সপ্তাহ বাড়িতে ছিল তাই ক্লাসে যাওয়া হয়নি। অন্যদিকে বাড়িতে রাত্রির কাজগুলো হচ্ছে শুধু রান্না করা। রান্নার পরে ওর মোটামুটি ছুটি। এই বাড়িতে সকালবেলায় আর রাত্রে রান্না হয়। দুপুরে কেউ থাকে না তাই রান্নাটাও হয়না।। এই সময়টা ও যা ইচ্ছা করতে পারে।
বৈশাখ মাসের মাঝামাঝি। আকাশে উতপ্ত সূর্য খাড়াখাড়িভাবে কিরণ দিচ্ছে। শনশন বাসাস বইছে। দুইটা ক্লাস শেষ করে আরাভ ওর বন্ধু তমালকে নিয়ে বাইরে বের হলো। দুজন গতক্লাসের পড়া নিয়ে আলোচনা করছিল হঠাৎ এমন সময় পেছন থেকে একটা থাপ্পড়ের শব্দ আর হৈচৈ শুনে দাঁড়িয়ে পড়লো। ওরা কৌতূহলী হয়ে পিছিয়ে আসতেই দেখলো ওদের ক্লাসের শাবের গালে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে আর ওর পায়ের কাছে একটা মেয়ে কিছু একটা তুলছে। ওরা একপা দুপা করে ওদের কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই মেয়েটা বইখাতা গুলো তুলে বিরক্তি নিয়ে ঝাড়ি দিয়ে বলে উঠলো,
> কখনও আমার সামনে আসবেন না। যদি দেখি না তাহলে খবর আছে।
আরাভ মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে ফেলল। মেয়ে না ওর সামনে কোনো পরি দাঁড়িয়ে আছে। সাদা গাউন পরিহিত মেয়েটার থেকে ওর চোখ যেনো কিছুতেই সরছে না। উপস্থিত সকলেই মেয়েটাকে অবাক চোখে দেখছে কারো মুখে কোনো কথা নেই। মেয়েটা হয়তো এখানে নতুন এসেছে। আগে কখনও দেখেনি তবুও চেনাচেনা।
চলবে
ভুলত্রুটি মার্জনা করবেন।
আসুন নামাজ ও কোরআন পড়ি।